0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in

পথেপ্রবাসে


পেরুতে বেড়ু বেড়ু
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী- পর্ব ২ 
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

৮ই এপ্রিল, ২০১৯- লিমা থেকে প্যারাকাস 

সকাল সাতটায় পেরু হপের বাস আসার কথা, হোটেল রিসেপশনে পৌনে সাতটায় আসতে না আসতেই লাল পোষাকে সজ্জিত, পেরু হপের টি শার্ট পরা চকচকে চেহারার গাইড হাজির। রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে- সেটিও লাল রঙ এ। বিরাট বড়ো বাস, প্রায় পঞ্চাশ জন বসার জায়গা। এয়ার কন্ডিশনড। হেলানো সীট, পা রাখার জায়গা, সর্বোপরি প্রচুর লেগ স্পেসওলা এই বাসগুলি যেন আরামের চুড়ান্ত। বাসের পিছনে টয়লেট আছে। বাস এগিয়ে চললো- আমাদের গন্তব্যস্থল ২৫০ কিলোমিটার দূরের প্যারাকাস (Paracas)। প্যারাকাস হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে একটি ছোট্ট শহর। রাস্তা কয়েক ঘন্টার। পথে পড়বে প্রাক ইনকা যুগের প্রশাসনিক ভগ্নস্তুপ ও সরাইখানা - নাম টাম্বো কলোরাডো(Tambo Colorado)। এই প্রসঙ্গে ইনকাদের কথা তোলা পাঠক পাঠিকাদের কাছে অনাবশ্যক হবে না। পেরুতে প্রাচীন কাল থেকেই সভ্যতার আনাগোনা।পাঁচ হাজার বছর আগের পু্রানো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে কারোলে,(Caral) যেটি লিমা থেকে ১৫০ কিমি দূর। তারপর থেকেই এই সভ্যতার অগ্রগতি। ১১৫০ সালে এক রহস্যে ঘেরা কাহিনীর মধ্য দিয়ে প্রথম ইনকা সম্রাট মাংকো কাপাকের আবির্ভাব আর ১৫৩৩ সালে স্প্যানিশদের হাতে ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপার পরাজয় ও মৃত্যু দিয়ে এই সাম্রাজ্যর পরিসমাপ্তি। প্রায় বলছি এইজন্য, যে তারপরও বেশ কিছু বছর ইনকা সম্রাটরা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশ হওয়া থেকে দেশকে রক্ষা করতে। কিন্তু সে চেষ্টা সফলতা পায় নি। এই চারশো বছরে ইনকারা ৬৫০০ কিমি দীর্ঘ এক সাম্রাজ্যকে উন্নতির চরমে পৌছে দিয়েছিলান। আজকের ইকুয়েডর থেকে দক্ষিণে চিলি, আর্জেন্টিনা পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সাম্রাজ্য রক্ষা করা ছিলো অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। এই আশ্চর্য ব্যাপার সম্ভব করতে, ইনকারা বানিয়েছিলেন হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা দুটি জাতীয় সড়ক উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাষ, বিপদের জন্য শষ্য সঞ্চয় করা, চাসকি বা ডাক চলাচল ব্যাবস্থা, জলের সুষ্ঠ ব্যাবহার, ভূমিকম্প নিরোধক স্থাপত্য- ইনকারা পাঁচশো বছর আগে যা করেছেন, তা আজকের দিনেও বিস্ময়। 

বাস এগিয়ে চলেছে। ক্রমে লিমার শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে খালি রাস্তায় বাস এসে পড়লো ন্যাশনাল হাইওয়েতে। চমৎকার রাস্তা- মসৃণ গতিতে বাস এগিয়ে চলেছে তরতর করে, মাঝে মাঝে গ্রাম আসছে, গাছপালা, কখনো বা শুধুই পাহাড়ী রুক্ষ জমি। পথে একজায়গাতে জলখাবার খাওয়া হলো, এ্যাভোগাডো স্যান্ডউইচ ও জুস। অপূর্ব তার স্বাদ । এখানেই প্রথম দেখলাম ল্লামা ও আলপাকা নামে কতকটা আধা উট আর আধা হরিন শ্রেণীর জন্তু। ফটাফট প্রচুর ছবি তোলা হলো। 

বেলা বারোটায় এলাম “টাম্বো কলোরাডো”। ইনকাদের উত্তর-দক্ষিণ হাইওয়ের ওপরে একটি সরাইখানা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। বিরাট ভগ্নস্তুপ - পাহাড়ের ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। যতো ওপরে যাচ্ছি- ততো অভিজাত লোকেদের থাকার জায়গা। ইনকার জন্য যে কক্ষটি ছিলো- সেটি সবার ওপরে। ওপরে করার কারণ- যে কোনও বিপদ এলে যাতে পালানো যায়। মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরী প্রাক ইনকা আমলের হাজার বছরের পুরানো কান্ডকারখানা দেখে অবাক লাগছিলো। অনেক জায়গা ছিলো রঙ্গীন- তা আজও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। পেরু হপের গাইড ও তাঁর সহকারীরা প্রাঞ্জল করে সব বুঝিয়ে দিলেন। প্রচন্ড রোদ ও পাহাড়ী রুক্ষ জায়গাতে তাপমাত্রা ৩৪ -৩৫ ডিগ্রী হলেও ইতিহাস আমাদের সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছিলো। 









বেলা একটায় বাসের আবার চলা শুরু ও একঘন্টায় এসে গেলাম প্যারাকাস। এই বাসের এখানেই পরিসমাপ্তি। অন্য লোকেরাও নেমে গেলো। পরের বাস পরের দিন বেলা এগারোটায়। আমরা অবশ্য এখানে দু রাত থাকবো, তাই তার পরের দিনের বাস ধরবো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে লাগেজ টেনে টেনে চললাম আমাদের হোটেল স্যান আগষ্টিনের(Hotel San Augstin) পথে। 

হোটেল দশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা - এসে দেখি ও বাবা, এ-তো এক বিরাট এলাকা জুড়ে রিসর্ট। সামনে বাগান ও পিছনে বিরাট সুইমিং পুল। বিরাট মানে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পুল- প্রায় ৫০০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট চওড়া। আর তার পরেই বিস্তীর্ণ প্রশান্ত মহাসাগর। অজস্র বসার বেঞ্চ হোটেল চত্তরে- অনেক গুলিই সমুদ্রের পাশে। ঘর পেলাম তিন তলায়- দরজা খুললেই ব্যালকনি- সামনে সমুদ্র। মন ভালো করা আবহাওয়া, দারুন ভালো খাবার, সত্যি পেরুর খাবার অতুলনীয়। 



৯ই এপ্রিল -২০১৯-প্যারাকাস 

পরদিন অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল সকাল সাড়ে নটায় এলাম হোটেল ফ্রেয়াসের সামনে। উদ্দেশ্য দু ঘন্টার “ব্যালেস্টাস আইল্যান্ড”(Balllestas Island) ট্রিপ করা। প্রসঙ্গতঃ বলে যেতে পারে, “ব্যালেস্টাস আইল্যান্ডকে” বলা যায় গরীবদের গ্যালিপিগো আইল্যান্ড। এখানে সি লায়নের ছড়াছড়ি। আছে পেঙ্গুইন, হাজার রকমের পাখী, ডলফিন ও কখনো বা তিমি মাছের দেখা মেলে। এখানে দেখা যায় আর এক বিস্ময়। আজ থেকে ২০০০ বছর আগে কে বা কারা পাহাড়ের গায়ে প্রচুর জ্যামিতিক লাইন ও নকশা টেনে গিয়েছে- তাকে বলে ক্যান্ডেলাব্রা লাইন( El CANDELABRE), সেই লাইনও দৃশ্যমান এই রুটে। 

ছোট ছোট বোট- জনা কুড়ি লোক লাইফজ্যাকেট পরে বসলাম। সামনে বোটের গাইড ও চালক। বোট চলতে শুরু করলো। খানিক যাওয়ার পর প্রথমে চোখে পড়লো ক্যান্ডেলাব্রা লাইন। প্রায় ছশো ফুট লম্বা লম্বা আর দু ফুট গভীর এই জ্যামিতিক নকশা কে বা কারা এঁকেছিলো, সে রহস্য এখনো পর্যন্ত অজানা। তবে কি গ্রহান্তরের মানুষ এখানে ছিলেন? সে সব রহস্যে না গিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওদিকে। 

দেখতে দেখতে এমনই মগ্ন ছিলাম- হুঁশ ফিরলো গাইডের ডাকে- সামনে তাকিয়ে দেখি তিনটে সি লায়ন। ঘাড় ফেরালাম- দেখি দূরে দ্বীপ গুলি দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে পাখীর কলকাকলী আর সামনে খান তিনেক সি লায়ন সাঁতার কেটে চলেছে। ক্রমে ঐ দ্বীপের যতো কাছে আসছি, দেখছি সি লায়নের ছড়াছড়ি। প্রায় শ খানেক সি লায়ন- কেউ বা খেলায় মত্ত, কেউ বা বাচ্চাকে আদর করছে আবার কেউ বা শুধুই রোদ পোয়াচ্ছে। হাজার হাজার পাখী উড়ছে - তাদের সম্মিলিত চিৎকার ও সি লায়নদের কলরব- সব মিলে কান পাতা দায়। 










এরই মধ্যে গাইড দেখালেন পাহাড়ের ওপর প্রথম পেঙ্গুইন। 


পরবর্তী একঘন্টা যে কিভাবে কাটলো! শুধু ছবির পর ছবি তুলে যাচ্ছি। পাখী, সী লায়ন, পেলিক্যান ও আরো নাম না জানা অজস্র পাখী - কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো ভেবে পাচ্ছি না। এছাড়া আগ্নেয় পাহাড়ের জন্য মাঝে মাঝেই অদ্ভুত রূপ দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের। 
ক্রমে সময় শেষ। আস্তে আস্তে দ্বীপের থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। ফিরে এলাম জেটিতে, তারপর হোটেল। 

প্রাণ ভরে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে যখন ক্ষিদের চোটে আর পারা গেলো না, তখন রেস্তোঁরাতে পেট ভরে খেয়ে রসনার তৃপ্তি । এরপর বসলাম সমুদ্রর ধারে- সাথে বই। ঠান্ডা হাওয়া, ঢেউ এর গর্জন ,পাখীর ডাক সাথে প্রিয় বই- আর কি চাই! 

১০ ই এপ্রিল- প্যারাকাস থেকে হুয়াকাচিনা (HUACACHINA) 

প্যারাকাসের স্বপ্নিল হোটেল ছেড়ে সমুদ্রর পাশের রাস্তা দিয়ে সুটকেশ টেনে টেনে আবার এলাম হোটেল ফ্রেয়াসের সামনে। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। এখান থেকে আমাদের পেরু হপের বাস ছাড়বে। আজকে আমাদের গন্তব্য – প্রথমে দেখবো প্যারাকাস ন্যাশনাল রিজার্ভ আর তারপর বাসে যাবো হুয়াকাচিনা, ওখানে রাতে থাকবো। 

প্রথমেই প্যারাকাস ন্যাশনাল রিজার্ভ সম্পর্কে একটু বলে রাখি। ৩৩৫০ বর্গ কিলোমিটার জায়গয় সমুদ্র আর মরুভূমি নিয়ে এই পার্ক অতুলনীয়। এটা বলা যায় বিভিন্ন প্রাণী যেমন সি লায়ন, পেঙ্গুইন, পেরুভিয়ান হাম্পব্যাক ও ডলফিনদের অভয়ারণ্য । 

বাস এগারোটায় ছেড়ে পার্কে ঢুকলো। জনমানব কোথাও নেই। ধূ ধূ প্রান্তর ও মরুভূমি। এগিয়ে চলেছি- আধঘন্টা পর সমুদ্রর ধারে এক জায়গাতে বাস থামলো। গাইডের থেকে জানা গেলো এটার প্রথম স্টপ ক্যাথিড্রাল। ক্যাথিড্রাল বলতে কোনো চার্চ নয়- সমুদ্রর মাঝে পাহাড় – তার আকৃতি অনেকটা ক্যাথিড্রালের মতো। গাইড জানালেন ২০০৭ সালে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে, এই পাহাড়ের অনেকটা ধসে যায়। তবুও এখনো যা রূপ- মোহিত হবার মতো। এছাড়া এখানে একটি ভিউ পয়েন্ট আছে- যেখানে উত্তাল সমুদ্রর রূপ ধরা পড়লো আবার। বেশ কিছু সি লায়ন ইতস্তত ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। 


বাস আবার চলতে শুরু করার পর আরো খানিকটা গিয়ে বারোটা নাগাদ বাস থামলো পরবর্তী স্টপ – ইসমিস(ISTHMUS)। এখানে সমুদ্র ও পাহাড় যেন লুকোচুরি খেলেছে। নীল আকাশ, আরো নীল সমুদ্র সব মিলে যেন এক যুগল বন্দী। সব শেষ আকর্ষণ ছিলো এক মন মাতানো বীচ – নাম “প্লেয়া রোজা”। পার্ক ঘোরা শেষ। বাস তার যাত্রা শেষ করলো আবার হোটেল ফ্রেয়াসের কাছে। এখানে মিনিট পনেরোর বিরতি, তারপর বাস ছুটলো হুয়াকাচিনার পথে। 
বাস মরুভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে পড়ছে ছোট ছোট গ্রাম। হুয়াকাচিনা প্যারাকাস থেকে বেশীক্ষণ নয়। মাত্র দেড় ঘন্টায় আমরা একের পর এক গ্রাম অতিক্রম করে এলাম ইকা মরুভূমির একমাত্র ওয়েসিস হুয়াকাচিনায়। গাইড বুঝিয়ে দিলেন যে কাল দুপুর একটায় এখান থেকে বাস ছাড়বে। আমরা চললাম সুটকেস নিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটা রাস্তায় হোটেল কুরেশী। 
হুয়াকাচিনা ওয়েসিস আমাদের চোখের সামনে। লেগুনের চারপাশ গাছে ভর্তি। শুনেছি হুয়াকাচিনার লেকের কাদা শরীরে মাখলে অনেক রোগের উপশম হয়। আমরা চললাম লেগুনের এক প্রান্তে আমাদের হোটেলে। চেক আউট করে তিনতলায় ঘরে এলাম। হুয়াকাচিনা খুব ছোট জায়গা, ফলে ভালো হোটেলের অভাব- তারই মাঝে হোটেল কুরেশী আমাদের ওয়েসিস। ট্রিপল বেড রুম- বারান্দায় বেরুলেই লেগুন আর বালিয়াড়ির শোভা- সব মিলে অন্যবদ্য। 

হোটেলে মাল পত্র রেখে চললাম লেগুনের ধারে। দু চার চক্কর মেরে এলাম বালিয়াড়িতে। দলে দলে লোক – কেউ যাচ্ছে স্যান্ড বোর্ডিংতে আবার কেউ বা জীপে করে সূর্যাস্ত দেখতে। আবার কেউ বা নিছকই হেঁটে হেঁটে বালিয়াড়ির চূড়ায় উঠবে। নীচে থেকে দেখতে ভারী ভালো লাগছিলো। অনেকক্ষণ বসে বসে দেখলাম। মরুভূমি হওয়াতে এখানে দিনের তাপমাত্রা অনেক বেশী- প্রায় ২৭ ডিগ্রীর মতো। বসে বসে বালিয়াড়ির আড়ালে সূর্যাস্ত দেখলাম, সূর্য যেন টুক করে বালির আড়ালে হারিয়ে গেলো। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমতে শুরু করলো, আমরাও চলে এলাম হোটেলে। 












(চলবে)

0 comments: