0

গল্প - রঞ্জন রায়

Posted in

গল্প


আগুনখাকী
রঞ্জন রায়


(১)

কিছুদিন হল ছত্রিশগড়ের এই শিল্পনগরীর স্কুল নাম্বার সেক্টর ফোর-এ বদলি হয়ে এসেছি। এমনি এমনি নয়, রীতিমত প্রোমোশন নিয়ে। চার বছর আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম, প্রথম পোস্টিং প্রোজেক্ট এরিয়ার স্কুল নাম্বার নাইনে। অ্যাসিস্ট্যান্ট টীচার। দায়িত্ব, প্রাইমারী লেভেলে ইংরেজি পড়ানো। কাজটা ভালো লাগত। বাবার আপত্তি ছিল। উনি এই স্টীল প্ল্যান্টেই রোলিং মিল ম্যানেজার। পিতা-পুত্রী একই অরগানাইজেশনে চাকুরি করিবে, ইহা কেমন কথা?

আসলে বাবার ভয় ছিল যে ওঁর আদরে বাঁদর হওয়া বেয়াড়া মেয়েটি চাকরি করতে গিয়ে এমন কিছু বখেড়া খাড়া করবে যে হাই লেভেলে কম্পপ্লেন হবে আর পিতৃদেবকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি চটে গিয়ে বলেছিলাম, ফর্মে বাবার নাম না লিখে মা’র নাম লিখব। বাবা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন যে কোন লাভ নেই। কারণ সবকটা সার্টিফিকেটে বাবার নাম লেখা আছে। বাবার রিটায়ার হতে এখনও বছর পাঁচ দেরি আছে।

ওহ, দিস প্যাট্রিয়ার্কি!

আমাদের কোয়ার্টার সেক্টর ফোরে, বেশ বড় বাগান। বাগানে দোলনা, ফেন্সিংয়ে সবুজ গাছ ও লতাপাতা। নিয়মিত মালী আসে; এককোণায় সার্ভেন্ট কোয়ার্টার; সামনে অফিসের জীপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর আমি এই সেক্টর ফোরের স্কুল থেকেই হায়ার সেকন্ডারি পাশ করেছিলাম। গ্র্যাজুয়েশনের পরে মাস্টার্স না করে বি এড করলাম, আমি টীচার হতে চাই। বাবা-মা’র মতে মেয়েদের জন্যে সেটাই নাকি সবচেয়ে ভালো জীবিকা; মার মতে নিরাপদও বটে।

সে যাই হোক, খুব খাটতে লাগলাম। আমার প্রাক্তন টীচার খোসলা ম্যা’ম আমাকে কাজ শেখাতে লাগলেন-- লেসন প্ল্যানিং, ইউনিট ভাগ করে টাইম লাইন সেট করা, ইউনিট টেস্টের কোয়েশ্চেন পেপার বানানো, তাতে মার্কস ডিস্ট্রিবিউশন... এই সব। ধীরে ধীরে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল হোমটাস্কের খাতাগুলো চেক করে দেওয়া—শুধু আমার ক্লাসের নয়, খোসলা ম্যামেরও। ছ’মাস কেটে গেল। উদয়াস্ত খাটি, প্রশংসা পাই, মন গর্বে ভরে ওঠে। আমার সঙ্গে জয়েন করেছিল আরও দু’টি মেয়ে। জয়তী ঘোষ ও রোজালিন লাল। জয়তী বাঙালী আর রোজালিন স্থানীয় ক্রিশ্চান।

জয়তী ছটফটে, মুখে একটা আলগা হাসি, রোজালিন শান্ত, খুব কম কথা বলে। জয়তী বাচ্চাদের ক্লাসে খুব পপুলার, ও যখন ক্লাস নেয়, বাচ্চাদের হৈচৈ দুটো ক্লাস দূর থেকে শোনা যায়। আর রোজালিনের ক্লাসে টীচার আছে কি নেই, তাই বোঝা মুশকিল। তবে হরদম ওর ক্লাস থেকে কিছু বাচ্চা বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছে দেখতে পাই। আমরা তিনজন একসাথে লাঞ্চ করি। আমি, জয়শ্রী বেদুলা তেলুগু ব্রাহ্মণ-- ভেজিটেরিয়ান। আর বাঙালী জয়তী এবং ক্রিশ্চান রোজালিনের লাঞ্চবক্সে ডিম বা চিকেনের পিস থাকেই, কখনও বা ফিশ। তা থাকুক গে, আমার কোনও অসুবিধে হয় না।

জয়তীর মুখে নন-ভেজ জোকস ও অন্য টীচারদের নিয়ে নানান খাট্টা-মিঠা মন্তব্য লেগে থাকে। আমি মুচকি হাসি, রোজালিনের মুখে কোনও ভাব খেলে না। রোজালিন বিবাহিত, ওর হাজব্যান্ড জোসেফ স্টীল প্ল্যান্টে চার্জম্যান গ্রেড ওয়ান। একদিন কুমারী মায়ের গর্ভধারণ নিয়ে জয়তী কিছু বলতেই রোজালিন কাতর মুখে হাত তুলল।

- প্লীজ ঘোষ, লীভ গড এ্যালোন! ইয়ু ওন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।

- আরে, এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? আমাদের হিন্দুদের পুরাণেও কুমারী কুন্তীর সন্তান হওয়ার কথা আছে। তার ফলে মহাবীর কর্ণ জন্মাল। তেমনি জোসেফ বোধহয় ইম্পোটেন্ট ছিলেন, তাই কুমারী মেরির সন্তানের উনি পিতা। এতে আশ্চর্যের কী আছে?

- লীভ জোসেফ ট্যু!

- হোয়াই?

আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল।

আমি না হেসে গম্ভীর মুখে বললাম— বিকজ, জোসেফ ইজ দ্য নেম অফ হার হাজব্যান্ড।

- ইজ ইট? ইজ ইট! সরি রোজালিন, এক্সট্রিমলি সরি। আই ডোন্ট ইন্টেন্ড টু বি পার্সোনাল।

ঘোষ হেসে গড়িয়ে পড়ে।

এবার রোজালিনও হাসে।

- ইট’জ অলরাইট; নো অফেন্স টেকেন। বিকজ আই হ্যাভ নট ওয়ান বাট টু বিউটিফুল চিল্ড্রেন ফ্রম মাই জোসেফ।

জয়তী ঘোষ চোখ গোল গোল করে নকল বিস্ময়ে ওকে দেখে।

- তুমি দুই বাচ্চার মা ? এই বয়সেই? পেটে পেটে এত! দেখলে তো মনে হয় ভাজামাছটি উলটে খেতে জান না।

রোজালিন লজ্জায় লাল।

আমি বলি— এবার ওকে ছাড়ান দাও। দেখছ না ও ওর বরকে কত ভালবাসে!

জয়তীর ছ্যাবলামি থামে না।

- তার মানে ওরা সব ভালবাসার ফসল, জোর-জবরদস্তির নয়। হাউ লাকি ইয়ু আর!

উত্তরে রোজালিন হাতজোড় করে।

এবার ঘোষ আমাকে নিয়ে পড়ে। বলে, আমি নাকি হদ্দ বোকা। সিনিয়র টীচার খোসলা নাকি আমাকে ইমোশনালি এক্সপ্লয়েট করছেন। কাজ শেখানোর নামে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নিজের হোমটাস্ক চেকিংয়ের বোঝা আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে মজা মারছেন।

আমার এসব কথা আদৌ ভাল লাগে নি। রেজিস্টার তুলে নিয়ে লাঞ্চরুম থেকে বেরিয়ে যাই।



একদিন মিসেস আলুওয়ালিয়া, মানে আমাদের হেড মিস্ট্রেস রাউন্ডে বেরিয়ে ক্লাসের সামনে বাচ্চাদের বারান্দায় এক্কাদোক্কা খেলতে দেখে ওদের নিয়ে ক্লাসে ঢুকে দেখলেন রোজালিন ওর টেবিলে ঝুঁকে একমনে খাতা চেক করছে। পাতা ওল্টাচ্ছে আর লাল পেন্সিলে দাগ দিয়ে চলেছে। ক্লাসরুমের পেছন দিকের জানালার ওপর তিনটে বাচ্চা চড়ে বসে গল্প করছে। লাস্ট বেঞ্চ ও দেয়ালের মাঝের খালি জায়গায় দুটো বাচ্চা জাপটা-জাপটি করে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, বাকিরা হাততালি দিয়ে দুই খুদে কুস্তিগীরকে উৎসাহ দিচ্ছে।

রোজালিন শশব্যস্ত হয় উঠে দাঁড়াল এবং কিন্তু কিন্তু করে জানাল যে বারান্দার বাচ্চারা সবাই ওর পারমিশন নিয়ে ছোট বাইরে সারতে গিয়েছিল। আলুওয়ালিয়া ম্যাম ঠান্ডা গলায় বললেন -- এতগুলো বাচ্চাকে একসঙ্গে বাথরুমের জন্যে ছুটি দেওয়া? আর ওরা ক্লাসে ফিরে এলো কি না সেটা কে দেখবে? উনি এটাও বললেন যে খাতা ফ্রি-পিরিয়ডে চেক করাই ভাল এবং লোয়ার ক্লাসগুলোতে টীচারের স্থান চেয়ারে নয়, বাচ্চাদের মাঝখানে। রাইটিং টাস্ক কম করে সঙ ও রাইমের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে ভাল হয়।

উনি যখন পরের ক্লাসরুমে, মানে মিস ঘোষের ক্লাসে পৌঁছুলেন ততক্ষণে জয়তী সবাইকে শান্ত করে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ কোরাস গাইতে লাগিয়ে দিয়েছে। ব্যস, হেডমিস্ট্রেস হাইলি ইম্প্রেসড।

তারপর আমার ক্লাস। আমি মন দিয়ে তিন ডিজিটের নাম্বারকে দুই ডিজিট দিয়ে মাল্টিপ্লাই করা শেখাতে ব্যস্ত ছিলাম। উনি কখন ঢুকেছেন টের পাইনি।

কিন্তু গোটা ক্লাসের একসঙ্গে উঠে দাঁড়ানোর শব্দে ফিরে দেখি চশমার ফাঁক দিয়ে ওঁর চোখ হাসছে। উনি দাঁড়ালেন না, তবে ‘ক্যারি অন’ বলে বেরিয়ে যাবার আগে আমার দিকে ফিরে বললেন ক্লাসের পরে ওঁর চেম্বারে যেতে।

দশ মিনিট কাটল। বেল বাজতেই আমি হ্যান্ডব্যাগ তুলে তাড়াহুড়ো করে বারান্দা পেরিয়ে ওঁর চেম্বারে ঢুকলাম। ম্যামের সামনে টেবিলের উপর রাখা কিছু খাতা দুটো আলাদা ভাগ করে রাখা। একটা খাতা তুলে উনি আমার দিকে মেলে ধরলেন, -- তোমার সিগনেচার? তোমার হ্যান্ড রাইটিং ?

--ইয়েস ম্যাম। এনিথিং রং ? এনি মিস্টেক ম্যাম?

উনি উত্তর না দিয়ে অন্য ভাগের থেকে আরেকটি খাতা তুলে বললেন— দিস রাইটিং অলসো সীমস টু বি ইয়োরস; ইজন’ট ইট?

আমার গলা শুকিয়ে গেছে। শুধু ঘাড় কাত করি।

--বাট ইট বিলংস টু ক্লাস এইট। সো?

আমি কিছু বলি না।

উনি চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখেন। তারপর বলেন-- শোন, একটা বেনামী কমপ্লেইন এসেছে। তোমাকে নাকি এক্সপ্লয়েট করা হচ্ছে। একজন সিনিয়র টীচার জোর করে তোমাকে দিয়ে ওঁর হোমটাস্কের খাতা চেক করাচ্ছেন। তুমি কিছু বলবে?

--ম্যাম, আমি মিসেস খোসলার পুরনো স্টুডেন্ট। উনি আমাকে কাজ শেখানোর জন্যে কপি চেক করাচ্ছেন। কোনও জোর-জবরদস্তি না। আমি হ্যাপিলি এই দায়িত্ব নিয়েছি। আমার লাভ হয়েছে।

আলুওয়ালিয়া ম্যাম আমাকে কড়া চোখে জরিপ করে বললেন- বেশ, মনে হচ্ছে তুমি নতুন নতুন দায়িত্ব নিতে ভালবাস। তোমাকে একটা নতুন দায়িত্ব দিতে চাই; এগজামিনেশন ইনচার্জের। দু’মাস পরে হাফ ইয়ার্লি এগজামের সময়। আর ইউ ওকে? রেডি টু টেক দ্য রেস্পন্সিবিলিটি? ইনভিজিলেশন ডিউটি এলটমেন্ট, কোশ্চেন পেপার ডিস্ট্রিবিউশন, ওভার অল প্ল্যানিং, সিকিউরিটি অ্যান্ড সিক্রেসি— এভরিথিং উইল বি ইওর রেস্পন্সিবিলিটি।

আমি শ্লথপায়ে বেরিয়ে আসার সময় উনি পেছন থেকে বললেন— আর তোমাকে অন্য ক্লাসের খাতা চেক করতে হবে না।



নোটিস বেরোনোর পর স্টাফরুমে হৈ চৈ পড়ে গেল। কয়েকজন এসে আমাকে কংগ্র্যাটস বলে গেল। তিনজন সিনিয়র টীচার আমাকে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ফিরে গেলেন। খোসলা ম্যাম হেসে বললেন – দেখলে তো! আমার কথা শুনে চলে কেমন লাভ হল? আমিই তোমার নাম রেকমেন্ড করেছিলাম।

দুজন টীচার বললেন কাজটা কঠিন। কোনও অসুবিধে হলে বলবে, আমরা আছি।

বিকেলে ফেরার পথে জয়তী বলল— কাল আমার জন্যে সাম্ভার-বড়া আর উত্তপম ঘর থেকে বানিয়ে আনবি। আন্টিকে বলবি যে রসম আর সাম্ভার যেন উনিই রান্না করেন।

--- কিস খুশি মেঁ?

---- পুছো, পুছো! হ্যায় কোই বাত। কনফিডেনশিয়াল। মাইরি বলছি। বলব, কিন্তু তোদের আগে দিব্যি গালতে হবে যে কথাটা পাঁচকান হবে না।

আমি বললাম ঠিক আছে, কিন্তু রোজালিন কিছু না বলে কেমন অবোধ গরু-গরু চোখে তাকিয়ে রইল।

--কী রে রোজালিন? কসম খেতে কোন অসুবিধে আছে?

-- কিসের দিব্যি?

-- তোর প্রাণপ্রিয় জোসেফের।

-- দ্যাখ, গড, ভার্জিন মেরি, ক্রশ, স্বামী, বাচ্চা –এদের নিয়ে কসম খাওয়া ঠিক নয়। এই যে তুমি মাইরি বললে ওটাও আসলে ‘ মা মেরি’র কসম থেকে এসেছে। এসব আমার পছন্দ নয়।

--উঃ, এমন মাদার তেরেসাকে নিয়ে যে কী করি! আচ্ছা, কোনও কসম নয়, শুধু আমার গা ছুঁয়ে কথা দে; তাহলেই হবে।

আমরা দুজনেই জয়তীকে ছুঁয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম। সে চোখে দুষ্টুমি নাচছে।

--দ্যাটস ইট; ওয়ান ফর অল, অল ফর ওয়ান। আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স।

--হয়েছে, হয়েছে। সেই গোপন কথাটি কী?

-- যে সিক্রেট কমপ্লেইন এর জোরে তোর খোসলা ম্যামের বেগারি থেকে ছুটকারা হল, কপাল খুলে গেল, সেটা আমিই পাঠিয়েছিলাম। ভাইয়ের কম্প্যুটার থেকে টাইপ করে আর পাড়ার আউটলেট থেকে প্রিন্ট আউট বের করে।

আমাদের গলা শুকিয়ে গেছে। যদি ধরা পড়ত!

ও আমাদের নীরব প্রশ্ন অনুমান করে বলল -- ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। সব প্রিকশান নিয়েছি। চিঠিটা একফাঁকে হেডমিস্ট্রেসের টেবিলে রেখে দিয়েছিলাম। জয়তী কোন কাজে আগুপিছু না ভেবে এগোয় না – সে বেনামী চিঠিই হোক বা ডেটিং।

আমাদের দুষ্টু হাসিতে রোজালিন যোগ দিল না।



(২)

একটা অ্যাকাডেমিক ইয়ার পেরিয়ে গেল। আমাদের থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের দোস্তি বরকরার রয়েছে এবং আরও পাক্কি হয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা গোটা স্কুলের নজরে এসেছে।

আমার পরীক্ষার ইনচার্জ হওয়া নিয়ে একটা আঁধি উঠেছিল। প্রথম তিনদিনের পরীক্ষার পর কিছু বান্ডিল থেকে দুটো-তিনটে করে আন্সারশীট গায়েব হয়ে গেছল। আমার হাত-পা ঠান্ডা হবার জোগাড়। এদিকে সমস্ত ক্লাসরুম থেকে সব ইনচার্জ সাইন করে পুরো বান্ডিল জমা দিয়েছিলেন, সঙ্গে অ্যাটেন্ডেস শীট। আমি নিজে চেক করেছিলাম। জয়তী বলল, ঘাবড়াও মৎ, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি –সব ঠিকঠাক হ্যায়।

-- সে তো না হয় বলে দেব, তারপর?

-- ম্যাঁয় হুঁ না ? দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু দেয়ালেরও বোধহয় কান আছে, অন্তত আমাদের স্কুলবাড়ির দেয়ালের। হেড মিস্ট্রেস একদিন ডেকে পাঠালেন। কড়া চোখে জানতে চাইলেন খাতাপত্তর সব ঠিক আছে কী না। আমি আশ্বস্ত করলাম যে শেষ দিনের পরীক্ষার পর ওঁকে সব বুঝিয়ে দেব।

আর মাত্র দু’দিন বাকি। খাতার বান্ডিলের হিসেব মিলছে না। কী যে করি!

চেপে ধরলাম জয়তীকে। কী হল মুশকিল আসানের? ওর ভরসায় তো ছিলাম।

এবার জয়তীর মুখেও দেখছি চিন্তার ছাপ।

বলল—আভি ভী খেল বাকি হ্যায়। হাতে আছে দু’টো দিন। ভরসা রাখ।

আরও একটা দিন কেটে গেল। বিকেলে ও আমাকে বলল—আমার উপর ভরসা আছে তো? তোর ড্রয়ারের ডুপ্লিকেট চাবিটা দে। কোন ভয় নেই।

পরের দিন একটু আগেই স্কুলে গেলাম। লাঞ্চের পর প্রিন্সিপাল আলুওয়ালিয়া ম্যামের কাছে গিয়ে সমস্ত আন্সারশিটের বান্ডিল তার ট্যালি লিস্ট শুদ্ধু জমা দিতে হবে।

ড্রয়ার খুলে চোখ ছানাবড়া!

সমস্ত গায়েব শিটগুলো আমার ড্রয়ারে হাজির; সঙ্গে সাবজেক্ট, পরীক্ষার তারিখ ও ক্লাসের নাম লেখা স্লিপ লাগানো। যথাসময়ে সবকিছু ঠিকঠাক জমা হয়ে গেল।

অনেক জেরা করেও জয়তীর কাছ থেকে ‘উত্তরপত্র অন্তর্ধান রহস্য’ ভেদের গোপন ফর্মূলা জানতে পারিনি।

ও বলত কিছু কিছু ব্যাপার গোপন থাকাই ভাল। আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কোন বাংলা গানের এক কলি গুনগুনিয়ে উঠত—আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলংকভাগী।

অনেক পরে আমাকে বলেছিল—একটা টিপস দিচ্ছি। স্কুলের ফোর্থ গ্রেড স্টাফের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখবি, হোলি-দিওয়ালিতে মিষ্টির বাক্স দিবি। মাঝে মাঝে ওদের পরিবারের কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করবি। দেখবি, অনেক প্রবলেম সল্ভ হয়ে যাচ্ছে।

তারপর ফিল্মি কায়দায় বলল—ডোন্ট আন্ডার- এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ কমনম্যান!



৩)

অ্যাকাডেমিক সেশন শেষ হবার মুখে। আমি অ্যানুয়াল এগজামিনেশন পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়াতে এবার কেউ কোনও প্রশ্ন তুলল না। যেন এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষার প্রথম দুটো দিন যেতে না যেতেই একটা সমস্যা মাথা চাড়া দিল। রোজালিন স্কুলে দেরি করে আসছে। এমনটা হয় না। আমি প্রত্যেক ক্লাসে দু’জন করে ইনভিজিলেটর দিয়েছি। ওর ক্লাসে আরেকজনকে প্রথম দশ মিনিট, মায় অ্যাটেন্ডেন্স ও কোশ্চেন পেপার দেওয়া অবধি দায়িত্ব একাই সামলাতে হচ্ছে।

রোজালিন লাল। আমাদের থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের সবচেয়ে নির্বিবাদ সবচেয়ে শান্তশিষ্ট সদস্য। আমাদের মধ্যে ও কেমন যেন বেমানান। ওকে ঠিক যোদ্ধা বলা যায় কি? জয়তী ড্যাম গুড ফাইটার। ও জানে যে এই দুনিয়াটা একটা লড়াইয়ের ময়দান, আর বেশির ভাগ পুরুষ হল হারামির হাতবাক্স। এই অসম লড়াইয়ে জিততে হবে। তাই ও জানে ‘হাউ টু ফাইট ডার্টি’! আমি অন্যভাবে বড় হয়েছি। যতদূর সম্ভব ফেয়ার প্লে আর পারদর্শিতায় বিশ্বাসী।

রোজালিন বিশ্বাসী পরম করুণাময় ঈশ্বরের ন্যায়বিচারে। ওর কাছে মাতা মেরী, হোলি ট্রিনিটি এবং ওর স্বামী জোসেফ সমস্ত সমালোচনার উর্দ্ধে। ওর জীবনযাত্রা আমাদের চোখে একটু একমেটে, একঘেয়ে। তা হোক গে, ও নিজের মত করে ‘হ্যাপি’ আছে। সেটাই কি যথেষ্ট নয়? ও আমার কাছে একটু খোলামেলা। নিজের ঘরের অনেক কথা বলে। কোনও সমস্যা হলেও আমাকে বলে, জয়তীকে নয়, যদিও জয়তী আমাদের আসল মুশকিল আসান।

হয়ত ও জয়তীর প্রগলভতাকে ভয় পায়। কখনও যদি ওর বিশ্বাসের আগল ভেঙে যায়!

এভাবেই জানতে পেরেছিলাম যে ওর স্বামী জোসেফ অসুস্থ, চারমাস ধরে ডিউটি যেতে পারছে না। ছুটি অনেকদিন হল শেষ হয়ে গেছে। লীভ উইদাউট পে! টানাটানি বাড়ছে। আমার থেকে একটু একটু করে ধার নিয়েছে রোজালিন; প্রথম প্রথম নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দিয়েছে, এখন আর পারছে না। তবু আমি দিচ্ছি, দিতে হচ্ছে। আমার তো কোন সাংসারিক দায়িত্ব নেই। আর জোসেফ সেরে উঠে কাজে যোগ দিলে সবটা রোজালিন শোধ করে দেবে। এখন যে ওর বড় দরকার। আর আমি ওকে বড্ড ভালবাসি। ওর সরল বিশ্বাস, ওর এই অসহায় ভাব—সব আমাকে টানে। আমি ওকে আগলে রাখতে চাই।

ইদানীং ওর কপালে ভাঁজ, পোষাকে অযত্ন আর চোখের কোনে কালি আমাকে ভাবাচ্ছে। অনেক করে বলায় জানলাম যে ওর ছোটবোন সিলভিয়াকে ও বিলাসপুর থেকে এখানে আনিয়ে নিয়েছিল। সিলভিয়া খুব কাজের মেয়ে, চটপটে। অসুস্থ জামাইবাবুর সেবাযত্ন, দিদির দুই ছোট বাচ্চাকে সময়মত নাইয়ে খাইয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে স্কুলে পাঠানো –সব সুন্দর করে করছিল। জোসেফ সেরে উঠছে, তবে এখনও ডিউটি যাবার মত হয় নি। রোজালিন ওর বোনকে একটা স্থানীয় কোচিং ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিল। যাতে ও আগামী সেশনে উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারে।

কিন্তু কাল ওই কোচিং থেকে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল। সিলভিয়া গত দেড়মাস ধরে টিউটোরিয়ালে যায় নি। অথচ ও তো রোজ তৈরি হয়ে প্রায় রোজালিনের সঙ্গে একই সময়ে কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে যেত। কোথায় যেত?

সিলভিয়া কোন উত্তর দেয় না, খালি কাঁদে।

মুখ খুলল জোসেফ। সিলভিয়াকে বকতে হবে না। ওকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। ও টিউটোরিয়ালের টীচিং ফলো করতে পারছিল না। তাই আমি ওকে পড়াচ্ছি।

দেখবে, ও ঠিক পাশ করে যাবে।

তাই? তাহলে আমাকে বলিস নি কেন সিলভি? খামোকা কোচিং এর জন্যে কিছু টাকা বরবাদ হল।

সিলভিয়া দিদিকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদে। দিদি গো, তুমি খুব ভাল। আমি ভয় পেয়েছিলাম তুমি বকবে বলে।

বকব কেন?

না, মানে জোসেফ জীজাজির শরীর ভাল নয়। ওঁর উপর বেশি চাপ না পড়ে!

রোজালিন নিশ্চিন্ত হল; সত্যিই হল কি?

আজকে ছিল ম্যাথসের পেপার। রোজালিনের দেখা নেই। আমি গিয়ে ওর ক্লাসে হাত লাগালাম। পরীক্ষা শুরু হল।

প্রায় আধঘন্টা পরে রোজালিন এল। এ কি চেহারা! চোখের পাশে নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। ফোলা ঠোঁটে রক্তের দাগ!

আমি বললাম, রোজালিন, তুমি আজ ছুটি নাও। এই চেহারায় ডিউটিতে নিতে পারব না। বাড়ি যাও।

বাড়ি যাওয়ার কথায় চমকে উঠল রোজালিন। প্রাণপণে মাথা নাড়তে লাগল।

--ঠিক আছে, ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের চেহারা ঠিক করে নাও। আর স্টাফ রুমে গিয়ে বস। পরীক্ষার পর আমরা কথা বলব।



কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে ডেকে পাঠালেন প্রিন্সিপাল ম্যাম।

--দিস কান্ট গো অন। তোমার বন্ধু, কিন্তু এ ভাবে ডিউটি করা যায় না। আই ওয়ন্ট অ্যালাউ। আমরা ওকে শো-কজ করব।

--ম্যাম, একটা চান্স দিন। ওর একটু ফ্যামিলিতে প্রবলেম চলছে। আমি নিজে কথা বলব।

-- লাস্ট চান্স। উই অল হ্যাভ সাম প্রব্লেমস। বাট ইফ শী ডাজ’ন্ট মেন্ড হার ওয়েজ, ওয়েল, ইউ নো।

স্টাফ রুম থেকে ওকে ডেকে নিলাম। বাড়ি যাবার পথে সব শুনব।

এই সময়ে কোত্থেকে হাজির জয়তী।

আমি একটু অপ্রস্তুত; খেজুরে করে বললাম যে আজ রোজালিনের সঙ্গে একটু কথা আছে।

--ননসেন্স! ‘অল ফর ওয়ান, ওয়ান ফর অল’--ভুলে গেলি!

-- না মানে ওর কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা—

ঝাঁঝিয়ে উঠল জয়তী।

--যে কথাটা ওর গোটা পাড়া জানে সেটা প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল! দিস ইজ হাইট!

-- মানে?

-- মানে শী ইজ এ সেন্টিমেন্টাল ফুল! সেইজন্যেই ভুগছে, ঠকছে। চীটেড।

-- কে চীট করেছে?

-- পতিদেব অউর বহন। গ্রেট জোসেফ অ্যান্ড সিলভি।

ভেঙে পড়ে রোজালিন, দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদে।

আমি শকড, রোজালিন খালি কাঁদে।

জয়তী একটু একটু করে খোলসা করে। সিলভিয়া প্রেগন্যান্ট। এখন অ্যাবর্শন সম্ভব নয়, দেরি হয়ে গেছে। গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক রোজালিনের চোখে অ্যাবর্শন পাপ। তাই জোসেফ ওকে বিয়ে করে নেবে বলেছে।

এদিকে জোসেফের চাকরি চলে গেছে। ওর ডিপার্টমেন্ট থেকে চিঠি এসেছিল যে ওকে আর ছুটিতে থাকতে হলে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে হাজির হয়ে ওদের রেকমেন্ডেশন পেতে হবে, নইলে ডিউটি জয়েন করতে হবে।

জোসেফ কোনওটাই করল না। এই নিয়ে আজ সকালে কথা কাটাকাটি, জোসেফ রোজালিনের গায়ে হাত তোলে—দুই বাচ্চা ও বোনের সামনে। রোজালিনের ইডেন গার্ডেনে এখন স্যাটানের রাজত্বি।

জয়তী জোর করে আমাদের দু’জনকে নিয়ে রোজালিনের বাড়ি যায়। দুটো বাচ্চা দৌড়ে এসে ওদের মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর আমাদের দেখে সরে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।

জয়তী সোজা ওদের বেডরুমে ঢুকে পড়ে। ঠেট হিন্দিতে জোসেফকে বলে যে রোজালিনের গায়ে যদি আরেকবার হাত তুলেছে তো ওর ঠাঁই হবে শ্রীঘরে। আর তাতে নাবালিক শালীকে রেপ এর চার্জ আনা হবে।

জোসেফ বুলি ও কাওয়ার্ড। প্রথমে শের হবার চেষ্টা করলেও ভেতরের শেয়াল সহজেই বেরিয়ে এল। হাত জোড় করল, রোজালিনকে চুমো খেয়ে আমাদের কথা দিল যে এমন ভুল আর হবে না।



পরের দুটো সপ্তাহ ভাল ভাবে কেটে গেল। রোজালিন অনেক ধন্যবাদ দিল জয়তীকে। বলল জোসেফ প্রপারলি বিহেভ করছে।

প্রিন্সিপাল শো-কজ দেন নি। ঈশ্বরের দুনিয়ায় সব ঠিক ঠাক চলছে। আমি জয়তীকে বললাম- অংক কী সোজা রে ভাই!



তারপর আজকের দিন। আবার রোজালিন আসে নি। কোনও ফোনও নয়। শরীর খারাপ হোল নাকি? আমার ডানদিকের চোখের পাতা নাচছে কেন?

জয়তী বলল, এত ভাবার কী আছে? আমরা না হয় লাঞ্চ ব্রেকের সময় স্কুটিতে করে ওর বাড়ি ঘুরে আসব।

কিন্তু সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হবার আগে একটা পুলিশের জীপ এসে স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকল। দুজন অফিসার প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে বসলেন আর আমাদের দুজনের ডাক পড়ল।

আমাদের এক্ষুণি ওদের সঙ্গে রোজালিনের বাড়িতে যেতে হবে। কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

ওর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই দূর থেকে পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখা গেল। ভেঙে পড়েছে লোকজনের ভিড়।

আমরা দুজন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমে পুরো ব্যাপারটা ফোকাসে আনতে একটু সময় লাগল।

বেডরুম ও তার গায়ে লাগা রান্নাঘরের আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও কালো ধোঁয়া উঠছে। দমকলের একটা গাড়ি বাগানের ফেন্সিং ভেঙে ভেতরে গিয়ে হোস পাইপ দিয়ে আগুন সামলেছে। এখন মাত্র দুজন একটা কোণায় জল স্প্রে করে চলেছে। কোয়ার্টারের লাগোয়া বাগানের জমি জলে ভেসে কাদা হয়ে রয়েছে। প্রথমে পাড়াপড়শির দল বোধহয় নিজেরা আগুন নেভাতে চেষ্টা করেছিল। কিছু কিছু বালতি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

রোজালিন ও বাচ্চারা কোথায়?

বাড়ির দরজাটা ভাঙা হয়েছে, জানলা ও দরজার পোড়া কাঠ থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। বারান্দায় সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো শরীর। একটা অ্যাম্বুলেন্স রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে।

বাড়ির উঠোনে একটা গাছের নীচে সিমেন্টের বাঁধানো চাতালে বসে আছে রোজালিন, পাশে দুজন মহিলা পুলিশ।

এরমধ্যে পুলিশ অফিসার আমাদের খানিকটা ব্রিফ করেছেন।

রোজালিন নিজেই থানায় ফোন করে। ওঁরা ফোর্স নিয়ে এসে দেখেন দুটো ঘর থেকে আগুন জ্বলছে। কিন্তু বেডরুমের দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ।

আঙিনায় রোজালিন তার দুই বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। বাচ্চাগুলো থরথর করে কাঁপছে। কে তালা লাগিয়েছে? চাবি কার কাছে? রোজালিন উত্তর দেয় না। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করলে ওরা কেঁদে উঠে মাকে দেখায়। রোজালিন কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না।

ভেতরে কে আছে? রোজালিন উত্তর দেয় না। বাচ্চাদের বাবা কই? রোজালিন উত্তর দেয় না।

বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করলে ওরা তালাবন্ধ ধোঁয়া ওঠা ঘরের দিকে আঙুল দেখায়।

অনেক কষ্ট করে দরজা ভাঙা হয়, কিন্তু আগুনের হলকা ও ধোঁয়ার চোটে ভেতরে ঢোকা যায় নি।

দমকল এসে আগুন নেভায়, তখন ভেতর থেকে আধপোড়া দুটো শরীর বের করা হয়। ওরা আগেই দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে।

রোজালিন কোনও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল না। অনেকবার জেরার পর জানা গেল যে দরজায় তালা ওই লাগিয়েছিল। দরজা জানলায় স্কুটারের জন্যে রাখা এক জেরিকেন পেট্রল ছিটিয়ে দিয়ে ওই আগুন লাগিয়ে দেয়।

কেন? কোনও উত্তর নেই। বাচ্চারাও কিছু বলতে পারেনি।

শেষে রোজালিন পুলিশ অফিসারকে বলে স্কুল থেকে ওর দুই বন্ধু জয়শ্রী ও জয়তীকে আনিয়ে নিতে। ওদের কাছে ও সব খুলে বলবে।

আমরা গিয়ে ওর পাশে বসে ওর হাতে হাত রাখি। কিন্তু ওর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

মহিলা পুলিশ আমাদের বলে – বন্ধুর থেকে জলদি জলদি কথা বার করুন। তারপর ওকে কালোগাড়ি করে থানায় নিয়ে যাব। ক্যা খতরনাক অউরত! অপনে হাথোঁ সে পতি অউর বহনকো জ্বলা দী!

জয়তী ওকে হাত তুলে থামায়। তারপর বলে আপনারা একটু সরে বসুন। আমাদের কাজ করতে দিন।

আমরা কোন ওকথা বলি না। শুধু দুদিক থেকে ওর দু’হাত ধরে বসে থাকি। আস্তে আস্তে হাত বোলাতে থাকি। ভাবি, সব তো ঠিক চলছিল, হঠাৎ কী হল?

রোজালিন যেন আমার অনুক্ত প্রশ্নটি শুনতে পায়। ধীরে ধীরে নীচুগলায় প্রায় বিড়বিড় করে বলতে থাকে।

আজকে আমি যখন স্কুলে আসার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তখন ভাবলাম দুধ গরম করে সিলভিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আসি। রান্নাঘর থেকে দুধের কাপ হাতে নিয়ে ওর নাম ধরে ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই। বাইরে এসে দেখি জোসেফ ওর হাত ধরে টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম—এ কী! হাউ কুড ইয়ু? বিফোর মাই ওন আইজ!

জোসেফ ফিরে আমাকে দেখল, তারপর ওকে বেডরুমের ভেতর নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। কখন গেটের তালাটা নিয়ে দরজায় লাগিয়ে দিয়েছি, কখন পেট্রোলের জেরিকেন এনে মাচিস মেরে দিয়েছি—কিছুই মনে নেই।

বাচ্চাদুটোর চিৎকারে আমার হুঁশ ফিরল। তখন বন্ধ ঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভেতর থেকে জোসেফ ও সিলভির চিৎকার ভেসে আসছে। কিন্তু আমার কিছুই মনে হল না। একটু পরে ওদের চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। পাড়াপড়শীর দল আসতে শুরু করল। তখন পুলিশে ফোন করলাম।



রোজালিনের মাথা নুয়ে পড়ল, বিড়বিড় করতে লাগল— হাউ কুড হী? বিফোর মাই ওন আইজ?

কালো গাড়িতে ওঠার আগে আমাদের বলল— প্রমিস, ইয়ু উইল লুক আফটার মাই কিডস? প্রমিস, দে উইল বি কেয়ারড ফর?

0 comments: