2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

জংলা ডায়েরি
শিবাংশু দে


মনে পড়ে যায় অন্ধ্রপ্রদেশের মদানাপল্লির ঘন জঙ্গলে পারমিট না নিয়ে ঢুকে পড়া আমাদের 'জনের। চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলুম পাহাড়ের ধারে ধারে পাকদন্ডি বেয়ে। উপরে উঠতেই রেঞ্জার সাহেব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে...
-পরমিট লাইয়ে...
-নহি হ্যাঁয়....
-তব তো চলান করনা পড়েগা....
-উসকে পহলে ডি এফ সাহব সে একবার মিলা দিজিয়ে....
-কিঁউ? জানতে হ্যাঁয় ক্যা উনকো?
-নহি জানতে হ্যাঁয়, জান জায়েঙ্গে....
-উওহ আজ হেডকোয়াটার্স মেঁ নহি হ্যাঁয়....
-তো কম সে কম আপকা ওয়াকিটকি কা রেঞ্জ তক লে চলিয়ে, পারমিট লে লেঙ্গে....
-কওন দেগা?
-চলিয়ে পহলে, তব না বতায়েঙ্গে.....
জঙ্গলের পথে বারো কিমি রেঞ্জারের জীপে আমরা তিনজন....
খোশমেজাজে গাছপালা দেখতে দেখতে গপ্পো করছি। রেঞ্জার আড়চোখে তাকাচ্ছে। তখনও জঙ্গলে মাও'ইস্টদের বোলবালা হয়নি। 
-অপলোঁগ ক্যায়সে আয়ে হ্যাঁয়?
-গাড়ি হ্যাঁয়, গেট কে বাহর...
গাড়ি এসে থামে রেঞ্জারের অফিসে। ভিতরে যাই। বেঞ্চিতে বসি। মুন্সিজি চালানের খাতা বার করে। বলি, অভি কুছ মত চড়াইয়ে...
-ক্যা ডি এফ সাব সে বাত করনা হ্যাঁয়?
-নহি, থোড়া রায়সাব কো লগাইয়ে...
-কওন রায় সাব?
-চিফ কনজারভেটর ...
চকিতে পট পরিবর্তন। 
-উনকো ক্যয়সে জানতে হ্যাঁয়....
-অ্যায়সে হি....
------------
রায়দা পঁয়ত্রিশ বছর অন্ধ্রপ্রদেশে, কিন্তু এখনো বাংলাকবিতা স্মৃতি থেকে ঝরঝর করে বলে যান আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে আধডোবা বয়া। ফোন যায়। তাঁর পি এস ধরে। তারপর আমাদের পালা....
-রায়দা, শিবাংশু...
- মোলো যা... তুমি কোন চুলোয় এখন...
-এই আপনার গেস্ট হয়ে জঙ্গল দেখতে এসেছিলুম। আপনার বরকন্দাজরা কাগজ চাইছে, না দিলে হাজত বাস.....
-ডি এফ 'কে ফোনটা দাও....
-সে মক্কেল নেই এখানে, রেঞ্জার আছে....
-তাকেই দাও....
রিসিভারটি বাড়িয়ে দিই। সাহেব সেটিকেই স্যালুট করে। কী কথা হয় জানিনা। ফোন রেখে দেয়। তারপর বিগলিত হয়ে জিগায় চা খাবো না কাপি? নারে বাবা কিস্যু খাবোনা.... রোদ চড়ে গেছে, এবার ফিরবো। তখন আবার কমলি না ছাড়ার অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স।
একেই বলে ঠাকুর বলেছেন স্বজনপোষণ  অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার।

 
----------------
রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে 
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায়
তুমি এখনও এলেনা
সন্ধ্যা নেমে এলো-পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে-ভরা হাওয়া
আর পাতার মর্মরধ্বনি
(বিরহ- সমর সেন)
সিমলিপাল-জোরান্ডার নিবিড় সবুজ আর ভেজা স্নিগ্ধতা ছেড়ে আরো দক্ষিণে পৌঁছে যাওয়া মহানদীর টানা গর্জ, সাত ক্রোশ জুড়ে। হঠাৎ মনে হতে পারে এক অলীক স্বর্গ। নাম সাতকোশিয়া' জঙ্গল। নদী বলে নদী। লালমাটির খাড়াই পাড় থেকে উঁকি দিয়ে নীচে নদী দেখা। পশ্চিমের দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে আসছে মহানদী। কী জাঁক তার। গেরুয়া জল, ছুটে যাচ্ছে দক্ষিনে, বুলেট ট্রেনের ইঞ্জিন, তার গতি, উচ্ছলতা , অহংকারে মশমশ করে। ঠিক উল্টোদিকে ক্রসগেট। বাঘবন্দী জঙ্গল সেটা। বাঘের ছবি দিয়ে লেখা আছে, " তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছো না, কিন্তু আমি তোমাদের দেখছি। সাবোধান হে ..." চারদিকে শাল, গামার, সেগুন, কাঁঠাল, অর্জুন বনস্পতি। পাতার পর পাতা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যের ঝলসানো চোখ। বারবার উড়ে আসে মেঘের ঝাঁক। এক পশলা, দু পশলা, তিন পশলা। শরীর ভিজিয়ে ফিরে আসা ছোটকেই উপত্যকা। যেখানে মেঘ আর পাহাড় হানিমুন যুগল হয়ে নিজেদের বাঁধছে, ছাড়ছে, মিশে যাচ্ছে একে অপরে। কে দেখলো, না দেখলো, পরোয়া নেই। 
-----------------------------------------
আরো জঙ্গল ? তবে ডালট্নগঞ্জ থেকে বেতলা রেঞ্জের দিকে চলে যান। অথবা রাঁচির দিক থেকে লোহারডাগা হয়ে নেতারহাটের দিকে। রাঁচি থেকেই আবার ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ যাওয়ার পথ। তবে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ এখন যতোটা কল্পনায় ততোটা বাস্তবে নেই। যদিও রাজার রাজা হচ্ছে সারান্ডা রেঞ্জ। এর মধ্যে পাঁচটা ফরেস্ট ডিভিজন রয়েছে। মনোহরপুর বা গুয়া হয়ে গেলে কাছে হবে। গুয়ায় স্যার বীরেনের একটা গেস্ট হাউস আছে, যেটার সাজসজ্জা লেডি রানু নিজে করেছিলেন। প্রথমবার দেখে আমি একেবারে ফেলাট। মেঘাতুবুরুতে সেলের মেঘা অতিথিশালা অপূর্ব। বৃষ্টির দিনে জানালা খুলে রাখলে ঘরের ভিতর মেঘ লুকোচুরি করে। আর বাড়িটির বাগানে কিরিবুরুর সর্বোচ্চ শিখরটি যেখানে দাঁড়ালে আমার গ্রাম সিংভূমের সীমান্তে সাতশো পাহাড়ের নীল মিছিল সিম্পলি ডুবিয়ে দেয়। হায়, হায়। সাতশো পাহাড় মনে পড়লেই গণেশ পাইনের রানি' সঙ্গে শক্তি' কবিতা, গপ্পো আর বনবাংলোর রাত মনে পড়ে যায়। তাও তো মনোহরপুর থেকে বিসরা, কোয়েল, কারোর গপ্পো বাকি থেকে যাচ্ছে। নতুন শালের সারি সারি বনসৃজন। রেল কন্ট্র্যাকটরদের করাত কলে জঙ্গলের গুষ্টিনাশ হয়ে গেছে। সেখানে একজন ছিলেন মহান ঠিকাদার বাবু রামস্বরূপ সিং। চাইবাসায় থাকার সময় আমাদের জামাই আদর করে নিয়ে আসতেন তাঁর ক্যাম্পে। মনোহরপুর থেকে পোড়াহাটের অন্ধ জঙ্গলে। সে রামও নাই, সে জঙ্গলও নাই। ঠিকাদার, চোরাচালান, পলিটিক্যাল মাফিয়া, সবাই মিলে সিংভূমের সম্ভ্রম লুট করে নিয়ে গেছে। 







(ক্রমশ

2 comments:

  1. হাম জায়েগা। আপসে মিলকে বাত করেগা। পিলান করেগা। সারান্ডা কি সিমলিপাল? কহাঁ অউর ক্যায়সে? একদম ছত্তিশগড়কে জঙ্গল মাফিক দিখতা হ্যায়।। আখির হ্যায় তো ছোটানাগপুর রেঞ্জ হি না ?

    ReplyDelete
  2. অপরূপ প্রকৃতিচিত্র।অসম্ভব সুন্দর লেখা

    ReplyDelete