1

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অনুবাদ সাহিত্য


অনুবাদকবিতাগুচ্ছ

অংকুর সাহা




উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস: (আয়ারল্যান্ড, ১৮৬৫-১৯৩৯)


কানাকড়ি

ফিসফিসিয়ে বলি, “আমার গোঁফ গজানো বাকি।”
আবার বলি, “ভালবাসার বয়েস আছে না কি?”
ঝর্নাজলে চকচকে এক কানাকড়ি ফেলে
শুধাই, “প্রেম আসবে না কি খিড়কি দুয়ার ঠেলে?”
“নির্ভয়ে যাও, নির্ভয়ে যাও, প্রেমের পথে যুবা,
জীবনসঙ্গী পাবে তুমি তন্বী, অপরূপা।”
কানাকড়ি, কানাকড়ি, আমার কানাকড়ি,
বিনুনিতে বাঁধলো আমায় আহ্লাদি সেই পরি।

প্রেম যদি হয় চলার পথ কঠিন, আঁকাবাঁকা;
মন করেছ উদাস, মগজ ইঁদুর বাদে ফাঁকা,
খুঁজেই পাবে প্রাণের আবেগ, হৃদয় খুঁড়ে ব্যথা -
হঠাৎ দেখা, প্রেমের ফিকির, কথার পিছে কথা;
সব তারকা ছুটে পালায়, বেবাক বনবাসে
চাঁদ গিলেছে নিবিড় ছায়া, গভীর খণ্ডগ্রাসে।
কানাকড়ি, কানাকড়ি, আমার কানাকড়ি,
আর দেরি নয়, প্রেমের খেলার আসর শুরু করি।

[আয়ারল্যান্ডের কবি; গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন; নোবেল পুরস্কার পান ১৯২৩ সালে। কবিতাটি নেওয়া হয়েছে ১৯৪০ সালে প্রকাশিত কবির “কবিতা সমগ্র” থেকে।]


রুবেন দারিও: (নিকারাগুয়া, ১৮৬৭-১৯১৬)

কাঁটাঝোপ (নির্বাচিত অংশ)

।।১।।

প্রথমে চোখের দেখা;
তারপর হাতে হাতে
ঝলসানো স্পর্শ; আর তারপর
রক্তে ঘোড়ার টগবগ
এবং যুদ্ধে জেতার চুম্বন।

এলো নিশীথ এবং সোহাগ। তারপর
মুখরোচক গুজব উড়ে বেড়ায়
মানুষের খোঁজে।

কাঁদলে ক্ষতি নেই,
তবে দেরি করে ফেলেছ।
দ্যাখো। আগেই বলেছিলাম তোমায়।

।।২।।

মধুর কৃষ্ণাঙ্গী মানবী আমার,
চাই না তোমাকে সংসারী মা হিসেবে দেখতে।

কিন্তু তোমার ঘরের পাশ দিয়েই
বয়ে গিয়েছে গভীর খাল,
আর সবাই জানে যে
পুরুষমানুষ
মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই
সাঁতার শিখে যায় না।

[কবির প্রকৃত নাম: ফেলিক্স রুবেন গার্সিয়া সারমিয়েনতো; কবি, সাংবাদিক ও কূটনীতিক। কেবল নিকারাগুয়ায় নয়, তিনি পুরো লাতিন আমেরিকার আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ, বিংশ শতাব্দীর এসপানিওল ভাষার সাহিত্যের পুরোধা। মা রোজা এবং বাবা মানুয়েল সম্পর্কে তুতো ভাইবোন; গির্জার বিশেষ অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। মানুয়েলের অত্যধিক মদ্যপান আর গণিকাগমনের ফলে অতিষ্ঠ হয়ে রোজা তাঁকে ছেড়ে চলে আসেন পিত্রালয়ে, এবং সেখানে কবির জন্ম হয়। তাঁর শৈশবে, মা আবার বিয়ে করে নতুন স্বামীর সঙ্গে চলে যান ওন্দুরাসে;রুবেনকে মানুষ করেন অন্য আত্মীয়রা। পরবর্তী কালে সামান্য যোগাযোগ ঘটেছিল বাবার সঙ্গে -- তাঁকে মানুয়েল-কাকা বলে ডাকতেন; মায়ের সঙ্গে দেখা হয় নি বাকি জীবন।

এসপানিওল ভাষার কবি হলেও তাঁর অনুপ্রেরণা মূলত ফরাসি -- বিক্তর উগো (১৮০২-১৮৮৫), তেওফিল গোতিয়ে (১৮১১-১৮৭২) এবং পোল ভেরলেন (১৮৪৪-১৮৯৬)। মাত্র একুশ বছর বয়েসে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই: “আসুল” (“Azul”, “নীল”, ১৮৮৮)। সেই থেকে লাতিন আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনা। সংকলিত কবিতাটি “আসুল” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া -- মূল কবিতা এবং লিসান্দার কেম্পের (১৯২০-১৯৯২) ইংরেজি ভাষ্যের সাহায্যে বাংলায় অনুবাদ।]


নাতালি ক্লিফোর্ড বার্নি: (ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৭৬-১৯৭২)


তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে থাকি 


তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে থাকি:

আস্তে কথা বলো,
অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ছাড়া
গলা চড়ানো বারণ;

আর বিরাট এক পট
জল গরম করে
সুন্দর চা বানাও।

[মার্কিন কবি ও নাট্যকার; জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে প্যারিসে; তিনি লেসবিয়ান এবং বহুগামিতায় বিশ্বাসী ছিলেন; অস্কার ওয়াইল্ডের ভাইঝি ডলি তাঁর এক বিখ্যাত প্রেমিকা; তাঁর রচনা এখন দুষ্প্রাপ্য এবং ইংরেজি অনুবাদের অভাব। কবিতাটির প্রথম প্রকাশ “How (ever)”পত্রিকায়। ফরাসি থেকে ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন প্যাট্রিস টিটারিংটন।]


ইওসানো আকিকো: (জাপান, ১৮৭৮-১৯৪২)

চুলের জট (নির্বাচিত অংশ)

।।১।।

চলে যায় বসন্ত,
পচতে শুরু করে খাবার।
আনন্দে কেঁদে উঠে
তোমার ছোঁয়ায়
আমার কম্পিত স্তন।


।।২।।

হাজার হাজার
ঘন কালো উজ্জ্বল চুলের গুছি,
জটপাকানো,
একসঙ্গে উথালপাথাল,
তোমার স্বপ্নে আমি যেমন।


।।৩।।

তুমি কি এখনো অধীরভাবে
খুঁজছো সৌন্দর্যকে,
যা সহজ ও সত্য?
হে প্রেমিক, দ্যাখো আমার হাতের
পুষ্পস্তবক টকটকে লাল।

[জাপানের এই বিতর্কিত, নারীবাদী কবি ছদ্মনামে লিখতেন; আসল নাম: “শো হো”। বহুপ্রজ কবি তিনি, এক এক দিনে পঞ্চাশটিরও বেশি কবিতা লিখেছেন বলে শোনা যায়। এই কবির লেখা কবিতার সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি। তাঁর বিবাহ হয়েছিল এক সমসাময়িক কবির সঙ্গে এবং তেরোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। জাপানি কবিতায় তিনিই প্রথম আনেন প্রেম ও যৌনতায় নারীর দৃষ্টিভঙ্গি; এখন এই কবি সম্পূর্ণ বিস্মৃত। কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদকের নাম অজ্ঞাত।]


হিলডা ডুলিটল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৮৬-১৯৬১)

ইভ্যাডনি

এপোলোর ঠোঁটে আমি প্রথম চেখেছিলাম
প্রেম এবং প্রেমের মিষ্টি স্বাদ,
আমি, ইভ্যাডনি;
টাটকা ভায়োলেট অথবা নীল জবা দিয়ে
বানানো আমার চুল,
হাওয়া তাকে আঁচড়ে দিয়ে
ধাক্কা খায় পাহাড়ের গায়ে।
আমি, ইভ্যাডনি,
আমায় সৃষ্টি করেছেন আলোর ঈশ্বর।

তার কেশগুচ্ছ এসে পড়ে আমার মুখে
সতেজ ক্রোকাসপুষ্পের মতন,
আমার দুই গালে চুম্বন দেয় তারা,
ইউরোটাস নদীর তীরের
শাপলা গাছের মতন শীতল;
আমার চিবুক আর কন্ঠের মাঝখানে,
তার ঠোঁট পিছলে যায় বারবার।

এখনো আমার বাহু আর কাঁধের মাঝামাঝি
তার কেশরাজির ছোঁয়া পাই বারবার,
আমার হাতের মুঠোয় ভরা,
তাদের ক্রমাগত সরে যাওয়া সোনালি আভা,
দীর্ঘ হাত জুড়ে ধরে থাকা পুষ্পস্তবকের মতন।

টীকা: ইভ্যাডনি (Evadne) গ্রিক পুরাণের চরিত্র, সমুদ্রের দেবতা পোসাইডনের কন্যা এবং সূর্য, আলোক ও কবিতার দেবতা এপোলোর নর্মসহচরী।

ক্রোকাস (Krokas) হেমন্তের ফুল; ভূমধ্যসাগরের তীরে জন্মায়।
ইউরোটাস (Eurotas) গ্রিসের একটি নদী।

[আমেরিকার আভাঁ গার্দ কবি, সংক্ষেপে “এইচ. ডি.” নামে লিখতেন; ইমেজিস্ট এবং মডার্নিস্ট কবিতা আন্দোলনের পুরোধা; গ্রিক মহাকাব্যের নারীবাদী রূপান্তরের জন্যে খ্যাত। কবিতাটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত কবির “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া।]


দেলমায়রা আগুস্তিনি (উরুগুয়াই, ১৮৮৭-১৯১৪)

বিস্ফোরণ

জীবনে যদি প্রেম আসে, হোক সে স্বর্গীয়!
দীর্ঘ জীবন চাই প্রেমের জন্যে! আজ মনে হয়
হাজার বছরের জ্ঞানগরিমা ম্লান হয়ে যায়
অনুভূতির এক নীল নিবিড় মুহূর্তের কাছে।

হৃদয় ছিল করুণ, শ্লথ, মৃতপ্রায় ….
এখন সূর্যের আলোকে ফুলের মত ঝেঁপে:
ফেটে পড়ছে জীবনের উদ্বেল সমুদ্র হয়ে
প্রেম এসে আঘাত করে তার সৈকতে!

আজ আমার প্রাচীন বিষণ্ণতা ভাঙা ডানায়
ভর দিয়ে মিলিয়ে গেল আঁধারে: শীতল, অবসন্ন;
অতীত দুঃখের প্রতীকচিহ্নের মতন

ভেসে গেল ছায়ার দূরত্বে……
হাসে, গায়, চুমু খায় আমার জীবন!
যে জীবন ফুলের মতন উন্মীলিত আমার ঠোঁটে!

[উরুগুয়াই এর কবি -- ২৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন। সদ্য বিবাহ-বিচ্ছিন্ন স্বামীর পিস্তলের দুটি বুলেটে নির্বাপিত হয় তরুণী কবির জীবন। তাঁর জীবনে ছিল কবিতা আর মৃত্যু, ছিল আকাশছোঁয়া কামনাবাসনার আগুন, ছিল আবেগের আতিশয্য। এক কনিষ্ঠা কবির লেখনে তাঁর জীবন --“আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতন”। মূল কবিতার নাম ”এক্সপ্লোসিওন“; কবিতাটি ১৯০৭ সালে প্রকাশিত “শুভ্র পুস্তক (ভঙ্গুর)” (“এল লিব্রো ব্লনকো (ফ্রাজিল)“) কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত। এসপানিওল থেকে ইংরেজি অনুবাদ: পেরি হিগম্যান।]


গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল: (চিলে, ১৮৮৯-১৯৫৭)

ভগিনী

এক রমণীকে জমিতে লাঙ্গল দিতে দেখলাম আজ। আমারই মতো তার প্রশস্ত শ্রোণী, ভালোবাসার জন্যে আর মাটিতে নুয়ে নুয়ে ক্ষেতে খেটে যায় তার দেহ।

তার কোমরে হাত বুলোই আমি; ঘরে ডেকে আনি তাকে। আমার গেলাস ভরে ঘন দুধ খেতে দিই; তারপর আমার বাগিচার প্রেমমধুর গর্ভিনী ছায়ায় তার বিশ্রাম। আমার স্তনে যদি পরিতৃপ্ত না হয় তার ঠোঁট, ডাকবো আমার ছেলেকে -- সে তার নিজের ঠোঁট দিয়ে ভরিয়ে দেবে তাকে।

[কবির প্রকৃত নামটি দীর্ঘ: লুসিলা দে মারিয়া দেল পেরপিতুও সোকোরো গোদোয় আলকায়েগা; ১৯৪৫ সালে লাতিন আমেরিকার প্রথম নোবেলজয়ী। তাঁর কবিতা নোবেল পুরস্কারের যোগ্য কি না তাই নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তাঁর কবিতা মোটা দাগের এবং আবেগপ্রবণ -- এমন অভিযোগ উঠলেও তিনি চিলের এক প্রধান কবি। শিক্ষিকা, শিক্ষাবিদ ও কূটনীতিবিদ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি। আমেরিকার নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসপানিওল ভাষার অধ্যাপনার কাজ করেছেন। মেহিকো আর চিলেতে নারীশিক্ষার প্রসারে কবির অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর সমাধিতে উৎকীর্ণ রয়েছে তাঁর কবিতার একটি পংক্তি: “শরীরের জন্যে রয়েছে আত্মা, মানুষের জন্যে তার শিল্প।”]



পেদ্রো সেলিনাস: (স্পেন, ১৮৯২-১৯৫১)

বিহ্বল

তুমি আর এখানে নেই। তোমাকে
যখন দেখি, শরীর নয়, ছায়া, ছলনা।
তোমার অন্তরাত্মা চলে গেছে আগেভাগেই,
তুমিও সেখানে রওনা দেবে কাল।
তবু এই অপরাহ্ন আমাকে দেয়
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, মনগড়া হাসি,
আর শিথিল অঙ্গভঙ্গি,
এক বিহ্বল প্রেমের।

কিন্তু তোমার বিদায় নেবার ইচ্ছে
নিয়ে যায় তোমাকে গন্তব্যের দিকে,
এখান থেকে দূরে,
আর সেই দূরত্ব থেকে তুমি
ডেকে বললে আমায়:
“দ্যাখো, এই যে আমি এইখানে।”

আর আমি দেখলাম তোমার অনুপস্থিতি।

[বিংশ শতাব্দীতে স্পেনের এক প্রধান কবি, অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচক; লেখাপড়া করেছেন ফ্রান্সে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসেন এবং সেখানেই কাটে তাঁর বাকি জীবন। মূল কবিতার নাম: “এল দিস্ত্রাইদা”; কবিতাটির রচনাকাল ১৯২৯; ওই একই বছরে প্রকাশিত “সেগুরো আসার” (“নিশ্চিত ভবিতব্য”) কাব্যগ্রন্থে সংগৃহিত। এসপানিওল থেকে ইংরেজি অনুবাদ: পেরি হিগম্যান।]

1 comment:

  1. আমার মন ভরে গেছে; ভাল লেগেছে কবিতার চয়ন এবং অনুবাদের সুষমা।
    আরও হোক।

    ReplyDelete