1

গল্প - বিপুল দাস

Posted in


গল্প


প্রলয় আসছে
বিপুল দাস


নীপা, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আজ তুমি যখন গেট খুলে ঢুকছিলে, আমি তোমাকেই চিনতে পারছিলাম না। অস্পষ্ট একটা বেগুনি রঙ শুধু। তখন হঠাৎ মনে পড়ল তোমাকে এই শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজপিসও এনে দিয়েছিলাম। তুমি আমাকে বলেছিলে কালার-ব্লাইন্ড। কিন্তু বানিয়ে আনার পর যেদিন অফিসে গেলে, ফিরে এসে বলেছিলে শেডের ঊনিশবিশে নাকি দারুণ খুলেছে। সব মনে পড়ল আমার। তা ছাড়া আমি তো জানি, এ সময়ে গেট খুলে তুমি ছাড়া আর কে আসবে। ঘরে ঢুকে তুমি আবার সেই আমার পুরনো চেনা নীপা হয়ে গেলে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রীম ঘষছিল নীপা। পলাশের কথা শুনে তার ঠোঁটের বাঁ দিকটা সামান্য ভাঙল। নীপা নিঃশব্দে হাসলে এ রকমই ভঙ্গি হয়। আয়নায় নিজের ভাঙা ঠোঁট একবার দেখল নীপা। অনেক কারণে মানুষ এভাবে হাসে। অপমান, অভিমান, বিদ্রূপ, তাচ্ছিল্য, বা সাধারণভাবে হয়তো কারও হাসির প্রকাশ এই তির্যক ভঙ্গিমাতেই। তারা কখনও জোরে হাসতে পারে না। কিন্তু নীপা তো খোলামেলাও হাসতে পারে। তবে এখন পলাশের কথা শুনে তার ঠোঁটের বাঁ দিকটা কেন একটু ভাঙল? আয়নায় আবার তাকাল নীপা। কিন্তু এবার সে তার নীল নাইটির নিচে শরীরের ঢেউগুলো লক্ষ্য করল। হয়তো নীল রং-এর জন্য, বা হয়তো ফ্যানের হাওয়ায় তার শরীরের ওপর দিয়ে নাইটির মৃদু ওঠানামার জন্য এই শরীর মনে হয় এক দীঘল নদী। স্ফীত এবং ক্ষীণ হয়ে, দুকূলপ্লাবী এবং মরাসোঁতা হয়ে, খলবল হাসি ও ঠোঁটভাঙা চাপা হাসি নিয়ে নীল ঢেউ-এ তার শরীর ঢেকে সংসারে, মেট্রোর ভিড়ে, বইমেলায়, বাসস্টপে এবং বিছানায় উষ্ণ ও শীতল জল নিয়ে বয়ে যায়। 

আমি জানতাম তুমি একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। তোমার অপটিক নার্ভ যখন শুকিয়ে যাচ্ছিল, তখনই আমাকে প্রলয় বলেছিল সে কথা। তুমি ভেবেছিলে প্রলয় তোমাকে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে। চোখের সমস্যা হচ্ছে,অথচ প্রলয়ের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য মিথ্যে অহংকারে ডাক্তার দেখাতে চাও নি।

নীপা, আমি ভেবেছিলাম সামান্য কোনও ইনফেকশন... ধুলো বা অনেক সময় স্পোর থেকে হয়, সে রকম কোনও সংক্রমণ...

নীপার চোখের দিকে তাকাল পলাশ। আয়নার ভেতরে। দেখল নীপার ঠোঁটের ডানদিকের কোণের ভাঙন। বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, অ্যাশট্রে টানতেই নীপা বলল – ঘরে স্মোক কোরো না, আমার অসুবিধা হয়। ব্যালকনিতে গিয়ে ধরাও।

এক মুহূর্তের জন্য পলাশের হাত সিগারেটের প্যাকেটের ওপর থেমে রইল। এবার নীপা মোটা দাঁতের চিরুণি হাতে নিল। পলাশ নীপাকে দেখল আয়নায় সামনে থেকে, বাস্তবে পেছন থেকে। সিগারেটের প্যাকেট মুঠোয় চেপে ধরল পলাশ। নীপার পিঠের আদ্ধেক ঢাকা পড়েছে চুলে। নীপার চুলে সামান্য ঢেউ আছে। আয়নায় নীপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে পলাশের দৃষ্টি চুলের ঢেউ পেরিয়ে বাট ক্লীভেজ হয়ে গোড়ালিতে এসে থামল। মোটা দাঁতের কালো চিরুণি খুব ধীরে সুস্থে নীপা তার চুলের ভেতরে চালাচ্ছে।

এখনও তুমি আমাকে ঠকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছ। বলো, প্রলয়কে তুমি কোনও দিন হিংসা করো নি? প্রলয় যখন প্রথম প্রথম তোমাকে বলত --- তোর বউ একটা জেম, তুমি মাতাল হয়ে সে কথাই আমাকে মিমিক্রি করে শোনাওনি?

হ্যাঁ নীপা, প্রলয়ের চোখে আমি লোভ দেখেছিলাম। দু পেগ নেবার পরই শুধু তোমার প্রশংসা করত। এমন কী, কোনও কোনও দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যেত তোমার রূপশোভা আর গুণপনার বর্ণনায়। আমার সহ্য হত না। ইচ্ছে হত একদিন নিশ্চয় ওর গ্লাসে আমি পয়জন মিশিয়ে দেব। ওকে খুন করার জন্য নিখুঁত একটা পরিকল্পনার কথা ভাবতাম। কিন্তু নীপা আঃ... আমার চোখ... 

তুমিও তো মাতাল হয়ে আমার শরীরের কথা নির্লজ্জ ভাষায় আমাকেই শুনিয়েছ। তুমি ভাবতে এ রকম স্তুতিবাদে আমিও নির্লজ্জ হয়ে উঠব। শুধুমাত্র একটি সামাজিক সম্পর্কের জোরে, তারই জেরে তুমি নির্মম অপমান করতে আমাকে। আমার এই শরীরের অপমান কি আমার আত্মার অপমান নয়? আমার এই শরীর কি আমি নই? আমার এই অস্তিত্ব কি শুধু আমার বার্থ সার্টিফিকেট? আমার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি?আমার শাড়ি? আমার মোবাইল নাম্বার?

হাঃ সেগুলো তুমি সব বিশ্বাস করতে?

কোনগুলো?

তোমার গ্রেস, তোমার সেক্স্‌ অ্যাপিল, তোমার লুক, তোমার হাস্‌কি ভয়েস -- গ্রেটা গার্বো, রোজমেরি ডেক্সটার, অড্রে হেপবার্ন, লিজ টেলর, মেরিলিন মনরো --- এদের সঙ্গে কমপেয়ার করতাম। তোমার চোখে আনন্দ দেখে পরে আমি এখনকার নায়িকাদের – কার সঙ্গে তোমার কোথায় মিল --বিশ্বাস করতে সেগুলো? পুয়োর গার্ল!

বানিয়ে বলতে? তার মানে আমাকে পাশে নিয়ে আমাকে ভালো বাসতে বাসতে ষড়যন্ত্র তৈরি করতে...

আমি শুধু তোমাকে আনন্দ দিতে চেয়েছি। আমি তো টের পেতাম নীপা, আমার ভাষা চাবুক হয়ে তোমার অস্তিত্বে আছড়ে পড়ছে। একটা সূক্ষ্ম প্রতিরোধের দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। কখনও শক্ত হয়ে গেছ। ওই দেওয়াল ভাঙার প্লেজার তোমরা, মেয়েরা, কোনও দিনই বুঝবে না। আসলে লোভ, নীপা। ভাষার আক্রমণ, তারপর আবার অন্য ভাষা দিয়ে তাকে কাউন্সেলিং করেছি। আমি টের পেতাম তুমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছ হাসলে তোমাকে ক্যাথারিন জিটা জোন্স্‌-এর মত দেখায়। দ্যাট স্প্যানিশ বিউটি। তখন তুমিও আমাকে তীব্র ভালো বাসতে বাসতে গরম মোমের মত গলে যেতে।

এক মুহূর্তের জন্য চিরুণি থেমে রইল নীপার বারগ্যান্ডি কালারে ডাই করা চুলের ভেতরে। থর থর করে কেঁপে উঠল নীপার সমস্ত শরীর। তার হাতের কাঁপনে মোটা দাঁড়ার চিরুণি কেঁপে উঠল চুলের ভেতরে। উপকরণসহ অস্তিত্ব কেঁপে উঠল নীপার। মুখ ঘুরিয়ে পলাশের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে আবার আয়নায় তার চোখের দিকে তাকাল নীপা।

তুমি মিথ্যে সুন্দর বানাতে চেয়েছ, তুমি চেয়েছ অলীক ভ্রমণ। তখন থেকেই তুমি অন্ধ হতে শুরু করেছ। তুমি ধূর্ত শেয়ালের মত কাকের কর্কশ স্বরকে বলেছ কোকিলের পঞ্চম সুর। বোকা কাক হা করে তোমাকে গান শোনাতে চেয়েছে। তুমি তার জীবনযাপনের রুটি ও রুচি গ্রাস করেছ। এই অপমান আর লাঞ্ছনা তার কি পাওয়ার কথা ছিল?

মুঠো আলগা করে জব্দ সিগারেটের প্যাকেট খুলল পলাশ। দেখল সিগারেটগুলো ভাঙেনি। একটু হাসল সে। পলাশ যথাযথ সতর্ক ছিল, যাতে সিগারেট ঠিক থাকে। সে যখন মুঠোয় প্যাকেট চেপে ধরেছিল, ভেতর থেকে কেউ মুঠোর জোর নিয়ন্ত্রণ করেছে। থ্যাঙ্ক ইউ পলাশ মুখার্জি -- মনে মনে উচ্চারণ করল সে।

প্রলয় কেন তোমার প্রশংসা করবে?

প্রলয় সব কিছুর প্রশংসা করে। তোমারও। একদিন আমার কাছে বলেছে মার্কেটিং-এ তোমার মত ডায়নামিক ম্যানেজার এর আগে কোম্পানিতে আসে নি।

প্রলয় তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে চেয়েছে। তা হলে তোমাকেও অর্জন করা ওর পক্ষে সহজ হবে --- এ রকম ভেবেছিল। 

তুমি, আমি আর প্রলয় একবার নর্থবেঙ্গলের ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়েছেলাম, মনে আছে তোমার? খোলা জিপ্‌সিতে জাঙ্গল সাফারি। যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ টাওয়ারে আমার হাতে বায়নোকুলার তুলে দিয়েছিল প্রলয়। সামনে মূর্তিনদীর ওপারে একপাল হরিণ, অসংখ্য বাইসন, সামনের সল্টপিটে একটা গন্ডার দুলকি চালে এগিয়ে এলে উত্তেজনায় আমি প্রলয়ের হাত চেপে ধরেছিলাম। জীপ থেকে নেমে তুমি ডানদিকের নির্জন ছায়াঘন সরু পথের দিকে গিয়েছিলে সিগারেট খাবে বলে। বুঝতে পারিনি কখন নিঃশব্দে এসে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছ। তোমার হ্যান্ডিক্যামে তুমি মুর্তিনদীর ওপারে কাশবন, নদীর বয়ে যাওয়া, কিংবা গন্ডার নয় --- তুমি আমার আর প্রলয়ের ছবি তুলে যাচ্ছিলে। পরে আমাকে টিভির মনিটরে সেই ছবি দেখানোর সময় অশ্লীল ভাষায় রানিং কমেন্ট্রি করছিলে। বলেছিলে লাগসই মিউজিক জোগাড় করে ছবির সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করবে। আর আমাকে এসব বলার সময় তোমার চোখদুটো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। যেন তুমি স্পষ্ট আলো সহ্য করতে পারছ না। চোখ বুজে তুমি অন্ধকার তৈরি করছ। তারপর ইঁদুর, প্যাঁচা কিংবা বাদুড়ের মত তীক্ষ্ণ দাঁত ও ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিতে চাইছ মানুষের আলোকিত আনন্দকে। ভেবেছিলে অন্ধ সেজে তার সুবিধাটুকু কড়ায় গন্ডায় উশুল করে নেবে।

বায়নোকুলারের ছুতোয় তোমরা দুজন দুজনকে স্পর্শ করছিলে। বলো সত্যি কিনা?

ওটুকু স্পর্শ নির্দোষ ছিল। প্রলয়কে মিথ্যে দোষ দিও না। কখনও আমার পাশে বসতে হলে যতটা সম্ভব এড়িয়ে থেকেছে। ছোঁয়াছুঁয়ি হলে সিঁটিয়ে গেছে। ওর ওপর আমার কোনও দিনই শারীরিক বা মানসিক আকর্ষণ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া তুমি-ই তো ওকে জোর করে আমাদের সঙ্গে নিলে। কি ভেবেছিলে? আমাদের লীলাখেলা হাতেনাতে ধরবে। অন্ধ, তুমি অন্ধ...

নীপা, প্রলয় কি আজ এসেছিল? তুমি আজ বেগুনি রং-এর শাড়ি হয়ে যখন গেট খুলে ঢুকছিলে, তার আগে আমি ওর গাড়ির শব্দ পেয়েছি। নীপা, আমি এখন শব্দ শুনে গাড়ির মেক বলে দিতে পারি। প্রলয়ের পুরনো ইন্ডিকার শব্দ, নটরাজনের নতুন শেভ্রলে অ্যাভিও, চারু মুখার্জির এস্টিলো, সুধা মেহতার ন্যানো। আমি তোমার পারফিউমের গন্ধ অনেকদূর থেকে বুঝতে পারি। পেপারওয়ালা পেপার দিয়ে গেলে সেই কাগজ থেকে আমি ওর ঘামের গন্ধ পাই। আমার কান, নাক, জিভ, ত্বক --- সব কিছু অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অথচ তুমি যখন গেট খুলে আমার সীমানায় আসতে থাকো, তখন শুধু অস্পষ্ট একটা রং শুধু ... তোমাকে চিনতে পারি না। তোমার চোখের ভাষা পড়তে পারি না। 

কালো সরু ফিতে দিয়ে সামনের দিকের চুল খুব টান করে পেছনে বাঁধল নীপা। ঠোঁটের বাঁ দিকটা এখনও সামান্য বেঁকে রয়েছে। ডিমের মত লম্বা ছাঁদের মুখে গালের দুপাশে আলতো হাত ঘষল। ঘুরে দাঁড়াল পলাশের দিকে।

ভয়ংকর একটা মিথ্যে তোমার বুকের ভেতরে তোমারই রক্ত খেয়ে খেয়ে বড় হচ্ছে। ওকে মেরে ফেলতে না পারলে তুমি-ই রক্তশূন্য হয়ে যাবে। আমাকে মিথ্যে শর্মিলা ঠাকুর বানাও, প্রলয়কে মিথ্যে লম্পট বানাও,আমরা যত অপমানিত হতে থাকি, তোমার সুখ ততই তোমাকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায। এর পর তোমার কান, নাক জিভ, ত্বক -- সব অসাড় হয়ে আসবে।

আঃ নীপা, আমি কী করব বলে দাও। আমার নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের ভেতরে মিথ্যে ঢুকে যাচ্ছে। আমার প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে অবিরত চামড়ার নিচে মিথ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ভাতের থালায় মিথ্যের বালি কিচ্‌কিচ্ করে। কানের ভেতর দিয়ে অবিরল শুধু মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা... নীপা, ঠিক করে বলো, আমার নাক, চোখ, মুখ, কান -- সব ঠিক আছে তো? আমার আঙুলের মাথায় একবার চিমটি কাটবে? হাতের,পায়ের। শুনেছি ওখান থেকেই পচন শুরু হয়।

পলাশ, তোমার আত্মা?

আত্মা কাকে বলে নীপা? কোথায় থাকে? বুকের কোন কুঠুরিতে? যাদের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়, তখন সেই আত্মা কোথায় লুকিয়ে থাকে?

আত্মা নিয়ে একদিন আমরা অনেক তর্ক করেছি পলাশ। তোমার মত আমিও জানি আত্মা বলে সলিড কোনও জিনিস নেই। তুমি তো মাইনাস থেকে জীবন শুরু করা মানুষ। তোমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যেতে খালি পায়ে। কলেজের ক্যান্টিনে কোনও দিন খেতে যাও নি। মুড়ি কিনে টিফিন সারতে। নাগেরবাজারে ভাড়াবাড়িতে থাকার সময় বলেছিলে বদ্ধ ফ্ল্যাটের জীবন তোমার অসহ্য। পারলে কোনও দিন একটু জমি কিনে নিজের মত করে বাড়ি বানাবে। বলেছিলে উঠোনে বকফুলের গাছ পুঁতবে। লাউ-এর মাচা বানাবে। বলেছিলে আমাকে গার্ডেন ফ্রেশ সবজি খাওয়াবে। ওই সবুজের শরীরে কোনও দিন পোকা মারার বিষ স্প্রে করা হবে না। ওই সবুজের শেকড়ে কোনও দিন কৃত্রিম সার দেওয়া হবে না। একটুকরো উঠোনের কথা তুমি প্রায়-ই বলতে। মাটির স্পর্শ না পেলে তুমি মরে যাবে। আমি বলছি তোমার বিবেকের কথা। তোমার বোধের কথা। এত তাড়াতাড়ি তোমার অতীত ভুলে গেলে পলাশ? এই ফ্ল্যাট ছেড়ে এখন আরও বড় ফ্ল্যাটের খোঁজ করছ। মাটি বলতে তুমি এখন চেন শুধু ছাদে ফুলগাছের টবের মাটি। আর সেই মাটির বৃত্তে বন্দী বনসাই হয়ে এক চিলতে আকাশ দেখে ভাবছ এই বুঝি তোমার সম্পূর্ণ আকাশ। ব্যালকনির জানালা খুলে দিলে যে বাতাস আসে, ভাবছ এই বুঝি দামাল হাওয়া।

নীপা, তুমি শোবে না? তুমি কেন আবার সাজগোজ করতে বসলে? ঠোঁট লাল করছ, ভুরু টানছ, আলমারি খুলে পোশাক খুঁজছ, এত রাতে তুমি কোথায় যাবে নীপা?

প্রলয় আমাকে ডাক দিয়েছে পলাশ। প্রলয় আসবে।

হাঃ হাঃ আমার সন্দেহ তাহলে ভুল নয়। আমি জানতাম, তোমাকে নিয়ে প্রলয় একদিন পালিয়ে যাবে। নীপা, আমার লাইসেন্সড্‌ রিভলভার আছে, তুমি জানো।

হায় আমার ডায়নামিক মার্কেটিং ম্যানেজার। অন্ধ ম্যানেজার, প্রলয়কে তুমি চিনতেই পারবে না। ধূসর কালো খ্যাপা মোষের মত অস্পষ্ট একটা রং শুধু তুমি দেখতে পাবে।

ছিন্নভিন্ন করে দেব সেই রং। গার্ডেনরিচের ফ্যাক্টরি থেকে সমস্ত লেবারদের ডেকে আনব। ডবল ও টি, ক্যান্টিন ফ্রি।

মেডিক্যাল লিভ নিয়ে এক মাস ঘরে বসে রয়েছ, তুমি জানো না গার্ডেনরিচ আর শালিমার ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রলয়?

চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। 



আলমারি খুলে নীপা একটা লাল সালোয়ার কুর্তা পরেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নীপা দুই ভুরুর মাঝখানে একটা লাল ভেলভেটের টিপ পরল। পেছন থেকে পলাশ দেখল আয়নার ভেতর থেকে যেন আগুনের একটা ঢেউ চিরকালের অসদ্‌বিম্ব হয়ে থাকার অপমান সইতে না পেরে কাচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ছায়ার মায়া নয়, প্রকৃত কায়া হয়ে উঠতে চাইছে আগুন। নীপার রক্তমাংসময় শরীরের দিকে, তার পেছন দিকে, তার বাট ক্লিভেজের দিকে তাকানোর সাহস পেল না পলাশ।

এসো পলাশ, তোমার রিভলভার নিয়ে এসো। আয়নার ভেতর থেকে নীপা বলল।

এ কি! আমার অস্ত্র কোথায়? আমার বন্দুক? শূন্য ড্রয়ারের দিকে তাকিয়ে পলাশের হাহাকার কান্না হয়ে ঝরে পড়ল। এক ধরণের ভয় ছিল এই কান্নার আড়ালে।

আচমকা ঘুরে দাঁড়াল নীপা। পলাশের মুখোমুখি। আয়নার ভেতরে তখনও আগুনের উল্লাস। পলাশ দেখল নীপার হাতে রিভলভার। পাশাপাশি দুই নারী। পলাশ বুঝতে পারছিল না অস্ত্র হাতে এই নীপার প্রতিচ্ছায়া কী ভাবে আগুনের ফুলকি হয়ে ওঠে। বস্তুর এবং প্রতিবিম্বের চরিত্র বিষয়ে সে আতান্তরে পড়ে যায়। তার মনে হয় প্রকৃতই আয়না এক রহস্যময় বস্তু। বামপন্থীকে দক্ষিণপন্থী করে, হাতের লেখা উলটে দেয়, ভুল আয়নায় মানুষের মুখ বিকৃত হয়ে যায়। তবে কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ বললে আয়না না ফিরিয়ে দেবে?

এই নাও। পলাশের দিকে রিভলভার এগিয়ে দিল নীপা।

একটা পচা গলা হাত প্রাণপণে চেষ্টা করছে নীপার হাতের দিকে এগিয়ে যেতে। হাতটা এগোচ্ছে আর শতাব্দীর পূঁজরক্ত মাখামাখি হয়ে খসে পড়ছে মাংস। সাদা হাড় খটমট করে বেজে উঠছে। স্নায়ু ও পেশীবিহীন ওই হাতের কাঠামো কিছুতেই ছুঁতে পারে না তার বিশ্বস্ত বন্দুক। ক্রমে হাড়ের কাঠামো থেকে সাদা সাদা গুঁড়ো ঝরে পড়তে থাকে। যেন ঘুণধরা প্রাচীন কাঠামো, দারুময়।

পলাশ, প্রলয় আজ আসবে। তুমি অন্ধ, তাতে প্রলয়ের কী আসে যায়, বলো?

মৃত মানুষের মত রক্তহীন সাদা মুখ তুলে পলাশ দেখল ঘরের ভেতরে গর্ভিনী কালো মেঘ জমেছে। ধুসর, খ্যাপা মোষের মত দুলে উঠছে জলভরা মেঘ।

এসো --- কালো মেঘের দিকে দুহাত বাড়ালো নীপা। দুচোখ বন্ধ করল পলাশ।

1 comment: