0

গল্প - বিভাস রায়চৌধুরী

Posted in

গল্প


দুর্বিপাকে আদবানীর হেলিকপ্টার
বিভাস রায়চৌধুরী


এ গল্প তখনকার যখন ভারতের হোম মিনিস্টার আর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন লাল কৃষ্ণ আদবানী। সে সময় এন.ডি.এ -২ ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে আর বাজপেয়ী সাহেব আবার নতুন করে প্রধান মন্ত্রী হয়েছেন। আমার পোস্টিং ১১৯ নং হেলিকপ্টার ইউনিটে। আমাদের ইউনিট সে সময় জামনগর এয়ার বেস থেকে Mi-8 (উচ্চারণ মি-এইট) হেলিকপ্টার অপারেট করছে, রাশিয়ান বিল্ড মিডিয়াম লিফট হেলিকপ্টার, বেশ শক্ত পোক্ত। এই হেলিকপ্টার মালপত্র, সেনা জওয়ান বা অস্ত্রশস্ত্র বহন করার জন্য যথেষ্ট ভাবেই উপযুক্ত।‌

জামনগর বা ‘নওয়া নগর’ গুজরাতের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের একটা জেলা শহর। ‘নওয়া নগর’ বা ‘নিউ টাউন’কে জাম সাহেবের নামের সাযুজ্য রেখে জামনগর বলে। আদতে, এই শহর জাদেজা বংশীয় রাজা জামসাহেবদের করদ রাজ্যের রাজধানী ছিল (প্রিন্সলি স্টেট)। ব্রিটিশরা জামনগরকে ১৩ গান স্যালুটের মর্যাদা দিয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতভুক্তির পরে বর্তমানে জাম রাজারা গরু পোষে আর রাজার ভাইপো ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বেটিং-এ ফেঁসে কমেন্ট্রি করে।

জামনগর আমাদের পশ্চিম বঙ্গের জেলা শহরগুলোর চেয়ে আয়তনে অপেক্ষাকৃত বড় হলেও জনসংখ্যা এত বেশিকিছু নয়। আমেদাবাদ, সুরাট, বরোদা, রাজকোটের পরেই জামনগরের নাম আসে। তবে হ্যাঁ,ভারতের পশ্চিম প্রান্তের সবচেয়ে বড়ো শহর, আর পাকিস্তান বর্ডারের কাছে বলে খুব গুরুত্বপূর্ন সেনা ঘাঁটি, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

আম-জাম বা জাম বাটির সাথে জাম নগরকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। যা বলছিলাম, জাম সাহেবের তামঝাম বেশ জাঁকজমক পূর্ণ ছিল। কেমব্রিজ প্রোডাক্ট, রনজি ট্রফির মহারাজা রনজিৎ সিং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার টেস্ট প্লেয়ার। পুরাকালের কেষ্ট ঠাকুর মথুরা ছেড়ে যে দ্বারকাতে এসেছিলেন, সেই দ্বারকা এই জামনগর জেলাতেই। তার সেই যদুবংশের উত্তরসুরী এই ‘জাম’ রাজারা! পশুপালক যদু বংশের কেউ রাজা হলে সে ক্ষত্রিয় হয়ে যায়। লোকাল ভাষাতে তাদের “বাপু” বলে। জাদেজা, ঝালা, সিং, গোহিল এই সব টাইটেল নামের শেষে এদের উত্তরাধিকার বোঝায়।

শহরের একপ্রান্তে পবন চাক্কি এলাকাতে আর্মি ব্রিগেড, ডিগজাম সার্কেলের দিকে বিশাল এয়ার ফোর্স স্টেশন, আর বেদী বন্দরের পাস দিয়ে গেলে নেভীর ইলেকট্রিকাল ট্রেনিং সেন্টার আই এন এস ভালসুরা। শহর তিন দিক থেকে সেনা বাহিনী দিয়ে ঘেরা। আর শহরের মধ্যে রিলায়েন্স আর ইসার (এখন একটা রাশিয়ান কোম্পানি কিনেছে) রিফাইনারির কর্মচারীতে জমজমাট। বাজারের বিক্রেতা দোকানীরা সব গুজ্জু ভাই, ক্রেতা সবই প্রায় গুজরাতের বাইরের।

তিনদিকে তিন সেনা বাহিনী থাকার অর্থ কিছু অস্বাভাবিক না। করাচী পোর্ট, পাকিস্তানের বর্ডার – এগুলো খুব কাছে। এয়ার ফোর্সের আবার তিনিটে ক্যাম্প। ‘এয়ার ফোর্স -১’ মানে’ রানওয়ে সংলগ্ন এলাকা,এখানে আমাদের স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্কুল (কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়-১) জঙ্গি বিমান আর মিসাইল ইউনিট, সাথে আমাদের হেলিকপ্টার ইউনিট। এই ইউনিটের লোকজন এখানেই থাকে। কোয়ার্টার না পেলে বাইরে বাড়ি ভাড়া করেও থাকে। ডিফেন্স কলোনির কাছে ডিগজাম স্যুটিংস এর নাম তো সবাই জানেন, এটা ‘জাম’ সাহেব দিগ্বিজয় সিং-এর কাপড়ের কল। সেই ডিগজাম সার্কেলের কাছে খোড়িয়ার কলোনিতে অনেক ভাড়া বাড়ি পাওয়া যেত। আমরাও তখন সেখানেই ‘রাজ চেম্বারে’ ভাড়া থাকি। জামনগরে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়-২ আর্মি ক্যাম্পে। আরেকটা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় নেভীর ভালসুরাতে।

সর্বাণী তখন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়-৩ এ পোস্টেড। সেটা আবার এয়ার ফোর্স-২ ক্যাম্পে। সেখানকার ইউনিটগুলো একটু সিক্রেট, তাই আর তাদের সম্বন্ধে কিছু বলছি না। দুই এয়ার ফোর্স ক্যাম্পের মধ্যে ৯ কিলোমিটারের তফাৎ। আমরা থাকতাম প্রায় মাঝামাঝি, আমার কর্মক্ষেত্র ৫ কিমি আর সর্বাণীর স্কুল ৪ কিমি দূরে । ছেলে তখন খুব ছোটো, কোনও একটা স্কুলে যেত, মনে নেই।

শীতের বিকেল। আমি তখন আমাদের ডেইলি সার্ভিসিং সেকশনে (DSS) কাজ করি। সহজ ভাষায় বললে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। ট্যাক্সি রেডি করা থাকে, খদ্দের এলে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। আমাদের কাজ তাই। সকালে হেলিকপ্টার রেডি করে দিলে কোথাও কোনো সর্টিতে চলে যায়। ফিরে আসে, তেল ভরে, চেক করে আবার চলে যায়। এভাবেই দিন কাটে। বিকেলে তার পরদিনের টাস্ক দেখে, আগাম প্রস্তুতি সেরে দোকান বন্ধ করে বাড়ি আসা। তিনটে শিফটে কাজ হয়। ভোরে একটা পার্টি গিয়ে সেদিনের সকালের জন্য হেলিকপ্টার রেডি করে। তারপর ডে শিফট গিয়ে হাল ধরে। দেড়টা নাগাদ আর্লি পার্টির ছুটি, তখন আসে বিকেলের শিফট। তারা আর্লি পার্টিকে রিলিভ করে। দুটো নাগাদ ডে শিফটকেও ছেড়ে দেয়।

সেই রকম এক বিকেলে খবর এলো, আগামীকাল সকালে VVIP মুভমেন্ট আছে। দুটো হেলিকপ্টার রেডি করতে হবে সকাল ছটার আগে। তার মানে ভোর চারটেতে রিপোর্টিং। এই "মহালয়া" বাজানোর টিমকে বলা হয় ‘আর্লি পার্টি’। এতে সব ডিপার্টমেন্টের এ জন করে থাকে। সাথে একজন বুড়ো সিনিয়র। এদের কাজ ভোরে এসে সব রেডি করে SPG (স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ) বা VVIP’র সিকিউরিটিকে হেলিকপ্টার হ্যান্ড ওভার করে দেওয়া। তারপরে প্যাসেঞ্জার হেলিকপ্টারে উঠে গেলে আমাদের কাজ স্টার্ট আপ করিয়ে দেওয়া।

ততক্ষনে দিনের আলো ফুটলে বাকি লোকজন যারা ডে শিফটে আছে তারা আসবে। তখন আর কাজ না থাকলে আর্লি পার্টি ‘নাস্তা’ করতে যাবে, সুযোগ পেলে ঘুমাবে। DSS রেস্ট রুমে সারাক্ষন টিভি চলার ফলে সে চান্স সীমিত।

ভোর বেলা এসে দেখি VVIP-র জন্য আরো দুটো হেলিকপ্টার এসেছে। লাল কৃষ্ণ আদবানী দিল্লী থেকে বোয়িং-এ আসছেন। জামনগরে নেমে হেলিকপ্টারে চেপে যাবেন সোমনাথ মন্দিরে। এয়ার ফোর্সের ভাষায়VVIP মানে মাত্র ৫ জন। রাষ্ট্রপতি, উপ রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী, রক্ষা মন্ত্রী, আর এয়ার ফোর্স চীফ। ডেপুটি প্রধান মন্ত্রী তখন নতুন সংযোজন। (জানি, এই লিস্ট নিয়ে অনেক আর্গুমেন্ট হবে) এই ৫-৬ জনের জন্য এয়ার ফোর্স এর SOP বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর একটু আলাদা। এই ধরনের মুভমেন্টের জন্য তিনখানা হেলিকপ্টার রেডি করা হয়। সব গুলোই Mi-8 হেলিকপ্টার।



ধরা যাক, এই তিন হেলিকপ্টরের নাম ‘জুলু- ১, ‘জুলু- ২’ আর ‘জুলু- ৩’ ( ‘জুলু’ নাম এই জন্য যে মি-৮ হেলিকপ্টার গুলোর নাম্বার Z দিয়ে শুরু হয়, আর Z কে ফোনেটিক অ্যালফাবেটে ‘জুলু’ বলে, যেমন A for Alfa , B for Bravo …...Z for Zulu ) । ‘জুলু-১’ হেলিকপ্টার এসেছে দিল্লীর কমিউনিকেশন স্কোয়াড্রন থেকে। এর বাইরের রঙ নীল সাদা, ভেতরে বসার সিটগুলো প্রায় সোফার মতো, এসি লাগানো,অ্যাটাচড টয়লেট, মেঝেতে ঝকঝকে কার্পেট পাতা, এ সব রাজীব গান্ধীর আমলের সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মডিফাই হয়ে আসা। ‘জুলু-২’ এসেছে যোধপুরের কমিউনিকেশন ফ্লাইট থেকে, এটাও নীল সাদা,এর সিট গলো এয়ারলাইন্সের প্লেনের মতো, টয়লেট ইন্ডিয়াতে মডিফাই করে বানানো, এসি নেই, মেঝেতে রঙচটা কার্পেট। আর ‘জুলু-৩’ হচ্ছে আমাদের হেলিকপ্টার! কালো আর ছাই রঙের ক্যামোফ্লেজ,একদম মালগাড়ী, সিট গুলো লোকাল ট্রেনের ভেন্ডারের মতো, টয়লেট নেই, এসি নেই, কার্পেট নেই, মেঝে’টা অ্যান্টি-স্কিড ডুরালমিনের পাত দিয়ে বানানো। মেঝে নোংরা ছিল বলে বিকেলে জল দিয়ে ধোয়া হয়েছে, বোঁটকা গন্ধটা আছে। জানলা’র কাঁচ বা ব্লিস্টার খোলা যায়।

‘জুলু ১’ হেলিকপ্টারে VVIP বসেন, সাথে আপ্ত সহায়ক, পার্সোনাল সিকিউরিটি – এই রকম দু তিন জন। ‘জুলু ২’ তে বসেন অন্য মন্ত্রী, সেই রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত নেতা, ডিপার্টমেন্টের চীফ সেক্রেটারি, সিনিয়র ব্যুরোক্র্যাট ধরনের লোকজন। ‘জুলু ৩’ এ ওঠেন মিডিয়া, লন্ড্রি, হেয়ার ড্রেসার, শেফদের মতো ব্যক্তিগত সহচর। এটাই প্রোটোকল।

সকাল আটটার আগেই আদবানী সাহেবের বোয়িং এসে গেল। ৭৩৭ থেকে নামার সময় জামনগর জেলার ডি এম, এস পি, আমাদের স্টেশনের এয়ার অফিসার কম্যান্ডিং (AOC) আর বোয়িং এর ক্যাপ্টেন সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে রিসিভ করেন। এটাও প্রোটোকল। ডেপুটি পি এম প্লেন থেকে নেমে প্রায় সাথে সাথেই হেলিকপ্টারে গিয়ে উঠলেন। তিনটে হেলিকপ্টার প্রায় এক সাথে টেক অফ করল। বিদায় পর্ব শেষ হতে আমিও আমার টিম নিয়ে ডেস্কে ফিরে ডে শিফটের হাতে দ্বায়িত্ব দিয়ে রেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। লো ভলিউমে টিভি চলছে, কেউ দেখছে না।

জামনগর বাঁধনির কাজের জন্য বিখ্যাত। জামনগরের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের পেশা এই বাঁধনির কাজ করা। এখানের জলে এমন কিছু কেমিক্যাল আছে যাতে কাপড়ের রঙে চমক আসে। বিশেষ করে লাল আর মেরুন। কেবল টিভি খুললেই যে কোনও চ্যানেলে দেখতে পাবেন লিন্ডি বাজার, বর্ধন চকের বিভিন্ন দোকানের বিজ্ঞাপন। সেই সব দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ বুঁজে এলো।

মিনিট পনের হয়ছে বোধ হয়, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। টিভি’র সামনে ভীড়। ওদিকে ডেস্ক থেকে সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার স্কোয়াড্রন লীডার গাট্টু আর ডেস্ক ইন চার্জ ওয়ারেন্ট অফিসার গিল-এর গলার আওয়াজ। দুজনেই খুব নিচু টোনে কথা বলেন। এখন চীৎকার করছেন। ধরফড়িয়ে উঠলাম।

-কেয়া হুয়া?

জি নিউজের নীচে, স্ক্রলে লেখা আসছে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাগ্রস্ত!

টারম্যাক শুটা পায়ে গলিয়ে এক লাফে রেস্ট রুম থেকে বাইরে এলাম। টারম্যাকে সবাই ছুটোছুটি করছে। স্কোয়াড্রন লীডার গাট্টু আমাকে দেখে বললো -রয় চৌ, গেট ইনটু দ্য এয়ারক্রাফট!

-লেট মি টেক দ্য ট্যুলস স্যর!

-ডু ইট ফাস্ট!

তখনো জানি না কি হয়েছে। ডেস্কের দিকে কর্পোরাল সাইনি আসছিল, ওকে জিজ্ঞেস করলাম -কেয়া হুয়া বে?

সাইনি কানপুরের ছেলে, গালাগালি দিয়ে কথা না বললে উত্তর দেয় না।

-ব্যাহেন কি **** আপনা জাহাজ মে ‘চিপ লাইট’ আ গ্যায়া!

-তো?

-পাতা নেহি লগ রাহা হ্যায়, কঁহী ফোর্স ল্যান্ড কিয়া!



এই হেলিকপ্টারে (সাধারণত সমস্ত প্লেনেই) তিন ধরনের ওয়ার্নিং লাইট থাকে।

সবুজ লাইট মানে সব নর্মাল চলছে, যেমন ধরুন তেলের পাম্প, কিন্তু অফ হয়ে গেলে মুস্কিল। তখন পাইলটকে খুঁজে দেখতে হবে কোনো সার্কিট ব্রেকার ‘অফ’ হয়ে গেছে কিনা।

আর যদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম ফেল করে যাতে প্লেন ক্র্যাশ করতে পারে, তবে সেই ওয়ার্নিং আসে লাল লাইটের মাধ্যমে। যেমন ধরুন ইঞ্জিনে আগুন লেগেছে। সেটা আবার জ্বলে নেভে। পাইলট ঘুমিয়ে পড়লেও চোখে লাগে এমন লোকেশনে এই লাল লাইট ব্লিংক করে।

আরেকটা ওয়ার্নিং হচ্ছে হলুদ লাইট। মানে এমন কোনো সিস্টেম ঘেঁটে গেছে, যেটা আর্জেন্ট না, কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট। তখন একটা স্যুটেবল জায়গা দেখে নেমে পড়ে দেখতে হয় কি হয়েছে। অবশ্য তার সাথে তখন প্রেশার গেজ, টেম্পারেচর গেজ – এই সব মিলিয়ে নিতে হয়। ভিডিও গেমস বা আধুনিক গাড়ি বা বাস-এ প্রায় একই সিস্টেম দেখে থাকবেন।

হেলিকপ্টারের প্রাণ-ভ্রমরা হচ্ছে গীয়ারবক্স। মি-৮-এ দুটো ইঞ্জিন এক সাথে মেইন গীয়ারবক্সকে ড্রাইভ দেয়। মেইন গীয়ারবক্স মাথার উপরের পাঁচটা ব্লেড বা মেইন রোটারকে ঘোরায়। এই মেইন রোটার হেলিকপ্টারকে লিফট দেয় মাটি থেকে উপরে উঠতে, ভেসে থাকতে আর সামনে পেছনে যেতে। আরেকটা ড্রাইভ লেজের দিকে ‘টেল গীয়ারবক্স’কে ঘোরায়। সেটার সাথে লেগে থাকে তিনটে ব্লেড বা টেল রোটার। টেল রোটার নিউটনের ‘থার্ড ল’ অনুযায়ী মেইন রোটারের উলটো দিকে যাতে হেলিকপ্টার নিজেই না ঘোরে, তার ব্যবস্থা করে (অ্যান্টি টর্ক) আর সেই টর্ক কম বেশি করে হেলিকপ্টার লেফট রাইট ঘোরে। জাহাজের হাল এর মতো।

এই মেইন গীয়ার বক্স যেমন ভারি তেমনই মজবুত। এর মধ্যে আছে অসংখ্য গীয়ারের দাঁত। আর এই গীয়ারকে ঠান্ডা আর লুব্রিকেট করতে লাগে প্রায় ৩৮ লিটার তেল। সেটা আবার পাম্পের সাহায্যে ঠান্ডা করা হয়। এবার কোনো কারণে যদি একটা গীয়ারের দাঁত ভেঙে যায়, আর সেই লোহার টুকরোটা তেলে ভেসে গিয়ে অন্য গীয়ারদের ঘষতে থাকে তাহলে একে একে অন্য সব গীয়ার ভাঙতে থাকবে আর শেষ পর্যন্ত গীয়ার বক্স জ্যাম হয়ে যাবে। তখন উড়ন্ত হেলিকপ্টার পাকা আমের মতো টুপ করে আকাশ থেকে মাটিতে পরে ছাতু হয়ে যেতে পারে। তাই গীয়ারবক্সের মধ্যে কতগুলো ম্যাগনেট দেওয়া থাকে , যদি কোনো লোহার টুকরো বা চিপ তেলে ভেসে আসে, তাহলে সেগুলো ম্যাগনেটে আটকে যায়। তেমনি একটা ইলেকট্রো ম্যাগনেট আর মাইক্রো সুইচ থাকে যাতে কোনো চিপ এসে লাগলে, সেই সুইচ পাইলটকে একটা হলুদ লাইটের সিগন্যাল দেয়। এ ক্ষেত্রে সেই লাইট জ্বলেছে।

গীয়ার বক্স দেখার দায়িত্ব সাইনির এয়ার ফ্রেম সেকশনের, আর ইলেকট্রো ম্যাগনেট আর হলুদ লাইট দেখি আমরা বা ইলিকেট্রিক্যাল সেকশন।

জামনগর এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল জানালো, পাইলট ফোর্স ল্যান্ড করার আগে জানিয়েছিল মেইন গীয়ারবক্সে ‘সেভিং লাইট’ এসেছে তাই মাঠেই ল্যান্ড করছে । তারপর থেকে আর কোনো কন্ট্যাক্ট নেই।

অসুখের সিম্পটমস জানা গেছে। এবারে হেলিকপ্টার খোঁজা। তবে তার আগে যন্ত্রপাতি নিয়ে নিতে হবে। এই ফল্টের জন্য আমার কি কি লাগে তা প্রায় মুখস্ত। ইলেকট্রিক্যালের ইন চার্য, ওয়ারেন্ট অফিসার কে পি সিং ব্যস্ততা দেখাচ্ছে কিন্তু কি করতে হবে বুঝতে পারছে না। ওয়ারেন্ট অফিসার গিলকে দেখতে অনেকটা তখন তালিবানের আফগান প্রেসিডেন্ট মোল্লা উমরের মত, তাই তার সাথে কে পি সিং কেও আমরা (ওসামা বিন) "লাদেন" বলেই ডাকতাম। অবশ্যই, সামনা সামনি না। গিল আর সিং এর ছোটাছুটির মধ্য দিয়ে আমি আর সাইনি আর সাইনি’র এয়ার ফ্রেম ইন চার্জ, ইঞ্জিনের অমিত পাল, সাথে অন্য আরো দু জনকে নিয়ে রেস্কিউ হেলিকপ্টার উড়লো।

এবার কাজ হচ্ছে এই হেলিকপ্টার নিয়ে জুলু-৩এর ফ্লাইট পাথ ধরে এগিয়ে যাওয়া আর আকাশ পথে খোঁজা কোথায় নেমে বসে আছে। এ ক্ষেত্রে টাইম খুব ইম্পর্ট্যান্ট তথ্য। জামনগর থেকে টেক অফের কত মিনিট পরে ওয়ার্নিং এসেছে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল থেকে পাওয়া সেই টাইম ধরে এগোলে প্রায় এগ্জ্যাক্ট লোকেশন খুঁজে পাওয়া সহজ। যথারীতি মিনিট ২০ পরেই খুঁজে পাওয়া গেল। আমাদের হেলিকপ্টার দেখে নিচের হেলিকপ্টারের পাইলট রেডিও অন করে গাইড করে দিল কোথায় নামতে হবে। আমরাও নেমে পড়লাম।

জামনগর থেকে নাক বরাবর সোমনাথ যেতে গেলে (দক্ষিণ পশ্চিমে) বাঁ দিকে একটা গ্রাম আসে। তার নাম সামানা। এখানেই আছে এয়ার ফোর্সের একটা ছোটো ইউনিট। তারপর একটা ছোট শহর ‘জাম যোধপুর’, এই সামানা আর জাম যোধপুরে’র মাঝে সেঠভাড়লা বলে একটা গ্রাম। সেখান থেকেও বেশ কিছুটা দক্ষিণে গেলে স্টেট হাইওয়ে থেকে বাঁ হাতে প্রায় দেড় কিলোমিটার মাঠের মধ্যে একটা ছোট্ট টিলা। তার এক দিকে জুলু-৩ নেমেছে। আমরাও নামলাম সেই টিলার আরেক দিকে। জুলু-৩’র পাইলট বুদ্ধি করে সেরকম জায়গাতেই হেলিকপ্টার নামিয়েছিলেন যাতে রেস্কিউ হেলিকপ্টার নামতে পারে। টিলা মানে পাথুরে শক্ত কাঁকড় মাটি, সমতল থেকে একটু উঁচু। তারপরেই নরম ব্ল্যাক সয়েল, তাতে চিনে বাদামের চাষ। হেলিকপ্টার ক্ষেতে নামলে চাকা মাটিতে ঢুকে যেতে পারত। সাথে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হত।

আমাদের রেস্কিউ হেলিকপ্টার নামতেই জুলু-৩এর সবাই ছুটে এলো। এতে ছিলো সব প্রেস রিপোর্টার। ফোকটে আনন্দ লাভের আশায় সোমনাথ এসে এইভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু আমাদের মিশন এখন অন্য। রেস্কিউ হেলিকপ্টার থেকে আমাদের যন্ত্রপাতি তেলের ড্রাম সব নামিয়ে জুলু-৩’র সব প্যাসেঞ্জারদের তুলে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হলো। এবারে শুরু হবে আমাদের কাজ। কিন্তু তার আগে এইটা জানতে হবে, যদিও জুলু-৩ ফোর্স ল্যান্ড করেছে, কিন্তু নিউজে কেন দেখালো আদবানীর হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাগ্রস্ত!

আসলে এই সব মিডিয়ার লোকজনের কাছে তখন মোবাইল ফোন এসে গেছিল। সর্বত্র টাওয়ার না থাকলেও তাদের মধ্যে জি নিউজের রিপোর্টারের মোবাইল থেকে প্রথম কল লাগে দিল্লীর নিউজ সেন্টারে। দিল্লীতে বসে নিউজ সেন্টার আর কি বুঝবে তিন নম্বর হেলিকপ্টারে তাদের রিপোর্টার বসে আছে। তার তো আদবানীজীর সাথে থাকার কথা। তাই রিপোর্টার যখন ফোন করে জানায় যে তার হেলিকপ্টার ‘গির গ্যায়া’, তার মানে আদবানীর হেলিকপ্টার “গ্যায়া”!

এবার টিভির রিপোর্ট দেখে হোম মিনিস্ট্রি থেকে শুরু করে মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স, প্রাইম মিনিস্টারের অফিস আর গুজরাত ‘গরমেন্ট’ সবার “হোঁশ উড় গ্যায়া”! আমরা পৌঁছনর ঘন্টা খানেকের মধ্যে এয়ার ফোর্স ষ্টেশন সামানা থেকে একটা জিপসী তে করে ওদের কুইক রিয়্যাকশন টিম (QRT) মাথায় লাইট মেশিন গান বসিয়ে এসে গেল। রাস্তা থেকে মাঠের মধ্যে সরু রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে। ওদিকে দু দুটো হেলিকপ্টার নেমেছে মাঠের মধ্যে, সেটা রাস্তা থেকেও দেখা যাচ্ছে। ট্রাক, বাস, টেম্পো, জুগাড়(মোটর ভ্যান) সব দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে হেলিকপ্টার দেখছে। বাদাম ক্ষেতের উপর দিয়ে সে সব আমরাও দেখতে পাচ্ছি।

সামানা এয়ার ফোর্স স্টেশন ৫০ কিমি মতো দূরে। টিভি নিউজ দেখেই ওদের QRTকে পাঠিয়ে দিয়েছে। খুঁজে খুঁজে এসে রাস্তার ভীড় দেখে আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করতে পেরেছে। আমেদাবাদের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে তখন যুদ্ধ চলছে। পুরো ফোর্স সোমনাথের দিকে মুখ করে আছে। আর টিভিতে দেখাচ্ছে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাগ্রস্ত। সব জেলা সদর, তহসিল (সাব ডিভিসন) আর পুলিশ চৌকিদের রেডিওতে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। ঢুঁড়ো! ঢুঁড়ো! তার মধ্যেই জাম যোধপুর আর সেঠ ভাড়লার পুলিশ স্টেশন’ এয়ার ফোর্স QRT গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ পিকআপ করে ওদের প্যাট্রল গাড়িকে পেছনে লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন PSI (পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর) আর তার টিম এসে হাজির।

আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি। প্রথম কাজ কর্পোরাল সাইনির, ম্যাগনেটগুলো খুলে দেখা আর আমার কাজ ইন্ডিকেটর লাইটটা ফলস ওয়ার্নিং দিচ্ছে কিনা সেটা দেখা। সাইনির ম্যাগনেট-এ হালকা মেটাল‘চিপ’ দেখা গেল। আমার ইন্ডিকেটর দেখালো “হম সব ঠিক হ্যাঁয়”। তার মানে গীয়ার বক্সে মেটাল পীস ঘুরছে। তেল ড্রেন করা হলো। তাতেও মেটাল চিপ দেখা গেল। এবারে ফ্রেশ তেল ভরে আবার স্টার্ট করতে হবে। গীয়ার বক্সে ৩৮ লিটার তেল ভরতে হয়। মারুতি ডিজায়ারে ২.৫ লিটার তেল লাগে। তখন আমরা ব্যাবহার করতাম OX -38 গ্রেড,এখন ব্যবহার হয় OX-27 গ্রেড। দুটোই সিন্থেটিক বেস তেল। তবুও স্পেসিফিক গ্রাভিটি বেশি বলে ওজন যথেষ্ট। ফাঁকা মাঠের মধ্যে কোনো ল্যাডার বা ক্রেন ছাড়া হেলিকপ্টারের উপরে এই ভারি ড্রাম তুলে তেল ঢালা বেশ ঝকমারি কাজ, সেটা বলাই বাহুল্য।

ততক্ষণে দুপুর দুটো। এয়ার ফোর্স স্টেশন সামানা থেকে আসা QRT বেস-এ ফিরে গেল। গুজরাত পুলিশের টিমকে বলা হলো একটু খাবারের ব্যবস্থা করতে। পেটে ছুঁচো মাল্টি জিমে পাওয়ার লিফট করছে। কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম বা বসতি নেই। সকালের দিকে মাঠের কাঁচা চিনে বাদাম তুলে খেয়েছিলাম। তিনটে নাগাদ জাম যোধপুর থেকে পুলিশের জিপ ফিরে এলো পুরি, আলুর সব্জী, গাঠিয়া আর গুলাব জামুন নিয়ে। পাইলট, ফ্লাইট ইঞ্জিনীয়ার, ফ্লাইট গানার, অন্য গ্রাউন্ড ক্রু পুরি সব্জীর সদগতি করে দিলো। আমি আর সাইনি কাজ শেষ করে গীয়ার বক্সের বেড ক্লীন করে নেমে এসে দেখি কয়েক গন্ডা গুলাব জামুন আর গাঠিয়া পরে আছে। আমি খান ১২ জামুন দিয়ে পিত্ত রক্ষা করলাম।

সন্ধ্যের আগেই বেস-এ ফিরে বাড়ি এসে দেখি সবার মুখ গম্ভীর। ভোর চারটের আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। তারপরে কি আর বাড়ি ফিরতে হয় না?

0 comments: