অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
গুটিপোকা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস
টিউশন থেকে ফিরছিল পলক। পিছন থেকে অনির্বাণের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালো। অনির্বাণ তার সাথে রাজা স্যারের কাছে সায়েন্স গ্রুপ পড়ে। মুখচোরা মেধাবী ছাত্র। পলকের হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়েই "এটা একটু দেখিস" বলে সাইকেলের বেগ বাড়িয়ে দেয় সে। পলক একটু অবাক হয়। তার সাথে প্রয়োজন ছাড়া টিউশনির কেউই খুব একটা কথা বলে না। ঘরের কোণে প্রায় ছায়ার মতোই বসে থাকে সে। স্যার সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেই শুধু তার উপস্থিতি বোঝা যায়। পলক চিরকুটটা খোলে। সাদা কাগজে গোটা গোটা হরফে অনির্বাণের হস্তাক্ষর, "আমার বন্ধু হবি…সারাজীবনের জন্যে?" পলক হেসে ফেললো।
অনিরুদ্ধের সাথে ডিভোর্সের পর পলককে নিয়ে সোদপুরের ফ্ল্যাট ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে অহনা। মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে। পলককে ভর্তি করিয়ে দেয় স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে। দুই বেণী ঝুলিয়ে চতুর্দশী পলক স্কুলে যায়। পড়াশুনোয় সে বেশ ভালো…আচার ব্যবহারও মার্জিত। কিন্তু তবু তার বন্ধু জোটে না স্কুলে বা পাড়ায়। কারণ তার মা ডিভোর্সী।
তার সহপাঠীদের অনেকেই, এমনকি তাদের কারও কারও মা-ও, খুব সমবেদনা জানাতে এসেছিল পলককে। তাদের আসল আগ্রহ ছিল তার বাবা আর মায়ের সম্পর্কে। পলক বয়সে ছোট হলেও এই অযাচিত কৌতুহলের নির্লজ্জতা বুঝতে বেশী সময় তার লাগেনি। যথাসম্ভব ভদ্রভাবেই সে গুটিয়ে নেয় নিজেকে সকলের থেকে। তার দুনিয়াটা মা আর দিদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে নেয়।
পলক আগে কখনও অনির্বাণকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করেনি…পরেও করবে কি না জানে না। চিরকুটটা ব্যাগে পুরে সে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। আহা রে, ছেলেটা জানে না পলকের মনটা সেইদিন থেকে মরে গেছে, যেদিন স্কুল থেকে ফিরে নিজের ভাগের চাবিটা দিয়ে দরজা খুলে বাবাকে দেখেছিল…বাবা-মায়ের বিছানায়…উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের ইস্টিদিদির সাথে। বছর কুড়ির সুন্দরী ইস্টিদিদির শরীরী ভাষা তার কাছে সাপের মতো লেগেছিল…বাবাকে রাক্ষসের মতো…।
ওরা তার উপস্থিতি টের পায়নি। পলকও কাউকে বলেনি, সে রাতে কেন তার ধুম জ্বর এসেছিল। …মা এই সম্পর্কের কথা অনেক পরে জেনেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি না করে মা স্বেচ্ছায় তার দাবী ছেড়ে দিয়েছিল, যেদিন ইস্টিদিদির প্রেগন্যান্সীর কথা তার কানে আসে। পলক কাউকে কিছু কোনওদিন জিগ্যেস করেনি। মাকে সে আহত করতে চায়নি। আর সেদিনের পর থেকে বাবার সাথে সে দূরত্ব তৈরী করেছে নিজে নিজেই।…
…শুধু চলে আসার আগের দিন মাঝরাতে সাদা তেলের বোতলটা ইস্টিদিদিদের দরজার সামনে খালি করে এসেছিল। …সকালের কাগজটা ইস্টিদিদিই তোলে কি না।
…জিনিসপত্র, মা আর পলককে নিয়ে ম্যাটাডোর যখন রাস্তার বাঁক অবধি চলে এসেছে, তখন সে অ্যাম্বুলেন্সটাকে তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে থামতে দেখেছিল...
0 comments: