অনুবাদ সাহিত্য - শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
Posted in অনুবাদ সাহিত্যঅনুবাদ সাহিত্য
মনে রাখার মতো একটি হাসি
মূল কবিতা – চার্লস বুকয়স্কি
অনুবাদ – শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
ভারী পর্দা টাঙানো জানলার সামনে টেবিলের উপর
কাঁচের পাত্রে রাখা আমাদের সোনালী মাছগুলি সারাদিন
গোল হয়ে ঘুরেই যেতো ঘুরেই যেতো
আর সর্বদা হাসিমুখ আমার মা, সবাইকে সুখী দেখতে চেয়ে,
আমাকে বলতেন, ‘হাসিখুশি থাকো হেনরি!’
ঠিকই বলতেন মা, সম্ভব হলে হাসিখুশি থাকাই ভালো,
কিন্তু ছ’ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা আমার বাবা ভিতরে কী যে সারাক্ষণ
তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করছে বুঝতে না পেরে রাগে প্রতি সপ্তাহে
নিয়ম করে বেশ কয়েকবার আমাকে আর মা’কে পেটাতেন।
আমার মা, বেচারী সোনালী মাছ,
সপ্তাহে দু তিনবার মার খেয়ে, খুশি থাকতে চেয়ে,
আমাকে খুশি দেখতে চেয়ে, বলতেন, ‘হেনরি, হাসো!
তোমার মুখে কখনও হাসি দেখি না কেন?’
আর তারপর আমাকে শেখাবার জন্য উনি হাসতেন, আর
সেটা ছিল আমার দেখা করুণতম হাসি।
একদিন মাছগুলি মরে গেল, পাঁচটি মাছই –
কাৎ হয়ে থাকা তাদের শরীর ভেসে উঠলো জলের উপর
তাদের চোখ তখনও খোলা,
আর আমার বাবা বাড়ি ফিরে মাছগুলোকে ছুঁড়ে দিলেন
রান্নাঘরে বসে থাকা বিড়ালের মুখে আর আমরা দেখলাম
মায়ের মুখে লেগে আছে হাসি।
নীলপাখি
মূল কবিতা – চার্লস বুকয়স্কি
অনুবাদ – শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
বুকের ভিতর এক নীলপাখির বাস।
মাঝে মাঝে সে বাইরে উড়তে চায়,
আমি কঠিন স্বরে তাকে বলি
ভিতরেই থাকো তুমি, কেউ যেন
তোমাকে দেখতে না পায়।
বুকের ভিতর এক নীলপাখির বাস।
মাঝে মাঝে সে বাইরে উড়তে চায়
আমি তার উপর ঢেলে দিই মদ
সিগারেটের ধোঁয়ায় তাকে ঢেকে দিই
আর গণিকারা, শুঁড়িখানার মালিকেরা,
মুদির দোকানিরা, জানতেও পারে না
সেই নীলপাখির বাস আমার ভিতর।
বুকের ভিতর এক নীলপাখির বাস।
মাঝে মাঝে সে বাইরে উড়তে চায়,
আমি কঠিন গলায় বলি ভিতরেই থাকো
তুমি – আমাকে কী লন্ডভন্ড করে
দিতে চাও? আমার সব কাজ পন্ড
করতে চাও? ইউরোপে আমার এত বই
বিক্রি বন্ধ হয়ে যাক তাই চাও তুমি?
বুকের ভিতর এক নীলপাখির বাস।
মাঝে মাঝে সে আকাশে উড়তে চায়,
তবে আমি খুব চালাক। রাত্রে
সবাই যখন ঘুমোয়, কেবল তখনই আমি
তাকে বাইরে আসতে দিই। আমি বলি,
নীলপাখি, কষ্ট পেও না, তুমি সবসময়
আমার খুব কাছেই থাকো।
তারপর তাকে আবার রেখে দিই ভিতরে।
কিন্তু আমি তো ওকে একেবারে মেরে ফেলি নি,
তাই বুকের ভিতর ও একটু একটু গান গায়।
আর এই গোপন সন্ধি বুকে নিয়ে
আমরা দুজন একসাথে ঘুমোতে যাই।
আর এই মিষ্টি গল্পে বোধহয়
চোখে একটু একটু জল আসে
কিন্তু আমি কাঁদি না – তুমি?
সবার সাথে একলা
মূল কবিতা – চার্লস বুকয়স্কি
অনুবাদ – শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
রক্তমাংস ঢাকে অস্থি
আর ওরা তার মধ্যে রেখে দেয়
মন আর মাঝে মাঝে আত্মা, আর
মেয়েরা দেওয়ালের গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
ফুলদানীগুলি ভাঙে আর ছেলেরা বড্ড
বেশি মদ খায় আর কেউই সেই একজন মাত্রকে
খুঁজে পায় না
তবু
গুঁড়ি মেরে বিছানার থেকে নেমে বা উঠে
খুঁজেই চলে
রক্তমাংস ঢাকে
অস্থি আর রক্তমাংস
খুঁজে চলে
রক্তমাংসের থেকে আরও বেশী কিছু।
এই সমস্যার
কোনো সমাধানই নেই :
আমরা সবাই সেই একই
ভাগ্যের হাতের পুতুল।
আমরা কেউ কখনই
সেই একজন মাত্রকে
খুঁজে পাই না।
শহরের ছাইগাদাগুলি
ভরে যায়
ভাঙ্গাচোরা আবর্জনার স্তুপগুলি
উপচে পড়ে
পাগলাগারদে
লেগে থাকে ভীড়
হাসপাতালে কোনো শয্যাই
খালি থাকে না
এমন কি কবরখানাতেও
জায়গার অভাব।
বাকি আর সবই
রয়ে যায় অপূর্ণ।
যেভাবে চড়াইপাখিটি
মূল কবিতা – চার্লস বুকয়স্কি
অনুবাদ – শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
প্রাণ দেবার জন্য তোমাকে প্রাণ নিতেও হবে
আর লক্ষ কোটি মানুষের রক্তে রাঙানো সমুদ্রের উপর
আমাদের শোক যেমন গভীরতাহীন শূণ্যতায় বয়ে যায়,
ভেঙে পড়া অন্তর্মুখীন সমুদ্রের তীরে ছড়িয়ে থাকা
ফ্যাকাশে পা ফ্যাকাশে নাভির পচে ওঠা
বিদ্রোহী মৃতদেহগুলির পাশ দিয়ে আমি হেঁটে চলি তন্ময়।
প্রিয় বন্ধু, চড়াইপাখিটি তোমার সাথে যা যা করেছিল
আমি শুধু তাই করেছি : যুবক হওয়া যখন রীতি
আমি তখন হয়েছি বৃদ্ধ; হেসে ওঠা যখন রেওয়াজ,
আমি কেঁদে ফেলেছি। ভালবাসার জন্য যখন
অতো সাহস না হলেও চলতো, আমি তোমাকে ঘৃণা করেছি।
এই তো, খানিক্ষণ আগেই
মূল কবিতা – চার্লস বুকয়স্কি
অনুবাদ – শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
প্রায় ছ’টা বাজে
ভোর হয়ে এলো,
রবিবারের নিস্তব্ধ সকালে
কাল রাতের ফেলে রাখা পাঁউরুটি চিবোচ্ছি আমি
টেলিফোন-তারের উপর দাঁড়কাকগুলি অপেক্ষায়
দেওয়ালের কোণে একপাটি জুতো দাঁড় করানো,
আর একপাটি হেলে পড়েছে
...হ্যাঁ, নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যই
কিছু জীবন
0 comments: