ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥৪॥
সেই বিজন বনে নানান কোণে চোরা পিছল মাটি/ছড়িয়ে থাকা মোম মাখানো দড়ি পরিপাটী
জেরকা
বরফ সাদা চিকন খড়ি পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ভাতের ফ্যানের মত দুধ সাদা জল বইছে। কিনারে কিনারে অজস্র গোল গোল নুড়ি পাথরগুলো যেন আমার খেড়িয়া শবর ভাইয়েরা। দুধ খেড়িয়া ঢেলকি খেড়িয়া। আরও নানান বনাঞ্চলের ভাইয়েরা। গোলগো ভুনিয়া সান্ডি গিদি নাগো। ঝর্ণা ঘিরে ওরা শত শত অযুত অযুত। এমনিতেই ওরা লোকালয়ে খুব কম আসে। গভীর নির্জন বনে থাকতে ভালোবাসে। ওরা কালো কিন্তু আজ ওই দুধ নদীর ধারে কেন ওদের গোরা দেহ? ওরা নাচছে হারিও নাচ হালকা আর কুদিঙ্গ নাচ আর পুজছে ভগবান সিংবোঙ্গাকে। কেউ দেখেনি সিংবোঙ্গাকে। কেউ জানেনা সে কেমন। কুড়ুখ ওরাম মুণ্ডা খেড়িয়া কোল সবাই জানে সিংবোঙ্গা দেবতা ধরমেস দেবতার কোনও রূপ নেই। টগর ফুলে আর বড় বড় লম্বা পাতায় ঢাকা গন্ধে বুঝে নাও সে আছে। তার সুগন্ধি নিঃশ্বাস আসা যাওয়া করে সেটা বোঝো। নীল রঙের হাঁসডিমের মতো গোল আকাশের নিচে দুধ সাদা পাহাড়! ওই তো সিংবোঙ্গা দেবতা! তার নিচে আদিবাসী ভাইদের ভীড়। মেলা বসেছে। এখানে আমি অগুনতিবার এসেছি। কতবার যে স্বপ্নে এসেছি তার হিসেব নেই। তবু নতুন লাগে। ওই দুধ ঝর্ণার উজানে ওই খড়ি পাহাড় পার হয়ে দোক্তা পাতার বন। বড় বড় সোনার চ্যাটাল পাতের মতো আধ শুকনো সোনালী দোক্তা পাতা। পাশে লাইন বন্দী ডুমকো ডুমকো চরস ফল। ফলের ডাঁটি ভাঙ্গলেই দুধ গড়ায়। সেই দুধের গন্ধ...ওই তো গন্ধ পাচ্ছি। ঝাঁঝাল মিষ্টি খুশবু। ওখানে বহুবার এসেছি। এখানে আসা মানুষের মানা কিন্তু কী করব আমাকে যে দেবতা ডাকে? আমার যে পরীর মতো ডানা বেরিয়ে যায়! আমিও গোরা হয়ে যাই, গোরাচাঁদ বাবুর মতো। চাঁদের মতো আলো বেরোয় আমার শরীর থেকে। এই তো এখন উড়তে উড়তে ওখানেই নামছি। যত কাছে যাচ্ছি ততো জর্দার পাতাগুলোর গন্ধ ফিকে হয়ে মধুগন্ধ আসছে। আঃ ওই সোনার পাতাগুলোতে মধুমাখা। ওগুলো কি সত্যিকারের? সোনা নিয়ে আমি কি করব? দিকুরা (শহুরে বাবুরা) আমাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। আঃ আমার সর্বাঙ্গ যে কুচি কুচি করে কেটেছে! এবার সিংবোঙ্গা ভগবানকে টেনে আনবে মাটিতে। নেশার জিনিষ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিবে। এখন আমার কাটা অঙ্গে অনু রেণু সোনা মাখাবে ভগবান আর ঘরে ফেরত পাঠাবে। তখন কি করব? ওরা আমার গা থেকে চামড়া খুলে নেবে। সোনার চামড়া। তখন আমার অরণ্য ঈশ্বর কি করবে? কে বাঁচবে তাকে? এখন আমি কি করি? আমার শরীর এখন এত হালকা আমার বশে নেই। আমার সারা গায়ে আপনা আপনি মাখা হয়ে যাচ্ছে সোনা রঙ মধু। আমার আহত ধর্ষিত শরীর আপনা আপনি মোড়া হয়ে যাচ্ছে সোনার দোক্তা পাতায়। ওই যে দুধ ঝর্ণায় স্নান সেরে গোরা হয়ে এসেছে আমার কুড়ুখ জঙ্গলী ভাইয়েরা। ওদের সাদা সাদা মুখগুলো থেকে দয়া ঝরে পড়ছে। তোমাদের কত দয়া! কত করুণাময় তোমরা! আহা দিকুরা যদি এখন দুধ ধারায় স্নান করতে পারতো তবে ওরাও পবিত্র হয়ে যেত। ওরা আমার ছেলের বয়েসী, তবু ওরা আমাকে ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে। আমি ওদের ক্ষমা করে দিতাম। যদি একবার এখানে এসে পবিত্র হতে পারতো! ও আমার আদিবাসী ভাইয়েরা। তোমরা কত সরল কত পবিত্র। আমার কাছে এসে আমার সোনার রেণু মাখা শরীর কি আদর করে কোমল হাতে মুছে দিচ্ছ, ধুয়ে দিচ্ছ। কে আমাকে অমৃত রস পান করিয়ে দিচ্ছ। দেখি দেখি তোমাদের মুখ! একটু কাছে এসো। কি নিয়ে কথা বলছ তোমরা? আঃ আমি যে চোখ মেলতে পারছিনা! তবু দেখবই। আমি দেখবই।
জেরকা অতল স্বপ্নের ভিতরে আবার তলিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল কাদের যেন উদ্বিগ্ন কথাবার্তা ঘূর্ণির মতো তার ফুসফুসে জমা হচ্ছে। ভারী হয়ে আসছে বুক। সারা গায়ে কে যেন ঠাণ্ডা চন্দনের প্রলেপ দিচ্ছে। আঃ কি আরাম। আবার স্বপ্নে এক ফুলের রাজ্যে ঢুকে পড়ছিল। কে যেন তাকে টেনে বার করছে। শরীর এখন আর শরীর নয় লম্বা টানেলের মতো। তার ভিতর থেকে নিজেরই এক অস্তিত্ব মাতৃস্নেহ হয়ে ঠেলে ওঠাচ্ছে উপরে। উপরে...আরও উপরে। তার মুখে মুখ দিয়ে টেনে নিচ্ছে মাতৃস্নেহ। যে আজীবন দূরে সরে থাকার প্রতিজ্ঞায়, যে তার অভিমান, তার হাহাকার সেই কি তার খুব কাছাকাছি? জেরকার চেতনা যেন ড্রপ খেয়ে ফিরল। অস্পষ্ট কালো একটা ধোঁয়া মানুষের মুখের রূপ নিল। ও যেন তার ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকছে আর জেরকাকে টেনে তুলছে। জেরকা বুঝতে পারল। পেরো তার মুখের হাঁ তে মুখ ঢুকিয়ে বাতাস দিচ্ছে। তার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ওর চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। তার এত দিনের জমে থাকা অশ্রু, পেরো। তার একমাত্র সন্তান। পেরোর পিছনে আর একজনের মুখ। গোরাচাঁদ বাবুর।
-সাবজী। হোঁস আ গেলো। ওকারকে হোঁস আইলো। পেরোর জোর বাতাস কাঁপানো ফিসফিসনি।
-সাবাস মাই ডিয়ার। আর একটু তোর ওই মধু মদ ওর মুখে ঢেলে দে। ওটা মদ তো নয়! মৃত সঞ্জীবনী সুধা। আর একটু দে, ওর যেখানে যেখানে ক্ষত সেখানে আবার লাগিয়ে দিই। খুব রেসপন্স দিচ্ছে। নাড়ির গতিও বেড়েছে।
0 comments: