2

পথে প্রান্তরে - সুনৃতা মাইতি

Posted in


পথে প্রান্তরে


মানময়ীর পটচিত্রে পাটায়া
সুনৃতা মাইতি



বেচুবাবু কর্মসূত্রে কেবল বিদেশভ্রমণ করেন। আর আমি মানময়ী তাঁর দুই ঠ্যাঁটা বাছুরপোনা সহ গোয়ালঘরের খুঁটি আগলে হত্যে দিয়ে বসে থাকি। ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া এবং একটি ঘাসের উপর দুইটি শিশির বিন্দু ঝেলিয়া ঝেলিয়া যখন আমি জীবনের প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ, বেচুবাবু বিগলিত হয়ে বললেন..."ব্যাঙ্কক পাটায়াই চলো তবে।" বলেই শূন্যে হাত চালিয়ে কিঞ্চিৎ অঙ্ক কষে নিশ্চিন্ত হলেন। বেশ বুঝলাম বেচুবাবু দুই দেশের মুদ্রা - টাকা এবং ভাটের তুলনামূলক মাতা ভগিনী হিসাব করে সস্তায় হাত ঝেড়ে ফেললেন এই বেলা। এক ঢিলে দুই পাখি! আমার অবস্থা তখন নেইমামার চেয়ে কানামামা ঢের ভালো। অতএব আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথম সব কিছুই বড়ো রোমাঞ্চকর। তা সে প্রথম প্রেম হোক বা প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাই সেই প্রথম বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আজও মানশ্চক্ষে চির অম্লান হয়ে ভাসে। আহা... পটলবাবুরাই কি কেবলমাত্র কলমাস্ত্র নিয়ে খেলবেন নাকি...? মানময়ীরা পিছে থাকবে কোন আক্কেলে, বলুন দেখি !

নেতাজী সুভাষ বোস হাওয়াই আড্ডা থেকে থাই এয়ারওয়েজে চলেছি সপরিবার বিদেশ ভ্রমণে। খেয়াল করে দেখি তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গের বিশুদ্ধ বাংলাভাষী সেলস বাবুদের একটি দলও চলেছেন ব্যাঙ্কক পাটায়া অভিমুখে। তাদের দেখেই পতিদেবতা বিড়বিড় করে স্বগোতোক্তি করলেন, "ব্যাঙ্কক তো নিমিত্ত মাত্র, আসল উদ্দেশ্য তো পাটায়া"। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমার বদ্ধমূল ধারণা সেলসের লোকেরা দুটি কারণে পাটায়া যায়... এক, টার্গেট অ্যাচিভ করার আনন্দে এবং দুই, টার্গেট অ্যাচিভড না হবার দুঃখে।

সে যা হোক, প্লেন আকাশে ডানা মেলতেই শুনলাম "দো দিনকা রাজা" এক সেলসবাবু সুন্দরী থাই বিমানসেবিকাকে ডেকে শুধোচ্ছেন,  "মে আই হ্যাভ রেড ওয়াইন প্লিজ?" ছেলেপুলে জাতীয় বস্তু সঙ্গে থাকলেই দেখবেন তাদের কান কটকট, মাথা ভনভন, পেট টনটন, দাঁত কনকন এইসব ধন্যাত্মক সমস্যা সবসময় এঁটুলির মতো সঙ্গে এঁটে থাকে। এইসব বিরক্তিকর ব্যাপারে আধঘন্টাটাক চলে গেছে... এর মধ্যেই আবার শুনি সেই এক কন্ঠস্বর "ক্যান আই গেট হোয়াইট ওয়াইন?" বক্তব্যের ধরণ কিছু পাল্টে গেলো বলে পেত্যয় হয়! এরপর আধঘন্টা কেটে গেছে এবং ছানাপোনার ঘ্যানঘ্যানানি সামলে একটু ঝিমিয়ে পড়েছি কি আধোঘুমে, শুনলাম সেই এক বঙ্গপূঙ্গবীয় কন্ঠস্বর "ওয়ানা টু হ্যাভ ককটেল। ব্রিং ইট সুন"। বুঝলাম আমরা গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। রাজামশাই "বাজা তোরা রাজা যায়" মনোভাব সহকারে থাই ভূমিতে পদার্পণ করতে চলেছেন ।

দঃ পূঃ এশিয়ার একটি থেরিবাদী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশ থাইল্যান্ড। এর উত্তরে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, দক্ষিণে মায়ানমার এবং পশ্চিমে আন্দামান সমুদ্র। দঃ পূঃ এশিয়াতে থাইল্যান্ডই একমাত্র দেশ যেটি অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিকতার সরাসরি প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। এটা অবশ্য ইতিহাসের প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে মোদ্দা কথা থাইল্যান্ড সেসময় কলোনাইজড হয়নি। 

১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ এর মধ্যবর্তী আমেরিকা এবং ভিয়েতনামের লড়াই চলাকালীন আমেরিকার রণক্লান্ত সেনাদের "rest and recreation" এর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় ব্যাঙ্কক এবং তার উপকূলবর্তী শহরগুলি। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে শুরু হয় আমূল পাশ্চাত্যকরণ। থাইল্যান্ডের নিজস্ব ফ্যাশান, সঙ্গীত, নৃত্য, সামাজিক জীবন, এমনকি মূল্যবোধের মাপদণ্ড পর্যন্ত সেই ঝোড়ো পশ্চিমা হাওয়ায় বেসামাল হয়ে যায়। পরোক্ষ ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক দেহব্যবসার মানচিত্রে থাইল্যান্ড একটি উল্লেখযোগ্য নাম হাসিল করে এবং অতি দ্রুত পুষ্ট হয় সেই দেশের অর্থনীতি। কিন্তু মজার কথা হলো, যৌনতার বিপনন অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও দেহব্যবসা কিন্তু সেখানে এখনও আইনসম্মত নয়।

আসল কথায় ফিরি এবার। পাটায়া হলো গিয়ে সেই দেশেরই পূর্ব উপকুলের একটি ছোট শহর। আবহাওয়া উষ্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য থাইল্যান্ডে মাত্র দুটি ঋতু - গ্রীষ্ম এবং বর্ষা। গোয়া, আন্দামান, কিংবা আমাদের অতি চেনা পাঁচপেঁচির দিঘার সাথে পাটায়া চরিত্রগত ভাবে অনেকটাই এক। কেবলমাত্র প্রবল আধুনিকায়ন, নিয়মশৃঙ্খলিত দেখভাল, যৌনতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের চতুর বিপনন কৌশল একে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় টুরিষ্ট হাবে পরিণত করেছে।

সকাল বেলায় হোটেলে চেক ইন করে প্রাতরাশ সারলাম। বুফেতে আমার জানা প্রায় প্রতিটি দেশের খাদ্যসম্ভার থরে থরে সাজানো। অদ্ভুত কায়দায় অমলেট বানানো হচ্ছে। মধ্যে স্টাফিং বা পুর দেওয়া হচ্ছে খাদকের ইচ্ছেমত। পর্ক, চিকেন বা ভেজিটেবল দিয়ে। এছাড়া বিখ্যাত থাই খাবার তো আছেই। রেড অথবা গ্রিন কারী কিংবা পাড থাই। এমনকি আমাদের অতি পরিচিত রাজমা চাবল পর্যন্ত বাদ নেই। 

সে যা হোক, প্রাতরাশ সেরে সবাই মিলে পাটায়া শহর দেখতে বেড়িয়েছি। একপাশে পাটায়া বিচ এবং অন্যদিকে থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম রাস্তা সুকুমভিট রোড। এই দুই এর মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে শহরের যাবতীয় মনোরঞ্জনের উপাদান মজুত। পথে বিভিন্ন দেশের বহু ভাষাভাষী মানুষের সমাবেশ বেশ একটা "বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" আবহ সৃষ্টি করেছে। চতুর্দিকে অবিমিশ্র উদার হাওয়ার সংস্পর্শে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও প্রফুল্লিত। প্রকাশ্য দিবালোকে মানব ও মানবীর ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি চোখে পড়লেই দুদণ্ড সেখানে দাঁড়িয়ে অজান্তেই দাঁত কেলিয়ে ফেলছি। কলকাতার সেন্ট্রাল পার্ক এবং ভিক্টোরিয়ার ঝোপঝাড় অভিলাষী প্রেমার্থীদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অমনি। আহারে বেচারারা! 

চওড়া রাস্তাঘাট চমৎকার ভাবে পরিচ্ছন্ন। পথের পাশে হরেক কিসিমের দোকানপাট। নিত্যদিনের সামগ্রীর জন্যে আছে সেভেন ইলেভেন নামের আধুনিক মুদি দোকান। প্রায় প্রতিটি রাস্তায়। জনবহুল রাস্তার একটু ভেতরদিকে আছে নানানদেশীয় খাদ্যের রেস্তোঁরা। পাটায়া খাদ্যবিলাসীদেরও অতিপ্রিয় স্থান। এখানে নারী শক্তির জয়জয়কার সর্বত্র। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সিংহভাগ নারী এবং তারা অতি সুনিপুনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। পান থেকে চুন খসাটুকু পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখে অতিথিকে জানাচ্ছেন... "খুন খাপ...খুন খাপ..." (থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু)। 

আমেরিকান দাদুদের একটি দলকেও "লাইফ বিগিনস অ্যাট সেভেনটি" মুখ করে সোৎসাহে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। বিশুদ্ধ ইংরেজী ভাষা যে এতটা গুরুত্বহীন হতে পারে এবং গোনাগুনতি কয়েকটা ইংরেজী শব্দ জানা থাকলেই যে জীবনটা দিব্য চলে যায়, পাটায়া না এলে সেটা কোনওমতে বুঝতাম না। রাস্তাজুড়ে দীর্ঘকায় ইউরোপিয়ানদের দল কৌপিন, লাঠি, ইউরো এবং একটি ম্যাপ সম্বল করে পাটায়া পরিভ্রমণ করছে। ইংরেজীর ধারও ধারছেনা কেউ! 

তাদের এমন হেন মনোভাব দেখে আমার অন্তরাত্মাতেও "আ মরি বাংলা ভাষা" সিনড্রোমটা চড়াৎ করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এমনিতেই আমি ফুটপাথ বিকিকিনি অন্তপ্রাণ এক মহিলা। অতএব পাটায়ার ফুটপাতেই শুরু করি পরীক্ষা নিরীক্ষা। আমার এইসব অদ্ভুত আচরণের সাথে ব্রাহ্মকুলজাত শান্তস্বভাব পতিদেবতাটি বিলক্ষণ পরিচিত। এইসব ক্ষেত্রে তিনি প্রখর ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যেও "আজি যত তারা তব আকাশে" মুখ করে অন্তরীক্ষপানে তাকিয়ে থাকেন। আমি ততক্ষণে রীতিমতো গড়িয়াহাটীয় কায়দায় দরদাম শুরু করে দিয়েছি। অবশ্যই মাতৃভাষায় -

থাইদিদি বলছেন..."তু হানদেদ ভাত"

আমি বলছি... "অসম্ভব... এ হতেই পারেনা! বিদেশি পেয়ে ঠকাচ্ছেন দিদি! আপনার দোকানে আর দ্বিতীয়বার আসবো? বলুন? পুজোর বাজার আছে সামনে।"

থাইদিদি বলছেন..."নো বাগেনিং...নো বাগেনিং...ইন্দিয়ান লেদি!"

যাচ্চলে কাকা! আমি বেজায় ব্যোমকে যাই। জানলো কি ভাবে? এ যে "আমি চিনিগো চিনি তোমারে" ব্যাপার স্যাপার! অন্তর্যামী নাকি? অথবা আমার হাতে দিবারের অমিতাভের মতো স্পষ্ট লেখা আছে "মেরা দেশ ইন্দিয়া হায়!" ট্রিপটা সম্পূর্ণ হবার আগেই অবশ্য এই রহস্যটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার কাছে। 

থাই অর্থনীতিতে একটি বৃহৎ অবদান থাকলেও ইন্ডিয়ান টুরিষ্টদের খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখেনা থাই জনগণ। কারণটা সবার জানা। ভারতীয়দের ঝগড়ালু মনোভাব, টিটকিরি দেবার প্রবণতা, অপরিচ্ছন্নতা, প্রাণান্তকর দরদাম করার স্বভাব বা সুযোগ পেলেই নিয়মভঙ্গের চেষ্টা। 

বিকেলে অবশ্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঝলমল করে পাটায়ার চারিদিকে। ফুটপাতে উচ্চিংড়ে এবং নানারকম পোকামাকড়ের কাঁচামাল নিয়ে জাঁকিয়ে বসে যায় সান্ধ্য তেলেভাজার দোকানগুলি। অনতিদূরেই হাতছানি দেয় ভোম্বা সাইজ খানদানি থাই পেয়ারা। সুরসিকা থাই দিদিমা বসেছেন রঙচঙে কিছু সামগ্রী নিয়ে। হাতছানি দিয়ে ডাকছেন আমার কন্যাটিকে। "টেক ইট ফর মামা পাপা।" ঘাবড়ে গিয়ে দেখি জন্ম নিয়ন্ত্রক দ্রব্যাদি! কি বিচক্ষণ রে বাবা! সুদূর বিদেশ থেকে আগত এই দম্পতিকে একঝলক দেখেই বুঝে গেলেন, এরা এতই করিৎকর্মা যে এই মুহূর্তে এদের না থামালে একটি ছোটোখাটো গ্রাম সৃষ্টি হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী বটে! 

এদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উজ্জ্বলতা। মদির কটাক্ষ হেনে প্রসাধিত সুন্দরী শহরটি দু হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে এক নেশাতুর সময়কে। যৌবন লাস্যে ভরপুর হয়ে যায় আবহ। পথপাশে ঝাঁপ খুলে বসে ভ্রাম্যমান ক্যারাভান বার। চারপাশে সঙ্গীত নৃত্যের অবিরল মূর্ছনা সেই যৌবনতরঙ্গে আনে তুমুল হিল্লোল। ম্যারাপ বাঁধা ছোটোছোটো বার কাম রেস্তোঁরাগুলোতে এক মনে গেয়ে যায় গিটার হাতে তরুণ গায়ক। চারিদিকে সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে দেন বব ডিলান। সেই অনন্ত যৌবনা নগরিনীর মায়া কাজলে চোখ ধাঁধিয়ে বাসস্থানে ফিরে আসি মৃদু পায়ে। আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে পাটায়া এবং তার অন্তর্গত পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিভ্রমণ।

"ইউ থ্রি মিনিটস লেত..." অত্যন্ত গম্ভীর মুখে জানালেন আমাদের মহিলা টুরিষ্ট গাইড। বলে কি হে? মিনিটের হিসেবে দেরি! এমনটা বাপের জন্মে শুনিনি বাপু! পরের বার থেকে এমন হবেনা... এই অঙ্গীকার সহ দুঃখ প্রকাশ করে সকাল সকাল রওনা হলাম নুং নুচ ভিলেজ মুখো। 

নুং নুচ ভিলেজ আদপে একটি সাজানো বাগান বই নয়। কঠিন ভাষায় বললে সপ্তদশ শতকজাত ইউরোপীয় রেঁনেসার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সজ্জিত উদ্যান। প্রচুর ক্যাকটাস, বনসাই এবং নানারকম লতা পাতার ভাণ্ডার পর্যবেক্ষণ করে বৃক্ষপ্রেমী মানুষদের আহ্লাদিত হবার কথা! যদি যান, থাই ক্লাসিকাল নৃত্য বাদ্যের কিছু নমুনাও দেখে নিতে পারেন ইচ্ছে হলে। তবে হ্যাঁ, ফেরার পথে অসীম প্রতিভাশালী হাতিদের সাথে পরিচয় করতে অবশ্যই ভুলবেন না। তারা পাবলিকের মনোরঞ্জন করে, নাচে, ফুটবল খেলে, ছবি আঁকে, জিমন্যাস্টিক করে, এমনকি অবলীলায় নির্ভুলভাবে অঙ্ক কষে দেয়। এমনভাবে যদি তাদের অঙ্ক অভ্যাস চলতে থাকে, আমার ধারণা, অচিরেই তারা পিথাগোরাস টপকে লগারিদমে পৌঁছে যাবে। 

সেই দিনই দ্বিতীয়ার্ধে দেখা হয়ে গেলো আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্লড। এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক এবং দীর্ঘতম সমুদ্র অ্যাকোরিয়াম। অসংখ্য প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। শার্ক থেকে শুরু করে স্টারফিশ, সি হর্স, জেলিফিশ, এমনকি বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, সি উইডস এবং সমুদ্র কোরাল... কি নেই সেই জলের তলার আজব দুনিয়ায়। আপাদমস্তক কাঁচের আ্যকোরিয়ামের বুক ফুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে ১০০ মিটারের একটি পায়ে হাঁটবার টানেল। এ যেন জলেও নামলাম অথচ বেনীও ভিজলো না! আমার পুত্র, কন্যা তো বটেই মায় খুঁতখুঁতে বেচুবাবুটি পর্যন্ত ভয়ানক খুশি ।

তার পরের দিন প্রায় সারাদিন ধরে ঘুরে বেড়ালাম কোরাল আইল্যান্ডগুলোতে। নানারকম বোটে করে। কোরাল বা কোহ লান আইল্যান্ড আসলে পাটায়ার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা নয়নাভিরাম দ্বীপ। আদিগন্ত স্বচ্ছ সুনীল আকাশ এবং চরাচর ব্যপ্ত অসীম জলরাশির মাঝখানে অগাধ বিস্ময়ে জেগে ওঠে আমাদের এই ক্ষুদ্র ইচ্ছে ভরা তুচ্ছ প্রাণটি। একের পর এক অসামান্য সুন্দরী দ্বীপের প্রাণহরা দৃশ্যে না মন হারাতে চাইলে সাহারা নিতে পারেন কিছু রোমাঞ্চকর মনোরঞ্জনের। আস্বাদ নিতে পারেন প্যারা ট্রুপিং, স্কুবা ডাইভিং কিংবা জেট স্কায়িং এর। 

সারাদিন টো টো করে সন্ধ্যাবেলায় সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে গেলাম আলকাজার শো দেখতে। এটি একটি নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। অনেকটা অপেরার মতো। দীর্ঘাঙ্গী মঙ্গোলয়েড সুন্দরীরা নৃত্য গীতের উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখেন অপেরা হাউস। আমি সেই কুশীলবদের দেখে বুঝতেই পারিনি যে তাঁরা আদপে মহিলা নন। সাথে ছিলো অনবদ্য "লাইট এবং সাউন্ড এফেক্ট"। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের জনপ্রিয় গানগুলিকে গ্রন্থিত করে একটি নৃত্যনাট্যের উপস্থাপনা করা হয়েছিলো। ভারতীয় গান "নাচলে নাচলে" চলাকালীন বেশ কটা সিটিও পড়লো হলে। 

তবে যেটা বলছিলাম। সেই নৃত্যশিল্পীদের কথা। তাঁরা নারী নন, আচরণগতভাবে পুরুষও নন। এঁদের আক্ষরিক অর্থে ট্রান্সজেন্ডার বা ট্রান্সসেক্সুয়ালও বলা যায়না। এঁদের পোশাকী নাম "ক্যাথয়ি" বা লেডিবয়। এঁরা গঠনগত ভাবে পুরুষ হলেও আচরণগত ভাবে নারী।গোটা থাইল্যান্ডে এই ধরনের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। নারীত্ব ভাবটি পাকাপোক্ত করতে অনেকেই সাহায্য নেন ব্রেষ্ট ইমপ্ল্যান্ট, সিলিকন ইঞ্জেকশন কিংবা অ্যাডামস আ্যাপেল রিডাকশনের মতো বৈজ্ঞানিক উপায়ের। শুধুমাত্র নাচাগানা নয়, নিজ নিজ ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে এমনকি দেহব্যবসাতে পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এঁরা। গোটা পৃথিবীর তুলনায় থাইল্যান্ডেই এঁদের অবস্থা সবচেয়ে সম্মানজনক। 

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। পাটায়া ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যাবেলায় হোটেলের লবিতে দেখি প্রবল দোলাচল। যে কোনও ঝামেলাঝাঁটির নীরব দর্শক হবার অভ্যাস আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক। তাই পোলাপানদের "বাবার কানে ঘ্যানাও এইবেলা" বলে হস্তান্তর করে আমি বাওয়াল সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে উৎসস্থলে রওনা দিই। 

ওমা কী কাণ্ড! কৌপিনসম্বল এক সর্দার পুত্তর ছুটছেন। পশ্চাতে এক থাই সুন্দরী। সে কি গতি, ভাইসাব! দেখলে ভুলতে পারবেন না কোনও দিন! পরে শুনি সেই ইন্ডিয়ান কেলো! সর্দার পুত্তর দরদাম পূর্বক "বড়ো আশা করে" যারে তুলে এনেছেন তিনি মোটেই বিশুদ্ধ ললনা নন, সেই বহু চর্চিত তৃতীয় লিঙ্গ। বন্ধ দরজার পশ্চাতে সেই হৃদয়বিদারক সত্যের মুখোমুখি হয়ে কয়েক পলের "উড়তা পঞ্জাব" সেই মুহূর্তে "ভাগতা মিলখা" হয়ে গেছেন। ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েসন অভ্যাসকালে প্রতিটি দৌড়বীরের পিছনে এরকম একটা প্ররোচনা লেলিয়ে দেবার কথা সদর্থক ভাবে চিন্তা করতে পারেন কিন্তু! এতে অন্তত দৌড়ে ভারতের পদক প্রাপ্তির সম্ভাবনা একটু উজ্জ্বল হয়, এই আর কি!

পাটায়াতে থাকার শেষ দিনে দেখা হলো "স্রিরাচা টাইগার পার্ক", বৌদ্ধ এবং হিন্দু প্রভাবে তৈরি কাঠের স্থাপত্য "স্যাংচুয়ারি অব ট্রুথ" এবং জলে ভাসমান বিকিকিনির হাট "ফ্লোটিং মার্কেট"। মার্কেটে নজরে এল অনেক জিনিসের মাঝে বিক্রি হচ্ছে অক্টোপাস ভাজা ও কেজি দরে কুমিরের মাংস। ট্রাই করে দেখতে পারেন। এর পরের দিন আমরা উড়ে যাবো রাজধানী ব্যাঙ্কক অভিমুখে। সে অবশ্য অন্য গল্প। শেষের রাত্তিরে বায়না ধরলাম ওয়াকিং স্ট্রিট যাবো। বেচুবাবু কাষ্ঠ হাসি হেসে অতি কষ্টে সম্মত হলেন ।

বিচ রোডের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আরম্ভ করে বালি হাই পাইয়ার পর্যন্ত ওয়াকিং স্ট্রিট এর ব্যপ্তি। থাই অর্থনীতির মাতাস্বরূপিনী এই স্থানটি না দেখিলে কি দেখিলেন জীবনে! পোলাপানদের হোটেলের রুমে ঘুম পাড়িয়ে কর্তা গিন্নি দুজনে মিলে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বেরিয়েছি ওয়াকিং স্ট্রিট দেখবো বলে। এখানে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি কোনও গাড়িঘোড়া চলেনা। পুরো রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। নিয়ম শৃঙ্খলার দায়িত্ব টুরিষ্ট পুলিশের হাতে। এই পুলিশেরা অবশ্য বিভিন্ন দেশের মানুষজনকে নিয়ে তৈরি একটি স্বয়ংসেবক দল। 

তা সে রাস্তায় পা দিয়েই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। চারদিকে যৌবনের এমন খুল্লামখুল্লা প্রদর্শন আমি এ জন্মে অন্তত দেখিনি। নিওন আলোর মায়ামেদুর রঙিন বাতাবরণে নানান দেশের জনগণ স্বল্প পোশাকে ভ্রাম্যমান। স্ফুরিত ওষ্ঠাধর, বিলোল কটাক্ষযুক্তা, ক্ষীণকটি, গৌরাঙ্গী ললনারা যৌবন লাস্যে, হাস্যে, পরিহাসে পরিবেশ মদির করে তুলেছে। নারী মাংসের এমন উন্মুক্ত বিপনন সত্যিই ভীষণ আশ্চর্যের! যার পোশাকি নাম বুমবুম। এছাড়া গে, লেসবিয়ান থেকে শুরু করে লেডিবয় কিংবা যৌনতার সম্মিলিত আহ্বান - কি নেই এখানে! 

রাস্তার দুপাশে বিশেষ ম্যাসাজ পার্লার, ডিসকো থেক, সি ফুড স্টল কিংবা গো গো বারের ঢালাও আতিথ্য যেকোনও স্বাভাবিক লোকের মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। এর ওপর আবার শরীর বাঁকিয়ে মুচড়ে ডাণ্ডা পেঁচিয়ে ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে নেচে চলেছেন অত্যল্পবসনা পোলনাচনি ভগিনীরা। দাদুর কোলে নাতনি আপত্তিকরভাবে শায়িতা। আপনার পছন্দের সবরকম উপকরণ আছে হেথায়। শেতাঙ্গিনী, পীত অথবা বাদামীবরণ নারীর দল। এমনকি "তিন তিগারা কাম বিগাড়া" এই প্রবাদটিকে ভুল প্রমাণ করে তৃতীয় ব্যক্তিও হাজির আছে যুগলের আনন্দে নতুন মাত্রা দিতে। এমনকি আপনি যদি "জরা হাটকে" হন তার ব্যবস্থাও দিব্য আছে। সাথে আছে "সবারে করি আহ্বান" মার্কা চরম যৌনতার শো, উপভোগ করবার প্রশস্ত গ্যালারি ব্যবস্থা সহ। "আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে" এই লাইনটি সদা স্মরণ রেখে, আছে আদিরস বিজড়িত "রাশিয়ান শো" কিংবা ছুরি, কাঁচি, ভাঙা বোতল সম্বলিত কদর্য এবং বিপজ্জনক "থাই শো" 

এইসব শো গুলোর প্রতি চৈনিক বন্ধুদের ভয়ানক আকর্ষণ দেখলাম। তারা আজকাল ভ্রমণপিপাসু জাতি হিসেবে বিপুল নাম কিনেছেন। শুধুমাত্র একা বা পরিবার নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ গোষ্ঠী তুলে এনেই তারা গুষ্ঠিসুখ অনুভব করে থাকেন। দেখি "রাশিয়ান শো" থেকে বেরিয়ে আবাল বৃদ্ধ বনিতার একটি দল চিং চাং কলরব সহকারে ভাবলেশহীন মুখে "থাই শো" তে ঢুকে গেলেন। ভাবখানা যেন "সবে মিলে করি কাজ... হারি জিতি নাহি লাজ"।

ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে হোটেলের দিকে ফিরছি দুজনে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। স্তব্ধ হয়ে গেছে সব কোলাহল। স্ট্রিটের বাইরের রাস্তা তখন শুনশান খাঁ খাঁ। পাটায়া কিছুক্ষণের বিরাম নিচ্ছে। চলতে চলতে কেবল মনে হচ্ছে প্রতিদিনের এই অবিরল ভোগসুখ ক্লান্ত করেনা মানুষকে! রাত বাজে আড়াইটা। পথের পাশে দোকানগুলোর ঝাঁপ ফেলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা হচ্ছে। একটি পাবে তখনও একলা মনে গেয়ে চলছে গিটার হাতে উদাসী তরুণ। শ্রোতাবিহীন নিরালায় এক অনাবিল শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস! শেষ থেকে শুরুর অন্তহীন অপেক্ষা কিংবা শুরু থেকে শেষের চরম শূন্যতা। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে একাকী বেজে চলেছেন জিম মরিসন...

This is the end
Beautiful friend 
The end of laughter and soft lies
The end of nights we tried to die...























2 comments:

  1. aparup lekha. Avik er lekha pore mugdho hoyechilam. eti pore mogdhota kom holo na. hats off !

    ReplyDelete
  2. সরস ভ্রমণকাহিনীটি শুধু সুখপাঠ্য নয়, অন্তরের ও চক্ষের ক্ষুধাও হরণ করিতে সক্ষম । অতিশয় প্রীত হইয়াছি ।

    শিখা কর্মকার

    ReplyDelete