1

রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


বিধিলিপি
পিনাকী চক্রবর্তী 



ডাক্তারবাবু বললেন, “কি আনন্দ পাস, ওই পোকামাকড়গুলো খেয়ে? কচি বাচ্চা তো আর নোস, পৈতেও তো হয়ে গেল সেদিন, এবার একটু সাত্বিক আহার টাহার করা অভ্যেস কর। নিতান্তই যদি খেতে হয়, তো কুচো চিংড়ি খাস, বাগদা গলদার মতো ওতে এতটা গণ্ডগোল হয় না। আচ্ছা যা, বাড়ী যা এখন, বাড়ী গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবি, ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নিবি যতটা পারিস। বিকেলবেলা খেলতে যাবি না। এই ওষুধগুলো লিখে দিলাম, আজকে শুধু বার্লির জল খাবি আর এই দুটো ওষুধ, দিনে তিনবার করে খাবি। কাল থেকে খিদে পেলে কাঁচকলা সেদ্ধ আর আলুভাতে খাবি, আর খাবার পর এই ওষুধটা একটা করে খাবি।”

আর খাবি! আমার তখন খাবি খাওয়ার অবস্থা … তাই আর কথা বাড়ালাম না। ডাক্তারবাবুর ফী-টা কোনওমতে তাঁর হাতে দিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম। ধরলাম তো, কিন্তু বাড়ী পর্যন্ত সসম্মানে পৌঁছাতে পারলে হয়! ইনি আবার বলেন কিনা, “বিকেলবেলা খেলতে যাবি না…!” আমার পেটের মধ্যে যে কিসের খেলা চলছে তা যদি উনি বুঝতেন, তাহলে আর এই অবান্তর কথাগুলো বলতেন না। এই চিংড়ি মাছের সাথে আমার কেমন যেন অহি নকুল সম্পর্ক সেই ছোট্টবেলার থেকে। আমি ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার বলেই কি এই অবস্থা? না, তা তো হতে পারে না! আমাদের বাড়ীতে তো মোহনবাগানী কেউ নেই, সবারই তো ওই একই ইষ্ট(বেঙ্গল)দেবতা – কিন্তু তাও চিংড়ি মাছের মালাইকারী তো পাতেই পড়তে পায় না, তার আগেই চেটেপুটে শেষ! তবে? শুধু আমার বেলাতেই এই পক্ষপাতদুষ্ট নিয়মটা খাটবে কেন?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওষুধের দোকানটা পার হয়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে! খেয়াল হতেই গোঁত্তা মেরে ঢুকে গেলাম ভেতরে। কাউন্টারে তখন দোকানের মালিক অরুণদা নিজেই দণ্ডায়মান। তার হাতে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি দাও তো ওষুধগুলো, অরুণদা!” অরুণদা কাগজটার দিকে এক ঝলক দেখে একটা টুল টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো, “আবার পেট খারাপ বাধিয়েছিস? কি খেয়েছিলি, এবারে?” আমার তখন গল্প করার কোনওরকম ইচ্ছে ছিলো না, ব্যাজার মুখ করে বললাম, “চিংড়ি, কিন্তু তুমি একটু জলদি করো না!”

আমার গলার আওয়াজে অরুণদা বোধহয় কিছু বুঝলো, পেছনে দাঁড়ানো অ্যাসিস্ট্যান্ট ভোম্পুর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “অ্যাই, তাড়াতাড়ি বের কর ওষুধগুলো। আর তুই পেছনের বেঞ্চিটাতে বস। খুব কাহিল দেখাচ্ছে তোকে।”

আমার বসার ইচ্ছে নেই। কিছু না বলে দাঁড়িয়েই থাকলাম। অরুণদা আমার দিকে খানিকক্ষণ দেখে বললো, “অ, বুঝেছি...”

দু’ মিনিটেই ভোম্পু এক তাড়া ওষুধ নিয়ে এসে অরুণদাকে দিলো। তারপর প্রেসক্রিপশনের তলার দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?”

অরুণদা বললো, “উঃ, কাকাবাবুর কি হাতের লেখা মাইরি!” বলে বার দুই তিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো কাগজটাকে। তারপর আমাকে বললো, “চিংড়ী মাছ খেয়েছিলি, না?” বলে কাউন্টারের তলায় ঝুঁকে নিচের থেকে এক পাতা ছোট্ট ছোট্ট ওষুধ বের করে ভোম্পুকে দিলো। ভোম্পু সব দামটাম হিসেব করে একটা ঠোঙ্গার মধ্যে সব পুরে আমাকে ধরিয়ে দিলো। আমি ওষুধ নিয়ে দাম মিটিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম।

দুই দিন পর পেটটা ঠিক হলেও শরীরের দুর্বলতাটা আর যায় না। আমি সকালে কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি, দুপুরে মার্ক টোয়েন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি, সন্ধ্যেবেলা পড়ার বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি... ক্লান্তির কোনও সীমা পরিসীমা নেই। শেষমেশ মা আমাকে ঠেলেঠুলে সেই রাত্তিরেই পাঠালো ডাক্তারখানায়, তাও আবার আমার দিদির সাথে, আমার সবরকমের ওজর আপত্তিকে ওভাররুল করে।

ডাক্তারবাবু দিদিকে দেখে আশ্চর্য হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোকে আবার আসতে হলো কেন? ওর পেট খারাপ এখনও চলছে নাকি?’’ দিদি বললো, ‘‘পেট ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু খালি ঘুমিয়ে চলেছে কাল থেকে। তাই মা বললো ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে, সাথে করে। যা অবস্থা, হয়তো আসতে আসতে মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়লো!’’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘সে কি? এরকম তো হবার নয়। এদিকে আয় তো দেখি চোখটা।’’ তা চোখ দেখা, জিভ দেখা, নাড়ি টেপা, পেট টেপা সবই হলো একে একে। শেষে তিনি বললেন, ‘‘কই প্রেসক্রিপশনটা দেখা দেখি, কি দিয়েছিলাম তোকে খেতে!’’

তা প্রেসক্রিপশনটা সেদিন সকালেই আমার হাত থেকে হাওয়ায় উড়তে উড়তে খাটের তলায় ঢুকে গেছিলো। বের করবো করবো করে করা হয় নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই পকেটে করে সব ওষুধের ছিন্নপত্র, মানে ছেঁড়া পাতাগুলো নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো টেবিলের ওপর রাখলাম। তারপর বুঝলাম দিদিকে কেন সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। দিদি ওর ব্যাগ থেকে আমার সেই প্রেসক্রিপশনটা বের করে ডাক্তারবাবুকে দিলো, আর আমার দিকে ফিরে বললো, ‘‘মঙ্গলাদি সকালবেলা ঝাঁট দিয়ে এটা খাটের তলা থেকে বের করেছিলো। তুই ঘুমোচ্ছিলি, তাই জানতে পারিস নি...’’

এদিকে ডাক্তারবাবুর আনন তখন ক্রুদ্ধ যোগীবর মহাদেবের মুখমণ্ডলের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, কেন কে জানে। মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বর্ণনা একদম পদে পদে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু কেসটা কি, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ ডাক্তারবাবু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের বললেন, ‘‘তোরা আয় আমার সাথে।’’ চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরে বসা রুগীদের বললেন, ‘‘দশ মিনিট বসতে হবে সকলকে। আমি এক্ষুণি আসছি...’’

পথে নেমে চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘অরুণের কাছ থেকে নিয়েছিলি ওষুধগুলো, তাই না?’’ আমি ঘাড় নাড়লাম। তিনি আর কোনও কথা না বলে হন হন করে চললেন অরুণদার দোকানের দিকে।

অরুণদার দোকানে একটাও লোক নেই। ওর দোকানের রোয়াকে দু’জন রিক্সাওয়ালা বসে বসে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পরাতের ওপর ছাতু না আটা কি যেন মাখছিলো। অরুণদা দোকানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পিঠের পেছনে হাত দিয়ে খুব দায়িত্বপূর্ণ ভাবে সেটা পর্যবেক্ষণ করছিলো। ডাক্তারবাবুকে দেখে অবাক হয়ে বললো, ‘‘এ কি কাকাবাবু... আপনি? কি হয়েছে?’’ তিনি বললেন, ‘‘ভেতরে চল, হতভাগা! আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন...’’

ভেতরে ঢুকেই বোমার মতো ফেটে পড়লেন ডাক্তারবাবু। ‘‘এটা কি ওষুধ দিয়েছিস তুই, ব্যাটা গণ্ডমূর্খ? আমি লিখেছি হজমের ওষুধ ফেস্টাল, আর সেই জায়গায় তুই দিয়েছিস অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ফোরিস্টাল? এই প্রেসক্রিপশনটা দেখ। কোনদিক থেকে তোর এটা ফোরিস্টাল মনে হচ্ছে রে, গর্দভ? তুই তো যে কোনওদিন মানুষ খুন করতে পারিস রে! দাঁড়া, তোকে আমি পুলিশে দেবো...’’

অরুণদা কাঁচুমাচু মুখ করে ডাক্তারবাবুকে বললো, ‘‘আমি কি করে জানবো কি হয়েছে, কাকাবাবু? সব ওষুধ ভোম্পু দিয়েছে, জিজ্ঞেস করুন ওকে! ও বোধহয় ভেবেছিলো চিংড়ি মাছ খেয়ে যখন অ্যালার্জিক পেট খারাপ, তখন ফোরিস্টাল-ই লাগবে। কালই আমি দূর করে দেব ওকে। নয়তো আমার দোকানের বদনাম হয়ে যাবে এইভাবে...’’

কি ডেঞ্জারাস লোক দেখেছেন? এই ফোরিস্টালটা অরুণদা নিজেই দিয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ দোষটা চাপালো ভোম্পুর ঘাড়ে। ভোম্পু তো তাও নামটা ঠিক বুঝতে পারেনি বলে জিজ্ঞেস করেছিলো অরুণদাকে। এখন তাকেই ফাঁসাতে চলেছে পুলিশের চক্করে।

ডাক্তারবাবু দেখলাম ভালোই চেনেন অরুণদাকে। বললেন, ‘‘শুধু শুধু ওই ভালোমানুষটার ভালোমানুষির সুযোগ নিস না, অরুণ। অনেক পাপ করেছিস, আর করিস না। পুলিশে দেবো না তোকে, তুই টাকা পয়সা দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসবি। তোর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করাবো আমি। সব্বাইকে বলে দেব তোর দোকান থেকে ওষুধ না নিতে, ব্যাটা খুনে!’’

অরুণদা হাত কচলাতে কচলাতে বললো, ‘‘আর হবে না, কাকাবাবু, এইবারের মতো মাফ করে দিন!’’ ডাক্তারবাবু আরও রেগে উঠে বললেন, ‘‘আমার কাছে মাফ চেয়ে কি হবে? এই ছেলেটার কাছে মাফ চা, ওর প্রাণ নিয়ে খেলছিলি তুই, ব্যাটা গোমুখ্যু! আচ্ছা একটা কথা বল, তুই কি পাক্কা ঠিক ওষুধ দিচ্ছিস জেনে দিয়েছিলি ওই ফোরিস্টালটা? সন্দেহ থাকলে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করে এলে কি হতো? দুই মিনিটের তো রাস্তা, তাতেও তোর কুঁড়েমি? নাঃ, তোকে এবার শিক্ষা দিতেই হবে। সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিস তুই। এবার দেখ, আমি কি করি...’’

রাগে গম গম করতে করতে ডাক্তারবাবু সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাঁটা দিলেন ডাক্তারখানার দিকে। সেইদিকে তাকিয়ে অরুণদা বললো, ‘‘ইঃ, এবার শিক্ষা দিতেই হবে…! নিজে হাতের লেখাটা ঠিকমত শিক্ষা করলেই হতো!!! আবার বলে, আমাকে জিজ্ঞেস করে এলে কি হতো? জানিস, জিজ্ঞেস করতে গেলে কি বলে? শুনবি সে কথা? শোন… বলে ডাক্তারবাবুর ভারী গম্ভীর গলা নকল করে বললো, তা তোর যদি ক অক্ষর গোমাংস হয়, তার জন্যে কি আমাকে প্রেসক্রিপশন লেখানোর স্টেনো-টাইপিস্ট রাখতে হবে? কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লিখবেন উনি, আর সেটা পড়ে উদ্ধার করবো আমি! আমি বলে শালা রোজ ভয়ে ভয়ে থাকি, কি ওষুধ দিতে কি দিয়ে ফেলবো কোন রুগীকে, আর কি কেলো হয়ে যাবে, আর এখন দেখ উনিই কিনা এলেন আমাকে ধমকাতে…’’

দিদি কিছুটা অসহিষ্ণু ভাবে আমাকে বললো, ‘‘ভুল ওষুধটা বদলে ঠিক ওষুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে আয়, আমি যাচ্ছি।’’ বলে সেও বাড়ীর পথ ধরলো। বোধহয় অরুণদার ভাষাটা ওর ভালো ঠেকলো না। কিন্তু অরুণদার সেদিকে খেয়াল নেই। আমাকে বললো, ‘‘এই প্রেসক্রিপশনটা দেখ ভালো করে। ফেস্টালের এফটা ভালো বোঝা যাচ্ছে। শেষের দিকে এসটিএএল এগুলোও বুঝে নেওয়া যায়। কিন্তু এই মাঝখানের গুগগীগুলো কি সেটা কি বোঝা যাচ্ছে, তুই বল?’’ আমি বললাম, ‘‘অত আমি জানি না, তবে ফোরিস্টাল লিখতে গেলে অনেকটা জায়গা লাগে, এখানে এফ আর এস-এর মধ্যে খুব কম গুগগী আছে।’’

অরুণদা বললো, ‘‘তুই এরকম বলছিস বটে, কিন্তু এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে তুই দে’জ মেডিক্যাল বা ফ্র্যাঙ্ক রসেও যদি যাস, এইরকমই ওষুধ পাবি। আবার ওই পোড়া বস্তির পাতি ফার্মেসীটাতে গেলে হয়তো সব ওষুধ ঠিকঠাক পেয়ে যাবি। চান্সের ব্যাপার, বুঝলি তো? কেউ ওই লেখা পড়তে পারবে, কেউ হয়তো পারবে না। আসলে কি জানিস, সব শালা ডাক্তারের হাতের লেখা হলো বিধিলিপি, মাইরি। বিধাতাপুরুষ লিখে তো দিয়ে যায় সবার কপালে, কিন্তু কার কপালে কি লিখলো বুঝতে হলে জ্যোতিষী ডাকতে হয়। সবাই ওই লেখা পড়তে পারে না। আমার কপালে শালা ওই কাকাবাবুই লেখা ছিলো, বুঝলি খোকন?’’


1 comment:

  1. খুব ঝরঝরে লেখা । সুখপাঠ্য । কিন্তু আমার মতে এটা তো গল্প । রম্যরচনা বলা হয়েছে কেন বুঝলাম না । - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

    ReplyDelete