3

স্মৃতির সরণী - অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in

স্মৃতির সরণী


বিশ্বভরা প্রাণ*
অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়



১৯৭৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা যখন দিলাম, তখন সাকুল্যে আমার বয়স চোদ্দোর একটু বেশি। বাড়িতে একটা বাম রাজনীতির আবহ ছিল, আর ছিল একটি নিম্নবিত্ত সংসার। সেই পারিবারিক প্রেক্ষিতে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতে চাওয়া এবং যাওয়া। একটু বাড়াবাড়িই শোনাল, যখন আমার মা আমাকে এই প্রস্তাবটা দিলেন। তখন আমার গান শোনার একমাত্র উপায় একটি মারফি ট্রানজিস্টার রেডিও। বাড়িতে হারমোনিয়ামও ছিল না। ৭টা ৪০ আর রবিবার ২টো থেকে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম। এছাড়া রবিবার সকালে ‘সংগীত শিক্ষার আসর’ হতো। সে সময় কিছুদিন গান শিখিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘ভুবনেশ্বর হে’ এবং ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ – গান দু’টি বড় যত্ন করে শিখিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। গান দু’টো শেখা গিয়েছিল। আমাদের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট পাড়ার প্রতিবেশী ছিলেন সমর পাত্র, ডাকনাম গোবরদা। তিনি রবিবার—রবিবার ১১টা নাগাদ ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ –এই লং-প্লেয়িং রেকর্ডটি মাঝেমধ্যে চালাতেন। বলা বাহুল্য, দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া। ওঁর বাড়ির সামনে গিয়ে গান শুনতাম। আরও ছিল। ‘বিজলী’ সিনেমার পাশে একটা সাউথ ইণ্ডিয়ান রেস্তোরাঁ ছিল ‘মেঘদূত’ নামে। সেখানে ‘বৈশাখ হে মৌনী তাপস’ – এই Season Song-টির লং-প্লেয়িং চালানো হতো। মাঝে-মাঝে বিকেলের দিকে সুযোগ পেলে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম।

এই ছিল আমার গান শেখার সম্বল। সেই অবস্থায় দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতে চাওয়া - প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ততদিনে প্রত্যক্ষভাবে দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনেছি তিনবার। দু’বার রবীন্দ্রসদনে, একবার ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হল-এ সকালের একটা অনুষ্ঠানে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আজও তাই আছি।

যাকগে, মার উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে এক রবিবার, সম্ভবত যেদিন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়, তার ঠিক পরের রবিবার, ট্রামে চেপে ট্রাঙ্গুলার পার্ক স্টপে নামলাম। পারিবারিক কোনও কাকা বা মামার কাছ থেকে ওঁর ঠিকানার হদিশ জোগাড় করে দেন আমার মা। স্টপেজে নেমে ঠিকানা খোঁজ করতে গিয়ে বুঝলাম, খালি হাতে কোনও বাঘের বাড়ির খোঁজ করছি আমি, আমার ওই বয়সে। তখনও হাফপ্যান্ট পরতাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা মিস্টির দোকান। শান্তি সুইট্‌স। পাশের গলি দিয়ে ১৭৪ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ঢুকে দেখলাম ঘর ভর্তি লোক। সব্বাই বয়স্ক এবং বয়স্কা। জোর কথাবার্তা চলছে। সঙ্গে চা, সিগারেট আর রান্না হওয়ার গন্ধ। আমাকে দেখে আওয়াজটা একটু পাতলা হলো। 

কাগে চাই, কী ব্যাবার? একটা গম্ভীর আওয়াজ বেরল, যার কণ্ঠ হতে, তিনিই আমার ‘তিনি’। ওহো, একটা আসল এবং অত্যন্ত জরুরী কথা তো বলা হয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই বাই ডিফল্ট আমার গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক ভারী ছিল, বয়সের তুলনায়। কারণটা হলো সেপ্‌টিক টনসিলাইটিস। এই ত্র্যাহস্পর্শের পরিণামগত তীব্রতার যোগফল ছিল আমার একটা ‘অ্যাবনরমাল বেস’ আওয়াজ। যাকে বাংলা বাজারে বলা হতো ‘হেঁড়ে গলা’। স্কুলে বা পাড়ার বা খেলাধুলোর জায়গায় আমি কথা বললেই, বিশেষত বয়স্করা বলতেন, এই, তুই কথা বলবি না। তার সঙ্গে ছিল তোতলামো। ভীষণ তোতলা ছিলাম। ফলে ছেলেবেলাটা বেশ বিড়ম্বনাতেই তখন কাটছিল। তাই আমি কেন দেবব্রতবাবুর কাছে গান শিখতে চাই, ওঁর গান কতটা ভালবাসি, আমার পারিবারিক পরিচয় কী এবং সর্বোপরি উনি গান শেখালে আমি যে কোনও সম্মান-দক্ষিণা দিতে পারব না - সেসব কিছু একটা চিঠিতে লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে তোতলামির বিষয়টা উল্লেখ করা ছিল। 

যেটা বলছিলাম। আমি কোনওরকমে নিজের নামটা বলে ওঁর হাতে চিঠিটা দিলাম। 

কার চিডি, কীসের চিডি বলে এক লাইন লেখাটা পড়ার পরই জিজ্ঞাসা করলেন, হাতের লেহাটা কার? বললাম। কিছুটা পড়ার পরে বললেন, আমি তো আর কাউরে গান শিহাই না। আপনি গান শিখসেন কারুর কাছে?

আমি বললাম, না, মা'র কাছেই যেটুকু শেখা। 

শুনে বললেন, ‘আমিও মা'র কাছে শিখেছি। তবে আমি তো গান আপনারে শিহাতে পারব না। শরীরও ভাল নয়। আপনি অন্য কারও কাছে যান। আমার পাশের রাস্তায় অশোকবাবু থাকেন। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁরে কন্‌ গিয়া। উনি আপনারে গান শিহাইবেন। ভাল trainer।

আমি জিগ্যেস করলাম, আমাকে আপনি বলছেন কেন? 

উনি বললেন, আমার পিতায় কইসেন। সে থাউকগ্যা। আপনারে আমি গান শিহাইতে পারুম না। 

ঘরের সবাই চুপ করে আছেন। একজন ভদ্রলোককে দেখলাম একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই চলেছেন, খেয়েই চলেছেন। খুব সৌম্য অথচ খুব রাশভারী। দেবব্রতবাবুকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করছেন। আমি স্বাভাবিক ভাবে কয়েকবার অনুরোধ করলাম এবং প্রত্যাখ্যাত হলাম। অনুরোধগুলো, বলাই বাহুল্য, তোতলামি-সহ। একটু পরে আমি কেঁদে ফেললাম। 

জানি না, ওই কান্নাটা ঘরের সবাইকে বোধহয় স্পর্শ করেছিল। বিশেষত ঠোঁটের কোণে সবসময় সিগারেট ঝোলানো মানুষটিকে। উনি দেবব্রতবাবুর পাশে গিয়ে কী একটা বললেন। পরে জেনেছিলাম, উনি ওঁর প্রাণের বন্ধু সোমেন গুপ্ত। যিনি ওঁকে বকুনি দিতে পারতেন এবং দেবব্রতবাবু শুনতেন। সোমেন বাবু বললেন, তুমি একটা গান শোনাও। 

আমি বললাম, আমি দু’টি গান শোনাব। 

কেন? দু’টো কেন? 

বললাম, প্রথমটা ততটা ভাল হবে না, নার্ভাস হয়ে যাব তো। তবে দ্বিতীয়টায় তা হবে না। 

কথাটা শুনে ঘরের সবাই একটু আওয়াজ করে হাসলেন। হাসলেন না দেবব্রতবাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, কোওন স্কেল? 
আমি বললাম, জানি না। বাড়িতে হারমোনিয়াম নেই। 

শুনে মাথা নেড়ে গান গাওয়ার সম্মতি দিলেন। আমি ওঁকেই হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ‘এ মণিহার আমায় নাই সাজে’ এবং ‘তোরা যে যা বলিস ভাই’ গান দু’টো শোনালাম। পরপর। এখন থেকে জর্জদাই বলছি। গান শেষ হলো। জর্জদা কিছু বললেন না। ঘরের সবার চোখে একটা ভাল লাগার ছাপ, স্নেহের দৃষ্টি। সোমেনবাবু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আবার কেঁদে ফেললাম, মাথা নিচু করে। কারণ জর্জদা আমাকে শেখাবেন বা শেখাবেন না – সেটা তো কিছু বলছেন না। 

সোমেনবাবু বললেন, জর্জের শরীরটা ভাল নেই। তোমাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠিটা নিয়ে স্বপনের কাছে চলে যাও। স্বপন গুপ্ত, ওঁর ছাত্র। জানো তো? ও সাউথ এন্ড পার্কে থাকে। চিঠিতে সব বলা থাকবে। ওর কাছে কিছুদিন গান শেখো তুমি। 

আমি বললাম, ওঁর নাম শুনেছি, তবে কখনও দেখিনি আর সাউথ এন্ড পার্ক জায়গাটা আমি চিনি না। 

ততক্ষণে জর্জদার চিঠি লেখা হয়ে গিয়েছে স্বপন গুপ্ত’কে। জলদগম্ভীর গলায় বললেন, এই চিডিটা নিয়ে যান। স্বপনেরে দিবেন। ঠিক আসে?

আমি বললাম, আমি তো আপনার কাছে শিখতে চাই। তা ছাড়া আমি তো ওঁকে গান শেখানোর পয়সা দিতে পারব না।

ক্যান, পিতায় কী করেন ?

আমার বাবা কারখানার শ্রমিকের কাজ করেন। ওঁর কারখানা উষা কোম্পানি মাঝে মাঝেই ৪ মাস, ৬ মাসের জন্য বন্ধ থাকে। আমি তো চিঠিতে লিখেছি, আমার গান শেখার পয়সা নেই। আপনি দয়া করে শেখান।

আমার মুখে এ কথা শুনে ঘরের সবাই হতবাক আর জর্জদার সে কী হাসি। হা হা করে হাসছেন। হাসি থামিয়ে বললেন, আপনার পিতা শ্রমিক! আপনি শ্রমিকের সন্তান? শহরে শ্রমিক আসে? এহানের তো সব্বায়ের পিতা বা মাতায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, বৈজ্ঞানিক। সেহানে আপনের পিতা শ্রম করেন, তিনি শ্রমিক ?

আমি ভাবছি উনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আর এতে এত অবাক হওয়ারই বা কী আছে? ঘরের অধিকাংশ মানুষ দেখি মাথা নিচু করে আছেন। 

তার একটু পরে বললেন, আমি স্বপনেরে টেলিফোনে যা কওনের কইয়া দিমু। আপনি ওঁর কাছেই যান। তা গিয়া কী করবেন, চিডিটা হাতে দিবেন? 

আমি ঘাড় নাড়লাম। উনি বললেন, স্বপনেরে আপনি দ্যাখছেন?

আমি বললাম, না। উনি বললেন, he is blind। ওঁরে গিয়া চিঠিটা পইড়া শুনাইবেন। আপনি চা খান? 

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, না। 

শুনে বললেন, তাইলে আইজ আসেন। 

আমি ওঁকে প্রণাম করতে গেলাম। করতে দিলেন না। শুধু এইটুকু বললেন, গানটা মন দিয়া শিহেন।

আমি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলাম। মা’কে এসে বলতে মা-ও আনন্দে কেঁদে ফেললেন। মাধ্যমিকের ছুটি তখন। দু'একদিনের মধ্যেই চিঠিটা নিয়ে শ্রী স্বপন গুপ্তর সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে চলে গেলাম। পড়ে শোনালাম চিঠিটা। ততদিনে জর্জদার সঙ্গে স্বপনদার সম্ভবত কথা হয়ে গিয়েছে। কারণ টাকাপয়সার কথাটা তুলতে উনি বললেন, সেটা কোনও অসুবিধে হবে না। গান শোনাতে বললেন। শোনালাম। চুপ করে রইলেন। বললেন, রবিবার করে আসতে। তারপরের রবিবারই গেলাম। উনি নেই। তারপর আরও দু'দুটো রবিবার গেলাম। শেষ রবিবারে গিয়ে বুঝতে পারলাম উনি বাড়িতে আছেন। বাড়ির লোকেরা বললেন, উনি নেই। কারণটা আমার আজও অজানা।

খুব মনখারাপ নিয়ে পরের দিন অর্থাৎ সোমবার জর্জদার বাড়িতে গেলাম। সকাল ১০:৩০ নাগাদ। দেখলাম, জর্জদা একদম একলা। বাড়িতে কাজের লোক আছেন। নাম অনন্তদা এবং শ্রীকান্তদা। অনন্তদাকে উনি মাঝে মাঝে ‘অন্ত’ বলে ডাকতেন। তা ওঁকে গিয়ে বললাম। কোনও অভিযোগ করিনি। শুধু ঘটনাটা জানালাম। সব শুনে বললেন, আপনার আর কোথাও যাওনের প্রয়োজন নাই। ঠিক আসে। আপনি আমার কাছেই গান শিখেন। 

আবার কেঁদে ফেললাম। আস্তে আস্তে বাড়ির কথা, স্কুলের কথা, ওপার বাংলা থেকে উৎখাত হয়ে এদেশে একবস্ত্রে চলে আসার কথা – সব জানালাম। চা খেতে অনুরোধ করলেন। খেলাম। তখন আমি স্বপ্নের ঘোরে। বললেন, কাল সকালে কী করছেন, অর্থাৎ মঙ্গলবার। আমি জানালাম, কোনও কাজই নেই। তো পরের দিন আসতে বললেন। 

গেলাম পরদিন। ১০:৩০ নাগাদ। গিয়ে দেখি, আগের দিনের প্রসন্নতাটা নেই। একজন ভদ্রলোক কিছু কাগজ দিয়ে চলে গেলেন। আর একজন অভিজাত মহিলা বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার।

আমি বললাম, আপনি আসতে বলেছেন। 

শুনে বললেন, আধঘন্টা একটু ঘুইরা আসেন। 

ফিরলাম আধঘন্টা পরে। তখন উনি একা। মন দিয়ে কী সব লিখছেন। আমাকে দেখে ভিতরে আসতে বললেন। ভিতরে আসতে বললেন। মানে, মেন গেটের ভিতরে ঢুকেই ডানদিকে ছোট একটা লাল সিমেন্টের বার-বারান্দা মতো। সেটা পেরিয়ে ওঁর সেই বিখ্যাত, বহুশ্রুত ঘর। 

ভিতরে আসার পর একটা মোড়ায় আমাকে বসতে বললেন। তারপর লিখতে লিখতেই বললেন, আপনার ডানদিকে ‘গীতবিতান’-টা নিয়ে ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’ গানটি বের করুন।

করলাম। এবার বললেন, পড়ে যান, গানডা। 

একটু অবাক হয়ে মনে-মনে গানটি পড়তে লাগলাম। শেষ হলো পড়া। জানালাম। 

বললেন, পড়ে যান – জোরে জোরে, আজ গানটা পড়েন, পড়তে থাকেন। 

চার-পাঁচবার পড়ার পরেও একই কথা বললেন। আরও কয়েকবার পড়ার পর বুঝতে পারলাম, আমার পড়ার মধ্যে একটা সুর আসছে – যা লেখাটার অর্থটাকে জানান দিচ্ছে। এবং পড়তে বেশ ভালই লাগছে। 

এরকম হওয়ার পর বললেন, আইজ এই পর্যন্ত। 

আবার পরের দিন সকালে চলে আসতে বললেন। ভাল লাগছে। আবার একটু খারাপও লাগছে। গানটা তো শেখাচ্ছেন না, হয়তো গরীবের ছেলে বলে এইভাবে ঘোরাচ্ছেন, যাতে আমি বিরক্ত হয়ে আর না আসি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, শেষ দেখে ছাড়ব। ভাবুন, তখন তো মাধ্যমিকের ছুটি। কোথায় আড্ডা মারব, সিনেমা দেখব বন্ধুদের সঙ্গে, বা খেলব, তা না করে গানের পিছনে, থুড়ি গানের কথার পিছনে পড়ে থাকতে হচ্ছে। ঠিক আছে, চলো।

আবার যাওয়া। গিয়ে দেখি সোমেন গুপ্তর সঙ্গে গল্প করছেন। সঙ্গে একজন ভদ্রলোক। যথারীতি ঠোঁটে সিগারেট ঝুলছে। আমাকে দেখে একটা প্রসন্ন হাসি হাসলেন। জর্জদাও। বললেন, পোলাডারে গানডা পড়তে কইছি। আজও পড়বো। সোমেনদাকে গানটার উল্লেখ করলেন। সোমেনদা ঘাড় নাড়লেন সহাস্যে। পড়ছি। ওঁরা শুনছেন। হঠাৎ সোমেনদা বললেন, তোতলামিটা কি তোমার ছোটবেলা থেকে? ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন? এটা সেরে যায়। 

আমি কিছু বলার আগেই জর্জদা বললেন, ওর ওটা আমি সারামু। বলে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন, কোনও তোড্‌লাই গান গাওনের সময় তোড্‌লায় না? 

আমি সেটা জানতাম না। তবে নিজেকে দেখেছিলাম গান গাওয়ার সময় তোতলাচ্ছি না। এই সময় অনন্তদা সবাইকে চা ও চিঁড়েভাজা দিয়ে গেলেন। খেলাম। জর্জদা বললেন, গান শুরু।

কিন্তু শেখাতে শুরু করলেন, ‘কুজনহীন কাননভূমি, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে’ দিয়ে। ‘আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে’ দিয়ে নয়। সে কী হারমোনিয়াম বাজানো, সে কী গান। আমি চুপ। দু’বার তিনবার ‘কুজনহীন’ থেকে ‘শ্রাবণঘন’-তে ফিরে এলেন। গান থামিয়ে বললেন, গানের ব্যাকরণ পরে হবে। স্বরলিপির আগে প্রথমে সুরলিপিটা শিখেন। গানডা ভাল কইরা শুনেন। Visualize করেন। Atmosphereটারে feel করেন। একটা থমথমে ভাব। এইডা জানতে হইবো।

...এই শুরু হলো গান শেখা। বলে দিলেন, আপনার কোনও দিন নাই। যেই দিন আইবেন, সেই দিন কইয়া দিমু, পরদিন কবে আইবেন। এখন ছুডির সময়। সকালের দিকে সোম-শুক্র কিছুটা ফাঁকা সময় পাইলে চইল্যা আসবেন।

গানটা করলাম।

সেদিন গানটা দেখে গেয়েছিলাম। বাড়িতে ‘গীতবিতান’ ছিল না। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে একটা খাতায় গানটা লিখে নিলাম বাড়ির জন্য। আর একটা কপি করে পাতাটা ছিঁড়ে জামার পকেটে পুরে নিয়ে চলে গেলাম পরের ক্লাসে। সেদিনও গম্ভীর মুখ। শরীরটাও ভাল নয়। খুব কাশছিলেন। হাঁপের টানটাও বেড়েছে। বললেন, আজ তাড়াতাড়ি চইল্যা যাইবেন। গানটা করেন -বলে হারমোনিয়ামে সুর ধরলেন।

আমি পকেট থেকে কাগজটা বের করে গানটি শুরু করতে যাব, এমন সময় জর্জদা বললেন, ওইডা কী? 

আমি গানটির কথা বললাম। শুনে এক্কেবারে ফায়ার। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। একে শরীরটা খারাপ।

বললেন, ‘কুজনহীন কাননভূমি’ আপনি পাতা দেইখ্যা গাইবেন? এদ্দুর গ্যাসেন? আপনে এক্ষুনি বায়ের হইয়া যান। আপনার কিস্যু হইবো না। আপনি পাতা দেইখ্যা ‘কুজনহীন কাননভূমি’ গাইবেন। শোনেন, একডা কাম করেন। আপনার পিতার নাম যখন কেউ জিগাইবো তহন পকেট থিক্যা কাগজ বায়ের কইর‍্যা পিতার নামডা কইবেন।

আমি হতভম্ব! দোষটা কী করেছি বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, দোষ করেছি। বললাম, আর করব না, কোনও দিন করব না।

উনি চুপ করে রইলেন। অনন্তদা একবার আমায় বললেন, বাড়ি চলে যেতে। উনি হাত তুলে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ভীষণ স্নেহভরে আমাকে গানটির রূপ ও বোধ ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, এই বোধ অন্তরে অনুভব না করলে তা গানের চেহারায় ফুটে উঠবে না। গানের কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। মোট কথা আমায় দেখে গান গাওয়া চলবে না, যদি ওঁর কাছে গানটা শিখতে হয়।

আমার ভয় ছিল, যদি সত্যিই আমাকে গানটা না শেখান রাগ করে। ফলে গান মনে রাখার অভ্যেসটা শুরু করলাম। তাতে কিছুদিন পর দেখলাম, দারুণ কাজ দিল। কয়েক মাসের মধ্যে কিছু মানুষজন বন্ধুবান্ধবরা জেনে গেলেন আমি জর্জদার কাছে গান শিখি এবং গান গাইতে বললে না-দেখে বেশ কয়েকটা গানও গেয়ে ফেলতে পারি।

মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হলাম নিউ আলিপুর কলেজে। কো-এড কলেজ। অঙ্কে ভাল নম্বর পাইনি বলে সায়েন্স পেলাম না। আর্টস নিলাম। প্রচুর মেয়েরা পড়তেন আমার সঙ্গে। ছেলেরাও ছিলেন। সংখ্যায় বেশি ছিলেন মেয়েরাই। ক্লাস অফ থাকলে গান গাইতাম। কিছুদিনেই বন্ধুপ্রিয় হয়ে উঠলাম। তখন তোতলামিটা থাকলেও, কেন জানিনা, ব্যাপারটা অতটা ছিল না। সে-বছরেই পুজোর ছুটির সময় একদিন সকালে জর্জদার কাছে গিয়েছি। উনি বললেন, আপনার হাতের লেখাতো পরিস্কার। একটা লেখা ‘কপি’ করতে হবে। 

আসলে জর্জদা যা লিখতেন, যাকে লিখতেন তার একটা করে কার্বন কপি থাকত। সেই সময় কিছুদিনের জন্য কোনও কারণে বাজারে কার্বন পেপার পেতে অসুবিধে হচ্ছিল। তো, আমি আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ওঁর কাজ করার সুযোগ। তা ছাড়া তখন প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও একটা স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওঁর তো অসামান্য হাতের লেখা। ঝকখকে, ঝরঝরে। লিখতে গিয়ে বুঝলাম, উনি কোনও একটা বই লিখছেন। ওঁর রাজনৈতিক জীবন ও সেই সংক্রান্ত ওঁর ভাবনা ও অভিজ্ঞতার কথা ওই লেখাটায় ছিল। উনি জানালেন, একটা কপি প্রেসে পাঠাতে হবে। তাই এই লেখার কাজ। আমি দিন দুয়েকের মধ্য লেখাটা শেষ করেছিলাম। কপিটার লেখাটা জর্জদা মঞ্জুর করলেন। পরবর্তী কালে লেখাটিকে দেখার সুযোগ হলো ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ বইটিতে। পরিচ্ছেদটির নাম ছিল সম্ভবত ‘বামের/বাঁয়ের রাস্তা’ এই রকম একটা কিছু।

গান শেখা চলছে। এখনও একা, কখনও দলের সঙ্গে, মহিলাই বেশি। তবে সবাই উচ্চশ্রেণির। আমার বয়সি একজনও কেউ ছিলেন না।

মাঝে মাঝে শ্রীমতী মায়া সেন, সুচিত্রা মিত্র, সুবীর সেন, বিভা সেনগুপ্তদের দেখতাম। শুক্রবার বিকেলে আমার আসা একেবারে বারণ ছিল। এমনিতেই বিকেলবেলা আসাই হতো না। উনি বলতেন, শুক্রবার বিকেলের দিকে উনি তাসের দেশে থাকেন।

৭৮-এর বন্যায় কলকাতা ভেসে গেল। রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম। শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল দু’দিন। কার্পেট, সিঁড়িতেও লোকভর্তি।

একদিন সকালে গান শিখছি। মনে আছে ‘গোধূলিগগনে মেঘে’ গানটি। ‘চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি, আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।’ উনি বলছেন, co-ed-এ তো পড়েন? প্র্যাম করেন? আপনার গান শুইন্যা আপনার প্র্যামে কেউ পড়ে? 

আমি ‘না’ জানাতে বললেন, এই আঁখি-ডা প্র্যামে না পড়লে দেহন যায় না, বুঝনও যায় না।

ভরসা দিলেন, তখনও কেউ প্রেমে না পড়লেও ভবিষ্যতে পড়বে যদি মন দিয়ে গানটা করি। এই সময় একজন বিখ্যাত গায়ক এসে হাজির। সুদর্শন গায়কটিকে দেখে একগাল হেসে বসতে বললেন। মোড়াটা এগিয়ে দিলাম। কথায়-কথায় উনি, মানে সেই গায়কটি বললেন গতকাল তাঁর ফাংশন ছিল।

উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ফলাফলটা কী? কাল কেমন কইর‍্যা গান কইলেন? 

শিল্পী মানুষটি একটু জোর গলায় বললেন, ‘কথাবার্তা’ ছিল না। 

উনি বললেন, সেইডাই তো কইত্যাচি। গান কাল কেমন কইর‍্যা কইলেন? 

উনি কীরকম অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। ভাবলেন, জর্জদা ওঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। আমার মতো ছোট একটা ছেলের সামনে। উনি বেশ স্পষ্ট করে বললেন, আমার গান ছিল।

 গাইলেন? কী কী গান গাইলেন? -গম্ভীর গলা জর্জদার।

উনি বললেন, ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ 

জর্জদা শুনে মুচকি হাসলেন। একটু জর্দা মুখে দিলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন, আপনি কইছেন vowel কিন্তু শ্রোতারা শুনছে consonant। যাউকগ্যা, আজ আসেন। পরে কথা হইব। 

তো উনি চলে গেলেন। যাওয়ার পর জর্জদা বললেন, প্রতিদিন আপনি একই কথা একইভাবে কন, না একডু আলাদা করেন? চিন্তার variation না থাকলে কথাতেও তার প্রকাশ হয় না। রবিঠুকুরের গান করে, রসিকতা বুজে না। শুধু বম্বে গিয়া গান গায়।

আমি বললাম, vowel-consonant টা কি ?

বললেন, বুঝলেন না? উনি কইত্যাছেন এ পথে(A-পথে) – শ্রোতারা শুনছে বিপথে (B-পথে)। এ পথ যে অন্য পথ থেকে আলাদা। সেটা তো বুঝাইতে হইব? সবই একই পথ -বলে হাসলেন। 

তখন বুঝতাম না। আজ সাতচল্লিশ বছর বয়সে এসে বুঝি, কী গভীর দৃষ্টি, বিশ্লেষণ ছিল তাঁর প্রতিটি গানে।

‘আকাশভরা সূর্য তারা’ – গানটি শেখাচ্ছেন। অনেকে আছেন। বারে বারে ‘তাহারি মাঝখানে’ জায়গাটা গাইতে বলছেন। বলছেন, feel করেন। you are surrounded by the cosmic elements and energies। আপনি তার মাঝখানে, feel করেন। 

ঐ মাঝখান-এর মধ্যে উনি জানালেন কীভাবে eternal India-র সুর লেগে আছে — ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’র সেই সুর। 

একদিন উনি একজনকে একটা চিঠিতে লিখেছেন – মাঝে মাঝে পাওয়া চিঠি পড়ে পড়ে শোনাতেন, আবার চিঠির উত্তরও শোনাতেন— সেরকমই একটা চিঠিতে উনি জানাচ্ছেন ‘প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে’ গানটির প্রসঙ্গে : আপনারা চিন, ভিয়েতনাম, রাশিয়ার বিপ্লবের কথা জানেন এবং শুনেছেন, হয়তো দেখেছেনও। মানুষের মুক্তির কথা সেই বিপ্লবে বলা আছে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন আলো-আঁধারের আনন্দ বিপ্লব — এতে রক্তপাত নেই, হত্যা নেই। শ্রেণীশত্রু নিধন নেই। আর লিখেছিলেন, ওই একটি গানের লাইন-ই রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর সারকথা হতে পারে। তা হলো ‘বহুজনতার মাঝে অপূর্ব একা’। সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ তাই ছিলেন। 

...কথাগুলো বলছেন, জর্জদার গলা ভারী হয়ে আসছে। চশমা খুলে চোখ মুছছেন। 

আর একদিন না বলেই গিয়েছি। গিয়ে দেখি, বিশিষ্টা এক গায়িকার হাতে ‘স্বরবিতান’। আমাকে দেখে বললেন, আজ আপনার কী চাই?

বললাম, এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই আপনার একটু খবর নিয়ে গেলাম এই আর কী। 

বললেন, থাকেন পোটোপাড়ায়, এই বয়সে এইখানে কাম পড়ে। বসেন — বলে গায়িকাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এনারে চিনেন?

আমি নাম বললাম। সবাই চেনে, আমিও চিনি। 

—গান শুনসেন? কী গান শুনসেন? 

আমি ওঁর গাওয়া একটি গান শুনেছি তখন। গানটির উল্লেখ করলাম। 

শুনে বললেন, আর একটি গান কন। 

আমি তো জানি না। 

বললেন, আপনি ক্যান উনিও জানেন না। কেউই জানে না।

শুনে ওঁর স্বামী ও উনি হাসতে লাগলেন। উনি ওঁকে ডাকছিলেন ‘দিদিমণি’ বলে। বললেন, আর কি জানেন উনার সম্পর্কে? 

আমি তো আর কিছু জানি না। 

শুনে বললেন, উনি রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট শিক্ষিকা। 

আমি ভাবলাম এটা তো আমি জানি, যেটা জানি না সেটা হলো জর্জদার ভাষায়, এহানে গান শিহানোর সবার গ্রুপ আসে, ওঁর ট্রুপ আসে। 

তো গানটি শেখাচ্ছেন। আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, পোলাটা আমার কাছে গান শিহে। না না গান শিহে না – গান গ্যালে। যাই কই, তাই গিল্যা লয়। 

ওঁদের হাসি। তবে দিদিমণিটি এমনিতে আপাতভাবে খুব গম্ভীর। বুঝতে পারলাম অনেক সকাল থেকে গান শেখাটা চলছে। তখন ১১:৩০ কী ১১:৪০। গানটি ছিল ‘তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই—’। দ্বিতীয় অন্তরা অর্থাৎ ‘একটি চাওয়া ভিতর হতে ফুটবে তোমার ভোর আলোতে/প্রাণের স্রোতে--/অন্তরে সেই গভীর আশা বয়ে বেড়াই/তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই—’

গানটা শেখাচ্ছেন। আমি বাইরের ছোট বারান্দায় বসে আছি। যতবার ‘একটি চাওয়া’-র লাইনটা সেই শিক্ষিকা গাইছেন ততবারই জর্জদা একটু হেসে বলছেন, হইলো না, আবার গান – বলে একবার দু’বার গেয়ে দেখাচ্ছেন। একদম ঠিক সুরে উনিও গাইছেন। জর্জদা নাকচ করে দিচ্ছেন। 

এইবার গায়িকাটি বেশ বিরক্ত, জর্জদা আপনার problemটা কী বলুন তো, যা গাইছেন তাই গাইছি, স্বরলিপিতেও কোনও ভুল নেই – অসুবিধেটা কোথায়? 

কথা থামাতে জর্জদা মুচকি হেসে পানের ডিবে থেকে দু’টো পান বের করে মুখে দিলেন। তারপর বললেন, দিদিমণি, রবীন্দ্রনাথের সিরিব্রাল হইলে কি দোষডা আমার? আগের অন্তরায় কইসেন ‘সে সব চাওয়া’ আর এখন কইত্যাসেন ‘একটি চাওয়া’। একইভাবে কওন যায়? A Single solitary desire…from within। আর শুনেন, রবীন্দ্রনাথের ভোর হইতো চাইরটার সময়। আপনার ভোর হইত্যাছে বেলা দশডায়। অত Zo-রে অত স্পষ্ট কইর‍্যা ভোর হয় না। ভোর হয় অস্ফুটভাবে। ফিল করতে হইব। 

দিদিমণি চুপ। ওঁর স্বামীর চোখে জল। জর্জদার মুখ থমথমে। 

আমার সঙ্গে ভালবাসার গাঢ়ত্বটা বাড়ল ’৭৮-এর শেষ বা ’৭৯-এর গোড়ার দিকে। সময়টা সঠিকভাবে মনে নেই। উনি আসতে বলেছেন। গিয়ে দেখি, ইজিচেয়ারে বসে আছেন জর্জদা, চোখ-মুখ বিস্ফারিত, উঠতে পারছেন না, হাতড়াচ্ছেন কিছু একটা। আমি ঢুকতেই তাকালেন অসহায় যন্ত্রণার দৃষ্টি নিয়ে। 

বুঝতে পারলাম, পানের পিকসমেত চিবোনো পানসুপুরি জর্দা কোনওভাবে গলায় আটকে যাওয়াতে দমের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ আর হাতড়াচ্ছেন পিকদানিটা। আমি তাকিয়ে, পিকদানিটা যেখানে সাধারণত থাকে, দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। 

আমি বললাম, আমার হাতে ফেলুন ওটা, আপনি জানেন যে ওটা আমি খেয়ে নিতেও পারি। আমার হাতে ফেলুন এক্ষুনি। বিমুঢ় বেদনার দৃষ্টিতে জর্জদা আমার দিকে তাকিয়ে হাতে ফেললেন পান পিকের প্রথম ভাগ এবং পরে দ্বিতীয় ও শেষ ভাগ। আমি বাইরে ফেলে দিয়ে, হাত ধুয়ে যখন ঘরে ঢুকলাম জর্জদা নিঃশব্দে হাত নেড়ে আমাকে ওঁর একদম পাশে আসতে বললেন। যাওয়াতে, সেই নিঃশব্দেই আমার মাথাটা ওঁর হাফহাতা গেঞ্জি পরা বুকে চেপে ধরলেন কিছুক্ষণ। তারপর ছেড়ে দিলেন। ‘ফিল’ করলাম, ভালবাসার আশীর্বাদ কীভাবে ট্রান্সমিটেড হয়। 

সেদিনের পর থেকে জর্জদা বাহ্যিক কোনও প্রকাশ না-করে ওঁর সংগীত ভাবনার নির্যাস আমাকে দিয়ে যেতে লাগলেন। যার ফল আমি এখনও পাচ্ছি। একদিন জিগ্যেস করলেন, আমার গান লোকের এত ভাল লাগে কেন? যদি বলেন গলার আওয়াজ, হেমন্তবাবুর গলার আওয়াজ আমার থেকে অনেক অনেক গুণ ভাল— তবু রবীন্দ্রনাথের গানে আমাকে লোকেরা এত চায় কেন এবং যে সে লোক নয়, সাধারণ শ্রোতা থেকে মনস্ক শ্রোতা পর্যন্ত – ফলে এত রেকর্ড, অনুষ্ঠানে এত ভালবাসা কেন ?

আমি জানালাম যে, জানি না। 

উনি বললেন, শোনেন, আমার গান হুইন্যা হক্কলের মনে হয় গানডা আমারই লিখা, আমারই সুর করা এবং আমারই গাওয়া – অর্থাৎ ইডা রবিবাবুর গান নয়, আমার গান, আমার গান আমি গাই, আমি অপরের গান গাই না। এই বোধটা আমি শ্রোতাদের বুঝাইতে পারসি। I do believe those songs। এই যে কয়, আমি এর কাছে গান শিখি, যন্ত্র শিখি – কথাটার মানে কী? আমি রবীন্দ্রনাথের গান আলাদা করে কী করে শিখাব? শেখানো মানে ইন্টারপ্রিটেশন শেখা, শব্দপ্রয়োগের ভঙ্গি শেখা, উচ্চারণের বৈশিষ্ঠ শেখা, তার কারণ শেখা, যতিচিহ্নের প্রয়োগের যুক্তি শেখা। সবাই গায় ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ/জ্বেলে দিবস/গেলে করবে নিবেদন।’ কথাটা তো তা নয়। ‘জ্বেলে দিবস’ মানে কী? দিবস জ্বালিয়ে দেবে? কথাটা হলো— ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে/দিবস গেলে করব নিবেদন।’ তবে কথাটার মানে হয়। বা ‘দিনশেষের রাঙামুকুল’ গানটিতে ‘রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে, এসো এসো প্রাণে/মম গানে/মম হে।’ এই ‘মম হে’ কথাটার মানে কী? কোনও মানে নেই। কথাটার মানে হয় যখন বলা হয় ‘এসো এসো প্রাণে মম/গানে মম/হে’, তখন।

১৯৮০ সালে চলে গেলেন উত্তমকুমার। ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ি আশুতোষ কলেজে। জর্জদার শরীরটা ভাল নেই। হেমন্তবাবু, বাণী ঠাকুর ‘কিংশুক’-এর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রসদনে ওঁকে সম্বর্ধনা দিলেন। জর্জদার মুখে তখন দাড়িগোঁফের বোঝা।

একদিন বললেন, শুনেন গাঙ্গুলিমশয়, যেই দিন আপনার হইতে বিনয় চইল্যা যাইবো, সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ আপনারে ত্যাগ করব। এহন গানডা মন দিয়া করেন। হারমোনিয়াম শিখতে সময় লাগব না। আর হারমোনিয়ামের সুর গলায় অনেক ত্রুটিরে ঢাইক্যা দেয়। ও আপনেরে শিখাইয়া দিমু। খালি গলায় করেন।

একদিন সকালে গান শেখানোর পর জর্জদা জিগ্যেস করলেন, বটুকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত হুনসেন? 

আমি বটুক বলতে গীটারবাদক বটুক নন্দীর কথাই শুধু জানতাম। তিনি যে রবীন্দ্রনাথের গানও করেন, তা জানতাম না। আমার অজ্ঞতার কথা ওঁকে জানাতে উনি একটু হেসে জানালেন যে, ‘নবজীবনের গান’-এর রূপকার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর স্বজনমহলে ‘বটুক’ নামেও পরিচিত। আমি ওঁকে একবারই আসতে দেখেছি। কারণ সে-বছরই, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালেরই সম্ভবত অক্টোবর মাসে, উনি সবাইকে ছেড়ে হঠাৎই চলে যান। শুনেছিলাম হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের কামরায় ওঁর নিষ্পন্দ শরীরটি পাওয়া গিয়েছিল। জর্জদা শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। 

যাক গে, যা বলছিলাম, জর্জদার জিজ্ঞাস্য ছিল আমি ওঁর গাওয়া ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানটি শুনেছি কি না। আমি শুনিনি বলায়, জর্জদা আবারও একটু হেসে বললেন, বটুকের গান হুইন্যা মনে হয় এই ‘আনন্দযজ্ঞে’ যিনি নিমন্ত্রণ করসেন আর যিনি নিমন্ত্রিত, তাদের স্ট্যান্ডার্ড ইক্যুয়াল। আর বাদবাকি গায়করা নিমন্ত্রিতই নন। নিজেরাই আইস্যা ঢুইক্যা পরসে। মনে আর কন্ঠে এত দুঃখ লইয়া আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণের গান গাওন যায়।

এটা ’৭৮ সালের ঘটনা। গান শিখতে গিয়েছি সকাল। কলেজে গরমের ছুটি চলছে। ঢুকতে-ঢুকতে শুনতে পেলাম জর্জদা গান গাইছেন। আমাকে দেখে অনন্তদা ঠোঁটে আঙুল চাপার ইঙ্গিতে কোনওরকম আওয়াজ করতে নিষেধ করলেন। দেখলাম ঘরে ধুতি পাঞ্জাবী পরা প্রায় পৌঢ় একজন ভদ্রলোকের পিঠের দিকটা। তিনি হারমোনিয়ামে সংগত করছেন জর্জদার সঙ্গে। হারমোনিয়াম, না বেহালা প্রায় বুঝতেই পারছি না। সে কী অসামান্য কান-পবিত্র-করা বাদন। আর জর্জদা গাইছেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’। সে কী আর্তি, সে কী বেদনের উচ্চারিত গায়ন। গেয়েই চলেছেন। বারবার। বিভিন্ন এক্সপ্রেশন-এ গাইছেন আর সঙ্গে ওই অসামান্য হারমোনিয়ামের সংগত। বুঝলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরেই গানটি গাওয়া চলছে। আর যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন তিনি মাঝে-মাঝে বেলো ছেড়ে তাঁর বাম হাতের ওপরের দিকটা নিজের মুখের কাছে উঠিয়ে নিচ্ছেন। পরে বুঝেছিলাম, চোখ মুছছিলেন। 

গান থামল। চোখ-ভরা জল নিয়ে দু’জনে দু’জনের হাত চেপে আছেন। আমার চোখেও জল। আলাপ করিয়েছিলেন সেই পুণ্যশ্লোক মানষটির সঙ্গে। সুযোগ পেলাম তাঁর চরণ স্পর্শ করার। সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।

তোতলামিটা জর্জদা সারিয়েছিলেন। অসামান্য একটি উপায়ে। একদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বইটি আমার হাতে দিলেন। যেখানে বসতাম, তার ডানদিকের র‍্যাকে বইটি ছিল। দিয়ে বললেন, বিভিন্ন লয়ে লেখাটি অর্থাৎ চতুর্দশপদী ছন্দোবদ্ধ কাব্যটি আওয়াজ করে 
জোরে-জোরে tail drop না করে সচেতনভাবে পড়ুন ও প্র্যাকটিস করুন। 

মাস 'ছয়েক বিভিন্ন লয়ে প্র্যাকটিস করার পর দেখলাম তোতলামিটা আর সেভাবে নেই। গলার আওয়াজটাও বদলে গিয়েছে। যে কথা বলার জন্য বিড়ম্বিত হতাম সেই কথাই রূপান্তরে মানুষের ভাল লাগার কারণ হয়ে উঠেছে। ওঁরই চিঠি নিয়ে ‘আকাশবাণী ভবন’-এ যাই অডিশন ফর্ম দিতে। কিন্তু জর্জদাকে আমার বেতার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ শোনাতে পারিনি। কারণ ততদিনে জর্জদা আমার হাত ছেড়ে দিয়েছেন। 

১৬ই অগাস্টে শেষ গিয়েছিলাম ওঁর কাছে।

১৮ই অগাষ্ট সকালবেলা আমার মা আমাকে সাতটা নাগাদ ডেকে দিলেন। আমি সাড়ে সাতটার আগে ঘুম থেকে উঠতাম না। উঠিয়ে বললেন, চা-টা খেয়ে নাও। মা-বাবার মুখটা থমথমে। ছোট বোনও ঘুম থেকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম না। মুখ ধুয়ে, চা খেতে-খেতে ‘স্থানীয় সংবাদ’-এ খবরটা শুনলাম। 

মুহূর্তে বাড়ির পোশাক বদলে একছুট। খালি পা, ছুটে সর্দার শংকর রোডে আমার বন্ধু রাহুল সেনের বাড়ি। ও বলল, তুই এগো, আমি আসছি। আর একছুট – গলির মুখে প্রচুর ভীড়, ভীড় সরিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে গিয়ে একজনের পেটে আমার ধাক্কা লাগল। ভীষণ ভারী গলার আওয়াজ তাঁর। ‘অ্যাই, ঠিক করে’—তাকিয়ে দেখলাম সত্যজিৎবাবুকে, পাশে রুমা গুহঠাকুরতা, পিছনে জ্যোতিবাবু। পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। প্রচুর মানুষ। ন্যাশনাল প্যানাসোনিক-এর চ্যাপ্টা টেপ রেকর্ডারে বাজছে ওঁর গলা ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’। আওয়াজটা মনে হচ্ছিল, ওঁর বুক থেকে বাজছে। 

আর এক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী উপস্থিত ছিলেন সেখানে। বললেন, মরদেহ ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে রাখা হবে – সেখান থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে শ্মশান। প্রতিবাদ উঠল। শরীর রবীন্দ্রসদনে যাবে। গেলোও। রবীন্দ্রসদন থেকে বেরল। আবার ফতোয়া। সেই একই ব্যক্তি। হরিশ মুখার্জী রোড দিয়ে এবার নিঃশব্দ শোকমিছিল। ঠিক করে ফেললাম, আমি কি করব। অনেক পরিচিত মুখ। মিছিলের একদম সামনে আমি, কিছু চেনা মানুষ, মাঝে বিখ্যাত লোকরা, নাটকের, গানের। পিজি হাসপাতাল পেরিয়ে গুরুদ্বারে মিছিলটা পড়ামাত্র আমি একা শুরু করলাম ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’। একটু পরেই গানটা হয়ে গেল সমবেত। তখন থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত গান গাওয়া চলল। কোনও এক অলৌকিক কারণে গান শুরু করছিলাম আমি, তাতে গলা মেলাচ্ছিলেন বাকি সবাই। আমার পাশে ডানদিকে বাঁদিকে জায়গা বদল করছেন সাগর সেন, প্রদীপ ঘোষ, হেমাঙ্গবাবুর ছেলে মৈনাক বিশ্বাস, প্রমুখ। 

গান শেষ হলো মিছিলও শেষ হলো, তার গন্তব্যে। শেষ হলো ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে’ গানটি দিয়ে।


*পুনর্মুদ্রিত



3 comments:

  1. স্তব্ধ হলাম। আপনি যে অপার ভালোবাস পেয়েছেন তা শুধু শব্দে প্রকাশ নয়, সেই ভালো বাসা কে আপনার অর্জিত সম্পদে জারিত করে সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিন, আজ ভালোবাসার বড় অভাব। আপনার চেয়ে অর্বাচীন এক দেবব্রত-গুণমুগ্ধ মানুষের অনুরোধ।

    ReplyDelete
  2. অসামান্য উপস্থাপনা! প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল লেখাটি আগেও পড়েছি কোথাও...শেষে এসে ভ্রান্তি দূর হ'ল পুনর্মুদ্রিত দেখে। দেবব্রত এর রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কী এবং শব্দ ও অক্ষরের নিখুঁত স্পষ্ট উচ্চারণ আমি খুব অল্প লোকের গানেই শুনেছি। "বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়" এর ঢ় উচ্চারণ মুগ্ধ করে দিত! আমি নিজে একজন হাঁপানীর রুগি, তাই জানি হাঁপানি নিয়ে নিখুঁত বাচনভঙ্গিতে গান গাওয়া কতোটা কষ্টকর।

    ReplyDelete
  3. শিল্পী9 July 2018 at 00:59

    সমৃদ্ধ হলাম।
    ৩রা জুলাই,২০১৮র সন্ধ্যায় এমনই এক অভিজ্ঞতা হল।
    সেদিনের ছাত্র,আচার্যের স্থানে এখন। ��

    ReplyDelete