ব্যক্তিগত গদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
স্বয়ংপ্রভা
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার
আমি যতদূর জানি - ইনি কবি নন - ঔপ্যন্যাসিক বা গল্পকারও নন, সে সব গুণ ওঁর নেই। তবু প্রতিদিন এক নীল খাতায় কি যে রাত জেগে সব লেখেন কে জানে! এখন রাত একটা বাজে। অদম্য কৌতূহল নিয়ে নিদ্রিতার পাশ থেকে খাতাটি নিয়ে পড়তে বসি।
আচ্ছা কি লিখতে পারেন? যাপিত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কথা? নাকি আর দশটা গৃহবধূর মতো ছেলে, বৌমা, নাতি নিয়ে... দূর পড়েই ফেলি...
২৯শে অগাস্ট ২০১৬
রাত ১১টা ৪০ মিনিট
যে দিন তোমার সাথে প্রথম দেখা
সে দিন বুঝিনি আমি হব যে একা---
আজ দুপুরবেলা তোমার এক বছরের কাজ হলো।
আমার এই শ্রাবণেই গুটি গুটি ছিয়াত্তর এসে ঘাঁটি গাড়ল দেহে। কবে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, হে জমিদার তনয়?
বয়েস তখন আঠারো অথবা উনিশ
হাওয়ায় ভাসতো স্বপ্নের শুভ্রতা
ছিল না কোথাও কোনও আবিলতা কালো
সবুজ ঘাসের পরশ লাগতো ভালো।
গত বছর আমাকে একলা রেখে তুমি চলে গেলে। আজ তোমাকে আমার কিছু কথা জানাই। যাহা বলিব সত্য বলিব, গো বিচারক।
আচ্ছা, এই যে সাতান্ন বছর ঘর করার পর তুমি চলে গেলে - আমি কি খুব দুঃখ পেয়েছি? একসাথে এতদিন অতিবাহিত করার পর একা হওয়ার এক বেদন অনুভাব করছি না বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি তোমাদের কাছে এক হাবা গোবা, মুখ্যু মেয়েছেলে ছাড়া আর কিছুই কি হয়ে উঠতে পেরেছি?
অষ্টম শ্রেণীর বিদ্যে নিয়ে মেয়েছেলে থাকা যায়, কিন্তু মেয়েমানুষ? আরে ছি!
তবে আমি নাকি অপূর্ব সুন্দরী, ঘরে পরে লক্ষ্মী বলে সবাই। আমি যে কেমন তা তোমাদের ঐ দাড়ি কামানো আয়নাতে সিঁদুর পরার সময় যতটুকু বিম্বিত হয়, তাই দেখেছি। আমার চাঁপাফুল রঙ, সাদা পায়রার মতো স্তন, নিটোল গভীর নাভিকূপ - এ সব তোমার মুখে শোনা। সেই যখন চারদিকে ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে ন্যাতা, সেই যখন বোশেখী দাহে বা বৃষ্টির জল পড়ত টিনের চালের ফুটো দিয়ে টুপটুপ আর জেগে উঠত তোমার দেহ তখনই, একমাত্র তখনই এগুলো আমার শোনা।
কোনওদিন ভাবিনি আমার মন কি বলে - সেই উনিশে তোমাদের যজ্ঞিবাড়ির উনুনের ধারে মুখ করে বসেছিলাম। তারপর কখন যে সংসারের জালে নিজেই এক মাকড়সা-মন হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।
তুমি গত কয়েক বছর ধরে আমায় মাসান্তে তিনশ টাকা দিয়ে বলতে 'নাও তোমার হাত খরচ তি ন 'শ টাকা দিলাম'। ঘেন্না করত। বড়ো ঘেন্না করত নিতে, তাও নিতাম। কেন জান? তাই দিয়ে তোমাদের কিছু দেওয়ার আনন্দ কিনতাম আমি। বড়ো আনন্দে - বড়ো লজ্জায় - বড়ো ঘেন্নায়।
জান, এখনও আমার বড়ো ভালো লাগে এই পৃথিবীর আলো। ভালোবাসি ঘাস, ফুল, আকাশ ভরা সূর্য তারা। রবি ঠাকুরের গান। কি ভালো গাইতাম আমি। এখনও গাইতে চেষ্টা করি - সবাই বলে কাঁদছ কেন? পেত্নীর খোনা সুর আজ আমার সাথী।
লেখা পড়া শিখিনি তো, ওই রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, তারাশঙ্কর, গজেন মিত্র আর কথামৃত। যা পাই তাই পড়তাম। ঠোঙাটাও বাদ দিতাম না। আজও দিই না। এই বয়েস অবধি শুনে আসছি - ভারি তো বিদ্যে, তবু লেখা পড়া ছাড়া রাতে ঘুম হয় না!
বয়েস হয়েছে। লেখার তাল আর ঠিক রাখতে পারি না। তবু আমার যে আরও বলার আছে। ক্ষমা-ঘেন্না করে নিও। জান, আমি রোজ বলি আমার আরও বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোমাদের সুখেই আমার সুখ। আমার তো সাঙ্গ হলো ধূলা খেলা। আমি হাসছি ---
রাহু রঙ চাঁদের হাসি। হ্যাঁ, আমার এখনও বাঁচতে ইচ্ছে করে। কেন জান? তুমি চলে গিয়ে আর তিনশ নয় গো, আমি এখন অনেক টাকা পাই। ঘেন্নার নয়। ওই যে তোমাদের জন্য জীবনের সব ফুল- কুঁড়িগুলো দিয়ে দিয়েছি - এ বোধহয় তারই মূল্য। পেনশন পাই গো! বৈধব্য ভাতা। রীতিমত আমার টাকা। তুমি আগে চলে গেলে বলেই না এই 'আমার টাকা'র সুখ পাচ্ছি গো!
আমার এখনও খুব ইচ্ছে করে নির্ভার মেঘের মধ্যে দিয়ে এরোপ্লেন করে যেতে - আমার সেই একা তালগাছের মতো বলতে ইচ্ছে করে 'যদি পেত পাখা সে...'
এই ধরিত্রী, আকাশ, অন্ধকারের জোনাক আলো, টিপ টিপ তারার আলো, হয়তো তার মধ্যে তুমিও আছ - আছেন সেই সে মানুষটি 'তুমি জানাও যারে সেই জানে' আমি সব সব কিছু যে বড়ো ভালোবাসি।
আমি জানি আমি তো গুছিয়ে লিখতে পারি না -
তাও ছেলেটা দুটো চোখেই ফেকো না কি, করিয়ে দিয়েছে - তাই তোমায় এই তুচ্ছ কথা জানাতে পারছি।
এবার তোমায় বলি - হে আমার ইষ্টদেব, যেখানে যত দেব দেবী আছ, সবাইকে আমার প্রণাম। আর একটা শেষ ইচ্ছে জানাই দয়াময়-আমাকে পরের জন্মে এইখানে আবার পাঠিও মেয়েছেলে করে নয় -
মেয়েমানুষ করে, স্ব- নির্ভরা মেয়েমানুষ করে....
আরও কি সব লেখা আছে - আমি পড়তে পারছিনা। আমার চোখপাতা ঝাপসা।
আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে খাতাটা বন্ধ করে দেখি আমার দিদি... হ্যাঁ, এতক্ষণ চুরি করে যাঁর লেখা আমি পড়ছিলাম, সেই ছিয়াত্তর বছরের সাধারণী "অনিতা গঙ্গোপাধ্যায়" জেগে উঠে তাঁর প্রয়াত স্বামীর ছবির দিকে চোখ বুজে ধ্যানস্থ... অবিরল ধারায় গোলাপী গাল দুটো ভেসে যাচ্ছে...
0 comments: