ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
পূর্বকথা---
দেবগ্রাম নামক অখ্যাত গ্রামের সম্পন্ন এক গৃহস্থের বালক এক প্রত্যুষে গৃহত্যাগ করিল সেই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধার সাহায্যে, যে বৃদ্ধার সেই বালকটি অপেক্ষা আপনজন আর কেহ নাই, কিন্তু অনাথা বৃদ্ধা পরিবারেরও কেহ নহেন। বালকটি আর কেহ নহে, সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার কনিষ্ঠ পুত্র। কিন্তু বালকটি গৃহত্যাগ করিল এমন এক সময়ে যখন গৃহে অপর এক সন্তানের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আসিয়াছে, বাটীস্থ সকলে ভীত, সন্ত্রস্থ। এমত সময়ে বালকটি গৃহত্যাগ করিল উচ্চবিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে। বালকটি গৃহত্যাগ করিল, গৃহস্থ সকলের মনে যাহাই হোক, সকলে জানিল। কিন্তু যে বালকটি গৃহত্যাগ করিল, তাহার বিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষার স্বপ্ন কি সফল হইল?
অতঃপর...
রাজ ইস্কুলে আসিয়া জ্ঞানতোষ বিস্মিত হইল। ইহাকেই বুঝি রাজার ইস্কুল বলে! বিরাট দালান ঘর একপ্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত। প্রকাণ্ড খেলার মাঠ। চমৎকৃত হইল সে। তাহাদের গ্রামে একখানি চালাঘর ছিল বটে, তাহাকে লোকে ইস্কুল বলিত না, দনু পণ্ডিতের পাঠশাল বলিত। দনু পণ্ডিত, জনার্দন বিদ্যাবাগীশ ভট্টাচার্য্য তাহাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। তাঁহার একখানি টোল ছিল। সে কবেকার কথা। জ্ঞানতোষ তাহার ভগ্ন মৃত্তিকাটুকু দেখিয়াছে মাত্র। কিন্তু শুনিয়াছে, ইহা একসময় দনু পণ্ডিতের টোল ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের গ্রাম, সংস্কৃত শিক্ষার টোল ছিল, তাই বোধকরি তাহাদের গ্রামে বিদ্যালয় তৈয়ারি হয় নাই। পার্শ্ববর্তী গ্রামে একখানি বিদ্যালয় আছে। প্রথমে টিনের চালা ছিল, পরে দুইখানি পাকা ঘর হইয়াছে। দেবগ্রামের দুই/চারিটি বালক তথায় বিদ্যাশিক্ষা করিতে যায়, কিন্তু শিবতোষ তাঁহার পুত্রদিগকে যাইতে দেন নাই। শিবতোষ বোধকরি সংষ্কৃত শিক্ষা ব্যতিরেকে আর কোনও শিক্ষায় উৎসাহী নহেন। আধুনিক বিদ্যাশিক্ষা করিলে পুত্রেরা গৃহে থাকিবে না, জমি-জায়গা সব বিফলে যাইবে, জমিদারী কে দেখিবে, ইহাই তাঁহার যুক্তি ছিল। কিন্তু আবহাওয়া যে অন্যদিকে ঘুরিতেছে, আর তাহাদিগকে ঘরে চিরদিন বাঁধিয়া রাখা যাইবে না, ইহা বুঝিতে পারেন নাই। পুত্রেরা গৃহে শিক্ষালাভ করিয়া বড় ইস্কুলে গিয়া শুধুমাত্র পাশ দিবে ইহাই একরকমের বন্দোবস্ত হইয়াছিল। জ্ঞানতোষের বড়দাদা রণতোষ, মেজদাদা প্রিয়তোষ তাহাই করিয়াছেন। হয়ত সেজদাদাও তাহাই করিবেন। কিন্তু সেজদাদার লেখাপড়ায় মন নাই। তবে কি তিনিও স্বদেশী হইবেন?
জ্ঞানতোষ শিশুবেলা হইতে আর পাঁচটি শিশু বালক অপেক্ষা পৃথক রকমের ছিল। অত্যন্ত মেধাবী, তাহার প্রখর দায়িত্বজ্ঞান। যে কার্য্য তাহাকে করিতে বলা হইত, তাহা সম্পন্ন করিত নিজ কষ্ট স্বীকার করিয়াও। গৃহে একমাত্র মেজদাদার সহিত জ্ঞানতোষের কথাবার্তা হইত, তিনি তাহাকে খুবই স্নেহ করিয়া থাকেন। গৃহে বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারেও গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথ ব্যতিরেকে মেজদাদাই সাহায্য করিয়া থাকেন, পড়া দেখাইয়া দেন। ইস্কুলে ভর্তির জন্য সে যে গৃহছাড়া হইয়াছে, ইহা একমাত্র বুঝিলে মেজদাদাই বুঝিবেন, আর কেহ বুঝিবেন না। আর আছেন দিনমণি, কিন্তু তিনি নিরক্ষরা স্ত্রীলোক, তাহার উপর অপরের আশ্রিতা, তিনি কেবল মাত্র জ্ঞানতোষের জন্য কিছু করিতে পারিলেই শান্তি পাইয়া থাকেন, আর কিছু বুঝিতে চাহেন না। জ্ঞান বড় হইবে, লেখাপড়া শিখিয়া জজ হইবে, এই তাঁহার আশা ছিল। তিনি ইহাই বুঝিতেন।
গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথ জ্ঞানতোষকে চিনিয়াছিলেন। ক্ষেত্রনাথ ছিলেন রাজাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অবনী মাষ্টারের ছাত্র, শিষ্যও বলা চলে। স্বাধীনতার আন্দোলনের জোয়ারে তখন সকলেই দেশের জন্য কিছু করিতে চায়। অবনী মাষ্টার ছাত্র তৈয়ারির কাজটি বাছিয়া লইয়াছিলেন। একজন শিক্ষকের ইহা অপেক্ষা উত্তম কার্য আর কি আছে? ক্ষেত্রনাথ অবনীর দীক্ষায় দীক্ষিত। শিক্ষক হইয়া তাঁহারও প্রথম কাজ হইল উপযুক্ত ছাত্র গঠন। যদি কোনওভাবে দু/একটি করিয়া মেধাবী ছাত্র মাষ্টার মহাশয়ের নিকট পাঠানো যায়, তাহা হইলে তিনি তাহাদের তৈয়ার করিয়া লইবেন। বালকগুলি সম্বন্ধে মাষ্টারমহাশয়ের সহিত পূর্বেই কথা হইয়াছিল। কিন্তু জ্ঞানতোষের ব্যাপারে ক্ষেত্রনাথ নিশ্চিত হইতে পারেন নাই। তিনি জানিতেন শিবতোষ জ্ঞানতোষকে গৃহের বাহিতে যাইবার অনুমতি দিবেন না। সেই কারণেই কিছুদিন অপেক্ষা করিবার চিন্তা তাঁহার মনে ছিল। এমন একটি মেধাবী ছাত্রকে যদি ঠিকমত শিক্ষা দেওয়া যায়, দেশের ও সমাজের তাহাতে প্রভূত উপকার হইবে। কিন্তু তাহার জন্য জ্ঞানতোষের মনে স্বদেশ এবং উচ্চশিক্ষা উভয়ের বীজ বপন করিতে হইবে।
কিন্তু জ্ঞানতোষের মনে বীজ বহু পূর্বেই রোপিত হইয়াছিল। তাই পাখি নিজেই পলায়ন করিল।
দ্বিপ্রহরের পরে তিনটি বালক নির্দিষ্ট স্থানটিতে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। গন্তব্যস্থলটির ইস্টিশান হইতে দুরত্ব বড় কম নহে। তাহারা গ্রামের বালক, পথ চলিতে কষ্ট হয় না, কিন্তু বালকগুলি ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হইয়াছিল। ইস্টিশানে নামিয়া জ্ঞানতোষের নিকট যে আধূলিটি ছিল তাহা ভাঙ্গাইয়া কিছু ছোলা ও গুড় কিনিয়া তিনজনে খাইয়াছে। তবে জল পান করিতে কোনও অসুবিধা হয় নাই, পানিপাঁড়ে তাহাদের মাটির জালা হইতে ঠাণ্ডা জল পান করাইয়াছে।
ইস্টিশানের একজন ব্যক্তি তাহাদিগকে ইস্কুলে যাইবার পথটির হদিশ বলিয়া দিয়াছিলেন। বিদ্যালয়ের কাছাকাছি আসিলে একজন জামা-জুতা পরা কিন্তু লাঠিধারী ব্যক্তির সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ হইল, তাহার নাম জগু মাহাত। এই অঞ্চলে মাহাত, কুর্মী এইসব লোকের বসবাস বেশী। জগু মাহাত হাতে লাঠি লইয়া বৃদ্ধ এক ব্যক্তির সহিত কথা বলিতেছিল। জগু মাহাতর নিকট তাহারা বিদ্যালয়ের অবস্থানের কথা জিজ্ঞাসিলে জানিতে পারিল, জগু মাহাত সেই বিদ্যালয়েরই দরোয়ান। দুইজন দারোয়ান আছে, তাহারা পালা করিয়া পাহারা দেয়, ইস্কুলের নিয়মকানুন খুব কঠিন। বালকগুলি তাহাদের আসার কারণটিও বিবৃত করিল। তাহাতে জগু মাহাত বিদ্যালয়ের বিপরীত দিকের একটি রাস্তার মোড়ে বালকগুলিকে লইয়া আসিল। একটি মাঝারি আকারের পাকা ঘরের সমুখে আসিলে জানিতে পারিল ইহা ইস্কুলের শিক্ষকদিগকের থাকিবার আস্তানা। এই গৃহটির পার্শ্বেই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আরও একটি পাকা ঘর চোখে পড়িল। জগু তাহাদিগকে তথায় লইয়া আসিল, জানিল ইহাতে বিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকে। বিদ্যালয়ের পিছন দিকে আরও একখানি এইরূপ আবাস আছে, তাহাতেও কিছু ছাত্র বাস করে। জগু মাহাত বালকগুলিকে বাটির সমুখে দাঁড় করাইয়া অন্দরে প্রবেশ করিল। মিনিট পনেরো পর ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে লইয়া পুনরায় অন্দরে প্রবেশ করিল। প্রবেশের মুখে এক ব্যক্তির সহিত বালকগুলির সাক্ষাৎ হইল। সেই মহাশয়কে ঠিক যুবক বলা সমীচীন হইবে না, তাহা অপেক্ষা কিছু বয়স অধিক হইবে। ব্যক্তিটি সুদর্শন, পরনে ধুতি এবং ফতুয়া। জ্ঞানতোষ প্রথমে ইঁহাকেই অবনী মাষ্টার ভাবিল। ইনিও এই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বোধকরি তাঁহারও এই বালকগুলি সম্বন্ধে কিছু জানা আছে, কিন্তু তিনি অবনী নহেন। ইনি সুশীল স্যর। তিনি বালকদিগকে তাঁহাকে অনুসরণ করিতে বলিলেন।
(ক্রমশঃ)
অপূর্ব রচনাশৈলী, প্রীত হইলাম।
ReplyDelete