0

রম্যরচনা - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


রম্যরচনা


সাধনা 
সোমঙ্কর লাহিড়ী 



আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের নাম “করালবদনী” অ্যাপার্টমেন্ট। কিনতে যাওয়ার সময় দালালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আচ্ছা “মা কালীর আরও কত সুন্দর নাম আছে তারা, ব্রহ্মময়ী, এই রকম আরও কত, সব থাকতে এই ভয়ংকর নামটাকে পছন্দ করেছে?” দালালের বিগলিত উত্তর, “দাঁদাঁ আঁওঁয়াদের পোঁঙোঁটারের গুঁউঁডেব। খুঁউঁ বঁঞোঁ তাঁনঈঁক টোঁ, টাঁঈ”। ভাবছেন ভূত না গন্নাকাটা তাই তো? না। ওঁর মুখে প্রায় ২০০ গ্রাম পান মশলা ও থুতুর মিশ্রণ কাটিয়ে কথাগুলো উঠছিল।

আমি আর কথা বাড়াইনি। কারণ পান মশলার মানে-বই আমার কাছে নেই, কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না। ভাবলাম আমার তো বাড়ীর বাইরেটা নিয়ে দরকার নেই, ভিতরের ঘরদোর বাথরুম বারান্দা এই সবগুলো ঠিক হলেই হলো, আর দামের ব্যাপারটা বলাই বাহুল্য। প্রোমোটারের নাম রঞ্জিতলাল দাস। এখন আচরণে রঞ্জিত (ফিল্মের), চোখ লাল, আর কার দাস সেটা জানি না।

উল্কাসম উত্থান। রিক্সার সামনের সিট থেকে স্করপিওর পিছনের সিট - চার বছরের মধ্যে বড় কম কথা নয়। তা ওঁর অফিস ঘরে ঢুকলাম, বিনবিনে ঠাণ্ডার ঝিরিঝিরি হাওয়া। উনি টেবিলের অন্য দিকে বসে, মোবাইলে কারও সাথে কথা বলছেন। দালাল আর আমি যে বসে রয়েছি সেটা উনি দেখতেই পাচ্ছেন না, থেকে থেকে দালালের দিকে হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আর একটু সময় লাগবে কথা শেষ হতে। আর দালাল সেটা আমার দিকে তাকিয়ে ট্রন্সলেট করে দিচ্ছেন একটা গালফোলা চোখ বোজা হাসি দিয়ে।

খোকাকে পেটি করে, নাকি পেটিকে খোকা করে, কার কাছে বুধবার দুপুরের মধ্যে পাঠানোর ব্যাপারটা যখন শেষ করলেন ততক্ষণে প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন, “কিছু মনে করবেন না, এদের এত খাঁই বেড়ে গেছে না আমাদের আর কিছু করে খেতে দেবে না।”

আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না যে এই 'এরা'টা কারা, শুধু ঘাড় নাড়লাম। উনি দালালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের কোন প্রোজেক্টটা দেখালি দাদা কে?”

দালালের মুখ উঠে গেল আওয়াজ এল, “কঁআঁলবঙোঁনি”

“এক লাথি মেরে খোমা বিলা করে দেবো, মুখ থেকে মশলা ফ্যাল।” রঞ্জিতের মুখ থেকে চাবুকের মত বেরল কথাটা।

দালাল হাঁকপাঁক করে উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে দেওয়ালের কোণ নোংরা করে ফিরে এল।

রঞ্জিতের সতর্ক বাণী শোনা গেল - “মায়ের নাম মুখে আনার সময় মুখে যেন কোনও নেশার জিনিস না থাকে, থাকলে আগে মুখ খালি কর, পরে উচ্চারণ কর।”

ভাবলাম, ভক্তি হো তো অ্যায়সা। মনটা ভোরে গেল বলে মনে হলো।

দালাল বলল, “ভুল হয়ে গেছে দাদা, কিছু মনে কোরো না।”

এবার আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল রঞ্জিত, “তা কোন ফ্লোর পচ্ছন্দ হল দাদা?” 

আমি বললাম, “থার্ড, সাউথ ইস্ট টা।”

সাথে সাথে টেবিলের সামনের দিকে ঝুঁকে পরে প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “জন্মতারিখটা?”

আমি থতমত খেয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “মানে?”

এবারে অধৈর্য হয়ে আবার ফিসফিসালো, “আরে বাবা যার নামে রেজিস্ট্রী হবে তার জন্মতারিখটা কী?”

আমি বুঝতে পেরে বললাম, “১৯ শে এপ্রিল ১৯৬৪।”

স্যাট করে ল্যাপটপের ঢাকনা খুলে গেল। হুমড়ী খেয়ে হিসেব শুরু হলো, “উনিশ মানে দশ, দশ মানে এক, চার মানে চার মানে চার আর একে পাঁচ, নয় আর একে দশ মানে এক, মানে ছয় আর একে সাত, মানে সাত আর চারে এগার মানে একে একে দুই মানে পাঁচ আর দুয়ে সাত, ইসসস!! জল!”

দালাল টেবিল থেকে জলের গেলাস এগিয়ে দিল। রঞ্জিতলাল তার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বলল, “অগ্নি।” দালাল এবার লাইটার এগিয়ে দিল। তার পরে যেটা শোনা গেল সেটা লিখতে সাহস হলো না। দালাল আর আমি দুজনেই একটু পিছিয়ে বসলাম। 

ফট করে মোবাইলের গা ঘষা শুরু হয়ে গেল। তিনি আবার কানে উঠলেন,

 “বাবা?” রঞ্জিত লাল গলাকে মাখনে চুবিয়ে ফোনস্থ করলেন– “হ্যাঁ আমি! পাতঃ পোণাম নেবেন!”(বাবা! এখন তো বিকেল সাড়ে পাঁচটা!)
 “একটা পোসনো বাবা। না না একটাই, পায়ে পড়ি বাবা ফেরাবেন না একজনের জীবন বাঁচনের পোসনো বাবা! হ্যাঁ আমার সামনে বয়ে আছেন, খুব ভালো লোক, হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা মাথায় কাঁচা পাকা চুল- না না বাবা সাধারণ হাইট, ঊঃ আপনি কী বাবা সব দেখতে পান? হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়ী কিনতে চাইছেন? না মানে ফ্ল্যাট আর কী! সে তো বাবা একই হলো।”

আমার দিকে হাত উঠল অভয় হস্ত- “বাবা আপনাকে দেখতে পাচ্ছেন! হ্যাঁ আপনাকে!”

দালাল হাসল আমার দিকে তাকিয়ে, মানে আপনার তো হয়েই গেছে, আর কী!

এবার আমার চমকানোর পালা। খানিক আমার জামার দিকে তাকিয়ে বললেন- “হ্যাঁ বাবা যা বলেছেন ঠিক তাই সাদাটে রঙের জামা, সাদা গেঞ্জী। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা।
- না না কী করে জিজ্ঞাসা করি বাবা? ওঁর ডান দিকের পাছার নীচের দিকে লাল তিল আছে কিনা সেটা আমি কী করে ওঁকে জিজ্ঞাসা করব? আমার লজ্জা করবে, ওঁরও লজ্জা করবে বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। দয়া করে। 
- পাছার আড়াআড়ি কাটা দাগ? থাকতেই হবে? কিন্তু আমি...
- হ্যাঁ এটা দেখা যেতেই পারে।”

এবার আমার গলা শুকনোর পালা অফিসের মাঝখানে প্যান্ট খুলে দেখবে না কী রে বাবা? আর আমার পাছায় কী দাগ আছে তার সাথে আমার ফ্ল্যাট কেনার কী সম্পর্ক? না আসলেই হতো। দালালের দিকে তাকালাম সে ব্যাটাও ভড়কেছে, ভাবছে পার্টির পাছা দেখতে চাইলে তো পার্টিও পাছা দেখাতে পারে। আমাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু এবার বুঝলাম ওঁর নিজেরও কনফিডেন্সে ঝাড় নেমেছে।

রঞ্জিত লাল দাস আমায় প্রশ্ন করল- “আচ্ছা আপনার বাঁদিকের ডানার কাছে একটা জন্ম দাগ আছে?”

আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- “আমার ডানা?”

রঞ্জিত লাল একটু অধৈর্য হয়ে বললেন- “আরে বাবা পিঠের দিকে, বাঁ কাঁধের একটু নীচের দিকে।”

আমি হতাশ হয়ে ঘাড় নাড়লাম, জানি না, জানা আমার পক্ষে সম্ভবও না। দালাল ভাবল ট্রাই নেবে কিনা।

এবারে রঞ্জিত লাল যেটা বলল, সেটা শুনে আমি একগাল মাছি- “শুনুন বাবা বললেন আপনি জলের জাতক। আপনার পক্ষে অগ্নি কোণের উপস্থিতি হানিকারক। এই ফ্ল্যাট আপনি আপনার নামে বুক করালে আপনার সমূহ ধনহানির সম্ভাবনা।”

আমি ভাবলাম কথাটা তো ঠিক, আমি ফ্ল্যাট পাবো আমার লাখ দশেক চলে যাবে। কিন্তু সেটা তো হানি নয়। কি জানি বাবা কী সব বলছে।

রঞ্জিত আমায় আশ্বস্ত করার জন্যে বলল- “আপনি বরং নর্থ ইস্টটা নিয়ে নিন। ভগবানের দিক, সব থেকে ভাল। তাই না?”

দালালও সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। কিন্তু আমার খটকা গেল না, ছোটবেলায় শুনতাম পুব-দক্ষিণ খোলা বাড়ী নাকী খুব ভালো হয়। কিন্তু এতো জল হাওয়া আগুন কী সব বলে ঘুলিয়ে দিচ্ছে। কোনও মতলব নেই তো। আমার তো বাবা ব্যাঙের আধুলি। মন তো কু গাইবেই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম- “ওটা কত করে পড়বে?”

রঞ্জিত আমার স্বস্তিকে আরও বাড়ানোর জন্যে বলে চলল- “সে আপনি চিন্তা করবেন না, এটার থেকে কমই পড়বে। ধরুন না কেন ওটা ছিল ৫৯০ এটা ৬১০ আর ৩০% সুপার বিল্ট, মানে গিয়ে দাঁড়াল..”

এবার আমি বললাম- “আমাকে মোট কত দিতে হবে, আর কবে পজেসন পাবো, আর কবে রেজিস্ট্রি?”

- “সে আপনি কিচ্ছুটি চিন্তা করবেন না। রেজিস্ট্রির দিন তো বাবাই আমাদের জানিয়ে দেবেন। আর ধরুন না ডাউন, আপনি কবে করতে পারবেন? ব্যাঙ্ক লোনের ব্যাপার থাকবে তো? সেটা আমরাই করিয়ে দেব। সব ফরেন ব্যাঙ্ক। ঝট ডকুমেনটেসন পট স্যাংসান। আর তারপরেই পজেসান। হয়েই গেল। আপনি শুধু ডাউনপেমেন্টটা ক্যাশে করবেন, ঠিকাছে?”

বুঝলাম ফাঁদের মুখ খুলে গেল। মাথা নাড়লাম। আমি বললাম- “আমার একটা আর্জি আছে।”

রঞ্জিত লালের চোখ এবার একটু যেন লাল হলো। গলা মাখন– “কী দাদা?”

“ আমি আপনার বাবাকে একটু দেখতে চাই।” -এবার আমিই মাখন ছাড়লাম। যিনি শুধু টেলিফোনেই আমার পাছার তিল অবধি দেখতে পান তিনি যে খুব বড় মাপের যোগী তাতে আমার সন্দেহ নেই; আর আমার সেই ছোট বেলা থেকে সাধু সঙ্গ করার শখ, যদি আপনি..” 

“আপনি কবে যাবেন শুধু বলুন দাদা” রঞ্জিত লালের ছিপি খুলে গেল: 
“কী বলব দাদা ভগবান, ভগবান। আমার তো জিন্দেগী পালটে দিলেন উনিই। কী ছিলাম আজ থেকে চার বছর আগে আর আজ ওঁর আশীর্বাদে কোথায় পৌঁছেছি। সবই ওঁর দয়া। চলুন আজই চলুন, এখনই চলুন।”

দালালের দিকে তাকালাম, উনি চোখের ইশারাতে বোঝালেন যে আমার ভালো সময় এসে গেছে, বাবা ডাকছেন। স্করপিও বেরল আমি বাবা দর্শনে চললাম। দাদার হাত ধরে।



ছোটবেলায় মানে যখন আমি ক্লাস ইলেভেন ফাইনাল দিই সেই সময় আমি আমার ছোটমামার এক বন্ধু সন্তোষমামার কাছে থেকে ভেন্ট্রিলোকিজম শিখেছিলাম। মাঝে মাঝে এখনও অফিসে বা বন্ধুদের আড্ডায় সেটা নিয়ে ফাজলামি করি। আর বৌয়ের সাথে ঝগড়ায় যখন দেখি একেবারে হার অবধারিত তখন ওটার প্রয়োগ করে খেলা ঘুরিয়ে দিই। কিন্তু এটা তো বাইরের ব্যাপার। 

তবে ভিতরে আর একটা গল্পও আছে। আমি যখন এই বিদ্যা শিখেছি সেই সময় আমাদের পাড়ার নিতাই তারাপীঠের কোন এক সাধুর কাছ থেকে তন্ত্র বিদ্যা আয়ত্ব করার ফিকিরে পাড়া ছাড়া হয়েছে। চালাত রিক্সা, হতে চলল তান্ত্রিক। বছর খানিক বাদে যখন ফিরল তখন আবার রিক্সাচালানই শুরু করল নতুন করে।

যোগী নিতাইয়ের শুধুমাত্র ভূতের ভয়টা যোগ হয়েছিল। মদ টদ খেত, কিন্তু খুব একটা বেশী কিছু নয়। তবে খাবার আগে যা নাটক করত, সেটা দেখবার জন্যে অনেকে ওকে মদ খাওয়াতে ডাকত। নিতাই আমাকে নেশা না করা অবস্থায় বলেছিল যে, তান্ত্রিকদের নাকি মিনিমাম দুটো ভূতকে কব্জা করে রাখতে হয়। না হলে না কি ব্যাপারটার মধ্যে ঠিক ভাব আসে না। আর ওর যিনি গুরুদেব ছিলেন ‘সর্বাহারি বাবা’ তাঁর কব্জায় নাকি ৭৫১টা ভূত আছে, আর উনি সেটাকে ১০০০ করে তবে না কি থামবেন। সেই গুরুদেব নিতাইকে বলেছিলেন যে এদিক সেদিক থেকে দু একটা ভূত উনি জোগাড় করে দেবেন নিতাইকে। কিন্তু সেখানেই নাকি ক্যাঁচালটা বেধে যায়। উনি ওঁর নিজের ৭৫১টার থেকে দুটোকে নাকি নিতাই এর খিদমৎ খাটতে পাঠিয়েছিলেন; তা বাঘা তান্ত্রিকের খিদমৎ খাটা ভূত, সে যদি দেখে যে তার মালিক নিতান্তই এক জোলো তান্ত্রিক, তাকে মানবে? সে দুটোই নাকি নিতাইয়ের বগল ফস্কে বেরিয়ে গেছিল, আর শুধু গেছিল না নিতাইয়ের জানের দুশমন হয়ে উঠেছিল সে দুটো।

তাদের ভয়ে নিতাই শুধু তারাপীঠ ছাড়েনি, রাতে রিক্সা চালানো অবধি ছেড়ে দিয়েছিল। বড় জোর রাত নটা। ব্যাস তারপরেই নিতাই হাওয়া। বেশী পয়সা দিলেও স্টেশনের থেকে খুব বেশী দূরে যাবে না। সমস্ত গঙ্গার ধারটাই নাকি সন্ধ্যার পর থেকে ভূতেদের দখলে চলে যায়, তাই সেখানেও যাবে না। তা শীতকালের রাতে এক বিয়েবাড়ী খেয়ে আমি আর আমার বন্ধু বুড়ো হাটের দিক থেকে ফিরছি দেখি নিতাই রিক্সা চালিয়ে কোথা থেকে ফিরছে। মুখচোখে ভয়। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে রিক্সা চালাচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল। বলল,
“ওঠো ওঠো তোমরা স্টেশনের দিকে ফিরবে তো?”

আমরা বললাম, “পয়সা নেই কিন্তু।”

নিতাই বলল- “চেয়েছি? আগে গাড়ীতে ওঠো, তান্ত্রিক যোগীণীর “ভ্রুং ফট স্বহা” হয়েছে। যেখানে যত খোলা ভূত পিচাশ আছে তাদের সাথে আজ তান্ত্রিকদের লড়াই। তারাও তাদের ভাই ভাতিজাদের ছাড়িয়ে নিতে আসবে, আর তান্ত্রিকরাও তাদের বাঁধবার চেষ্টা করবে। সে মহাকালে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে।”

“ভ্রুং ফট স্বহা” ব্যাপারটা যে কী আর তান্ত্রিক যোগীনীই বা কে তা বুঝলাম না। কিন্তু বুঝলাম নিতাইয়ের আজকের ভয়টা অন্যদিনের ভয়ের চেয়ে অনেক বেশী। দাঁতের কত্তাল শোনা যাচ্ছিল। শীতে না ভূতে বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে হলো দিই ব্যাটাকে আরও ভয় পাইয়ে। গলা পালটে দুবার খালি “নিঁতাই নিঁতাই” বলে ডাকলাম। ব্যাস খেলা শুরু। নিতাই হঠাৎ রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্রাণপণে দৌড় লাগাল। সে যে কী দৌড় বলে বোঝাতে পারব না। আমি বুড়ো দুজনে পিছন থেকে ডেকে হয়রান। সে পগারপার। এইবার বুড়ো গেল খচে। 
বলল- “পিঁয়াজিটা মারার সময় একটু ভেবে মার। শালা জ্ঞানগম্যি কি বাজারে বেচে দিয়েছিস? আহাম্মোক কাঁহিকা। বেশ খেয়েদেয়ে বিনি পয়সায় ফিরছিলাম। দিলি সেটাকে চুলকে ঘা করে। এখন মাঝরাতে ভরাপেটে টান রিক্সা।”

আমি বুঝলাম সত্যি কেস খারাপ হয়ে গেছে। কী আর করা, মাঝরাত নয় মাত্র নটা সোয়া নটা হবে। আমি আর বুড়ো নিতাইয়ের রিক্সাটা টানতে টানতে নিয়ে চললাম। ফেলে রেখে তো আর যেতে পারিনা, যদি কেউ চুরি করে নেয়। আর মাইরি রিক্সা কি বেয়াক্কেলে জিনিস, একবার ডানদিকে টাল খেয়ে পালায়, তো একবার বাঁদিকে। যাই হোক, অনেকটা যাবার পরে দেখি নিতাই একটা বাড়ীর সামনের রোয়াকের উপর উঠে আমরা যেদিক থেকে আসছিলাম সেদিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় আমাদেরই খুঁজছে। আমাদের দেখে দৌড়ে এলো। বুড়ো সুযোগের সদব্যবহার করল।

নিতাইকে বলল- “তুই পালিয়ে এলি?”

নিতাই ভীত মুখে বলল- “কী করব, দেখলে তো কেমন নিশি লেলিয়ে দিয়েছিল পিছনে। ঐ দুটো ভূতেরই কাজ হবে। আর একবার ডাকত; ব্যাস তার পরে দুটো ডাবের খোলা মুখোমুখি ফট করে বন্ধ করে দিত আর আমার আত্মা ঐ ডাবের ভিতর। জম্মের জন্য ওদের দাস করে রাখত। মাথায় করে গু বওয়াত। বাবারে, খুব বাঁচা বেঁচেছি।”

বুড়ো বলল- “বাবা ভোলানাথ হচ্ছেন সব ভূতেদের বাবা, মানিস?”

নিতাই মাথা নাড়ল।

- “ বাবা ভোলানাথ কী জাত জানিস?”

নিতাই বলল- “ না তো।”

বুড়ো গম্ভীর মুখে বলল- “বামভোন।”

নিতাইয়ের অবাক জিজ্ঞসা- “বামভোন?”

এবার বুড়ো মাথা নাড়ল।

- “আর মন্দিরে আমাদের পুজো কে দিয়ে দেয় বাবা ভোলানাথের কাছে?”

নিতাই জিজ্ঞাসা করল- “কে?”

বুড়ো উত্তর দিল- “পুরুত বামুন। তাকে ছাড়া কোনও কাজ হয় সমাজে?”

নিতাই মাথা নাড়ল।

- “তেমনি ভূতেদের পুরুত কে জানিস, যে বা যারা বাবা ভোলানাথের পুজুরী?”

- “কে?”

- “বেম্মোদত্যি, তাকে ছাড়া ভূত সমাজে কোনও কাজ হবে না। আর ও কী জাত জানিস?”

বলে আমাকে দেখাল।

নিতাই মাথা নাড়ল।

বুড়ো বোঝাল ওকে- “ওরা হলো বামভোন। ওর দাদু মরে বেম্মোদত্যি হয়েছে। আজ যখন নিশি লেলিয়ে দিয়েছিল তোর পিছনে, তখন ওর দাদুও ছিল ওখানে। উনি দেখলেন নাতি রয়েছে ওখানে, সব ভূত ফুতকে ভাগিয়ে দিলেন। আমাদের দেখা দিলেন। বললেন, এখন থেকে সব সময় নাতির সাথে থাকবেন। আর পাহারা দেবেন। বুঝলি কিছু?”

নিতাই কি বুঝল কে জানে, আমায় এগিয়ে এসে প্রণাম করল। বুড়োকেও করল। তারপরে ও বেশ ভক্তি শ্রদ্ধা করত আমাকে। ভাড়া টাড়া নিতে চাইত না। তারপরে আবার শুনি তারাপীঠ চলে গেছে তন্ত্র সাধনা করতে। 



এই পর্যন্ত শুনে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে প্রোমোটারের সেই গুরুদেব হলো নিতাই, তবে ভুল ভেবেছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রোমোটারি করে যাঁরা খান তাঁরা অত বোকা নন। যার দুটো ভূত সামলানোর সাধ্যি নেই, সে এই ভূতের যজ্ঞি সামলাবে কী করে? অত সস্তা? গিয়ে দেখি নিতাই ওখানে চা জল দেয়টেয়, কিন্তু তান্ত্রিকের বেশেই আছে। ওর গুরুদেব “সর্বাহারী বাবা”র যিনি গুরু সেই পিশাচসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” হলেন আমাদের রঞ্জিত লালের বাবা। রঞ্জিত লাল তো গিয়ে পায়ে ঝাঁপাল। আমি প্রণাম করতে গিয়ে দেখি পাশে রাখা রিবক দুটোর মাপ দুরকম: ৭ আর ৮।

রঞ্জিত লাল আমাকে আলাপ করিয়ে দিল- “বাবা ফোনে আপনার “ডেডিকেশান” শুনে উনি আর থাকতে পারেননি, আপনাকে দেখতে এসেছেন। আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছেন।”

নিমাই তখন নিমাইবাবা হয়েছে বোধ হয়, মাঝখানে বলে উঠল- “বাবা আমি ওঁকে চিনি, ওঁরও বোমভোদোত্তি বশে আছে। বামুন তো।”

পিচাশসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” একটু থমকাল, রঞ্জিত লালও তাই।

পিচাশসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” বলল- “তাই বুঝি? তা কী করে বুঝব যে বোমভোদোত্তি তোমার বশে?”

- “কোঁর দুঁপাঁয়েঁর জুঁকোঁর দুঁ মাঁপ শাঁক আঁরঁ আঁক। কোঁঙরেঁ শ্বেঁকী আঁখেঁ। ডাংপাঁঙের বুঁওঁ আঁঙুলে ওঁখকুনি”।

পুব দক্ষিণের কথাটা ভুল নয়। আর লোক ঠকাতে বসলে আস্তিনে কয়েকটা বেশী তাস রাখতে হয়, সেটা বোধহয় অনেকের খেয়াল থাকে না। বা রাখে না। ভেন্ট্রিলোকিজম আজকাল হয়ত হয়না সেই রকমভাবে। কিন্তু একজন বছর ৬০ বা ৬৫ র লোক সেটার সম্পর্কে কিছুই না জেনে কী করে ওত ভূত কব্জা করেছিল কে জানে?


0 comments: