3

অণুগল্প - অনুষ্টুপ শেঠ

Posted in


অণুগল্প


নেশা
অনুষ্টুপ শেঠ

কাপে চুমুক দিয়ে ‘উফ্‌ফ্‌’ করে উঠল সানাই। বাণীমাসি আবার চিনি দিতে ভুলেছে। অর্দ্ধেক দিনই ভুলে যায়, বয়েস হচ্ছে বটে! সামনে রাখা বইপত্তরের ডাঁই ঠেলে আবার খাট থেকে নামতেও ইচ্ছে করছে না। ধুৎ! ভারি তো চা! না খেলেই বা কি!

জ্বলজ্বলে চোখে ব্যাপারটা বিভু লক্ষ্য করল। লক্ষ্য করল তার অভ্যস্ত প্রিয় জায়গা, বইয়ের আলমারির পাশের খাঁজে গুটিসুটি বসে থেকে। সানাইয়ের বন্ধু মিতালি এটা দেখলেই বলে ‘ধ্যানস্থ বিভু’। ভুল বলে না। ল্যাজের ডগাটুকুও নড়ে না বিভুর। এমনকি ঘাড়ও ঘোরায় না, খালি সবুজ চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মেপে যায়।

সানাইয়ের কলেজ ছুটি আজ। কিন্তু বাড়িতে বলেনি সেটা, বন্ধুরা মিলে সিনেমা যাবার প্ল্যান আছে। আজ মার কি যেন তুতো দিদির নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন আছে দুপুরে। কলেজ ছুটি জানতে পারলেই মা ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে। সুতরাং ঠিক পৌনে দশটায় রোজকার মতো হালকা সেজে সানাই বেরিয়ে পড়ে - ইশ্ আজ টুটুল আসতে পারে, অথচ বেশি মাঞ্জাও দেওয়া যাবে না। কলেজে বেশি সাজ দেখলেই ভদ্রমহিলা উকিলে জেরা শুরু করবেন। যাকগে, জিনস টি শার্টে ওকে ভালই মানায়।

সানাইয়ের মা দুপুরে পরার শাড়ি বাছতে বাছতে একটা ছোট্ট শান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে যে আবার এমন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে ভাবতেই পারতেন না তখন - ঐ গত বছরের কাণ্ডটার পর। এযুগের ছেলেমেয়ে হয়েও যে এরা এত অবিবেচক ইমোশনাল - কে জানত! না হয় তাঁরা নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির অপুষ্টিতে ভোগা কৌশিক নামের ছেলেটিকে নিয়ে আপত্তিই করেছিলেন, না হয় খুবই রাগারাগি করেছিলেন, তা বলে দুজনে মিলে ট্রেনলাইনে ঝাঁপ দিতে যাবে? কি ভাগ্যিস মেয়ের শেষ মুহূর্তে নার্ভ ফেল করেছিল! ছেলেটা গোঁয়ার ছিল, ফিরেও দেখেনি, থামেওনি।

তারপর কি যে আতঙ্কে কাটিয়েছেন, স্তব্ধ পাথর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে। কি ভাগ্যিস ঐ বন্ধুদের দলটা ছিল। আর কি ভাগ্যিস মিতালি কোত্থেকে বিভুকে নিয়ে এল এক সপ্তাহের মাথায়। বিভু প্রথমদিন থেকেই সানাইয়ের ন্যাওটা হয়ে গেছিল। গাবলুগুবলু বাদামি বেড়ালটাকে মিতালি সানাইয়ের কোলে ফেলে দিতেই সে যা মুগ্ধ চোখে সানাইয়ের দিকে চেয়ে ছিল, ভাবলে এখনও হাসি পায় আরতিদেবীর। বহুদিন পর সানাইও হেসে ফেলেছিল। না, সত্যি, বন্ধুগুলো আর বেড়ালটা মিলে ভোল পালটে দিয়েছে মেয়ের। 
আগের মত সহজ, চঞ্চল, হাসিখুশি হয়ে উঠেছে আবার।

আগের চেয়েও বেশি, আজকাল মনে হয়! তবে সে হয়তো ঐ নতুন ছেলেটি, টুটুল না কি নাম, আসার পর থেকে। মুচকি হাসেন আরতিদেবী, মার চোখ বলে কথা, নিজের মেয়েকে চিনবেন না!

সুর তুলে দশটা বাজল বসার ঘরের ঘড়িতে। আরতিদেবী স্নান করতে ঢুকলেন।

বিভু উঠে দাঁড়াল। পড়ে থাকা চায়ের কাপের দিকে গুটিগুটি পায় এগোল। 

মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল, প্রায় পুরোটাই পড়ে আছে আজ। কাপের ওপর বিভুর সবুজ চোখ দুটো স্থির হলো। কাপের মধ্যে সে চোখের ছায়ার মধ্যে আঁকিবুকি কেটে ভেসে ওঠে সানাইয়ের চোখজোড়া, আর্ত, আতঙ্কিত, সানাইয়ের গলায় সেই ছায়া বলে ওঠে, “ছেড়ে দে কৌশিক... ছেড়ে দে... খুব কষ্ট... আমায় রেহাই দে এবার প্লিজ”।

সিনেমাহলের অন্ধকারে, সানাইয়ের বন্ধুরা টেরও পায় না হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সানাইয়ের শরীরটা কেমন স্থির পাথর হয়ে যায়, দেখতে পায় না বন্ধ চোখের আড়ালে মণির অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটাও।

“বেড়ালটার কি যে নেশা হইচে, রোজ খুকির চায়ের তলানিটা চেটেপুটে খাবে! আমি রোজ এই বেড়ালের এঁটো মাজব নাকি!” গজগজ করে বাণীমাসি কাপটা নিয়ে যেতে যেতে।

বিভু নিজের প্রিয় জায়গায় ফিরে গেছে ততক্ষণে।


3 comments:

  1. সাত সক্কালে গা ছমছম, শীতের ভোরে লেপ টেনে নিয়ে ঘুম দেওয়ার মতো করে পড়লাম। এবার চাই এক কাপ চা .... আচ্ছা না থাক, কাপ লাগবে না, মাটির ভাঁড়েই চলবে। ইউজ অ্যান্ড থ্রো-ই ভালো

    ReplyDelete
  2. সাত সক্কালে গা ছমছম, শীতের ভোরে লেপ টেনে নিয়ে ঘুম দেওয়ার মতো করে পড়লাম। এবার চাই এক কাপ চা .... আচ্ছা না থাক, কাপ লাগবে না, মাটির ভাঁড়েই চলবে। ইউজ অ্যান্ড থ্রো-ই ভালো

    ReplyDelete