14

ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


ধারাবাহিক


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক



। ৭ ।



বাদশাহী শাসনে যেখানে দণ্ডমুণ্ডের একচ্ছত্র কর্তা ছিলেন দিল্লীশ্বর, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তা দ্রুত ক্ষীণ হতে হতে একেবারে প্রায় মিলিয়ে গেল। মুর্শিদকুলি খাঁর সময়েই বাংলার নবাব পরাক্রমশালী হয়ে উঠলেন। আলিবর্দী খাঁ দিল্লীর সম্রাটকে বিশেষ পাত্তাই দিতেন না। বছরের রাজস্ব কোনও রকমে নমো নমো করে পাঠিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ।

বাংলায় নবাবরা অবশ্য অনেকদিন ধরেই শাসন করছেন, কিন্তু এই বারফট্টাই তাদের ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় ছোট ছোট ভুঁইঞারা যথেষ্ট শক্তিধর ছিলেন – তাদের অনেকেই হিন্দু – তারা সুদূর দিল্লীর মুসলমান সম্রাটকে দেশের মালিক বলে মানতেন না। এমনকি মহা-শক্তিশালী আকবরের সময়েও তাদের বশ করতে ঘাম ছুটে গেছে দিল্লীর, মানসিংহের মত বীর সেনাপতিকে একাধিকবার আসতে হয়েছিল বাংলা জয় করতে। ভুঁইঞারা বহু বছর দিল্লীর আগ্রাসন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, কর দিতেন না। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি না করে একত্রভাবে সম্রাটের সেনাকে মোকাবিলা করলে ইতিহাস অনিবার্যভাবে বদলে যেত।

নবাবের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে বাংলায় সবচেয়ে অসুবিধেয় পড়ে গেল হিন্দু জমিদাররা, যারা নিজেদের রাজা বা মহারাজ বলেই ঘোষণা করতেন। এ রকম মহারাজা ছিলেন বর্ধমানে, বীরভূমে, বিষ্ণুপুরে, দিনাজপুরে, নাটোরে আর নদীয়ায়। রাজারা তাঁদের এলাকায় কর সংগ্রহ করে নবাবের ঝুলিতে দিতেন নবাব যেমন দাবি করতেন, নবাব সেই ঝুলি থেকে দিল্লীতে পাঠাতেন দিল্লীর দাবি অনুযায়ী। আকবরের সময় তোডরমল বাংলায় এই করের নিয়মনীতি বেঁধে দিয়ে গেছিলেন। মুর্শিদকুলি নিজের আয় বাড়ানোর জন্যে কর সংগ্রহ প্রথার কিছু পরিবর্তন করলেন, বসালেন নতুন নতুন ট্যাক্স। আলিবর্দীর আমলেও চলতে লাগল সেই প্রথা। আলিবর্দী যদিও সহনশীল ছিলেন, জমিদারদের সাথে বিরোধে যেতেন না কেননা ওরা বিগড়ে গেলে তো মুশকিল, এমনিতেই বর্গীদের হাঙ্গামা দমনে তার জীবন ব্যতিব্যস্ত, তবু কর প্রচুর বাকি পড়ে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন বৈকি। বারো লক্ষ টাকা কর অনাদায়ে কৃষ্ণচন্দ্রকেই জেলে পুরে দিয়েছিলেন, কয়েকদিন মুর্শিদাবাদের কারাগারে কাটাতে হয়েছিল তাঁকেও।

পলাশির যুদ্ধের পর সেসব অতীত হয়ে গেল। নবাব নামে একজন বসে বটে একটা চকমকে সিংহাসনে, তার না আছে ট্যাঁকের জোর, না আছে দাপট। পেছন থেকে ছড়ি ঘোরায় শ্বেতচর্ম ইংরেজরা। নবাবকে যত হীনবল করে দেয় তারা, তত বাড়ে তাদের প্রতিপত্তি। এতদিন যারা নবাবকে খুশি করতে জান লড়িয়ে দিয়েছে, এখন তারা ইংরেজদের প্রসাদ পেতে ছোঁকছোঁক করতে থাকে।

নবাবীর অধঃপতনে হিন্দু রাজাদের একাংশ বেশ খুশি। অর্থের প্রতিপত্তির সূত্র তো দুজনেরই একই – গরীব জনসাধারণের কাছ থেকে নেওয়া কর। এমন তো নয় যে নবাবের বিশেষ কিছু দৈবশক্তি আছে, যা রাজাদের নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টোই। কৃষ্ণচন্দ্র জ্ঞানী ব্যক্তি, গুণের কদর করেন, তাঁর রাজসভা আলো করে থাকে সমগ্র বঙ্গের বিশেষ গুণী ব্যক্তিবর্গ। রাজা নিয়মিত কাব্যচর্চা করেন, নিজেও লেখেন কবিতা, গান। তিনি হিন্দু-সমাজের অবিসংবাদিত নেতা, অথচ তাঁর জাঁকজমক নবাবের তুলনায় ম্লান। নবাবের পোশাক অনেক বেশি ঝলমলে, নবাবের যানবাহনের কেতাই আলাদা, নবাবের প্রাসাদের কাছে রাজার প্রাসাদ পাত্তা পায় না। তার কারণও আছে। নবাব যদি জানতে পারেন কোনও রাজা অতিরিক্ত স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে, আমোদ আহ্লাদে গা ভাসাচ্ছে, খুব জাঁক করে অনুষ্ঠান করছে প্রকাশ্যে, সেই রাজার কাছে দুদিন বাদেই চলে আসে অতিরিক্ত কর-দানের নোটিশ। এই মাশুল গুণতে কার ভাল লাগে? 

তবে সে সব দিন বুঝি শেষ হয়ে এল। এখন নবাব যেন নেংটি ইঁদুর। আর ইংরেজরা, অন্তত এখনও অবধি রাজাদের সঙ্গে বেশ ভাল ব্যবহার করে চলেছে। রাজারা সাথ না দিলে কি আর ওদের যুদ্ধ জেতার মুরোদ ছিল ঐ কটা সেনা নিয়ে? এবার একটু দিল খুলে আনন্দ-ফুর্তি করা যেতে পারে।

দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রকে ডেকে একদিন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, কাত্তিক, ভাল্লাগচে না। কোনও আমোদ নেই আল্লাদ নেই, কী করা যায় বলো দিকি। ঐ দ্যাখো, চৈতন্যের চ্যালারা ষাঁড়ের মত চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে অষ্টপ্রহর শহর জুড়ে হরেকেষ্ণ হরেকেষ্ণ করচে আর রথের দড়ি টানচে। ওদের আমি দুচক্ষে দেকতে পারিনে। যত সব ভণ্ড নপুংসকের দল হরিনামে জগৎ মাতাচ্চে। এর নাম নাকি প্রেম। প্রেম না হাতি, ওই সব মাকুন্দের ব্যাটারা প্রেমের কী বোঝে? রাজবাড়িতে কিছু একটা ব্যবস্থা লাগাও দিকি।

কার্তিকেয় জানেন শক্তির উপাসক রাজা বৈষ্ণবদের তেমন সুনজরে দেখেন না। আড়াআড়ি নেই কোনও, তবে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় তার অনুভূতি তেমন চাপা থাকে না। বললেন, কেন মহারাজ, এই তো কদিন আগে অন্নদামঙ্গল পাঠ শুনলেন। রসমঞ্জরী পাঠের তাহলে একটা ব্যবস্থা করি।

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, না না, সেসব আর না। বয়েস হয়েছে। তাছাড়া ভারত মারা যাবার পর আমার আর ওসবে রুচি লাগে না। যার সৃষ্টি সেই যখন নেই।

ভারতচন্দ্র মারা গেছে বছর তিনেক হ’ল। বহুমূত্র বড় সাংঘাতিক রোগ, মানুষকে বড় দুর্বল করে দেয়। নাহলে কতই বা বয়স হয়েছিল তার? মাত্রই আটচল্লিশ। ওর মত গুণী কবি আর আসবে কি এই বাংলায়?

ভারতের শেষ জীবন বড় সুখের ছিল না। মহারাজ তাকে মূলাজোড় গ্রাম দান করলেন, সে সেখানে বসতিও করছিল। বর্গী হাঙ্গামায় বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দ্রের মা নিজের দেশ ছেড়ে উঠলেন এই মূলাজোড়ের পাশের গ্রাম কাউগাছিতে। মূলাজোড়ে থাকে ভারত, সে ব্রাহ্মণ, তার জমির ফসল যদি রাজমাতার গরু-ছাগলে মুড়িয়ে খায়, তাহলে ব্রহ্মশাপ লাগবে, এই চিন্তা করে রাজমাতা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় দরবার করলেন, মূলাজোড়ের ইজারা তাঁকে দিয়ে দেওয়া হোক। হাজার হোক রাজার মা, তাঁর ইচ্ছা কি ফেরানো যায়? রাজা মঞ্জুর করলেন। রামদেব নাগ নামে এক কর্মচারীকে দিয়ে সেখানে রাজমাতার ঘরদোর বানানো হলো।

ভারত গেল রেগে। তাকে দেওয়া জমি ফেরৎ নেওয়ার মানে কী? সেও ক্ষুব্ধ হয়ে রাজার কাছে নালিশ করলে রাজা তাকে গুস্তে নামে এক গ্রামে জমি দান করলেন। ভারত সেখানে উঠে যাবার তোড়জোড় করছেন, গ্রামবাসীরা এসে চেপে ধরল, তারা ভারতের মত দেশের সুসন্তানকে গ্রাম ছেড়ে যেতে দিতে চায় না। ভারত তাই থেকেই গেল সেখানে। এদিকে হাড়বজ্জাত রামদেব নাগ চায় ভারতকে সেখান থেকে উঠিয়ে দিতে, তার অত্যাচারে ভারতের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। ভারত তো ক্ষত্রিয় নয়, সে যুদ্ধবিগ্রহ অশান্তি করতে জানে না, তার অস্ত্র তার কবিতা। সে নাগাষ্টক নামে একটা কাব্য রচনা করে ফেলল। রাজা নাগাষ্টক পড়েই বুঝলেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। লোক পাঠিয়ে নাগ দমন করে দিলেন তিনি। সেও তো অনেক বছর হয়ে গেল।

এইসব ভাবনাচিন্তার মধ্যে ডুবে ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও কার্তিকেয়চন্দ্র। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, কাত্তিক, আমি অশ্বমেধ যজ্ঞ করি যদি?

কার্তিকেয় বললেন, মহারাজ, এ নিয়ে তো আগেও কথা হয়েছে। পণ্ডিতদের বিধান, কলিকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ নিষিদ্ধ। সেইজন্যেই তো আপনি বাজপেয় যজ্ঞ করলেন সেবার, মনে নেই?

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, তা আর মনে থাকবে না! তবে এখন কী করা যায়? অন্নপুন্না, বারোদোল সব তো সেই চোত মাসে। আর ওসব এক দুদিনের ব্যাপার। আমি এমন কিছু একটা করতে চাই বেশ অনেকদিন ধরে, যা এই বাংলার ঘরে ঘরে চলতে থাকবে। সবাই বলবে, হ্যাঁ, রাজার মত রাজা ছিল এক কৃষ্ণচন্দ্র। তুমি ভাবো না কী করা যায়। ওভাবে সঙের মত মুখ করে বসে আছ কেন? 

কার্তিকেয়চন্দ্র বললেন, তাহলে দুগ্‌গাপুজোটা ভাল করে করা যেতে পারে। অ্যাদ্দিন শিবনিবাসে থাকার দরুণ সে তো তেমন জুত করে করা হয়নি। আগের মহারাজরা শুনেছিলাম বেশ ধূমধাম করে মা দুর্গার পুজো করতেন কেষ্টনগরের রাজবাড়িতে। আপনারই পূর্বপুরুষ মহারাজ ভবানন্দ সম্রাট আকবরের আমলে দুর্গাপুজো করেছিলেন। তারপর আপনার ঠাকুদ্দার বাবা মহারাজ রুদ্র রায় এই কেষ্টনগরের রাজবাড়িতেই দুর্গাপুজোর চল করেছিলেন। আমরাও তো বেশ ক’বছর ধরে করেছি। বর্গি হাঙ্গামায় শিবনিবাস চলে যেতে না হলে এখানে আমরাও এত বছর ধরে জাঁক করেই সেই পুজো করতাম নির্ঘাৎ। ভারতও ও লিখে গেছে সে কথা –

আশ্বিনে এ দেশে দুর্গাপ্রতিমা প্রচার।
কে জানে তোমার দেশে উহার সঞ্চার।।
নদে শান্তিপুর হৈতে খেঁড়ু আনাইব।
নতুন নতুন ঠাটে খেঁড়ু শুনাইব।।

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ও রকম খেঁড়ু-ফেড়ুর জাঁক না হে, তুমি বুঝতে পারছ না, আমি চাইছি বেশ ক’হাজার টাকা খরচা করে একটা এমন জিনিস চালু করতে, যা লোকের রক্তে ঢুকে যাবে। শুধু খেউড় দিয়ে কী হবে, দ্যাকো না কী করি, কলকাতা থেকে নিকিকে নিয়ে আসব একেনে।

কার্তিকেয়চন্দ্র বললেন, মহারাজ নবকৃষ্ণর ওখানে নাচে যে বাঈজি, সেই নিকি?

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই। তার তো দুনিয়াজোড়া নাম। কিন্তু নিকি কি লবোকেষ্ট মুন্সীর বাপের সম্পত্তি নাকি? আমি ডাকলে সুড়সুড় করে আসবে। ভাত ছড়ালে কাগের অভাব হয় না, বুজলে? লবোকেষ্ট ছিল ক্লাইভের মুন্সী, ক্লাইভকে বাংলা শেকাতো, পলাশির যুদ্ধে জিতে ক্লাইভ তাকে রাজা বানিয়েচে। সেই জন্যেই তো সে ক্লাইভ আর তার দলবলের পা চাটতে শোভাবাজারে দুগ্‌গাপুজো কল্লো। মদ-মাগী নিয়ে ফুত্তি কল্লো। কতা হচ্ছে, দুগ্‌গাপুজো কি তেমন করে করা যায়? শাস্তরে কী বলেচে? একটু জিগ্যেস করে নাও না শাস্ত্রকারদের। বসে বসে মাইনে খাচ্চে, শাস্তরের পাতাটাতাগুলো একটু উল্টাক। করা গেলে আমিই বা করবো না কেন? আমি কি লবোকেষ্টর চেয়ে কমা? দ্যাকো আমাদের রাজবাড়ির এই যে বিশাল নাটমন্দির বানিয়েচি, এখানেই হবে সেই মহোৎসব। সমাজের সব শ্রেণির লোক তাতে যোগ দেবে, হিঁদু-মুসলমান নির্বিশেষে। সবাইকে নিয়ে আমোদ কল্লে তবেই না তার মানে থাকে। পুজো শুধু বড় ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে কেন?

দুদিন বাদেই কার্তিকেয়চন্দ্র খবর নিয়ে এলেন, রাজশাহী জেলার তাহেরপুর গ্রামে রাজা কংসনারায়ণ নাকি কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে দুর্গাপুজো করেছিলেন। পুরো গ্রাম সেই পুজোয় সামিল ছিল, আনন্দ হয়েছিল মাসাধিককাল ধরে। সেই পুজো হয়েছিল নদীয়ারাজ ভবানন্দের আমলেই, তার কাছাকাছি সময়ে সাবর্ণ রায়চৌধুরীরাও তাদের বাড়িতে এই পুজো চালু করেছিল। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, কংসনারায়ণের পুজোর বিধান কী তার খবর পেলে? কেমন করে করা হয়েছিল সেই পুজো?

জানা গেল রাজা কংসনারায়ণের পৌত্র উদয়নারায়ণের সভাপণ্ডিত আচার্য রমেশ শাস্ত্রী দুর্গাপূজার এক বিধি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। রাজশাহী থেকে অবিলম্বে এসে গেল সেই বিধি। তাতে বলা ছিল, শুধু শিলাপাথর নয়, মাটির তৈরী দেবীর মূর্তি গড়ে সেই পুজো হয়েছিল। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, আমরাও তাই করবো। কেষ্টনগরে কি মৃৎশিল্পীর অভাব? আর বাকি যা যা আছে, পণ্ডিতদের বলো, একটু সহজ সরল করে নিক। মানুষের ভিতর কোনও অনুষ্ঠান চালু করতে গেলে অত অং বং চঙের দরকার নেই বাপু, দরকার প্রাণের আলাপ। ডাকো এক পণ্ডিতকে, বলো এই বিধির একটা সহজ সাদাসিধে রূপ দিতে।

কার্তিকেয়চন্দ্র বললেন, ত্রিবেণীর পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে খবর দিই? উনিই এখন এতদাঞ্চলের সেরা পণ্ডিত।

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, কাত্তিক, তোমার কি মাথার ঠিক নেই, না আমার কাজে তুমি বাগড়া দিতে চাও? তুমি জানো না সেই পণ্ডিত আমার মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটিয়ে গেছে? তাকে আমি ডেকে আনবো আবার? এই তোমার বুদ্ধি?

কার্তিকেয় বললেন, না সে তো চুকেবুকে গেছে কবেই।

মানীর মান একবার ভাঙলে তা কি সহজে চুকেবুকে যায়? জগন্নাথের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের বিবাদের কারণটি এইরূপ – মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দীর দেওয়ান রায় রায়ান নন্দকুমারের সঙ্গে জগন্নাথের আলাপ হওয়ার পর নন্দকুমার জগন্নাথকে গুরুর মত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। নবাবের কাছে গুরুর গুণকীর্তন করায় নবাব বললেন, কই আমার এখানে তাঁকে নিয়ে এসো দেখি, কেমন তিনি পণ্ডিত, আমার সভাসদদের প্রশ্নের কেমন উত্তর তিনি দিতে পারেন। নন্দকুমারের ইচ্ছায় জগন্নাথ গেলেন মুর্শিদাবাদ। আলিবর্দীর সভার বিচক্ষণ মুফতি মৌলবীরা হিন্দুধর্মের স্থূলতা নিয়ে যে প্রশ্নই উত্থাপন করেন, জগন্নাথ তাদের বোঝার মত ভাষাতেই তাদের উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দেন তিনি কত বড় পণ্ডিত। সভার অমাত্যগণ এবং সর্বোপরি বৃদ্ধ নবাব অত্যন্ত খুশি হয়ে নবাবি বাংলার সর্বোচ্চ খেতাব ‘বাইশ শিরোপা’ দান করেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে। তিনি সসম্ভ্রমে উপহারের তালিকা থেকে ব্রাহ্মণের অব্যবহার্য হাতি, ঘোড়া, ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করে ঘড়ি, নিশান, ডঙ্কা, পার্সিভাষায় নিজের নাম লেখা মোহর, ইত্যাদি নিয়ে এবং দোতলা বাড়ি বানানোর, শিবিকায় আরোহণের ও নিজগৃহে নহবৎ বসানোর নবাবি অনুমতি গ্রহণ করে ত্রিবেণীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

এর আগে বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দ্র বাহাদুর তাঁর সভাস্থ পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করার জন্য জগন্নাথকে পাণ্ডুয়া পরগণার হেদুয়াপোঁতা গ্রাম, অনেক ব্রহ্মোত্তর জমি ও তিনশো বিঘার পুষ্করিণী দান করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের শিরোপা পাওয়ার পর তাঁর শিষ্যদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে ও তারাও তাঁকে প্রচুর জমিজিরেত ও পুকুর দান করেন। শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে জগন্নাথের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল ঈর্ষণীয়।

নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এসব সম্ভবত জানতেন না। তিনি তাঁর সভাসদ সুকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারকে কোন এক বিশেষ ভাবে থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, বাণেশ্বর, এত যে কবিতা লিকেচ, সবই তো অন্য কারো ভাব থেকেই নেওয়া। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ এসব থেকেই ভাবের ঘরে চুরি করে নিজের বলে চালাচ্চ। এক সপ্তার মদ্যে যদি নতুন ভাবের একখানা কবিতা লিকে আমায় দেকাতে পারো, তো বুজি কেমন তুমি কবি। একশো রূপোর মুদ্রা আর একশো বিঘে জমি পুরস্কার পাবে।

বাণেশ্বর আর কী করেন! ছ’দিন ছ’রাত ভেবে ভেবে কূল না পেয়ে সাত দিনের দিন একটা কবিতা লিখে এনে রাজার হাতে ধরিয়ে বলেন, দেখুন, একেবারে নতুন ভাবের কবিতা। মহারাজ নিজেও কবিতা রচনা করেন, তিনি পড়ে তো খুব খুশি। কিন্তু সত্যিসত্যিই নতুন ভাবের কিনা, তা যাচাই করার জন্যে তিনি কৃষ্ণনগরের যাবতীয় পণ্ডিতকে ডেকে বললেন, দেখুন তো সংস্কৃতে বা প্রাকৃত ভাষায় এমন ভাবের আর কোনও কবিতা আছে কিনা, না কি এটা সত্যিই এক নতুন ভাবের কবিতা। যদি প্রমাণ করতে পারেন এটা অন্য কোনও কবিতার ভাব থেকে চুরি, তবে একশো রৌপ্যমুদ্রা ও একশো বিঘে জমি আপনার। পণ্ডিতরা তো অন্য পণ্ডিতদের জাত মারতে পারলেই খুশি, তার সঙ্গে রাজ-অনুগ্রহ ও পারিতোষিকও জুটবে, এই আনন্দে যাবতীয় পুঁথি ওলটপালট করেও সেই কবিতার ভাবের শ্লোক খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে স্বীকার করলেন, এটা নতুন ভাবের কবিতাই বটে।

বাণেশ্বরের পুরস্কার আর ঠেকায় কে!

কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও তত সহজ মানুষ নন। তিনি যেমন সুন্দরের পূজারী, তেমনি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও নির্মম। বাণেশ্বরকে বললেন, বাণেশ্বর, তুমি তো পুরস্কার পাবেই, আর একটু অপেক্ষা করো। ত্রিবেণীতে এত্তেলা পাঠানো হয়েচে, ওখানকার পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কালঙ্কার নাকি মহাপণ্ডিত। তো সে এসে বলুক যে এটা নতুন ভাবের কবিতা, আমি তোমাকে হাসতে হাসতে লিকে দেবো পুরস্কার।

জগন্নাথ এলেন কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণচন্দ্রের সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, নতুন ভাবের কবিতা লেখা খুবই কঠিন ব্যাপার। ব্যাসদেব-বাল্মীকি তাঁদের মহাকাব্যে ভাবের যে বিন্যাস ঘটিয়েছেন, তার প্রকরণ বিশাল, তার ওপরে কালিদাস-ভবভূতি চাপিয়েছেন জরির কারুকার্য। আপনি শোনান সেই কবিতা, আমি দেখি কেমন তা নতুন ভাব।

রাজা বাণেশ্বরের কবিতা পাঠ করে শোনালেন জগন্নাথকে। জগন্নাথ চুপ করে শুনলেন। তারপর চোখ বুঁজে কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে ধীরে ধীরে আবৃত্তি করলেন –

জগ্‌মে তুম যব আয়া, সব হাসা, তুম রোয়।
অ্যায়সা কাম করো পিছে হাসি না হোয়।।

রাজা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এই রকমই তো বাণেশ্বরের কবিতাটা। এটা কার লেখা?

জগন্নাথ বললেন, এটা মহাত্মা তুলসীদাসের একটা দোঁহা।

বাণেশ্বর পুরস্কারলাভের প্রত্যাশায় এতক্ষণ উজ্জীবিত ছিলেন, জগন্নাথ এই উদ্ধৃতি দিতেই তাঁর মাথা নিচু হয়ে গেল। রাজা বললেন, ছি ছি বাণেশ্বর, এটাও তুমি টুকেচ? বাণেশ্বর লজ্জিত হয়ে কৈফিয়ৎ দিলেন, মহারাজ, আপনি আদেশ করলেন, আমি বহু পরিশ্রমেও নতুন কোনও ভাব খুঁজে বের করতে পারলাম না। তখন চোখে পড়ল এই দোঁহাটা। ভাবলাম, আমাদের দেশীয় পণ্ডিতেরা সবাই সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত, তাঁরা প্রাকৃত ভাষার খবর হয়ত রাখবেন না। এই দুরন্ত মেধাবী মহাপণ্ডিত যে দোঁহাও অভ্যাস করেছেন, তা আমি ক্ষুদ্র মূর্খ ভাবতেই পারিনি।

রাজা জগন্নাথকে প্রত্যাশামত শতমুদ্রা ও শতবিঘা জমি দান করে বললেন, আপনার চণ্ডীপাঠের বৃত্তিটিত্তি আচে?

জগন্নাথ বললেন, না।

রাজা বললেন, তবে আপনার চলে কী করে?

রাজা তো জানেন না জগন্নাথের প্রচুর জমি-জায়গা, পুকুর, অর্থ, দোতালা বাড়ি, প্রচুর শিষ্য। তিনি ভেবেছেন অন্যান্য ব্রাহ্মণদের মতই জগন্নাথও আর এক মেধাবী গরীব ব্রাহ্মণ যার বাড়িতে হয়ত হাঁড়ি চড়ে না।

জগন্নাথ উত্তর দিলেন, বর্ধমানের রাজার দয়ায় আমার কিঞ্চিৎ পারিতোষিক জুটেছে। তাছাড়া শিষ্যদের কল্যাণে আর চুঁচড়ো-ফরাসডাঙার মত জনপদের কাছাকাছি থাকার জন্যে মোটামুটি চলে যায়।

নদীয়ারাজের অহঙ্কারে ঘা লাগলো। তিনি থাকতে তাঁর সামনে বর্ধমানের রাজার প্রশংসা! মনে মনে ক্ষেপে গেলেন। তার ওপর তিনি শুনেছিলেন জগন্নাথ কোনও এক ব্রাহ্মণকে তামা ও তুলসী ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ রকম অশাস্ত্রীয় বিধান দেওয়ার অর্থ কী। জগন্নাথ হেসে বললেন, এতে অশাস্ত্রীয় কিছুই নেই। গড় গড় করে বিষ্ণুপুরাণের শ্লোক উদ্ধৃত করে বললেন, এখানেই তামা তুলসীর বিধান আছে। রাজা তো চৈতন্যদেব ও তাঁর পন্থা একেবারে সহ্য করতে পারেন না। তাই মন্তব্য করলেন, এইসব বুজরুকদের জ্বালায় দেশ অতিষ্ঠ, প্রতারক উন্মার্গগামী মূর্খের দল উন্মত্তের মত খালি খোল পেটায় আর হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ করে নেচে বেড়ায়। জগন্নাথ বললেন, মহারাজ, আমার এতদিন সন্দেহ ছিল চৈতন্যদেব প্রকৃতই ভগবানের অবতার কিনা, আজ সে সন্দেহ দূর হ’ল।

রাজা বললেন, কী করে?

পণ্ডিত বললেন, পুরাণে উদ্ধৃত সমস্ত অবতারেরই এক একজন করে বিদ্বেষী রাজা ছিল। হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যকশিপু, বলি, রাবণ, কংস – কাকে ছেড়ে কার নাম বলি? চৈতন্যের ক্ষেত্রে সে রকম বিদ্বেষী রাজন খুঁজে পাচ্ছিলাম না এতদিন, এইমাত্র পেলাম। তাই আমার আর সন্দেহ রইল না যে চৈতন্য প্রকৃতই ভগবৎ-অবতার।

বলাই বাহুল্য, রাজা এই উত্তরে মোটেও প্রসন্ন হলেন না। 

কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার রাজা হলেও সমগ্র বঙ্গদেশে তিনি মোটামুটি হিন্দু সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর প্রতিপত্তি বিশাল। বস্তুতঃ কর-সংগ্রহে তাঁর পারদর্শিতা ততটা ছিল না, যতটা ছিল ছলে-বলে কোনও হিন্দু ব্যক্তিকে জাতিচ্যুত করা, অথবা জাতিচ্যুত কোনও ব্যক্তিকে পুনরায় হিন্দুসমাজে প্রতিষ্ঠা করায়। এই ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজনেরই ছিল, কৃষ্ণচন্দ্র যার শীর্ষে। আর এ সমস্ত কাজে বেশ দু-পয়সা আয়ও হ’ত। আসলে আয়ের সম্ভাবনা না থাকলে সমাজচ্যুত লোককে তিনি সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতেন না। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই দুনিয়া টাকার বশে। 

একবার ত্রিবেণীর কাছে বিশপাড়া নামে এক গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ কোনও এক অছিলায় জাত খুইয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকল। রাজা দেখলেন একে সমাজে ফিরিয়ে কোনও লাভ নেই, কেননা তাঁর কোষাগারে দেওয়ার মত সেই বামুনের কিছুই নেই, বহুদিন ধরে তাঁর দোরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেও রাজার মন গললো না। বেচারি ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল নিজের গ্রামে। ঘটনাচক্রে সেই ব্রাহ্মণ আবার জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মামার পরিচিত। তার মাধ্যমে খবর পেয়ে জগন্নাথ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। এমনিতেও কৃষ্ণচন্দ্রের অহঙ্কারে তিনি তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন, এখন এই ব্যবহার তাঁকে কুপিত করে তুলল। তিনি ত্রিবেণীর বেশ কিছু পণ্ডিত ও সম্ভান্ত ব্যক্তিকে নিজের গৃহদেবতার পূজায় আমন্ত্রণ করে সেই ব্রাহ্মণের প্রতি কৃষ্ণচন্দ্রের ব্যবহারের কথা ফলাও করে বললেন, শাস্ত্রে তার প্রায়শ্চিত্তের বিধান থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতায় তা করা যায় নি। কৃষ্ণচন্দ্র নিজেকে রাজা বললেও তিনি তো আদতে একজন জমিদারের অধিক কিছু নন, তার জমিদারিও গঙ্গার অন্য পাড় অবধি। তিনি অর্থলোলুপ, নিরপেক্ষ কাজ কাকে বলে জানেন না, কাজেই সমাজের মুখ্য ব্যাপারে তার অনুমতি নেওয়ার, বিশেষ করে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের ব্যক্তিদের ব্যাপারে, অর্থহীন। অনুমতি নিতে হলে বর্ধমানের রাজার অনুমতির প্রশ্ন আসে, নদীয়ার রাজার নয়। এইসব যুক্তি দেখিয়ে জগন্নাথ বললেন, তিনি নিজে সেই ব্রাহ্মণের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রায়শ্চিত্যে পৌরোহিত্য করতে ইচ্ছুক, যদি এঁরা তাঁর সঙ্গে থাকেন।

সকলেই জগন্নাথকে সমর্থন করলেন, সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলেন, কৃষ্ণচন্দ্র অতিশয় প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, তিনি এটা জানতে পারলে জগন্নাথের ওপর খুবই ক্রুদ্ধ হবেন এবং তাঁর ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করবেন। জগন্নাথ বললেন, তিনি শাস্ত্রবিদ্‌ ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রসম্মত ন্যায় কাজে তিনি জগতে কাউকে ভয় করেন না। আগামী পূর্ণিমাতেই তিনি প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করবেন, তাঁরা যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকেন।

পরের পূর্ণিমাতে বহু পণ্ডিত ও অভ্যাগতের উপস্থিতিতে সেই ব্রাহ্মণ হিন্দুসমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন। খবর পেয়ে অন্যান্য জাতিচ্যুত ব্যক্তিগণ জগন্নাথের দ্বারস্থ হতে লাগল। এতদিন কৃষ্ণচন্দ্র ছড়ি ঘুরাচ্ছিলেন সমগ্র বঙ্গদেশের হিন্দুসমাজের ওপর, হঠাৎ দেখা গেল তিনি পাত্তাই পাচ্ছেন না জাত-মারা মানুষের বিধান দেওয়ার ব্যাপারে। আয় তো কমতে লাগলই, মর্যাদাও বিলুপ্তির পথে।

অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি কার্তিকেয়চন্দ্রকে বলেছিলেন, কাত্তিক, আমি অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই। আমার ঘোড়া যাবে সারা বাংলার আনাচে কানাচে আমার আদেশ নিয়ে। দেকি কার ঘাড়ে কটা মাথা যে আমার ঘোড়া আটকায়। তারপর দেকি সেই পণ্ডিতের কত ক্ষমতা। কিন্তু রাজার সে ইচ্ছে পূর্ণ হলো না, পণ্ডিতেরা নিদান দিলেন কলিকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ শাস্ত্রবিরোধী। বদলে রাজা বাজপেয় যজ্ঞ করতে পারেন। রাজার তখন ক্রোধের আগুন ধিকিধিকি বইছে। সাড়ম্বরে শুরু হলো সেই যজ্ঞ, রাজা নিমন্ত্রণ করলেন কাশী, মিথিলা, কনৌজ, দ্রাবিড়, তৈলঙ্গ সমস্ত প্রদেশের তাবড় পণ্ডিতদের, বাদ দিলেন জগন্নাথকে। ঘোষণা করা হলো সেই যজ্ঞস্থলে নানা শাস্ত্র নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হবে।

জগন্নাথের কানে গেল সেই ঘোষণা। অন্যান্য পণ্ডিতরা যতই শাস্ত্রজ্ঞ হোক, তাঁর তুল্য ওজস্বিতা তাঁদের কোথায়! যজ্ঞের পঞ্চম দিনে বিনা নিমন্ত্রণে জগন্নাথ নিজের একশো শিষ্য নিয়ে সেই সভায় হাজির হলেন। রাজা তো হতবাক, লজ্জিত হয়ে জগন্নাথকে শিষ্যসহ আতিথ্য গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে জগন্নাথ তা প্রত্যাখ্যান করে অন্যত্র নিজেদের থাকার ও খাদ্যাদির বন্দোবস্ত করলেন। প্রতিদিন তিনি সভায় হাজির হতে লাগলেন ও ন্যায়শাস্ত্রের বিভিন্ন জটিল তর্কে উপস্থিত পণ্ডিতদের ধরাশায়ী করতে লাগলেন। যজ্ঞশেষে রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন আমার এই বাজপেয় যজ্ঞ? জগন্নাথ মৃদু হাস্য করে বললেন, যে যজ্ঞে জগন্নাথ বরাহূত, তার আর মহিমার সীমা কী! রাজার লজ্জার অবধি থাকল না।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। নবাবের দেওয়ান নন্দকুমার জানতে পারলেন, তাঁর গুরুকে নিগ্রহের চেষ্টা করছেন নদীয়ারাজ। কৃষ্ণচন্দ্রের তখন নবাবের কোষাগারে বারো লক্ষ টাকা বকেয়া। নন্দকুমার আলিবর্দীর কানে সেই কথা তুলে টাকা আদায়ে লোক পাঠালেন কৃষ্ণনগরে। অনাদায়ের দায়ে বন্দী হলেন রাজা মুর্শিদাবাদে। যদিও পরে প্রচার করেছেন দেবী অন্নপূর্ণার প্রসাদেই তাঁর মুক্তি হয়েছে বন্দীদশা থেকে, ভারতচন্দ্রকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন সেই মঙ্গলকাব্য, তিনি নিজে তো জানেন, কারাগার থেকে পায়ে হেঁটে জগন্নাথের বাসগৃহে গিয়ে তাঁর কাছে গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমাভিক্ষা করায় তাঁর অনুকম্পাতেই রাজার মুক্তি হয় নবাবের কারাগার থেকে। জগন্নাথই নন্দকুমারকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন আলিবর্দীকে বলতে যে কৃষ্ণচন্দ্র সম্প্রতি বাজপেয় যজ্ঞ করেছেন, তাতে অনেক ব্যয় হয়েছে, কোষাগারে অত টাকা নেই, পরে ধীরে ধীরে দিয়ে দেবেন। সেই শর্তেই মুক্তি।

সেই জগন্নাথকে নিমন্ত্রণ জানাবেন তিনি তাঁর নতুন আড়ম্বরের নিয়ম-প্রকরণে? অসম্ভব।

জগন্নাথ নয়, অন্যান্য পণ্ডিতদেরই বহাল করা হলো বিধির সরলীকরণে। পরদিন উলটোরথ। রথে দড়ি পরিয়ে আবার টানতে টানতে রথ ফেরত নিয়ে যাবে চৈতন্যের চ্যালারা। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ঐদিনই যেন মূর্তি তৈরী শুরু করা হয়। বাঁশবাগান থেকে রাজরাজেশ্বরী দুর্গাপ্রতিমা তৈরির প্রধান বাঁশ কেটে আনল এক মুসলমান ঘরামি, সেই বাঁশ বসানো হলো পাটে। মহারাজ বললেন, এ বড় শুভদিন। এরও পুজো আচ্চা হোক। এই কে আচিস, তোপধ্বনি কর। রাজবাড়ির কামান থেকে তোপ দাগা হ’ল। সবাই বলাবলি করতে লাগল, ঐ শোন, পাটে ঘা পড়েছে।

কৃষ্ণনগরের কুমোররা লেগে গেল রাজবাড়ির প্রতিমা বানানোয়। কাঠামোর ওপর খড় আর মাটি লেপে তাতে রঙ বসানো হলো মাতৃমূর্তির। মুসলমান শিল্পী এসে এঁকে দিল দেবীর চোখ, মুখ, নাক। এ মূর্তি রাজরাজেশ্বরীর, দেবীর অঙ্গে যোদ্ধার সাজ, তিনি বর্মপরিহিতা, তাঁর বরাঙ্গে স্বর্ণখচিত বক্ষাবরণ। দেবীর বাহন পৌরাণিক অশ্বসদৃশ সিংহ। অর্ধগোলাকৃতি চালিতে স্থিত দেবীমূর্তির সামনে ঝুলন্ত ঝলমল অভ্রধারা। এ পুজোয় লাগে পদ্মফুল, তা জোগাড়ে লেগে গেল বাগদিরা। অন্য ফুলের জোগান দিতে কাজে লেগে গেল মালি-মালিনীর দল।

এলাহি কাণ্ডকারখানা। নিয়ম সহজ সরল করার পরেও সেই মূর্তি বানাতে লাগল একশো আট মণ গঙ্গামাটি আর একশো আট ঘড়া গঙ্গাজল। বেহারারা বয়ে নিয়ে এল সেই জল আর মাটি। পুজোর আগে নাটমন্দিরে ডেকে আনা হলো একশো আটখানা ঢাকি, তাদের সমবেত ঢাকের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হ’ল, জলঙ্গীর পাড়ে দুলতে লাগল নবীন কাশের গুচ্ছ, সমগ্র রাজধানীর প্রাণ স্পন্দিত হ’তে লাগল।

সর্বসুলক্ষণযুক্ত একটা পাঁঠা বলি দিয়ে দেবীর বোধন হলো মহালয়ার আগের কৃষ্ণা নবমীতে, মাটির ঘট স্থাপন করে। জ্বালানো হ’ল হোমকুণ্ড, জ্বলতে লাগল টানা সতেরো দিন, বিজয়া দশমী অবধি। প্রতিমা প্রতিষ্ঠা হ’ল। পূজারীরা পালা করে হোমকুণ্ডে দিনরাত গুঁজে দিতে লাগলেন পবিত্র বিল্বকাষ্ঠ ও গব্যঘৃত, মন্ত্র পাঠ করতে করতে। এগারোজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিযুক্ত হলেন পূজার দায়িত্বে। তাঁদের সমবেতকণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল পবিত্র চণ্ডীমন্ত্র –

সর্বমঙ্গলামঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।
সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তুতে।।
শরণাগতদীনার্তপরিত্রাণপরায়ণে।
সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।

অন্দরমহলের মহিলাদের বার-বাড়িতে আসার নিয়ম নেই, তারা সেই পুজো দেখতে লাগলেন নাটমন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে চকের আড়ালে বসে। মহারাজ পট্টবস্ত্র পরিধান করে অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গে নগ্নপদ হয়ে পুজোর তদারকি করতে লাগলেন, আহ্বান জানালেন সর্বসাধারণকে মায়ের পুজোয়। পুজোর প্রধান তিনদিনে বলি হলো আরো একশো আটটা খুঁতহীন পাঁঠা, সারারাত রাজপ্রাসাদের নিভৃত কক্ষে বসল রাজন্যবর্গ নিয়ে বাঈজি নিকির চটুল নৃত্যের আসর, সঙ্গে সুরাবৃষ্টি। নাটমন্দিরের বাইরে আপামর জনসাধারণের জন্য চলতে লাগল রাসযাত্রা, চণ্ডীগীতি, পাঁচালি, মনসার ভাসান, পীরের গীত, কবিগান, জারিগান, পুতুলনাচ, কুস্তিখেলা। মাঠে ঘোড়দৌড়। নদীতে নৌকার বাইচ। এ জাতীয় বিরাটকায় অনুষ্ঠান এর আগে বাঙালি দেখেনি।

মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি পুজো। অষ্টমী-নবমীর সঙ্গমে সন্ধিপুজো শুরু হলো কাছারিতে তোপধ্বনি করে। নবমীপূজার দিন মহিষ বলি দিয়ে মহারাজ যুবরাজ আর অন্যান্য রাজকুমারদের সঙ্গে শুরু করলেন কাদা খেউড়। রাজা কিছু চটুলরসের পদ বলেন, রাজকুমারদের তার প্রত্যুত্তর করতে হয় তার সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন চটুল পদ দিয়ে। দশমীর পুজো শেষে নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত হলো যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান। মহারাজ সবৎসা ধেনু, বৃষ, গজ, অশ্ব, দক্ষিণাবর্ত বহ্নি, দিব্যস্ত্রী, পূর্ণকুম্ভ, ব্রাহ্মণ, নৃপ, গণিকা, পুষ্পমাল্য, পতাকা, সদ্যমাংস, ঘৃত, দধি, মধু, রজত, কাঞ্চন, শুক্লধান্য ও জীবিত মৎস্য আদি সুলক্ষণ বস্তুসমূহ পরিদর্শন করে নাটমন্দির থেকে যাত্রা শুরু করে রাজপ্রাসাদে গেলেন। পূজান্তে বিসর্জনের জন্যে এলো একশো আটজন দুলেশ্রেণির পালোয়ান বেহারা, তাদের চওড়া কাঁধে চড়ে বিশাল শোভাযাত্রা করে রাজবাড়ি থেকে মূর্তি বের করা হলো। রূপোর লাঠিসোটা, নিশান, বাদ্যিবাজনা নিয়ে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল শোভাযাত্রা, তার একেবারে সামনেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং। শোভাযাত্রা দেখার জন্যে রাস্তার দুধারে মেয়েপুরুষের প্রচণ্ড ভিড়, মহারাজকে তারা স্বাগত জানাতে হাজির উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি দিয়ে। রাজরাজেশ্বরীর নিরঞ্জন হবে জলঙ্গীর জলে, তার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে একশো পঁচিশ হাত চওড়া ভেলা। 

নদীর জলে প্রতিমা নিরঞ্জন হতেই মহারাজ দুহাতে উড়িয়ে দিলেন রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে আনা দুটো নীলকণ্ঠ পাখি। তারা নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে রাজমহিষীকে বুঝিয়ে দিল, নির্বিঘ্নে সমাপন হয়েছে বিসর্জন।

অসাধারণ ও অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে সমাপিত হলো মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাপুজো।

কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাপুজোর রকম সকম দেখে তাঁর পিতা রঘুরামের মন্ত্রণাদাতা কৃষ্ণরাম সেন তার নেদিয়ার পাড়ার বাসভবনে শুরু করে দিলেন এই পূজা। তার ব্যাপার আবার আলাদা, সেই দুর্গার তিনটে হাত। কৃষ্ণরাম বললেন, তিনি এই মূর্তি স্বপ্নে পেয়েছেন। ব্যাস, অভিনব ত্রিভুজা দুর্গা দেখতে দূর দূরান্তর থেকে লোক আসা শুরু করল। এমন জিনিস তারা তো দেখেনি। যতই হোক বাবার পরামর্শদাতা, আসলে তো বদ্যির ব্যাটা এবং তাঁর প্রজা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এসব অশাস্ত্রীয় কাণ্ডকারখানা দেখে তার ওপর রেগে গেলেন। তারই প্রজা কিনা তার ওপর টেক্কা দিয়ে এই সব অনাচার করছে! ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করলেন তিনি। ঝঞ্ঝাটের উপক্রম হলো তাতে। কৃষ্ণরাম নেদিয়ার পাড়ার মানুষকে নিয়ে জোট বেঁধে রাজার আদেশের প্রতিবাদে সবাই কর দিতেই অস্বীকার করল। সে এক মহা গণ্ডগোল।

এই সব চারিদিকে যত প্রচার পেতে লাগল, দুর্গাপূজার তত প্রসার বাড়তে লাগল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। ইংরেজরাও চায় এ দেশের মানুষের ওপর তাদের তাঁবেদারি সহ্য করতে কিছু কিছু দেশীয় অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা। তারা দল বেঁধে আমোদে যোগ দিতে লাগল।

কৃষ্ণচন্দ্রের কুলগুরু যশোর জেলার সারল গ্রামের ছান্দরবংশের কাঞ্জারি গোষ্ঠিপতি কুমুদ ন্যায়বাগীশের পুত্র রঘুনাথ সিদ্ধান্তবাগীশ, তিনি রুদ্র রায়কে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই বংশের উত্তরপুরুষ ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ রামভদ্র ন্যায়লঙ্কার কৃষ্ণচন্দ্রের গুরু, তারই দান ও বৃত্তিতে সংসার নির্বাহ করেন। রামভদ্রকে কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গাপুজোয় উৎসাহিত করলেন। কৃষ্ণনগর থেকে সারল তো খুব কাছে না, তাই কাছাকাছি বহিরগাছি নামে এক গ্রামে বানিয়ে দিলেন বাসস্থান, শিবমন্দির, পুজোর দালান, ব্যবস্থাপনা করে দিলেন আনুষঙ্গিক উপচারের। সেখানে ধূমধাম করে দুর্গাপুজো হতে লাগল।

শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর দিয়ে, ছড়িয়ে পড়ছিল গ্রামে গঞ্জে, ক্রমে তার ঢেউ এসে লাগল অন্যান্য শহরেও। ত্রিবেণীর মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছে এসব খবর পৌঁছে যাচ্ছিল ঠিকই। বৃদ্ধ পণ্ডিত দেখলেন এর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হলেও সামাজিক আচার-আচরণ মানতে তো বাধা নেই, আর তাঁর আর্থিক সঙ্গতি হতদরিদ্র ব্রাহ্মণের মত তো নয়, বরং জমিদার ও ধনী শিষ্যদের বদান্যতায় তিনি বেশ কিছু বামুনকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর সম্বন্ধে রটে গেছে, তিনি নাকি হাড়কেপ্পন। একবার এক অতিথি তাঁর গৃহে মধ্যাহ্নে উপস্থিত হলে তাঁর খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য অন্দরমহল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল কিছু চাল আর একটি বেগুন, অনবধানে সেই বেগুনটি ছিল পোকায়-কাটা। অতিথি দেখলেন সেটা, আর বেগুনপোড়া বানানোর জন্যে উনুনে বেগুনটা দিয়ে স্নানে গেছেন। ফিরে এসে বেগুনটা উনুন থেকে বের করতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। বেগুনটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে অভুক্ত অবস্থাতেই সেই বাড়ি থেকে চলে গেলেন, যাওয়ার আগে দেওয়ালে লিখে গেলেন –

কীটাকুলিত বার্ত্তাকুরেকাখু বৃষণোপসা।
পঞ্চাননা দ্বি নিষ্ক্রান্তা ন নিষ্ক্রান্তা হুতাশনাৎ।।

যার মানে হচ্ছে, ইঁদুরের বৃষণের মত কীটদষ্ট বার্ত্তাকু যাও বা পঞ্চাননের হাত গলে নিষ্ক্রান্ত হ’ল, হুতাশন থেকে সে আর নিষ্ক্রান্ত হ’ল না।

নামের সঙ্গে লেগে থাকা এই কৃপণের ছাপ্পার দাগ তুলতে জগন্নাথও মহাসমারোহে ত্রিবেণীতে শুরু করলেন দুর্গাপূজা। পুজোর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল শহর কলকাতায়। বড়লাট, ছোটলাট ও তাদের অধস্তন সকলের প্রসাদে হৈ হৈ করে পুজো হতে লাগল কলকাতার বিভিন্ন ধনীগৃহে।

হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের আদি বাসস্থান। সেখানে একদিন আড্ডা মারতে মারতেই বারোজন বন্ধু নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন, এই পুজো জিনিসটা নিজেদের ঘরে ঘরে না করে অনেকজন মিলে একসাথে আয়োজন করে করলে হয় না? যে যেমন সামর্থ্য, তেমন কিছু কিছু করে এর জন্যে খরচ দিলে কারো তেমন গায়ে লাগবে না, অথচ সকলের উদ্যমে পুজো হবে, ফলে তা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে। বারোজন ইয়ার মিলে তারা সেই যে পুজো শুরু করলেন, তা প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে গেল। কয়েক বছরের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন শহরে গ্রামে শুরু হয়ে গেল বারো-ইয়ারি পুজো।

কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য সব দেখে যেতে পারলেন না। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলা শ্মশান হয়ে গেল, খুব ক্ষতি হ’ল তার রাজ্য নদীয়ার। রাজার মন ভেঙে গেল তার পর থেকেই। ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব ব্যবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন করলেন বটে, কিন্তু ইংরেজদের প্রতিপত্তি যে হারে বেড়ে চলছে, তাতে রাজবংশ কতদিন চলবে তাতে তার বিলক্ষণ সন্দেহ দেখা দিতে লাগল। রাজ্য দেখাশুনা করার উত্তরাধিকারী কাকে করবেন, সেই ব্যাপারে মনস্থির হয়ে যেতেই পুত্র শিবচন্দ্রকে রাজ্যাভিষেক করিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হ’ল।

বাংলায় এর পরেও রাজা শব্দটা কোনওরকমে টিঁকে রইল বটে, তবে কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এত বিশাল এলাকা নিয়ে সুদীর্ঘ তিপ্পান্ন বছর ধরে এত পরাক্রমের সঙ্গে বাংলায় রাজত্ব করার ব্যাপারটা সাঙ্গ হয়ে গেল।


* * *


ষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর ঠিক এক বছর পরের গ্রীষ্মকাল, ১৭৮৩ সাল। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে কলকাতায় এসেছেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। আটত্রিশ বছরের ঝকঝকে যুবক, সঙ্গে তার নবোঢ়া স্ত্রী অ্যানা মারিয়া শিপলি। বিয়ের কুড়িদিন আগে তিনি নাইট উপাধি পেয়েছেন আর বিয়ের মাত্র চারদিন পরেই তারা ইংল্যান্ড থেকে উঠে বসেছেন ভারতগামী জাহাজে, কলকাতায় আসা তাদের কাছে এক রকম হানিমুনে যাওয়ার মতই ব্যাপার। জাহাজে উইলিয়াম স্ত্রীর সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে এসেছেন সারাটা পথ। প্রাচ্যদেশের ব্যাপারে তার উৎসাহ ছেলেবেলা থেকে, এবার স্বচক্ষে তার রীতিনীতি দেখে নিতে চান তিনি।

স্বামী-স্ত্রী এসে উঠেছেন গার্ডেনরিচে। অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যেকদিন মাইল তিনেক পথ হেঁটে উইলিয়াম এসে দাঁড়ান ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে। সেখানে অপেক্ষায় থাকে তার পালকি। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তিনি চেপে বসেন পালকিতে, পালকি সোজা তাকে নিয়ে হাজির করে কোর্ট হাউসের গেটে। কোর্ট বন্ধ থাকলে ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক, নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানে, কখনো হিন্দু পণ্ডিতদের টোলে, কখনো মুসলমান মৌলবিদের ডেরায়। এশিয়ার ব্যাপার স্যাপার তাকে জানতেই হবে। ভারতীয়দের দিয়েই শুরু করা যাক।

আদালতের কাজকর্ম শুরু হয় সকাল ন’টায়, চলে বেলা তিনটে অবধি। জোন্স আদালতে পৌঁছান সূর্যোদয়েরও বেশ খানিকটা আগে, তখনও কলকাতা ঘুম ভেঙেই জেগে ওঠেনি। কোর্টের স্নানাগারে স্নান করে পোশাক পরিবর্তন করে প্রাতরাশ সারেন তিনি। ততক্ষণে রামলোচন পণ্ডিত এসে যান কোর্ট হাউসে। তার কাছে জোন্স সংস্কৃতের পাঠ নেন। ভারতকে চিনতে গেলে তার আদিভাষাকে জানতেই হবে। কিছুকাল পাঠ নিয়েই তিনি সংস্কৃতে রস পেতে শুরু করেছেন, সবাইকে বলছেন সংস্কৃতই দেবভাষা, গ্রীক লাতিনের চেয়ে অনেক বেশি অনুপম। এমনকি আরবি-ফারসীকেও গ্রীক লাতিনের ওপরে রাখতে চান তিনি, তবে তারা সংস্কৃতের পরে।

অফিসে ছুটির পর কোর্ট হাউসে আড্ডা বসে। লন্ডনে থাকতে তার বন্ধু ছিলেন তাবড় পণ্ডিতেরা, তাতে ইওরোপীয় যেমন ছিলেন, ছিলেন কিছু আমেরিকানও। আমেরিকার স্বাধীনতা নিয়ে দু’দেশের কথা চালাচালি চলছে, জোন্স আমেরিকার স্বাধীনতার পক্ষে, সেই নিয়ে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে তার বহু আলোচনা হয়েছে। বেঞ্জামিনও এক আশ্চর্য মানুষ, আকাশের বাজ পড়া যে ইলেকট্রিসিটি, তা তিনি সম্প্রতি প্রমাণ করেছেন ঝড়-বৃষ্টির বিকেলে আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে। বয়স হলে মানুষের চোখে চালশে পড়ে, কাছের জিনিস দেখতে, বিশেষ করে পড়াশুনা করতে অসুবিধে হয়, চোখে পজিটিভ পাওয়ারের লেন্স লাগে। অধিকাংশ মানুষের চোখ খারাপ মানে দূরের জিনিস দেখার অসুবিধা, তাতে লাগে নেগেটিভ পাওয়ারের লেন্স। যাদের দুটোতেই অসুবিধা, তাদের তাই দুখানা চশমার প্রয়োজন হয়, একটায় কাছের আর একটা দূরের জিনিস দেখতে। সেই সমস্যা সমাধানে বেঞ্জামিন আবিষ্কার করেছেন বাইফোকাল লেন্স, যাতে একই সঙ্গে দূরের আর কাছের জিনিস দেখতে সুবিধে হয়। তিনি বুঝেছিলেন দূরের জিনিস মানুষ দেখে প্রধানত চশমার ওপরের অংশটা দিয়ে আর কাছের জিনিস নীচের অংশ দিয়ে। তাই ওপরে নেগেটিভ পাওয়ারের আর নীচে পজিটিভ পাওয়ারের লেন্স একত্রে জুড়ে দিলে একই চশমায় দুটো কাজই করা সম্ভব।

সৃজনশীল মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দই আলাদা। উইলিয়াম খুবই পছন্দ করতেই এঁদের সঙ্গ। এর আগে তিনি স্যামুয়েল জনসনের বিখ্যাত সাহিত্যসভা দ্য ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। সেই ক্লাবে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য সব চরিত্র – জেমস বসওয়েল, এডমন্ড বার্ক, ডেভিড গ্যারিক, টমাস পার্সি, অ্যাডাম স্মিথ। সেই দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ, যিনি অর্থশাস্ত্রকে এক নতুন দিশা দেখালেন আর যার সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল আধুনিক বাস্পীয় ইঞ্জিনের জনক জেমস ওয়াটেরও। 

এখন কলকাতার কোর্টহাউসের আড্ডায় আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস, চার্লস উইলকিন্স, ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। এরাই এখন তার নতুন বন্ধু। কলকাতায় পৌঁছেছেন তখনও চার মাস হয়নি, কোর্ট হাউসের সেই আড্ডার ঘরটাকেই জোন্স বানিয়ে দিলেন এক আনুষ্ঠানিক সভার, তার নাম দিলেন – এশিয়াটিক সোসাইটি। ভারতে আসার আগেই তালিকা করে রেখেছিলেন তিনি কী কী পড়বেন, জানবেন, লিখবেন, করবেন। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা করলেন – The bound of its investigations will be the geographical limits of Asia, and within these limits its inquiries will be extended to whatever is performed by man and produced by Nature.

এশিয়াটিক সোসাইটির কাজ জোর কদমে চলতে লাগল। এদিকে আদালত চালাতে গিয়ে জোন্স মুশকিলে পড়লেন। দেশীয় মানুষ হয় হিন্দু, নয় মুসলিম, তাদের বিচারের ধারা দু’রকম। সমস্ত ফৌজদারি মামলা নিষ্পন্ন হয় মুসলিম আইন অনুযায়ী, কিন্তু দেওয়ানি মামলার বিচারে হিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দু মতে ও মুসলমানদের ক্ষেত্রে মুসলমানি মতে। মুসলমানদের জন্যে ফতোয়া-ই-আলমগীরী নামে একটা বই লেখা আছে, কাজেই তাদের নিয়ে সমস্যা কম, হিন্দুদের জন্যে এ ধরণের কোনও বই নেই। সমস্যা দেখা দিলে ডাক পড়ে এক টিকিধারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের, তিনি যা বিধান দেন, তাই দিয়েই কাজ চালাতে হয়।

সব সময় সেই পণ্ডিতের বিচার মনঃপূত হয় না জোন্সের। মাঝে মাঝে নিরপেক্ষতার অভাব অনুভব করেন। একাধিক পণ্ডিতকে ডেকে আনলে তারা প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করতে থাকে, তাতে মামলার বিচারে রায় দেওয়ার সুরাহা হয় না।

এই অসুবিধাও আগেও পড়তে হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই। ওয়ারেন হেস্টিংস সেই অসুবিধার মোকাবিলা করতে ঠিক করেছিলেন মুসলমানদের মতই হিন্দুদের আইনের বই লিখিয়ে নেওয়া হবে। সেই কাজ তিনি সঁপে দিয়েছিলেন বাংলার এগারোজন পণ্ডিতকে। তারা হলেন রামগোপাল ন্যায়ালঙ্কার, বীরেশ্বর পঞ্চানন, কৃষ্ণজীবন ন্যায়ালঙ্কার, কৃপারাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণচন্দ্র সার্বভৌম, গৌরীকান্ত তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণকেশব তর্কালঙ্কার, সীতারাম ভট্ট, কালীশঙ্কর বিদ্যাবাগীশ, শ্যামসুন্দর ন্যায়সিদ্ধান্ত ও নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। এগারজন মিলে দু বছরের মধ্যে তারা বিবাদার্ণবসেতু নামে একখানা বই লিখে জমা দিয়েছিলেন হেস্টিংসের কাছে। সেটা জোন্সের কলকাতার আসার বছর দশেক আগে। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কেননা ইংরেজ বিচারকদের কেউ সংস্কৃত ভাষা জানেন না, তাদের সুবিধের জন্যে দোভাষীর সাহায্যে বইটাকে ফার্সীভাষায় অনুবাদ করা হ’ল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানীর ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ফার্সীভাষা থেকে বইটাকে ইংরাজিতে রূপান্তরিত করেন। ইংল্যান্ড থেকে ছাপিয়ে আনা হয় তা ‘এ কোড অফ জেন্টু লজ’ নাম দিয়ে।

সংস্কৃত থেকে ফার্সী, ফার্সী থেকে ইংরাজি – এর দুই অনুবাদের চোটে বইটা শেষমেষ যে অবস্থায় দাঁড়াল, তা মোটামুটি হাস্যকর। মূল সংস্কৃতে যা লেখা আছে, আর এই অনুবাদে যা দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে বেশ অনেকটা তফাৎ। তা ছাড়াও বোঝা গেল এগারোজন পণ্ডিত আলাদা আলাদা করে বইটার কিছু কিছু অংশ লিখেছেন, যার জন্যে কিছু কিছু জায়গায় অসঙ্গতি আছে। একই দোষে আইন ভঙ্গ করলে তো আর দু রকমের শাস্তি হতে পারে না! 

জোন্স বুঝলেন, এ দিয়ে কাজ হবে না। সবচেয়ে ভাল হয় একজন পণ্ডিতকে নিয়োগ করা, যার সঙ্গে তিনি বসে একত্রে এই বিশাল কাজটা সুচারুভাবে সমাধা করতে পারবেন। ইংরেজদের পরম সুহৃদ্‌ রাজা নবকৃষ্ণর পরামর্শে লর্ড কর্ণওয়ালিশ সুপারিশ করলেন ত্রিবেণীর পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে।

স্ত্রী অ্যানাকে সঙ্গে নিয়ে উইলিয়াম জোন্স গেলেন ত্রিবেণীতে জগন্নাথের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য, তার সঙ্গে সংস্কৃত শাস্ত্র ও কীভাবে নতুন আইন-সংক্রান্ত বইটা লেখা যায় একসঙ্গে, তা নিয়ে কিছু আলোচনা করা। জগন্নাথের সম্বন্ধে তিনি বড় মজার কথা শুনে এসেছেন। পণ্ডিত একদিন ত্রিবেণীর গঙ্গার ঘাটে স্নান করছিলেন, সেই সময় বজরায় চেপে দুজন ইংরেজ যাচ্ছিলেন কোথাও। জগন্নাথ শুনলেন, তারা বজরার মধ্যে ভীষণ ঝগড়া করছে ইংরাজিতে। ঝগড়া হ’তে হ’তে হঠাৎ একজন অন্যজনের মুখে মারল এক ঘুষি, তার নাক ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। এর পর আর কিছু জগন্নাথ দেখতে পান নি, কেননা ততক্ষণে বজরাটা বেশ অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই ফের, কদিন পরে আদালত থেকে তাঁর নামে এক নোটিশ এসে হাজির। ইংরেজ দুজন আদালতে মামলা করেছে এবং তাদের মীমাংসার জন্যে কোর্ট থেকে এক প্রত্যক্ষদর্শী তলব করায় কী করে যেন জানা গেছে ঐ সময় জগন্নাথ স্নানের ঘাটে ছিলেন, তাই এই সাক্ষ্যের শমন। বিচারকের প্রশ্নের জবাবে জগন্নাথ সবিনয়ে জানালেন, তিনি ভারতীয় ভাষা বেশ কিছু জানেন তবে ইংরাজি জানেন না একদমই। তবে স্নানের সময় যে শব্দাবলি তার কর্ণগোচর হয়েছে, তা তিনি বলে দিতে পারবেন। এরপর গড়গড় করে বেশ কয়েকদিন আগে শোনা সেই ইংরাজি কথোপকথন, যার অর্থ তিনি বিন্দুমাত্র জানেন না, তা বলে দিলেন জাজের সম্মুখে। উপস্থিত সবাই চমৎকৃত হয়ে গেল। জাজ তার বিচারের রায় দিলেন সেই কথার ভিত্তিতেই।

ত্রিবেণীতে জগন্নাথের দোতালা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো – আগচ্ছ।

অ্যানা উত্তর করলেন – আবাং ম্লেচ্ছৌ। তিনি ততদিনে স্বামীর সুযোগ্যা সহধর্মিণী হয়ে সংস্কৃতে পাঠ নিতে শুরু করেছেন, জানেন এ দেশে ইংরেজরা হচ্ছে ম্লেচ্ছ এবং হিন্দু বসতবাড়িতে পায়ে জুতো পরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

উইলিয়াম ভেবেছিলেন ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তার কাজ শেষ হয়ে যাবে, জগন্নাথের সঙ্গে তার আলোচনা চলল সারা বেলা ধরে। আলোচনা হলো সংস্কৃত শাস্ত্র নিয়েও, বিশেষ করে কালিদাসের অভিজ্ঞানম্‌ শকুন্তলম্‌ যা সম্প্রতি উইলিয়াম পড়ে শেষ করেছেন রামলোচন পণ্ডিতের কাছে। এই বয়সেও শকুন্তলার পুরো নাটকটা জগন্নাথের কণ্ঠস্থ দেখে উইলিয়াম অবাক হয়ে গেলেন। দুজনে মিলে আইনের বই লেখার প্রস্তাব অবশ্য নম্রভাবে নাকচ করে দিয়ে জগন্নাথ বললেন, দেখুন সাহেব, আমার বয়স হয়েছে। এই বয়সে আমার পক্ষে সপ্তাহে তিন চারদিন কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি এতদূর থেকে এসেছেন, লাটসাহেব আমার নাম সুপারিশ করেছেন, আমি আপনাদের মান রাখতে বই লিখে দেব। আমি একাই পারব লিখতে, আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। জোন্স রাজি হলেন ও এই কাজের জন্য আজীবন মাসে তিনশ’ টাকা বৃত্তি ঘোষণা করলেন।

জগন্নাথের বাড়িতে প্রচুর লোকের খাওয়া দাওয়া হয় প্রতিদিন, অতিথিকে না খাইয়ে তিনি ছাড়বেনই না। চাকরকে ডেকে বললেন, কানাই, এঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দে এখানে। উইলিয়াম বললেন, কিছু মনে করবেন না, হিন্দুদের মধ্যে কানাই নামের বড় বাড়বাড়ন্ত। কানাই নামের মানে কী? শ্রীকৃষ্ণকেই বা কানাই বলা হয় কেন? জগন্নাথ ঠাট্টা করে বললেন, আসলে এটা শ্রীকৃষ্ণের সর্বব্যাপিত্ব বোঝাতে। হিন্দিতে ‘কাঁহা নাই!’ থেকে বাংলায় কানাই! 

জোন্সের ভয় ছিল বইটা লেখা বৃদ্ধ জগন্নাথ শেষ করে যেতে পারবেন কিনা। আশঙ্কা অমূলক নয়, জগন্নাথের বয়স পঁচানব্বই বছর। তবে জগন্নাথ অন্য ধাতুতে গড়া। তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি আটশো পৃষ্ঠার এক বই লেখা শেষ করে জোন্সের হাতে দিলেন। ঋণদান, নিক্ষেপ, ভৃত্যাদি, পারষ্যাদি ও দায়ভাগ নামে পাঁচটি অধ্যায় – যার তিনি নাম দিয়েছিলেন দ্বীপ – তাতে মোট পঁয়তিরিশটি পরিচ্ছেদে –জগন্নাথের ভাষায় রত্নে – ন্যস্ত সেই ‘বিবাদভঙ্গার্ণব’ নামের আকরগ্রন্থটি।

১৭৯২ সালের প্রথম দিকে বইটা হাতে পেয়েই উইলিয়াম ঠিক করলেন, বছর দুয়েক পরিশ্রম করলেই তিনি এর ইংরাজি অনুবাদ শেষ করে ফেলতে পারবেন।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কলকাতার সঙ্গে উইলিয়াম যতটা মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন, অ্যানা ততটা নয়। মাঝে মাঝেই অসুস্থতায় পড়ছিলেন তিনি। উইলিয়াম বইটার অনুবাদ নিয়ে যখন প্রচণ্ড ব্যস্ত, অ্যানার অসুস্থতা বেড়ে গেল অনেক। কলকাতায় উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পেরে ১৭৯৩ সালের শেষদিকে এক শীতের সন্ধ্যেয় তাকে ইংল্যান্ডের জাহাজে তুলে দিতে হ’ল। ঠিক হলো, বইটা শেষ করেই উইলিয়াম একটা লম্বা ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ডে যাবেন। ততদিনে নিশ্চয় সেরে যাবেন অ্যানা। দুজনে ফিরে আসবেন ফের কলকাতায়। প্রাচ্য সম্বন্ধে দশ বছর কলকাতায় থেকে বহু জ্ঞান আহরিত হয়েছে এর মধ্যে, সংস্কৃত ও ইওরোপীয় ভাষার মিলের সূত্র ধরে উইলিয়াম পেশ করেছেন তার যুগান্তকারী নৃতাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা, কিন্তু জানার কি শেষ আছে?

সে আশা অপূর্ণই রয়ে গেল তার। প্রিয়তমা পত্নীর সঙ্গে আর দেখা হলো না। পরের বছর সাতাশে এপ্রিল আটচল্লিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই হেপাটাইটিসে মারা গেলেন পৃথিবীর সেরা প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স। ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে কবিতাও লিখেছিলেন তিনি বেশ কয়েকটা, সে নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য হয়নি তখন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই সেই কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকজন ইংরেজ কবি অন্য ধরণের কবিতা লিখতে শুরু করলেন। তাদের নাম টেনিসন, বায়রণ, কোলরিজ, শেলি। শুরু হলো ইংরাজি কবিতায় রোমান্টিক যুগ।


* * *


উইলিয়াম জোন্সের মৃত্যুর পর কেটে গেছে আরও সাড়ে তের বছর। এসে গেছে আরও একটা আশ্বিন মাস। আকাশে সোনালী রোদ আর সাদা মেঘের ভেলা। নদীর ধারে ধারে ফুটে উঠেছে কাশ। 

বিজয়া দশমীর বৈকাল। একে একে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন হচ্ছে ত্রিবেণীর গঙ্গার ঘাটে। তাঁর নিজের পুজো করা প্রতিমার পিছনে পিছনে ঠুকঠুক করে হেঁটে গঙ্গার ঘাটে এলেন অতিবৃদ্ধ জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। অন্যান্যবার দশমীপূজা ও বিসর্জনের মন্ত্রপাঠ হয়ে গেলেই উনি প্রতিমার সামনে থেকে উঠে চলে যান নিজের কক্ষে, প্রায় চব্বিশ ঘন্টা তাঁর দেখা পাওয়া যায় না। মাতৃমূর্তি তো শুধু একটা মাটির প্রতিমা নয়, টানা পাঁচদিন তার সামনে বসে দাঁড়িয়ে নানাবিধ উপচারে তার পুজো করতে করতে কখন সে ঘরের একজন হয়ে যায়। তার বিসর্জনে বিরহের করুণ সুর বেজে ওঠে শরতের আকাশে বাতাসে। বৃদ্ধ প্রাজ্ঞ হলেও তো মনুষ্যসন্তান, তিনি এই বোধের ঊর্ধে উঠতে পারেন না, তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীও করুণরসের মূর্ছনায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। কিন্তু এবার যেন তাঁর সেই বোধ লোপ পেয়েছে। যদিও শরীরে বয়সের ছাপ পরিষ্কার, শক্তি হ্রাস পায়নি এখনও, এখনও তিনি যথেষ্ট সচল। স্মৃতি রয়েছে পুরোমাত্রায়, সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁর বশে, রোগবালাই তেমন কিছু নেই। গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে লাগলেন প্রতিমার নিরঞ্জন।

দূর থেকে ভেসে আসছে আরও অনেক ঢাকিদের সমবেত বাজনা – ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। ছেলে-ছোকরার দল নিজেদের মধ্যে মস্করা করছে চটুল ভঙ্গিতে রসের গান গেয়ে। তাদের গলায় শোনা যাচ্ছে দুর্গাপুজো নিয়ে তামাশা –

কী ঠাহুর দ্যাকলাম চাচা!
কী দুগ্‌গী দ্যাকলাম চাচী!
সিঙ্গির ওপর উইঠ্যা ছুঁড়ি
অসুরের পিঠটা ধরি
গলায় দিসে খাপ ছড়াইয়া, 
বুকে দিসে খোঁচা।।
কী ঠাহুর দ্যাকলাম চাচা!
কী দুগ্‌গী দ্যাকলাম চাচী!

হুই যে একডা থোম্বা বদন
দাঁত দুইডা তার মূলার মতন
কান দুইডা তার কুলার মতন
মাতা লেপা-পোঁছা।
কী ঠাহুর দ্যাকলাম চাচা!
কী দুগ্‌গী দ্যাকলাম চাচী!

আসে ডাইনে বাঁয়ে দুই সেমড়ি
পইরা আসে ঢাহাই শাড়ি
ঘুরতে দ্যাকসি বাড়ি বাড়ি
ফেশন দ্যাহায় ভারি!
আবার ময়ূরের পিটে বইসেন যিনি
তেনার বড্ড সিকসিকানি
ধুতি করসেন কোঁচা
কী ঠাহুর দ্যাকলাম চাচা!
কী দুগ্‌গী দ্যাকলাম চাচী!

হিন্দুদের পুজোয় মুসলমান পল্লীকবিকে ডাকিয়ে এইসব তামাশার গান বাঁধিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই গানের জন্যে তাকে দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত পারিশ্রমিক। অর্ধশতাব্দী পূর্বে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জাঁকজমক করে যখন প্রথমে নিজের রাজপ্রাসাদে ও পরে নিজের রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপুজোর যে ঘটা শুরু করে গেছিলেন, তিনি কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন, তার সেই উদ্যম একদিন সারা বাংলায় মহাসমারোহে ছড়িয়ে পড়বে! বাঙালি পেয়ে যাবে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার এক আশ্চর্য হুজুগ।

পুণ্যসলিলা ভাগীরথী বয়ে চলেছে। তার দিকে চেয়ে জগন্নাথের মনোরাজ্যে কী এক বৈকল্য দেখা দিল, তিনি সঙ্গে যারা পরিজন ছিলেন, তাদের উদ্দেশে ধীরমন্দ্রস্বরে বললেন, আমি ঠিক করেছি, আমি আর বাড়ি ফিরবো না। এই ভাগীরথীর তীরেই বাস করব, তোরা আমায় এখানেই একটা চালা বানিয়ে দে। প্রপৌত্রদের যারা উপস্থিত ছিল, তারা বলল, না, না, সে কী কথা, এখানে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে, বাতাসে হিম। কিন্তু জগন্নাথ অনড়, তাঁর সাধ হয়েছে অন্তর্জলি যাত্রার। কোনওভাবেই তাঁকে নড়াতে না পেরে পরিজনরা সবাই মিলে হাত লাগিয়ে সেইক্ষণেই বাঁশ, খড়, ইত্যাদি দিয়ে একটা কাজ চালানো গোছের চালা বানিয়ে ফেলল। জগন্নাথ প্রসন্নবদনে তাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেই চালায় প্রবেশ করলেন। বাড়ি থেকে আসার আগে তিনি তাঁর সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করে এসেছেন, পাণ্ডিত্যের গরিমায় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ঈর্ষণীয়। দশজন পৌত্রের প্রত্যেককে দশ হাজার করে একলক্ষ টাকা লিখে দিয়েছেন, আরো ছত্রিশ হাজার টাকার কিছু দিয়েছেন প্রপৌত্রদের, বাকিটা রেখেছেন নিজের শ্রাদ্ধের খরচ উপলক্ষে। বাকি চার হাজার টাকা, জমি-বাগান-পুকুর রেখে গিয়েছেন দুর্গোৎসব-আদি পারিবারিক উৎসব উদ্‌যাপনের জন্যে।

পরদিন একাদশীর সকাল থেকেই খবর পেয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা জ্ঞানী-গুণী মানুষের ভিড় হতে লাগল গঙ্গাতীরে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক উচ্চপদস্থ ইংরেজও। তারা দেখতে চায় প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধকে, অনুরোধ করতে চায় তাঁকে ঘরে ফিরে যাওয়ার। অনেকে সঙ্গে এনেছে খাদ্য-পানীয়, ইচ্ছে পণ্ডিতমশাই তা থেকে অন্তত কিছু যেন গ্রহণ করেন। তিনি কারও সঙ্গেই বিশেষ কথা বললেন না, মৃদু হাস্য করে হাত তুলে জনতার উদ্দেশে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলেন। কোনও খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করলেন না। মনস্থির করে ফেলেছেন, এখন থেকে তাঁর একমাত্র ভোজ্য হবে পবিত্র গঙ্গোদক। 

সাত দিন পর কৃষ্ণা তৃতীয়া তিথিতে গঙ্গাতীরের সেই অস্থায়ী কক্ষ থেকে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত একশো তের বৎসর বয়সী জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন তাঁর বৃহৎ পরিবার ও বৃহত্তর শিষ্যগোষ্ঠী, অনন্য মেধা, স্মৃতি ও জ্ঞানভাণ্ডারকে পিছনে রেখে পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে।


(ক্রমশ)

14 comments:

  1. অসাধারণ এক ইতিহাস! এমন প্রাঞ্জল ভাষায়, গল্পচ্ছলে অজানা ইতিহাসকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা :) এ এক অনন্য দলিল হয়ে রইলো দূর্গাপুজোর পত্তনের!

    ReplyDelete
  2. just fantastic.ধৈর্য ধরে পুরোটাই পড়লাম। এই ধরণের লেখায় ডুব দিতে খুব ভালোবাসি।। অমিতাভকে অশেষ ধন্যবাদ এই দূরূহ পরিশ্রম করার জন্য।
    বেলালদা।

    ReplyDelete
  3. অমিতাভবাবু, এমন লেখা লিখতে আপনিই পারেন। অসাধারণ!

    ReplyDelete
  4. অসাধারণ! বহুদিন পর এই ধরনের লেখা পড়লাম। কল্পকাহিনীর চেয়ে এই ধরনের ঐতিহাসিক সত্যি গল্প পড়তে বেশী ভাল লাগে। বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত এই ধরনের লেখা আরও পেলে খুব ভাল লাগবে।

    ReplyDelete
  5. Bhalo laaglo. Hinduder Thahur dekhlaam gaanTar prathom stabak, aamaar ek kRishNanagar baasini boner golaaY ChhoTobelaay shunlaam.

    ReplyDelete
  6. Bhalo laaglo. Hinduder Thahur dekhlaam gaanTar prathom stabak, aamaar ek kRishNanagar baasini boner golaaY ChhoTobelaay shunlaam.

    ReplyDelete
  7. কিছু ভুল তথ্যের সমাহার চোখে পড়লো। নবকৃষ্ণ ক্লাইভের মুন্সি ছিলেন না। দেওয়ান ছিলেন। উনি ক্লাইভ কে বাংলা শেখাতেন না। ফার্সি শেখাতেন। “পলাশীর যুদ্ধে জিতে ক্লাইভ তাকে রাজা বানিয়েচে। সেই জন্যেই তো সে ক্লাইভ আর তার দলবলের পা চাটতে শোভাবাজারে দুগ্‌গাপুজো কল্লো। মদ-মাগী নিয়ে ফুত্তি কল্লো”। লেখকের এই কথাগুলি সত্যের অপলাপ, বাস্তবের বিকৃতি এবং বিনা গবেষণায় চলতি সস্তা বই এর অনুকরণ মাত্র। পলাশীর যুদ্ধে জিতে রাম, শ্যাম, যদু, মধু, অমিতাভ কে রাজা না বানিয়ে নবকৃষ্ণ কে রাজা বানালো কেন ক্লাইভ? একটু পড়াশোনা করে লিখলে এই ভুলগুলি কিন্তু অনায়াসেই সংশোধন করে নেওয়া যেত প্রামাণিক বাবু! দুগ্‌গাপুজো কি সাহেব দের উৎসব? তাহলে ক্লাইভের পা চাটতে নবকৃষ্ণ খ্রীষ্টমাস পালন না করে দুগ্‌গা পুজো করতে গেল কেন? হ্যাঁ, পলাশীর যুদ্ধজয়ের পরে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাইভ একটি উৎসব পালন করতে চেয়েছিলেন। এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেটি কোলকাতার কোন চার্চে পালন করার বাসনা ছিল ক্লাইভের। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরে কোলকাতার কোন চার্চ ই আর অক্ষত ছিলনা। তাই ক্লাইভ অনুরোধ করেছিলেন নবকৃষ্ণকে তাঁর প্রাসাদে এই উৎসব পালন করার জন্যে। আপনি নবকৃষ্ণের মদ-মাগী নিয়ে ফুত্তি করাটাই দেখলেন শুধু? শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে নবকৃষ্ণ ও তার পরিবারের কতোটুকু জানেন আপনি? কিছু লেখার আগে একটু পুরোনো কোলকাতা নিয়ে পড়াশোনা করে নিন। মনে তো হচ্ছে আপনি ওপার বাংলার লোক! আপনার লেখার এটুকু অংশ পড়েই বাকি লেখাটা পড়ার অভিরুচি চলে গেল আমার!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভুল যদি হয়, তবে তা ভুলই, তার সাথে এপার বাংলা, ওপার বাংলার তো কোনো সম্পর্ক নেই, নয় কি? আমি 'ওপার' বাংলার হ'লে কি আমার সাত খুন মাপ হবে?

      না, আমি ওপার বাংলার নই, আমার ছোটবেলা কেটেছে কৃষ্ণচন্দ্রের দুই রাজবাড়ির এলাকায় - শিবনিবাস এবং কৃষ্ণনগরে, যে কারণে এই লেখাটা লিখতে সাহস পেয়েছি। আপনি ক্ষুব্ধ হয়ে হয়ত খেয়াল করেননি যে, যে অংশটাতে আপনার আপত্তি, তা কোনো ন্যারেটিভ বা লেখকের বিবৃতি নয়, তা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উক্তি, তার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রের প্রতি। অহঙ্কারী রাজা বা জমিদাররা অন্য রাজা বা জমিদারদের সম্বন্ধে নিজেদের লোকের কাছে ন্যায্য সম্মান দিয়ে কথা বলতেন বলে আপনার ধারণা? আমি যতটুকু জানতে পেয়েছি, তা যেমন লিখেছি, তেমনই। শুধু ঐ অংশের তথ্যাদি অন্তত ৫-৬টা বই থেকে সংগৃহীত।

      বাংলা-টা ফার্সী হবে, ওটা ভুল স্বীকার করে নিচ্ছি। তবে পুজোটা হয়েছিল পলাশির যুদ্ধের পরপরই, ক্লাইভের তখন দেওয়ান কী করে হওয়া সম্ভব? দেওয়ান হ'ত নবাবের। সিরাজের পর নবাব তখন মীরজাফর। দেওয়ান তখন সম্ভবত নন্দকুমার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি পাওয়ার আগের ঘটনা এসব। ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধ জিতলেও তখন বাংলার অফিসিয়াল নবাব তো নয়।

      রামরাম বসু উইলিয়াম কেরিকে, রামলোচন পন্ডিত উইলিয়ম জোন্সকে দেশীয় ভাষা শেখাতেন, তাঁদের মুন্সিই বলা হ'ত। এতে অসম্মানের কিছু তো দেখিনা।

      শোভাবাজার যে আদতে সভা বাজার, আমি সেসব ডিটেইলসে যাইনি। রাজবাড়ির পক্ষ থেকে সেই দুর্গাপুজোটাও বোধ হয় অস্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু অনেক জায়গাতেই তার উল্লেখ আছে। দুর্গাপুজোকে জনপ্রিয় করার ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক থিসিসও লেখা হয়েছে, দেশে শুধু নয়, বিদেশেও, তাও পড়েছি আমি। আমার কখনোই মনে হয়নি ব্রিটিশরা চার্চে উৎসব করতে খুব আগ্রহী ছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর। সেকালে অধিকাংশ পুজোয় তাদের পৃষ্ঠপোষকতাই তার প্রমাণ।

      এই লেখাটায় বাংলা সংস্কৃতি প্রসঙ্গ আসেনি। ধারাবাহিক রচনা তো, আসবে একে একে। যখন আসবে, তখন অন্যান্যদের সঙ্গে নবকৃষ্ণ দেব, রাধাকান্ত দেবের প্রসঙ্গ আসবে বইকি। ভুল হ'লে ধরিয়ে দেবেন তখন, যদি পড়ার রুচি হয় আপনার।

      অন্তত কিছুটা যে পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, তাতেই আমার আনন্দ।

      Delete
  8. "১৭৫০ সালের ৮ই অক্টোবর অন্যান্যদের সঙ্গে হেস্টিংস ভারতে আসেন আর সেই সময় থেকেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবকৃষ্ণের যোগাযোগ যা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এরপর তাঁর দ্বিতীয় চাকরি হল ১৭৫৬ সালে East India Companyর মুন্সী পদ। রাজবল্লভ, মীরজাফরদের পাঠানো চিঠির পাঠোদ্ধার করার জন্য ইংরেজদের একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন ছিল। এই কাজটা খুব ভালভাবে নবকৃষ্ণ মুন্সীকে দিয়ে করানো হত, মাসিক বেতন হিসাবে তাঁকে দেওয়া হত ৬০ টাকা। ১৭৬০ সালে তিনি ক্লাইভের মুন্সী হলেন। ভারতে ক্লাইভের কার্যকাল ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৭, তাঁর এদেশ ছাড়ার আগেই নবকৃষ্ণ ক্লাইভের ডানহাত ও একজন নামজাদা পুরুষ হয়ে যান। সিরাজদ্দৌল্লার ভয়ে ইংরেজরা যখন ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে ফলতায় জাহাজে দিন কাটাতেন, সেই সময় নবাবের ফতোয়া না মেনে তিনি গোপনে তাদের জীবনধারণের জিনিসপত্রের জোগান দিয়েছিলেন বলে ইংরেজদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। সেই কারণে নবকৃষ্ণের পারিবারিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। পুরস্কারস্বরূপ ১৬ই জানুয়ারী ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ নবকৃষ্ণকে Political Banian to the East India Company নিযুক্ত করেন আর মাসিক বেতন দাঁড়ায় ২০০ টাকা।"

    - সুশান্তকৃষ্ণ দেব (তিন শতাব্দীর শোভাবাজার রাজবাড়ি, শরৎ বুক হাউস, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ৩)

    নবকৃষ্ণ সম্বন্ধে এই তথ্য আহরিত হয়েছে দেব পরিবারেরই অধস্তন পুরুষের লেখা থেকে। আমার লেখাটা "সত্যের অপলাপ, বাস্তবের বিকৃতি এবং বিনা গবেষণায় চলতি সস্তা বই এর অনুকরণ মাত্র" মনে হ'লে আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই।

    ReplyDelete
  9. সুশান্ত কৃষ্ণ দেব আমার দাদা। কিন্তু ঐ বইটি একটি পাতি বই। ওটা পড়ে গবেষণামূলক কোন লেখা না লেখাই উচিত বলে আমার মনে হয় অমিতাভ বাবু। আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই বা আবার ও সেই বাজার চলতি বই এর সাহায্য নিয়ে বলে দিলেন, শোভাবাজার নাকি আদতে শোভাবাজার ছিল! তা কিন্তু নয় অমিতাভ বাবু। শোভাবাজার নামটা এসেছে শোভারাম বসাকের নাম থেকে। নবকৃষ্ণ শোভারাম বসাকের বাড়িটির ই সম্প্রসারণ ঘটিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রুপান্তরিত করেন। শ্যাম-রাই ছিল শোভারামের গৃহ দেবতা। তাঁর নামেই শ্যামবাজার, শ্যামপুকুর নামকরণ হয়। আমি একটা কথা বলি প্রামাণিক বাবু? আসুন দুজনে ঝগড়া না করে একদিন বৈঠকে মেজাজে আড্ডা দি ! তাতে পরস্পরের লাভ বই ক্ষতি হবেনা। আমি আপাতত ইউ এস এ তে আছি। ফিরে গিয়েই যোগাযোগ করব আপনার সাথে। কৃষ্ণনগরের মহারাজা আর রাজা নবকৃষ্ণের মধ্যে পারিবারিক গৃহ দেবতা গোপীনাথ নিয়ে অনেক গল্প আছে। সেটা আপনাকে শোনাব আর আপনার কাছ থেকেও নিশ্চয় জানবো অনেক কিছুই। ওপার বাংলার লোক বলেছিলাম এই কারণে যে তাঁদের অনেকেই শহর কোলকাতার আদি বৃত্তান্ত না জেনেই লেখালেখি শুরু করে দেন বলে ! আমার কথায় যদি আপনি আহত হয়ে থাকেন তাহলে করোজোড়ে মার্জনা চাইছি।

    ReplyDelete
  10. আর একটি কথা অমিতাভবাবু, শোভাবাজার রাজবাড়ীর তরফ থেকে সেই পুজাটিকে অস্বীকার করা হয়েছে--এই তথ্য আপনি পেলেন কোথায়? ইতিহাস কে কি অস্বীকার করা যায় অমিতাভবাবু ? না। দায়িত্ব নিয়েই বলছি শোভাবাজার রাজপরিবারের তরফ থেকে সেই প্রথম দুর্গা পুজাটিকে কোনদিন কোথাও অস্বীকার তো করা হয় ই নি, বরং সেটিকেই প্রথম পুজা ধরে দুর্গাপুজার ২০০তম এবং ২২৫ তম বার্ষিকি পালন করা হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্বপনবাবু, ঝগড়ার কোনো ব্যাপারই নেই। আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে খুবই উপকার হবে, নি:সন্দেহে। এই লেখাটা লেখার জন্যে আমি এখনো পর্যন্ত সাড়ে তিনশো'র ওপর বই জোগাড় করেছি। অফিসের সময় ছাড়া ওগুলো পড়তেই সময় যাচ্ছে। প্রচুর অসঙ্গতি আছে প্রকাশিত লেখাগুলোয়। যেগুলোয় পরস্পরের সাযুজ্য আছে, সেগুলোই নিচ্ছি। কাজটা সহজ নয়। পরে প্রভূত এডিট করে ছাপানোর ইচ্ছা।

      আমি ব্যাঙ্গালোরে থাকি। কলকাতায় গেলে আপনার সাথে যোগাযোগের ইচ্ছা রইল। এ পর্যন্ত একবারই ঢুকেছি শোভাবাজার রাজবাড়িতে, একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে।

      Delete
  11. এর আগের পর্বের লিঙ্কগুলো একটু দেওয়া যাবে?

    ReplyDelete