1

প্রবন্ধ - গৌতম মিত্র

Posted in

প্রবন্ধ


নতুন জীবন : বইয়ের গোলকধাঁধা ও গোলকধাঁর বই
গৌতম মিত্র


ইস্তাম্বুল শহর। মধ্যরাত। বহুক্ষণ হল নিঃসঙ্গ ফেরিওয়ালা বাড়ি ফিরে গেছে। মালবাহী ট্রেন বিষাদ মাখানো রেললাইনে শব্দ তুলে দূরে মিলিয়ে গেল। ভেজা ও শূন্য পথের আলোয় যেন হ্যূজ্যূন মিশে আছে। তুরস্কের এই 'হ্যূজ্যূন' বিষণ্ণতা ও নস্টালজিয়ার এক মিশেল।

ওসমান নামের কুড়ি-বাইশ বছরের একজন তরুণ, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, রেলচাকুরে বাবা বহুদিন হল মারা গেছে, আর মা সদ্য টিভি বন্ধ করে ঘুমাতে গেল।

ঠিক এমন একটা মুহূর্তে ওসমান নিজের কামারায় একটি বই দ্বারা আক্রান্ত।

হ্যাঁ! এমনভাবে আক্রান্ত হল যে তার অতীত দ্রুত মুছে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। এক দ্যুতিময় আলো বইটির পৃষ্ঠা থেকে ধেয়ে এসে ওসমানের চৈতন্যকে গ্রাস করছে। আন্দোলিত সেই আলোয় ওসমানের চোখের সামনে থেকে তখন উড়ে যাচ্ছে রংচটা ঘর, উন্মত্ত যান, আবছা অক্ষর, মৃত শহর, হারানো জীবন ও অপদেবতা। পরিত্রাণহীন এক বিধুর ভ্রমণে উত্তমপুরুষে কথক নায়ক ওসমানকে এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।

এভাবেই তুরস্কের নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুকের পঞ্চম উপন্যাস 'Yeni Hayat' বা 'নতুন জীবন' শুরু হচ্ছে। তুরস্কের সাহিত্যের ইতিহাসে দ্রুত বিক্রির রেকর্ডধারী যে বইটিকে আজও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। প্রথমেই নামটি নিয়ে ধাঁধা লাগে। একজন উৎসুক পাঠক প্রশ্নটি করেই ফেলেন পামুককে। দান্তের 'Vita Nouva' বা 'নতুন জীবন'-এর সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা আছে বইটির? উত্তরে পামুক বলেন, 'দান্তের কাছে বিষয়টি ছিল কীভাবে তিনি প্রেমে পড়েছেন আর তার সঙ্গে প্রণয় পরিনতির আত্মজৈবনিক বিষয়বিচ্যুতি। ...আর আমার বইটি প্রেমের মধ্য দিয়ে পরিণামদর্শী হয়ে ওঠার প্রয়াস।'

এরপর স্বভাবতই দান্তের বিয়াত্রিচের সঙ্গে পামুকের 'নতুন জীবন'-এর নায়িকা জানান(হৃদয়েশ্বরী)-র তুলনার প্রসঙ্গটি ওঠে। পামুক আগের মতোই শান্ত। শুধু অবাধ্য চুল সামলে স্মিত হাসিমুখে উত্তর দেন, 'হ্যাঁ বিয়াত্রিচের প্রতিরূপ জানান, তবে বিয়াত্রিচের থেকে একটু কম সরলমতি, একটু কম আদর্শবান আমার জানান।' আলোচনার শেষে স্ব স্ব দেশের, ধর্মীয় উদ্বেগের ভিন্নতার কথা জানাতে পামুক ভোলেন না।

তবে পামুক তো আর ১৯৯৬-কে ১২৯০-তে পৌঁছে দিতে 'নতুন জীবন' লেখেন না। বরং তাঁর লেখায় ১২৯০-এর সকল আর্তি ও সংকট ১৯৯৬-তে এসে দাঁড়ায়। সুনিপুণ এক অন্তর্বয়নে তিনি তাঁর উত্তর আধুনিক আখ্যান বোনেন। ১৬ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ২৯৬ পৃষ্ঠার বইটির জুড়ি বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। প্রাচী ও প্রতীচী, সময় ও সময়হীনতা, গতি ও মন্থরতা বইটির পরতে পরতে। দান্তের মতো পাশ্চাত্যের এক মহাকবিকে আশ্রয় করে এই রচনা প্রাচ্যের একজন তরুণ প্রতিভাবান লেখকের তর্পণও বটে।

বইকে বিষয় করে বই লেখার সূচনা সেই বাইবেলের সময় থেকে। পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনায় বই রীতিমত একটি চরিত্র। মালার্মে, প্রুস্ত, বোর্খেস, কালভিনো থেকে শুরু করে ভলটার বেনিয়ামিন, এডমণ্ড জেবস, দেরিদা অবধি এই ভাবনার সহচর। পামুকও এর উত্তরসূরি। ওসমান যেমন বইটির প্রভাবে বদলে যায়, বইটিও তেমন ওসমানের ঈক্ষণ দ্বারা পরিমার্জিত হয়। বাস্তব ও কল্পনা, কোনওটিই ঠাহর করতে না পেরে পাঠক দিশেহারা।

কী অমোঘ আর হিমহিম এই উচ্চারণ:

'তুমি ভাবছ যে তুমি বইটি পড়ছ, আসলে তুমি বইটিকে পুনর্লিখন করছ মাত্র। বেশিরভাগ মানুষই নতুন জীবন বা নতুন জগতকে বরন করতে জানে না। ফলত তারা বইয়ের লেখককে হত্যা করে।'

'নতুন জীবন' উপন্যাসে কোনও একরৈখিক গল্প নেই। সময় এখানে বারবার টাল খায়। কখনও অতীত তুবড়ে গিয়ে ভবিষ্যতে সিঁধিয়েছে আবার কখনও ভবিষ্যৎ এসে আছড়ে পড়েছে বর্তমানে। এ এক নিরুপম যাত্রা। আততায়ীর গুলিতে এইমাত্র মৃত্যু হল যার, সে আদৌ মৃত কিনা আন্দাজ করা যায় না। সমস্ত চরিত্রই এখানে সান্দ্র। যেন যে কোনো মুহূর্তে গলে যাবে। ডিফর্মড হয়ে যাবে।

তো সেই না-গল্পের গল্পটা কী? গল্পটা এই। 'নতুন জীবন' নামের একটি বই ওসমানের জীবন বদলে দিয়েছে। বইটি যেন ওসমানকে নিয়েই লেখা। বইটির প্রতিটি অক্ষর যেন ওসমানের সত্তার নির্মাণ। বইটি এতদূর অবধি আলোকিত যে ওসমান নিজের মত্যু অবধি দেখতে পায়। অবশ্য বই পড়ার অভিজ্ঞতা ওসমানের কাছে নতুন নয়। ছোটবেলায় বই পড়তে পড়তে 'সমাপ্ত' শব্দটিতে পৌঁছে ওসমানের মনে হত, এ যেন একটা দেশের নিষ্ক্রমণপথ, যা সে কোনওদিনই পেরোতে চায় না। বইয়ের জগতকে বাস্তব ভেবে নেওয়া তার ছোটবেলাকার অভ্যাস।

কিন্তু শুধু বই তো নয়। আমাদের ওসমান যে প্রেমে পড়েছে। কলেজ ক্যান্টিনে একটি মেয়ের হাতে 'নতুন জীবন' বইটি দেখতে পেয়ে আশ্চর্য ভাবে বাড়ি ফেরার পথে পুরনো বইয়ের দোকানে সে 'নতুন জীবন' বইটি পেয়ে যায়। এরপর ওসমান মেয়েটিকে খুঁজে বেড়ায়। দেখাও মেলে একদিন। জানান নামের মেয়েটি একই কলেজে স্থপতিবিদ্যার ছাত্রী।

মেয়েটিকে সে 'নতুন জীবন' পাঠের শিহরণের কথা জানায়। জানতে চায় বইটির মধ্য দিয়ে মেয়েটির যাত্রা ও ফিরে আসবার অভিজ্ঞতার কথা। উত্তরে জানান নামের সেই মেয়েটি জানায়, বইটির অন্দরমহলে পৌঁছানোর জন্য কী কী করতে পারবে ওসমান। মৃত্যুবরণ করাটাও তো তখন ওসমানের কাছে সামান্য ঘটনা।

মেয়েটি ওসমানকে মেহমেত নামের এক যুবকের কথা বলে যে 'নতুন জীবন' বইটির মধ্য দিয়ে যাত্রা করে ফিরে এসেছে। এই মেহমেতের প্রতি জানানের দুর্বলতা আছে ভেবে ওসমান ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়। আর কী আশ্চর্য, ওসমানের সঙ্গে পরিচয়ের দিনটিতেই আততায়ীর গুলিতে মেহমেত মারা গেল। আর জানানকেও সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলল ওসমান।

দিশেহারা ওসমান এক নতুন জীবনের সন্ধানে বাস ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল। তুরস্কের মফস্বল শহর পথে ছুটে চলে সেই বাস। পথ দুর্ঘটনায় বারবার যাত্রা বিঘ্নিত হয়। তবু বাস বদল করে হলেও ওসমান যাত্রা অব্যাহত রাখে। আবারও এক দুর্বিপাকেই জানানের সঙ্গে দেখা হয় ওসমানের। গ্যুজ্যুল নামের এক শহরে পৌঁছায় তারা। স্বামী-স্ত্রী সাজতে তাদের নাম এখন অলি কারা ও এফসুন কারা।

দেখা হয় ডক্টর ফাইন-এর সঙ্গে। মৃত মেহমেত-এর বাবা সে। জানতে পারে মেহমেতের আরেকটি নাম নাহিত। নাহিতের অর্থ শুকতারা। জানানের চোখ জলে চিকচিক করে। অদ্ভুত মানুষ এই ডক্টর ফাইন। চার ছেলের নাম রেখেছে চারটি বিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানির নামে। জেনিথ, সেইকো, মোভাদো ও ওমেগা। তার বিশ্বাস মুসলিম দুনিয়ার মতো ঘড়িকে আর কেউ চেনে না। দিনে পাঁচবার নামাজে বসবার কথা এই ঘড়িই তো জানান দেয়। পাশ্চাত্যে ঘড়ি শুধু ছুটে চলবার হিসেব রাখে। ডক্টর ফাইন আরও মনে করে, মুদ্রিত অক্ষর একটি জাতির সম্মিলিত স্মৃতি-লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এরপর ওসমানকে আমরা আবিষ্কার করি বিবাহিত রূপে। এক কন্যার পিতা সে। ঘুরতে ঘুরতে ওসমান একদিন বাবার মৃত বন্ধু রিফকি কাকার বাড়ি চলে যায়। এই রিফকি কাকাই ছোটবেলায় ওসমানকে গল্প শোনাত, ছোটদের জন্য গল্পের বই লিখত। পেশায় রেলের উকিল। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রিফকি কাকার বিধবা স্ত্রী রতিবে কাকীর সাহায্যে আবিষ্কার হল, 'নতুন জীবন'-এর লেখক বড়োদের জন্য একটিমাত্র বইয়ের লেখক ছদ্মনামের আড়ালে রিফকি কাকা।

ওসমান এবার রিফকি কাকার পড়াশোনার টেবিল তন্নতন্ন করে হাতড়াতে লাগল। যদি 'নতুন জীবন'-এর জীবাশ্ম কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়ি ফেরার পথে রিফকি কাকার পড়ার টেবিল থেকে তেত্রিশটি বই ধার নিয়ে আসে। 'নতুন জীবন' লেখার সময় রিফকি কাকা যে এই বইগুলির মধ্যেই ডুবে ছিল।

শুরু হয় ওসমানের রাত জেগে বই পড়া। বইগুলোর পাতায় পাতায় কাকার হাতের মার্জিনের দাগ। কী বই? কী বই? দান্তের 'নতুন জীবন', রিলকের 'দুইনো এলিজি', ইবন অ্যাররির 'দ্য সীলস্ অফ উইজডম ', জুল ভের্নের 'ফামিল-সঁ-নো' ইত্যাদি। বইগুলোর সঙ্গে 'নতুন জীবন'-এর যোগসূত্রটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে ওসমানের কাছে। বিশেষত দান্তের 'নতুন জীবন' -এর মার্কিং করা এই পংক্তিটিতে চোখ আটকে যায় ওসমানের:

'আমি জীবনের সেই প্রান্তে পা ফেলেছি যেখানে প্রত্যাবর্তনের আশা করে কেউ যায় না।'

শেষবারের মতো ওসমান আবারও পথে নামে। আবারও ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। মনে প্রশ্নের ঢেউ।

জীবন কী? সময়ের একটি পর্যায়? সময় কী? একটি দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা কী? একটি জীবন। নতুন জীবন।

উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের আলো ওসমানের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই আলোর সঙ্গে বইয়ের সেই আলোর আশ্চর্য মিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ওসমান এক নতুন জীবনে পৌঁছে যাবে। বুঝতে পারে একেই তবে মৃত্যু বলে। তবু সে বাড়ি ফিরতে চায়। এই মুহূর্তে মরবার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। নতুন জীবন পেরিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই তার।

উপন্যাস শেষ হয়। ভ্রমণও। কিন্তু পাঠকের আর এক যাত্রা শুরু হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে। উপন্যাসটির আত্মতা, ধমনী, মৃত্যু ও প্রেম কখন যেন চারিয়ে যায় পাঠক সত্তায়। ওসমান বা পামুকের(হ্যাঁ! এটি পামুকের আত্মজীবনীই) বইয়ের সন্ধানে পাঠকও ডানা দেয়। যে দেবদূতটিকে উপন্যাসে বারবার দেখা যায়, ঘুরে ঘুরে কথা কয়, সে যে আর কেউ নয়, স্বয়ং পাঠক।

পামুক লেখক ও পাঠকের মাঝখানের কাঁটাতারটি হটাতে সক্ষম হয়েছেন। আমরাও ওসমানের মতো কিংবা পামুকের মতো বইয়ের শেষে 'সমাপ্ত' দেখতে নারাজ।

1 comment:

  1. এবার ওই বইটি না পড়ে নিস্তার নেই ।

    ReplyDelete