গল্প - নীলাক্ষ চৌধুরী
Posted in গল্প
গল্প
নীলাক্ষ চৌধুরী
অফিসে সুদীপ্তকে এর আগে এমন অপ্রস্তুত আর বলতে গেলে অপমানিত কখনোই হতে হয়নি। কি যে কেলেঙ্কারি হলো! কখনোই এমনটি হয় নি আগে। কাজ করলে ভুল চুক হয়, কাজ না করলে এমনিতেই কিস্যুটি হবার নয়। সে নিজে একজন দায়িত্ববান কর্মী। এর আগে তার দায়িত্ব নিয়ে কেউ কখনো একটি প্রশ্ন তক তোলে নি। আর তারই আজ কিনা এতটা কথা শুনতে হলো।
শহরের নামী স্কুল থেকে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ভালো কলেজে ভর্তি। বাবা সুবিমলবাবুও সেখানকারই অধ্যাপক ছিলেন। তারপর উনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে ওখান থেকেই ডিরেক্ট প্লেসমেন্ট নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায়। সেখানে তিন বছর কাটিয়ে প্রথম কাজ বদল।
দ্বিতীয়টাও বিজ্ঞাপনেরই, তবে একটু উপরের পোস্টে। এখানে চার বছর হতে চলল আরও। ভুল চুক করতে করতে যেমন এগিয়েছে সুদীপ্ত, কাজও তেমনি শিখেছে। কাজের প্রতি তার যেমন দায়িত্ববোধ বেড়েছে, সংস্থার নির্ভিরতা বেড়েছে তার উপর এর কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু এই সামান্য একটা ভুলের জন্য এত কথা শুনতে হতে পারে, তার কোনও কিনারা করতে পারে না সে। সামান্য এক 'স্যাম্পল' বানানে 'এ'র জায়গায় 'ই' হওয়া নিয়ে যত বিপত্তি। এই ভুল যদিও এতগুলো বছর পার করে এসে হওয়াটাও ক্ষমার অযোগ্য। তবুও ওর বস ওর এই ভুলকে যে 'যন্ত্রণা' বলে আখ্যায়িত করবেন, এই যন্ত্রণাই যেমন এখন খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে সুদীপ্তকে। তার এতদিনের নিজেকে ছাপিয়ে এগিয়ে চলার সাধ্য সাধনাকে তুড়ি মেরে গুঁড়িয়ে দিলো ভদ্দলোক।
বিদীপ্তাও স্কুল থেকে ফিরে সান্ধ্য চা-এর জন্য অপেক্ষা করে সুদীপ্তর ফেরার। সে ফিরলে চা সহযোগে হালকা গল্প কথায় বসে বিদীপ্তা। সারা দিনের একলা যাপন ছেড়ে তাতে সুবিমলবাবুও যোগ দেন। আজ চা'এর ডাকে প্রথমে সাড়া তো মেলেইনি সুদীপ্তর বরং তিনবারের বার 'খাবে কি?' জিগ্যেস করায় বিরক্ত উত্তর আসে 'দিলে দাও'। সুদীপ্তর ভাব গতিক কেমন একটা লাগায় বিদীপ্তা আর কথা বাড়ায় না। ঘরেই চা দিয়ে আসে। শ্বশুর-বৌমা দুজন নিজেদের মুখ তাকাতাকি করে টিভি চালিয়ে তখনকার মত চা-এর পাট চুকিয়ে দেন।
রাতে নিঃশব্দে প্রায় খাবার পর্ব শেষ হওয়ার মুখে সুবিমলবাবুই বলে বসলেন - কি রে, অফিসে কাঠি করেছে কেউ? বাঙালির জাত তো!
- না, বাবা।
- তো তুই সেই আসা অবধি কেমন যেন হয়ে আছিস।
- কই, কিছু হয় নি তো।
- সে আর কিছু হয় নি?! দেখেতো মনে হচ্ছে চিরতার জল গিলে এসেছিস। তোর মা এখন বেঁচে থাকলে বলতে পারতেন, সেই মুখ আর এই মুখে কোনো তফাৎ আছে কিনা।
শ্বশুর বউমা আবার একটু চোখা চোখি করে নেন এই কথা বলতে বলতে। একটু যদি হালকা করা যায় পরিবেশ। কিন্তু বেশ ঝাঁঝিয়েই সুদীপ্ত বলে উঠে - রাখো তো বাবা তোমার বাজে কথা।
এবার স্নেহ মাখিয়ে বৃদ্ধ বলেন - বল না বাবা কি হয়েছে? তুইতো এমন গুম মেরে যাস না কখনো। মনে আছে, তোর সেকেন্ড ইয়ারের টেস্টের সময় সুদাম পাত্র তোর পেছনে টুকলি ফেলেছিল। অনাদিবাবু তোর পেপার প্রায় ক্যান্সেল করে দিয়েছিলেন প্রথমে। পরে আবার সুদামকে চেপে কথা বের করা হয়। আমার অপমান ভেবে, লজ্জায় তুই বাড়ি এসে দরজা দিয়েছিলি। দশ বছর আগের ঘটনা প্রায়। আজকেও হঠাৎ কেন এই অপমানিত চেহারা তোর, বাবা?
বিদীপ্তাও জোর করে। - বলেই ফেল না গো, কি হলো?
- কিছু না।
- কিছু না মানে! আলবাৎ কিছু। পেটে ধরিনি বলে তোকে চিনতে ভুল হবে বলছিস।
- আরে দূর। আজ খুব বিরক্ত লাগছে নিজের উপরই।
হতাশা ঝরে পড়ে কথায়। আহত সেনাপতির মতো সুদীপ্ত বলে যায় ''স্যাম্পল' বানানে 'এ'র জায়গায় 'ই' করে দিয়েছি। কি করে যে হলো! বসটাও মনে হয় খিঁচড়ে ছিল। 'নুইসেন্স' বলেছে বাবা লোকটা। এই শব্দটা খুব শক্ত শব্দ। এখনো হজম হচ্ছে না। যন্ত্রণা হচ্ছে।
বৃদ্ধ একটু হালকা হাসলেন, একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললেন, অনুমান করার চেষ্টা করলেন যে ভুলের জন্য ছেলে অনুতপ্ত নাকি যন্ত্রণার যন্ত্রণা ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করলেন, কাজ ছেলেকে গিলে খেয়েছে কিনা। অনেকটা মদ যেমন নেশারুকে গিলে ফেলে। শুধোলেন - সরোদটা আছে?
- কি যে বল বাবা। সরোদ দিয়ে কি হবে? মাথাটা ফেটে যাচ্ছে রাগে, দুঃখে, অপমানে। আর তুমি বলছ সরোদ।
- বলছি তার কারণ আছে। বল না আছে কিনা? বৌমা সরোদটা আছে না তোলা? লাস্ট কবে বাজিয়েছিলি মনে আছে?
- হ্যাঁ বাবা। আছে যেন, ছাদের ঘরে।
- মনে আছে। ছোটমামুর বাড়িতে জলসা হয়েছিল মাম্মার দ্বিরাগমনের রাতে। যোগ বাজিয়েছিলাম।
বিদীপ্তা এই অপ্রাসঙ্গিক যোগাযোগটা ঠাহর করার চেষ্টা করে। বিয়ে হওয়া অবধি ছাদের ঘরে দেখেছে সরোদটা। বাবার বাড়িতে যেহেতু গান বাজনার খুব একটা চল নেই, তাই এই ব্যাপারে ওর আগ্রহও একটু কম। সুবিমলবাবু আবার বলতে শুরু করেন - দেখ সুদীপ, 'নুইসেন্স' শব্দটা যদিও খুব শক্ত আর যন্ত্রণাদায়ক শব্দ, তবুও বলি যন্ত্রণা কি আমরা আমাদের কম বাড়িয়েছি? আমিও তো তোকে যন্ত্র হয়ে যন্ত্রণা পেতেই শিখিয়েছি রে। তুই শুধু এগিয়ে গেছিস। পড়ায় ভালো ছিলি। পড়েই গেছিস। কাজে ভালো। কাজ করে যাচ্ছিস। সব ভালো। কিন্তু, তোর দ্বারা ভুল হতে পারে, এটা হয়তো আমরাই শেখাইনি তোকে। ভুল ছোট হোক আর বড় হোক। ভুলকে ভুল হিসাবে গ্রহণ করতে পারা আরও শক্ত বাবা। তোর যে লেখার হাতটা ভালো ছিল, আমরা তাকে গুরুত্ব দেই নি। তোর বাজনার হাতটাও কি ভালোই না ছিল। তোর ছোটমামা কত চেয়েছিল সরোদ নিয়েই তোর পেশা হোক। আমিই না করেছিলাম সত্যি। আজ মানি। ওটাও আমার ভুল ছিল হয়তো। আমাদের চাওয়ার জন্য তুই এগিয়ে গেছিস। কিন্তু হারতে শেখাতে পারি নি তোকে। হারতে শেখাটাও জরুটি। শোন, তোর বস তোর উপর যতটা নির্ভর করেন, তাতে বিরক্ত হয়ে নুইসেন্স বেরিয়ে আসতে পারে। তবে তুই অতটাও কাজের গভীরে তলিয়ে যাস না, যেখান থেকে তোকে ফিরে পেতে আমার যন্ত্রণা হয়। কষ্ট হয়। নেহ, উঠে পর। শুতে যা।
এঁটো হাতে বিদীপ্তা নতুন করে সুদীপ্তকে আবিষ্কার করে। আর চেনেই বা কতদিন, এইতো বছর চারেক হতে চলল বিয়ের। যে লোক রোজ রোজ অফিসের চাপে ক্লান্ত বিধস্ত হয়ে ফেরে তার সত্যি নিজের দিকে আর তাকানোর সময় থাকে নাকি। নিজের শখ আল্লহাদ ভালো লাগা কিংবা না লাগা সব ঠিক করে দেয় অন্য কেউ। ওর যেমন বাচ্চাদের পড়াতে ভালো লাগে, ভাগ্য করে সেই কাজই পেয়েছে।
হঠাৎই বিদীপ্তার মনে হয়, সরোদটা যদি সুদীপ্তর চোখের সামনে রাখা যায়! হাতের কাজ সেরে ছাদের ঘর থেকে সরোদটা নামিয়ে আনে আলতো হাতে। দেখে তো মনে হয় তার-টার ঠিকই আছে। মুছে যত্ন করে গুছিয়ে রাখে বিছানার বাঁ পাশের ওই লম্বাটে বক্স ডিভানের উপর। দেখে যদি ইচ্ছা জাগে সুদীপ্তর। বাঁ দিকেই ঘুমায় সুদীপ্ত। এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
যোগ-এর আলাপে ঘুম ভেঙ্গে যায় সুবিমলবাবুর। আলাপ অবরোহনে ফিরছে শুদ্ধ গা, মা, কোমল গা, সা হয়ে। বিদীপ্তা পর্দা সরিয়ে দেখছে, ভোর হচ্ছে সবে।
0 comments: