6

গল্প - পিউ মহাপাত্র

Posted in
গল্প


বড়ির ডায়েরি
পিউ মহাপাত্র


লাহাবাড়ির ভেতর ঘরের সিঁড়িগুলো এরকমই ভেজা ভেজা অন্ধকারে জুবুথুবু যেন। অনেকটা ভাগবদদার খইনি খাওয়া দাঁতের মত এলোমেলো, ক্ষয়াটে। সদরের মুখে নির্জীব বাল্বটার ঘোলাটে আলোয় দিনমান ঝিমোয় যেন সিঁড়িগুলো একের পিঠে এক পড়ে পড়ে। ওদের বুকে পা ঠেকাতে ভয় লাগে বড়ির - যদি নড়ে চড়ে জেগে ওঠে কোনও এক দিন? সত্যি যদি জেগে ওঠে!!

ভ্যাপসা সরু খাড়াইটুকু বেয়ে, সেই একতলা থেকে ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে তিনতলায় পৌঁছাতে মনে হয় সিঁড়িগুলোরও হাঁফ ধরে যায়। জিরিয়ে নেয় ওরাও খানিক খানিক ওই বড়ি, বড়ির দাদা, পিকান আর পাপ্পুদের সাথে, এ পাড়ার পাঁচ মেশালি কুচোকাঁচাদের দল। তিনতলার মুখেই আধা ভেজানো দরজা। এর পাল্লা দুটো পুরোপুরি কোনদিনও বন্ধ হতে দেখেনি বড়ি। দরজার কাছে, শেষের চার পাঁচটা সিঁড়ি না উঠেই থমকে দাঁড়ায় ও।

‘জিতুদা আছে?’ গলা বাড়িয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় পিকানদা। ওর এই সবে ক্লাস নাইনে পা। জিতুদার মত শুঁয়ো শুঁয়ো নরম গোঁফের রেখা না উঠলেও, গলা ভাঙছে খানিক খানিক। ওর প্রশ্নটাতে দোরগোড়ায় বসা জুবুথুবু মূর্তিটার হেলদোল হয় না বিশেষ। একপাশ ফিরে আপন মনে বসে বসেই দুলে যায় কেবল। ‘ও ও ঠাকমা...বলি...তোমার পেয়ারের নাতি ঘরে আছে?’ এবার খানিক খানিক কথাগুলো ঢোকে বুঝি ঝোলা ঝোলা কান দুটোয়। কান দুটো দেখলেই গা শিরশির করে বড়ির। দুলের ফুটো দুটো বাড়তে বাড়তে কখন দু টুকরো করে দিয়েছে নরম লতিটাকে। নির্জীব ঢোড়া সাপের জিভের মত ওরাও দোলে জিতুর ঠাকমার সাথে। ডাঁটি ভাঙা চশমার কাঁচ পেরিয়ে অসাড় মনি দুটো আস্তে আস্তে স্থির হয় ওদের পানে। বড়ি দেখে ঘোলাটে বাল্বটার মতই হলদেটে সে চাউনি।

‘ক্যাড়া? ক্যাড়া আসছ্যাস ? কি আনছ্যাস, ঝালমুড়ি??’

এরপর শুকনো পাকানো হাতদুটো কেঁপে কেঁপে জুড়ে যায় ওদের সামনে। পেতে ধরা হাতদুটো নিঃশব্দে আকুতি করে যেন ... ‘দাও... দাও।’ দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁটের চামড়াগুলো ছিঁড়তে থাকে বড়ি। নোনতা নোনতা ব্যথাটা ঠোঁট থেকে চারিয়ে যায় গভীরে, আরও গভীরে কোথাও।

‘ধ্যুত শালা!’ নামতে নামতে পিকানদার স্বগতোক্তি কানে আসে। দুড়দাড় সিঁড়ি টপকে, তিনতলার দমবন্ধ থেকে দোতলার অন্ধকারে পা ঠেকে ওদের। খানিক বাঁক নেয় সিঁড়িটা এবার, বুড়ো অজগরের অলস বাঁক। আর ঠিক এইখানেই, সিঁড়ির ডান দিকের দেওয়ালে, বরফি ছকে জাফরিটা গাঁথা। কচি নাক আর গুলতির মত চোখদুটোকে ঘুলঘুলির ফোঁকর দিয়ে সেঁদিয়ে দেয় বড়ি। আবছা হলেও বুঝতে পারে ঠিক, জাফরির ওপারেও ধুলো ধুলো আন্ধকার নিথর, জমাট। এ বাঁকে আসলে থামতেই হয় বড়িকে কি এক টানে। ঠাহর করার চেষ্টা করে ওইপারের ছোট্ট খুপরি ঘরটাকে। অনেক আগে, সে কত আগে তা বড়িও ঠিক ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না ওর নয় বছরের বয়েসের মাপকাঠি দিয়ে, তখন নাকি এই ঘরটাকে অমন আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে দেওয়া হয়নি মোটেও। এই লাহাবাড়ির সোনা দিদিমার কোন এক কচি বিধবা মেয়ের ঠাকুর ঠাকুর খেলনা ঘর ছিল নাকি। সেই ছোট্ট লক্ষ্মী রোজ বসতো পাঁচালী নিয়ে। ধুপ ধুপ ধোঁয়ায় মাখা মিঠা কদমা, কাটা শাঁকালু, শসার মিষ্টি গন্ধ পিদিম জ্বালালেই যেন এখুনি পাওয়া যাবে ওই ঘরে। বড়ির তো তাই মনে হয়। এমন ভাবতে বড় ভাল লাগে বড়ির।

আর ক’ ধাপ পরেই ভাঙা সদর দরজাটা পেরিয়ে বিকেলের ফরসা আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢোকে। আর ঠিক এইখানে... এই বাঁকে পিকানদাও বিরতি নেয় মাঝে সাঝেই। ‘যা ... যা নাম তোরা ! আমি আসছি।’ পিকানের এই কথা শুনে বড়ির দাদার মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে, গলাতেও। নেমে যেতে যেতে বন্ধুকে বলে যায়, ‘ওস্তাদি করিস নে পিকান। জিতের বাবা দেখলে তোর লাশ ফেলে দেবে।’ বেরিয়ে জেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে দেখে বড়ি, পিকানদা কবর দেওয়া ঠাকুর ঘরের দেওয়ালের দিকে ফিরতে ফিরতে প্যান্টের চেন টানছে যেন। একটা আস্ত মিনিট পেরতে দেওয়ার আগেই সদর পেরিয়ে বেরিয়ে আসে ক্লাস নাইনের ফার্স্ট বয় পিকান কান এঁটো করা বিজয়ী হাসি নিয়ে।

মাঝে মাঝেই আসে ওরা এই লাহাবাড়িতে। জিতুদাকে ছাড়া খেলা জমে না ওদের, বিশেষত দাদাদের। বড়, বিনি, চিকিরা হল এলেবেলে। পিট্টু খেলার সময় আচ্ছাসে পেটানোর জন্যেই বোধহয় নেওয়া হয় ওদের। যেদিন যেদিন পাত্তা পায়না মেয়েগুলো, নিজেরা জটলা করে গোল গোল খেলে। এ পাড়াটার একটা দিকের বেশ বয়স হয়েছে। নান্টু মামাদের ভাঙা খুপরি আর লাহাবাড়ির লড়ঝড়ে পেল্লাই তিনমহলা দিয়ে এদিকটা ঢাকা। গলির বাকি দু দিক অবশ্য দিব্যি ছিমছাম। তিন চার তলার মধ্যবিত্ত ফ্যাট বাড়ি আর নকশা কাটা গ্রিল। গ্রিলে গ্রিলে অবশ্য গামছা নইলে আন্ডারওয়্যার ঝোলে। বড়ির মত মন খাড়া করে শুনলে ঠিক বুঝতে পারা যাবে, এই পড়ন্ত বিকেলে কচিকাঁচাদের শোরগোল নতুন বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে ফিরে আসছে যেন। আর সেইগুলিকে কি ভীষণ এক খিদেয় চুষে নিচ্ছে ওই লাহাবাড়ির নুন ছাল ওঠা, নিঝুম দেয়ালগুলো। খোপ খোপ আন্ধকারে জারিয়ে নিচ্ছে, জমিয়ে রাখছে পরম যত্নে।

মা মাঝে মাঝেই বাবাকে শোনায়, ‘ওদিকটা ভেঙে নতুন বাড়ি হলে বাঁচি।’

‘এ জায়গাটার ভ্যালু জানো? কোনও কন্ট্র্যাক্টর ধান্দা করছে না বলতে চাও?’ সকালের খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে চালাক চালাক কথাগুলো তারিয়ে তারিয়ে বলে বাবা।

গোল গোল খেলার সময় গোটা চারেক গোল কাটে ওরা। ম্যানহোলের ঢাকনিটাও একটা গোল বঠে। তবে ওতে বিশেষ কেউ দাঁড়াতে চায় না, ওই বড়ি বাদে। কালচে রিংটার ওপর ঠ্যাঙ বেঁকিয়ে নিশ্চিন্তে দাঁড়ায় ও আর ভাবতে থাকে, ভেবেই চলে। লাহাবাড়িটা ভেঙ্গে দিলে, ওর চামড়া ফাটিয়ে বেড়ে ওঠা বটগাছটার কি গতি হবে। ওতে একটা কাকের বাসা আছে। সহজে ঠাহর করা যায় না বঠে, তবে বড়ি জানে। ওটার পাশেই ফাটা জলের পাইপটার সারা গায়ে ক্ষতের মত দগদগে জং। ফোঁটায় ফোঁটায় লালচে জল চুঁয়ে চুঁয়ে একটা ছবি হচ্ছে নোনা দেওয়ালটা জুড়ে। রোজ তৈরি হচ্ছে... রোজই একটু একটু করে। একটা বুড়ির জুবুথুবু অবয়ব যেন। মাথাটা হয়েছে, গাটাও। এবার বর্ষায় পাটাও হয়ে যাবে ঠিক। তারপর একদিন রাতে, পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখবে হয়তো বড়ি জলপড়া লালচে ছবিটা আস্তে আস্তে দুলছে যেন। দুলছে আর হাত জোড় করে বলছে ... দাও ...দাও। শিরশির করে ওঠে বড়ির শিরদাঁড়ার ল্যাজাটুকু।

‘সং-এর মত দাঁড়িয়ে থাকবি তো খেলতে নামিস কেন?’

বড়ি দেখে পপির মুখটা মুড়ির ঠোঙ্গার মত কুঁচকে। ওর কাঁচা লঙ্কার মত বিনুনি দুটো যত না ঝুলে তার চেয়ে বেশি উঠে। অগত্যা গণ্ডির বাইরে পা রাখতেই হয়ে। আর রাখতে না রাখতেই চোর !

‘মরলেই বাঁচি!!’ জিতুদার সঙ্গে ওর হাওয়াই চটি পরা পা দুটোও যেন ঝাঁকি মেরে বলে ওঠে একই কথা। ‘তোর ঠাকমা না?’ কে যেন ফুট কাটে। ‘তো?!!’ টুসকি মেরে জিতুদার পাল্টা জবাব।

‘সেই কবেকার কাসুন্দি ঘেঁটে চলেছে বাপেতে আর তার মায়েতে। সহ্য হয় না আর।’ জিতু ওরফে জিতে দাদার বাকি বন্ধুদের চেয়ে ঢের বেশি সরেস। বছর বছর পাশ না করলে কি হয়, একটানে একটা আস্ত বিড়ি ফুঁকে দিতে পারে। দাদাদের কাছে জিতুদার আকর্ষণ প্রবল। বড়ির কাছেও। তবে সেটা বোধহয় ওর বাড়িটার জন্যে। মরলেই বাঁচি... মরলেই বাঁচি... কথাগুলো বাদুড়ের মত ডানা ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে মগজের কোন এক অন্ধকার গলিতে ফিরে গেল যেন। জামির লেনের একতলা ভাড়া বাড়িটার কলতলায় পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল খালি খালি। সন্ধ্যার মা ছাই দিয়ে থালা বাটি ঘসতে ঘসতে গজ গজ করত রোজই, ‘আবাগী গুলো মরলেই বাঁচি।’ যেদিন যেদিন কাজ বাড়িতে ওর ছোট মেয়েটাকে বয়ে আনত, মেজাজ থাকত তিরিখ্যে। বলেই চলত, ‘মরণ হয় না তোর ?’ বড়ির মাও নিমপাতা মাখা গলায়, একই সুরে প্রায় অন্য কথা বলত, ‘মেয়েকে বাইরে বসাও সন্ধ্যার মা। মাথা ভরতি উকুন। উফ!!’ ‘সন্ধ্যার মায়ের উকুন নেই মা’, আবাক চোখের বড়ির নির্দোষ প্রশ্নটাকে, দুর্বাসা মুনির দৃষ্টি দিয়ে চুপ করিয়ে দিতেন মা। শিঁটকে সরে আসতে আসতে বড়ি আড় চোখে দ্যাখে ‘মরলেই বাঁচি’ তখন মন দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘসে ঘসে একরাশ কালো কালো ময়লা তুলছে। বাবাগো... বলে শিউড়ে পালায় বড়ি। তবু না ভেবে পারে না...ওই ‘মরলেই বাঁচির’ খড়ি ওঠা চামড়াটা যদি ওর বাঁ হাতের হত তো বেশ হত। নখ দিয়ে দাগ কেটে কেটে ছবি আঁকা যেত বেশ। নিদেন পক্ষে বীরেন স্যর-এর অঙ্ক ক্লাসে কিছু না হলে কাটাকুটি। সকালের জ্যাম পাঁঊরুটির ঠিক মাঝখানটুকু চিবোতে চিবোতে চোখে পড়ত সিঁড়ির বাইরের দৃশ্যটা। সন্ধ্যার মা আর তার মেয়ে বাসি হাতরুটি পাকিয়ে চায়ে ডুবিয়ে মুখে ঢোকাচ্ছে। ‘মরলেই বাঁচির’ মুখে তখন বাঁচার কি দারুণ তৃপ্তি। মায়ে মেয়ে খাচ্ছে আর দুলে যাচ্ছে... ঠিক জিতুর ঠাকুমার মত।

সব কটা সিঁড়িই এখন দাঁত খিঁচিয়ে চেয়ে আছে যেন বড়ির দিকে। পারতপক্ষে এদিকে একা আসেই না ও। বাড়ির আনাচে কানাচে যে ছায়াগুলো ঘাপটি মেরে ঘুমায়, তারা আজ বড়িকে একলা পেয়ে ওদের কালোকুলো আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। ‘রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে...’ বিড়বিড় করতে করতে ও ওর নড়বড়ে সাহসটাকে ঠেকনা দেওয়ার চেষ্টা চালায় আপ্রাণ। তিনতলার দোরজুড়ে নিঃসাড় মূর্তিটার এত কাছে আগে আসেনি কখন বড়ি। ওর ডান হাতের ছোট্ট মুঠিটাকে এগিয়ে দিয়ে... জোর করে কথা দুটোকে ঠেলে বার করে গলা থেকে... ‘এই নাও!’ জীবন্ত পুঁটলিটা আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরায়। মরা মাছের মত ছানি পড়া চোখ দুটো, নয় বছরের বড়ির কাছে ভয়ানক পেল্লাই আর ভীষণ মৃত। কাঁপতে কাঁপতে হাতদুটো জুড়ে গিয়ে পাত পাতে। Eclairs লজেন্সের ছোঁয়া পেয়েই র‍্যাপার খলার সেকি তড়বড়ানি।

ব্যাকগিয়ার-এ পিছোতে পিছোতে বড়ি দেখে কি আবেশ আরামে দুটো চোখ গ্যাছে বুজে। তোবড়ানো গাল দুটো চুষেই যাচ্ছে... চুষেই যাচ্ছে... এক্কেবারে ওর তিন বছরের ভাইটার মতোই। দুলে যাচ্ছে আর চুষে যাচ্ছে এক পরম তৃপ্তিতে। পেছন ফিরে এবার দুরদাড়িয়ে নামে বড়ি। সিঁড়িগুলোর ভয়কে ছাপিয়ে নাকে আসে চেনা ঝাঁঝালো গন্ধটা... ঠিক যেখানে পিকানদা মাঝে মাঝেই বিরতি নেয়। দমবন্ধ করে শেষ ধাপ ক’টা পেরিয়ে আসে ও। সদর দরজা ঠেলে সন্ধ্যার ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারে মুখে। ‘আহ’ আপনি বেরিয়ে আসে একঝলক স্বস্তি। আবছা আলোয় ঠিক ঠাহর করা যায় না, বাড়ির ঠোঁটের কোনে পিকানের সেই হাসিটাই লেগে ছিল কিনা।

6 comments:

  1. মায়াময় লেখা!

    ReplyDelete
  2. খুব খুব সুন্দর হয়েছে। বিশেষ করে তুলনাগুলো। জল সত্যিই ছবি আঁকে পুরনো দেওয়ালে, কেউ value জানে না!

    ReplyDelete
  3. দারুন লিখেছিস।

    ReplyDelete
  4. ছবির মতো লেখা ।ছবি গুলো চেনা।খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  5. Apoorbo likhechhish boRia ��

    ReplyDelete