0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

ধারাবাহিক


আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়



১০) 
অশোক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নীলরঙা বাসটি নগোইখার গাঁয়ের সামনে থেমে জনাতিনেক যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে পোড়া ডিজেলের কালচে ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে কোরবা নগরীর দিকে বেরিয়ে গেল। 

একটা শাড়ি দিয়ে বাঁধা পোঁটলি, তাই মাথায় করে হাঁটতে থাকে দ্রুপতী বাঈ। বাসরাস্তা আড়াআড়ি পেরিয়ে ঢোকে নগোইখার গাঁয়ে। 

এখন ভরদুপুর। আশ্বিনের শেষ, তবু রোদ্দূরের যা ঝাঁঝ। ধূলোয় ভরা মেঠো রাস্তা। এখনও কয়েক কোশ পথ। এর পর আসবে আগারখার গাঁ, তারপর আহিরণ নদী। নদীর ওপারে বলগীখার গ্রাম। সেখানে ভারত সরকারের কোল ইন্ডিয়া কয়লা খাদান খুলবে। হবে ওপেন কাস্ট মাইনিং। 

বিশাল এরিয়া জুড়ে জমির অধিগ্রহণ হবে। পাটোয়ারির চেন ধরে ধরে জমির জরিপ, মাপজোক, গাঁয়ের লোকজনকে নোটিস, ক্ষতিপূরণের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, তা নিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি সবই চলছে। মানে, জমিটি শুধু আড়ে বহরে কতখানি তাই নয়, সেটি বহেরা নাকি টিকরা, নাকি ভাটাজমিন? অর্থাৎ ধানচাষের নাকি শাকসব্জি ফলাবার বেলেমাটি অথবা রুক্ষ পাথুরে? আবার তাতে কুয়ো আছে কি নেই,ফলদার বৃক্ষ অথবা ইমারতী, মানে আম-জাম-কাঁঠাল- সজনে অথবাসেগুন, বীজা, মেহগনি,সীসম, নিদেনপক্ষে শাল বা বাবুল? আবার জমিটি চাষের না হয়ে আবাদি বা বাসযোগ্য হলে তাতে বাড়ি আছে কি নেই ? থাকলে কাঁচা না পাকা? তার মাপজোক, চৌহদ্দি? খাজনা দেওয়া আছে নাকি বকেয়া? হ্যানো- ত্যানো- সাতসতেরো? 

দ্রুপতী অতশত বোঝে না, এসব মালিকমন বা ক্ষমতাশীলদের ব্যাপার। ও হলো আদার ব্যাপারি। বর্ষাকালে অলগুরামের ইঁটভাটার কাজ শেষ হয়েছিল। শুরু হবে সেই শীতের গোড়ায়, দীপাবলী তেওহারের পরে। কিন্তু ততদিন খাবে কী? পাপী পেট কা সওয়াল হ্যাঁয় বাবা! তা অলগুর ছেলে ফিরতরাম, ওর নবযৌবনের আশিক, ওকে একটা চিরকূটে দু’লাইন লিখে দিয়েছে। সেটা নিয়ে ওকে যেতে হবে আহিরণের পূবপাড়ে বলগীখার খাদানের জন্যে খোঁড়াখুঁড়ির ঠিকেদার চামাররায়ের কাছে। ও ফিরতের বন্ধু, দুরুপতীকে মাটি বওয়ার রেজার কাজে নিয়ে নেবে। চাটাইয়ের বেড়ার দেওয়াল আর টিনের চালের মজদুর ঝোপড়া। সেখানে থাকা, হপ্তায় হপ্তায় বনিভূতি, মানে মজুরি। দুরুপতীর একরকম চলে যাবে। মাত্র কয়েকমাসের ব্যাপার। তারপর ইঁটভাট্টার কাজ শুরু হলে আবার নিজের গাঁয়ে ফিরে আসলেই হবে। 

এইসব কথাই ফিরত বলেছিল আগের দিন, তারাভরা রাতে আহিরণের পশ্চিমপাড়ে ছোটকি ছুরি গাঁয়ের সীমান্তে পলাশ গাছের গোড়ায়, পাশাপাশি শুয়ে। আরও বলেছিল যে এই সময়টা ওকে ছেড়ে থাকতে ফিরতের খুব কষ্ট হবে। কষ্ট ব্যাপারটা দুরুপতী ঠিক বোঝে না। 

যন্ত্রণা বোঝে। সেই যে ছোট্টবেলায় বাপের সঙ্গে আহিরণের ওপারের জঙ্গলে কাঠ বয়ে আনার সময় ভালুর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল তখন জন্তুটার বড়ো বড়ো বাঁকা নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে যাওয়া খুবলে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা খুব মনে আছে। আর হাসপাতালে যখন নিয়মিত ব্যান্ডেজ খুলে ওষুধ লাগাত তার ব্যথাও মনে আছে। কিন্তু একরকম বোদা অনুভূতি আছে, যাকে দুরুপতী বাঈ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। 

বছর চার আগে যখন বাপু বুখার আর কিরকম এক ব্যথায় ধনুকের মত বেঁকে বেঁকে উঠছিল আর গোঙাচ্ছিল, দুরুপতী কী করবে বুঝতে পারছিল না। ও খবর দিল আমোল সিং বৈগাকে। নিয়ে এল হলুদ, ধূনো, লাললংকা আর ঝাঁটা। গোবর দিয়ে ঘরের দাওয়া নিকিয়ে চট পেতে বাবাকে বৈগার সামনে শুইয়ে দিল। শুরু হলো ঝাড়-ফুঁক। ওর কুঁড়েঘরের সামনে তামাশা দেখা লোকের ভীড় বেড়ে উঠল। কিন্তু বৈগা হার মেনে বলল—আমাকে খবর দিতে দেরি করেছ। 

চন্দু ডাক্তারও তাই বললেন—এত দেরিতে ডাকলি? এটা তো মনে হচ্ছে ধনুষ্টংকার। এই পায়ে ছোট্ট ঘা কিসের? 

তিনদিন আগে সাউজির ঘরে কাঠ চেরাই করার সময় পায়ে একটা পেরেক ফুটে গেছল, তারই ঘাও। 

ছোট্ট দুরুপতী বোঝেনি তার দোষটা কোথায়? কেন বাপু আর উঠবে না? সেটাই কি কষ্ট? মানে ওই বোদা ভাবটা? ওরকম আর একবার হয়েছিল। বাবা চলে যাওয়ার এক বছর পরে সাউজির বাড়িতে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বাসন মাজার সময় হটাৎ তলপেটে একটা যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে খেয়াল হয় ওর জামার তলায় ইজের ভিজে যাচ্ছে। তারপর অবাক হয়ে দেখে রক্তের একটি ধারা ধীরে ধীরে পা বেয়ে গড়িয়ে নামছে। ওর গা গুলিয়ে ওঠে। ওকে কি কোন অপদেবতার নজর লাগল? ভয় পেয়ে সোজা বাড়ির বড়ো গিন্নি তাঈমার কাছে গিয়ে নিজের ব্যথা ও ভয়ের কথা বলে ফেলে। 

সাউগিন্নির মুখচোখের ভাষা দ্রুত বদলে গেল। উনি কঠিন মুখে ওকে দূর করে দিয়ে বাড়ির অন্য নোকরাণীকে বললেন দ্রুপতীর ধোওয়া সমস্ত বাসনকোসন অপবিত্র হয়ে গেছে। সেগুলোকে আবার করে সাবান জল দিয়ে ধুতে হবে। 

তারপর অবাক চোখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে খিঁচিয়ে উঠে বললেন—দাঁড়িয়ে আছিস কেন, হতভাগী? বাপকে খেয়েছিস! এখন তোর কালোছায়া আমাদের বাড়িতে যেন না পড়ে। 

দুরুপতী সেদিনও বুঝে উঠতে পারে নি ওর দোষটা কী? কহাঁ গলতি হুয়ী? বড়ো বড়ো চোখে সাউগিন্নিকে দেখল, তারপর আস্তে আস্তে পেছনে সরতে সরতে এক ছুট। নিজের কুঁড়ে ঘরে। 

কিন্তু বাপ সেবার আকাশে তারা হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেই ঘর এর নিজের রইল কোথায়? ওদের সমাজের পঞ্চায়েতের বৈঠকে চাচা বলল যে ভাইঝির খাওয়া-পরার দায়িত্ব ও নেবে বৈকি! কিন্তু ওদের কুঁড়ে ঘরটা কাগজপত্তরে চাচা অনন্দরামের হয়ে যাবে। মোড়ল বা ‘সিয়ান’দের কাছে এটা খুবই যুক্তিসংগত প্রস্তাব। 

তারপর থেকে দ্রুপতীর খাওয়া পরার চিন্তা ঘুচল বটে, চাচা ও চাচি ওর সঙ্গে ভালই ব্যবহার করে। ওর চাচেরা ছোটভাই ও বড়ী বহনের সঙ্গে কোন ভেদভাব করে না। দিদির শাড়ি ওকে দেওয়া হয়। আর বছরে একবার দিওয়ালির সময় সবার জন্যে জনতা শাড়ি অথবা লুগরা। তবে ঘরের কাজকম্মে ‘হাত বটানা পড়তা হ্যাঁয়’। আর গরীবের ঘরে সবাই কাজ করে। চাচি ও দিদি বর্ষার দিনে খেতে ধান রুইতে যায়, আবার কার্তিকের দিনে ধান কাটতে। ওরা মুঠো মুঠো করে পাকাধানের গোছা ধরে, যেন অবাধ্য মেয়ের চুলের মুঠি ধরেছে। তারপর কাস্তের এক পোঁচে ঘ্যাচাং! 

কিন্তু দ্রুপতী তঁখনও ছোট, তাই চাচি ওকে খেতের কাজে না পাঠিয়ে সাউগিন্নির কাছে ফুট-ফরমাস খাটতে লাগিয়ে দিয়েছিল, আর আজ এই কান্ড। 

আজ বাড়ি ফিরে দেখে ঘরের দরজায় শেকল তোলা, একটা শস্তার তালা ঝুলছে। ও হতাশ হয়ে দাওয়ায় বসে পড়ে। মাকে ওর মনে পড়ে না,কিন্তু দু’বছর আগে হটাৎ করে জ্বর ও ধনুষ্টংকারে আকাশে তারা হয়ে যাওয়া বাপের কথা খুব মনে পড়ে,বিশেষ করে অল্পবয়সে ভালুকের সঙ্গে বাপ-বেটিতে মিলে সেই মরণপণ লড়াই। আজ সেই বাপের কথা মনে করে ওর চোখ দিয়ে কখন জল গড়াচ্ছিল তা ও নিজেই টের পায় নি। 

চটকা ভাঙল চচেরি বহন নোনীবাঈয়ের কথায়ঃ ‘ কী রে! কী হয়েছে? 

ও জলভরা চোখে দিদির দিকে তাকিয়ে দেখায় পা বেয়ে একটু আগে নেমে আসা রক্তের দাগ, এখন একটু কালচে দেখাচ্ছে। 

নোনীবাঈ গোল গোল চোখ করে ওকে দেখতে থাকে। তারপর একটা অস্ফুট উল্লাসের শব্দ, ও জড়িয়ে ধরেছে ছোট বহনকে। --আরে তু বড়ী হো গয়ী। জয় কোসগাঈ মহতারী কী! 

দ্রুপতী কান্না ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দিদির দিকে। ও তালা খুলতে খুলতে বলে –চল, ঘর লে কপড়া লেকর হমন আহিরণ যাবো; নহাকে সাফসুতরা হোকে আনা পড়ি। ওকর বাদ মন্দির মা পূজা চড়ানা পড়ি। তু অব মা বননে কী লায়ক বনে হস। 

দ্রুপতী ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে নি। নোনীবাঈ হেসে গড়িয়ে পড়ে। 

--অইসন জোজোয়া কস তাকতস কাবর? নদী যাওত যাওত তোলা সমঝাবো। কোনও ডরে কে বাত নো হাবে। 

অমন হাঁদার মত তাকাচ্ছিস কেন? নদী যেতে যেতে তোকে সব বুঝিয়ে দেব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। 

সত্যিই সব বুঝিয়ে দেয় নোনীবাঈ। মা-বাপ হারানো এই খুড়তুতো বোনের জন্যে হটাৎ ওর মনে জেগে উঠেছে মমতার এক চোরাস্রোত; কেন, তা ও নিজেও জানে না। 

দ্রূপতীর ভয় কেটে গেছে। অবাক বিস্ময়ে শুনেছে মানবজন্মের চিরন্তন রহস্য। নোনীবাঈ এও জানায় যে আগামী অগহনে (অঘ্রাণ মাসে) ওর বিয়ে। তারপর ও চলে যাবে জাঁজগীর জেলার বলোদা গাঁয়ে, ওর শ্বশুরবাড়িতে। ওর আদমি ওখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিওন। নোনীবাঈ দ্রুপতীর থেকে কথা আদায় করে ওর অবর্তমানে মা-বাবা আর ছোট ভাই দুকালুরামকে দেখাশুনো করার। 

তারপর একদিন দ্রুপতীরও বিয়ে হবে। ততদিনে দুকালু বড়ো হয়ে ওর বাবা-মার দেখাশুনো করবে। 

মানুষ ভাবে এক, হয় আর। নোনীর বিয়ের পরে বছর ঘোরার আগেই চাচা-চাচি দ্রুপতীর ‘হাত পীলা’ করার বন্দোবস্ত করে ফেলল। চাচি ওর সুন্দর করে চুল বেঁধে চোখে কাজল লাগিয়ে নোনীবাঈয়ের একটি শাড়ি পরিয়ে হাজির করল বারান্দায় কাঠের রংচটা চেয়ারে বসা একজন পুরুষমানুষের সামনে। সে ওকে হাঁটিয়ে চুল খুলিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটা টাকা তুলে দিল চাচির হাতে। 

সাতদিন পরে ‘ফলদান’, তারপরের সপ্তমী শুক্লাতিথিতে বিয়ে। কানাঘুষোয় শুনল যে ওর হবুস্বামী দোজবরে। আগের পক্ষের তিনটে ছোট ছোট মেয়ে আছে, ছেলে নেই। এরা তানাখার গ্রামের মাঝারিগোছের কিষাণ পরিবার, একই জাতের। বংশের ধারা ধরে রাখতে ছেলে চাই। বিয়ের আগে ওদের ‘সিয়ান’ ও গুরুগোঁসাইয়ের ওকে দেখে বেশ লক্ষ্মীমন্ত মনে হয়েছে। তাই চাচা-চাচির কোন বড়ো খরচা হলো না। উলটে কিছু লক্ষ্মীলাভ হলো। তাতে নিমন্ত্রিতদের চা ও পটেলের দোকানের ভাজিয়া খাওয়ানো গেল। সাহুপরিবার থেকে একটি লালের উপর কালো ডোরাকাটা শাড়ি উপহার পেল দুরুপতী। 

বিয়ের সময় মন্ডপ মানে জঙ্গলের গাছ কেটে সাজানো আসর বা মড়োয়ায় চাঁদোয়ার বরের টোপর ও মালায় জড়ানো মুখে কোন ভাব প্রকাশ পেল না। বর হাসে না কেন? 

বিয়ের পর্ব চুকে যাওয়ার শেষ অনুষ্ঠানে যজ্ঞের আগুন নিভিয়ে আমপাতা দিয়ে শান্তিজল ছিটিয়ে দেবার পর বৈগা পুরোহিত ওদের আশীর্বাদ করে বলে এবার তোমরা পতি-পত্নী হলে। সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকবে। সাতো- বচন নিভাওগে। সাতটি শপথ মেনে চলবে। 

আর শোন, কার্তিক পূন্নিমের রাতে চিড়িয়ামন ঘোঁসলা মা জেইসন করথে তুমন এইসন করিহ। কার্তিক পূর্ণিমার রাতে পাখিরা নিজেদের বাসায় যা করে তোমরাও— 

দ্রুপতীর মাথায় কিছু ঢোকে না,ওর ঘুম পায়। খালি চোখে পড়ে পুরোহিতের শেষ কথাটির সময় ওর নতুন দুলহা কেমন জুলজুলে চোখে ওকে দেখছে। 

বিদায়ের সময় চাচি ও নোনীদিদির সুর তুলে বিলাপ করে কান্না দেখে ছোট ভাইটাও কেঁদে উঠল। চাচা ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বিড়বিড় করলেন—বেটি হোথে পরায়া ধন। ভাইয়া উপর সে জরুর দেখ রহে। ম্যায় ওকর বেটি লা সময় পর বিহা করাই দিহে। জরুর খুশ হোয়থে। 

মেয়ে হলো পরের আমানত। দাদা নিশ্চয় উপর থেকে সব দেখছেন, খুশি হচ্ছেন যে আমি ওঁর খুকিকে সময়মত বিয়ে দিয়েছি। 

বর-বৌ চলেছে সাইকেল করে। বর একটায়, কনেবৌ অন্যটায়। সামনে চলেছে ঢম ঢম শব্দে গাঁয়ের কুকুরদের পিলে চমকে দিয়ে তিনজন ‘গাড়া বাজা’র দল। এর খরচা সরপঞ্চ কুমারসায়েবের। গাঁয়ের সাহসিনী ‘ভালুমার’ দ্রুপতী বিদায় হচ্ছে যে! পেছন পেছন চলেছে গাঁয়ের ছেলে ছোকরার দল, এরা সবাই যাবে ছুরিগাঁয়ের ‘সরহদ’ পর্য্যন্ত। 



সাইকেল ওর চাচা যৌতুক দিয়েছে, সিন্ধি দোকান থেকে ধারে, মাসিক কিস্তিতে শোধ দেবার কড়ারে। সাইকেল ঠেলে নিয়ে চলেছে দুজন ছুরিগাঁয়ের যুবক, ওদের সমাজের। তানাখার গাঁয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে তবে ওদের ছুটি। বরের বাড়ি থেকে ওদের খাওয়ানো হবে ‘ঠান্ডা চা’ ও গরম ভাজিয়া। আর ফুলশয্যার দিন তানাখার গাঁয়ে বরপক্ষের পার্টিতে ওরা নিমন্ত্রিত থাকবে; খাবে ‘বোগরাভাত’—খাসির মাংসের ঝোলভাত। 

কিন্তু ‘ভালুমার’দ্রুপতীর ফুলশয্যা আর হলো না। 

দ্রুপতী শ্বশুরবাড়ি দেখে বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। পাকাবাড়ি,অনেকগুলো ঘর, কিন্তু কেমন যেন অগোছালো। অনেকটা সাঊবাড়ির মত। কিন্তু পেছনে গোটা চারেক দেশি বলদ আর হাইগ্রেড মুররা ভৈঁস বাঁধা রয়েছে। তাই গোটা বাড়িতে গোবর গোবর গন্ধ। ওর যে ঘরটা তার কোনায় ও কিছু খড় গাদা করে রাখা; তার উপর চটের বস্তা ও একটা হাঁসুয়া। 

কাঠের ফ্রেমে শণের দড়ি দিয়ে বোনা খাটিয়ায় মশারি টাঙানো। ঘরের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে একটা টেমি জ্বলছে। একথালা ভাত খেয়ে জামাকাপড় বদলে ও মশারির ভেতরে ঢুকল। বড্ড গরম, নাকের পাটায় ও কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে। চাচি কী যেন বলেছিল? 

ও হ্যাঁ, শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে খুশ করতে হবে। বড়োদের সম্মান করতে হবে। পতি পরমেশ্বর হোয়থে। ওকর বাত মাননা পঢ়হি, ওলা খুশ রখনা পঢ়ি। তবে সবাই ধন্য ধন্য করবে। ও যেন এমন কিছু না করে যাতে চাচাচাচির বা ছুরিগাঁয়ের বদনাম হয়। 

এইসব সাতকাহন ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত দুরুপতী কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছেঁড়া মশারির ফুটো দিয়ে ঢোকা মশকবাহিনীর অবিরাম আক্রমণ ও টের পেল না। অভ্যাসের বশে কখনও হাত নেড়ে দু-একটাকে সরিয়ে দিচ্ছিল, কখনও রক্তচুষে কচ্ছপ হয়ে পড়া মশা ওর হাতের থাবড়ায় চেপটে যাচ্ছিল। 

ঘুমটা ভাঙল এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে। 

সেই আহিরণের পারে ছোটকি ছুরি গাঁয়ের জঙ্গল। সেই কোসম ও মহুয়াগাছের আড়াল থেকে ভালুকের হামলা। তবে সেবার ভালুক আক্রমণ করেছিল বাপুকে, ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাপুকে বাঁচাতে, আর সেবার হাতে ছিল কুড়ুল। কিন্তু এবার ভালুকটা আক্রমণ করেছে সোজা ওকে আর একেবারে বুকের উপর সওয়ার হয়েছে। 

খুবলে খাচ্ছে ওর শরীর, ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে ওর জামাকাপড়। ভালুকের মুখের লালায় ভিজে যাচ্ছে ওর গাল, ওর গলা। আর ভালুকের শরীর ও মুখে মহুয়ার গন্ধ। ও প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওকে বুকের থেকে নামাতে পারছে না। কিন্তু স্বপ্নে বাপু নেই কেন? কুড়ুলটা কই? বাপুকে ছাড়া একা ও কী করে পেরে উঠবে? ভয়ে ওর হাত পা অবশ হয়ে আসে। কপালের পুরনো সেলাইয়ের জায়গাটা ছুঁয়ে যায় ভালুকের জিভ আর চিনচিনে ব্যথায় মরিয়া হয়ে জেগে ওঠে সেই পুরনো ভালুমার দ্রুপতী। একঝটকায় ভালুককে সরিয়ে ভালুর তলপেটে পা ও হাঁটুর গুঁতোয় ওকে কাবু করে ফেলে। ভালু অপ্রত্যাশিত এই পালটা হামলায় মশারি ছিঁড়ে দ্রুপতীকে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ে যায়। 

ঘরের মধ্যে ভালুর হামলা! টেমি কখন নিভে গেছে। 

দ্রুপতী কোনরকমে উঠে পরে দৌড়য় ঘরের কোনায়, খড়ের গাদায় হয় কুড়ুল নয় কিছু একটা পাবে এই দুরাশায়। কিন্তু ভালুক বড়ো সেয়ানা, তায় মহুয়ায় মাতাল। এই চুহা-বিল্লি খেলায় ও বেশ মজা পেয়েছে। খিল খিল হেসে ওকে কায়দা করে ধরে ফেলে খড়ের গাদায় পটকে দেয়। এবার ওর নিস্তার নেই। শরীরের শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। ও লড়াই করা ছেড়ে দেয়। ও বিশ্বাস করতে চায় যে যা ঘটছে তা দুঃসপ্ন, সত্যি নয়। এমন তো আগেও দেখেছে। খালি এবার বাবা সঙ্গে নেই। ওর বুকের উপর আবার ভালুক সওয়ার হয়েছে। আর খড়ের গাদায় ওর নড়াচড়ার বিশেষ সুযোগ নেই। ভালু যেন কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছে, ওর শ্বাস পড়ছে বিলম্বিত লয়ে। দ্রুপতী এবার গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যেতে চায়। 

দুই জানুর সন্ধিস্থলে প্রচন্ড যন্ত্রণায় ওর বোধ হলো যে যা ঘটছে তা স্বপ্ন নয়। ভীষণ এক ভয়ে আচ্ছন্ন দ্রুপতী ছটফট করে হাতড়ায়। হাতে ঠেকে হাঁসুয়া। 

এবার একটা প্রচন্ড চড়ে ওর গাল ও মাথা ঝনঝনিয়ে ওঠে। আর তার পরেই এক আসুরিক চিৎকার—মোলা মার ডারিস এ ডাইন ! মোলা বাঁচালে! 

ডাইনিটা আমায় মেরে ফেলল গো! আমায় বাঁচাও ! 

দ্রুপতী কিছু না ভেবেই যন্ত্রের মত চালিয়ে দিয়েছিল হাঁসুয়াটা। ভালুকের কোথায় লেগেছে কিচ্ছু বোজে নি। এবার বিজলির মত এক চমকে পরিষ্কার হয় যে ওর আঘাতে আহত হয়েছে একজন মানুষ। তার আর্তনাদে জেগে উঠছে অন্য ঘরের লোকজন, শোনা যাচ্ছে নানান গলার স্বর, জ্বলে উঠছে টেমি ও মোমবাতি। পরিস্থিতি বুঝতে ওর একটুও দেরি হয় না। এক ঝটকায় উঠে পড়ে ও দরজার খিল খুলে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে। পেরিয়ে যায় শ্বশুরবাড়ির আঙিনা, ঢুকে পড়ে পেছনের সজনে ও কুলগাছের জঙ্গলে। রাতচরা পাখিরা ডানা ঝাপটায়,ও থামে না। কোনদিকে দৌড়ূচ্ছে তাও জানে না। খালি জানে ওকে নদীর দিকে যেতে হবে। সাঁতরে আহিরণ পেরিয়ে গেলে ও নিরাপদ। শ্বশুরের পরিবার বা তানাখারের লোকজন ওর নাগাল পাবে না। 

কতক্ষণ হলো ও জানে না। তবে ও পেরিয়ে গেছে নদীর পার। আহিরণের এ পাড়ে পঞ্চায়েত হলো ছুরিকলাঁ গাঁয়ের, সরপঞ্চ কুমারসাহেব। কিন্তু এটা কোন গাঁ ? আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। দেরি করা চলবে না। লোকজন ভোর ভোর লোটা নিয়ে প্রাতকৃত্য করতে নদীর পাড়ে জঙ্গলের দিকে আসে। মেয়েরা আসে স্নান করে কলসি ভরে জল নিয়ে যেতে। ওদের কাউকে জিজ্ঞেস করে ছুরি গাঁয়ের রাস্তা জেনে নেওয়া যাবে। 

কিন্তু তার আগে ওকেও স্নান করে পরিষ্কার হতে হবে। এমনিতেই হাঁটু জল পেরোতে গিয়ে পায়ের দিকে শাড়ি ভিজে গেছে। বড্ড অশুচি লাগছে নিজেকে। 



১১) 

কতক্ষণ ধরে হেঁটেছে দ্রুপতী? তা ঘন্টাখানেক হবে নিশ্চয়ই। ঘামে ভিজে গেছে পিঠ। একটু জল খেতে পারলে হত। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখে পড়ল ‘আঙনবাড়ি’ বা একধরণের সরকারি ক্রেচ। ওর সামনেই একটা টিউকল, নাকি হাথপাম্প। ও পোঁটলা নামিয়ে রাখে আঙনবাড়ির বারান্দায়। তারপর একহাতে জোরে পাম্প করে আরেক হাত চটপট পাম্পের মুখে লাগিয়ে শুষে নেয় জল। এভাবে খেতে গিয়ে ভিজে যায় ওর জামা, ভেজে কপাল মুখ সামনের চুল। 

আঃ, কী শান্তি! কী আরাম! আঙনবাড়ি থেকে ভেসে আসছে বাচ্চাদের কলকল; আর আয়াদিদিমণির উঁচু আওয়াজ। একটু বড়ো বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে দুইয়ের ঘরের নামতা। --দো একম দো; দো দুনে চার! দো তিয়া ছে--! 

দ্রুপতীর চেহারায় একটা মুচকি হাসি খেলে যায়। ভুলে যাওয়া কোন দিনের কথা। না,ওদের সময় কোন আঙনবাড়ি, বালবাড়ি এসব ছুরিগাঁয়ে হয় নি। তবে ও গেছল কয়েক বছর ছুরির সরকারি আদর্শ বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে; সেই ভালুকের সঙ্গে লড়াইয়ের পরের বছর। শিখেছিল হিন্দিতে নিজের নাম দাগা বুলিয়ে লিখতে। জেনেছিল --লেজওলা ছোট্টমত দৌড়ে পালানো ধানচালের বস্তায় ফুটো করা কাপড় ‘কুতর কুতর কে’ কুটকুটিয়ে কেটে ফেলা দুষ্টু মিষ্টিটাকে ‘মুসুয়া’ বলে না, বলতে হয় ‘চুহা’ অথবা শুদ্ধ করে বললে ‘মূষিক’। আর শিখতে হয়েছিল কিছু ‘পাহাড়া’, অর্থাৎ নামতা। বেশ সুর করে দুলে দুলে উঁচুগলায় বলতে হত। ওর পাঁচের ঘরের ‘পাহাড়া’ অনেকটা মনে আছে। হাতের পাঁচ আঙুল নেড়ে নেড়ে ‘পাঁচ একম পাঁচ, পাঁচ দুনে দশ, পাঁচ তিয়া—‘ নাঃ,মনে পড়ছে না তো! 

--তঁয় ছুরিগাঁওকে দুরুপতী নো হস? 

ও চমকে ওঠে। এখানে কে ওকে চিনে ফেলল? পাঁচবছর হয়ে গেল ও এদিকের ছায়া মাড়ায় নি। তাহলে? ও লোকটির দিকে ভাল করে তাকায়। ঘামে তেলতেলে মুখ, মাথার মাঝখান দিয়ে পরিপাটি করে সিঁথে কাটা, কায়দা করে পরা রঙিন কুর্তা আর ছোট জ্যাকেট, হলদে ছোপানো ধুতি হাঁটুর নীচে। তবে পায়ে রঙিন মোজা ও গাঁয়ের মুচির তৈরি নাগরা জুতো। না,একে দ্রুপতী কস্মিনকালেও দেখেনি। 

--কস না ও! তঁয় ওহ ভালুমার টুরি নো হস? 

এ তো দেখছি আমার জনমপত্রিকা (ঠিকুজিকুষ্ঠি) খুলে বসেছে! এর মতলবটা কী? দ্রুপতী সতর্ক হয়, আত্মরক্ষার তাগিদে কাঁটা উঁচিয়ে খ্যারখ্যার করে ওঠে। 

--মহু টুরি হন,কোনো গাঁওকে, তোর কা মতলব? তঁয় আপন বাত লা বাতা। 

আমি যে গাঁয়ের মেয়ে হই,তাতে তোর কী? কাজের কথা বল। 

--ধৎ তেরিকে! তু তো বুরা মান গয়ী। আরে আমি কি খারাপ কিছু বলেছি? 

--তুই ব্যাটা কে- সেটাই বলিস নি। 

-- আমি বিসরু, মনগাঁওয়ের বিসরু; আমার আছে সর্বমঙ্গলা নাচা পার্টি। যাচ্ছি ছুরি গাঁওয়ের সরপঞ্চ কুমারসাহেবের কাছে। নগৈখার পৌঁছে বড়োরাস্তায় বাস ধরব। আগামী গণেশপূজোয় আমার দলের প্রোগ্রাম হবে তার বায়না করতে এসেছি। এবার নতুন পালা লিখেছি—ধানকাটার পর গাঁ থেকে দলে দলে দিল্লি এলাহাবাদ ভোপালে জন খাটতে যায়, সেই সমস্যা নিয়ে। নাম দিয়েছি ‘পলায়ন’। গাঁ ছেড়ে পালানো। একেবারে মারকাটারি পালা; জনতা কো, জনগণেশকো জগানা হ্যাঁয় না? মেরা কাম এহি হ্যাঁয়, গাঁও গাঁও মেঁ ঘুম ঘুম কর অলখ জগানা। তুই তো গণেশপঞ্চমীর সময় ছুরিতে থাকবি, তখন দেখিস আমার পালাগান। 

[ ‘নাচা’ হলো ছত্তিশগড়ের ‘যাত্রা’।] 

এই লম্বা ‘ভাষণ’ শুনতে শুনতে দ্রুপতী হেসে ফেলে। এই মূর্তিমান বিসরুই বটে, বিসরু নাচাওলা। কিন্তু ওকে দ্রুপতী দেখেছে মুখে রং মাখা অবস্থায়, কখনও মূল পালাগায়ক, কখনও ভিলেন, কখনও ‘জোক্কার’ বা’ভাঁড়’ সাজা অবস্থায়। 

ও বলে যে গণেশপূজোর পালাগান অনেক পরের ব্যাপার, তখন দেখা যাবে’খন। এখন ও নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে। বলগীখার কয়লাখাদানে রেজার কাজ পাওয়া যাচ্ছে। 

বিসরু গম্ভীর হয়, তারপর বলে –শোন, তোর সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল। তোর ভালর জন্যেই। 

দ্রুপতী কঠিন চোখে ওকে দেখে; দম নেয়। --বলে ফ্যাল। 

-- তানাখার গ্রামের দিকে যাস না। 

--মানে? 

-- বলগীখার যেতে হলে তোকে তো ওপারে তানাখার গ্রামের পাশ দিয়েই যেতে হবে। মানে তোর শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের? 

ঠিক কথা নদী পেরোলেই বলগীখার আর তার গায়ে লাগা গ্রাম হলো তানাখার। 

--কাল বিকেলে তোর সোয়ামী মারা গেছে। তুই এখন বিধবা। সিঁদুর মুছতে হবে, আরও কত কী আছে। 

দ্রুপতী বোবাচোখে তাকায়। তারপর বলে যে সেসব বছর তিন আগের কথা। ও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ছুরিগাঁয়ে চলে এসেছিল। আর যায় নি; ওর ‘গৌনা’ হয় নি। ফুলশয্যা হয় নি। সে বিয়ে তো দুধভাত। ফেরত এসে ও তো আর সিঁদুর পরে নি; কাজেই মোছার কথা উঠছে কেন? 

বিসরু পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ধূলোয় দাগ কাটে। তারপর বলে যে আসল কথা হলো সেই যে হাঁসুয়ার আঘাত, সেটা বিষিয়ে গেছল। অনেক ওষুধপত্তর করে ভুগে ভুগে কাল লোকটা মারা গেছে। ওদের গুরুঠাকুর বলেছেন যে আসলে গ্রহণ লেগেছে। ওর ডাইনি বউয়ের কালোছায়া পড়েছে। তাই গোটা পরিবার আর ওদের পাড়ার লোক ক্ষেপে উঠেছে। এখন সামনে দুরুপতী এসে পড়লে রাগের মাথায় কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। 

তাহলে? 

তাহলে এর সমাধান হতে পারে ছুরিগাঁয়ে ফিরে যাওয়া এবং মাসখানেক পরে শ্রাদ্ধশান্তি প্রেতশুদ্ধি দেবীভাগবত পাঠ, নওধা রামায়ণ ( টানা নয়দিন ধরে মঞ্চে বিভিন্ন গানের দল মিলে পালা করে রামায়ণ গান)—এসব চুকে গেলে তবে কাজের খোঁজে এ তল্লাটে আসা। 

ততদিন খাবে কী? 

বিসরুর সঙ্গে বাসে করে ফিরে চলুক দুরুপতী। ও তো সরপঞ্চ সায়েবের কাছেই যাচ্ছে। উনি ঠিক পঞ্চায়েতের কোন রাস্তা তৈরি বা অমনি কোন কাজে লাগিয়ে দেবেন। 

দুরুপতীর মাথা ঘুরতে থাকে। 

এ যেন আগে মেলায় দেখা কোন সিনেমা এ বছর আবার দেখছে। 

তিনবছর আগের সেই কাকভোরে আহিরণের হাঁটুজলে স্নান করে ও রাস্তা খুঁজে নিয়ে ছুরিগাঁয়ে ফিরে এসে চাচা-চাচির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। 

ওরা অবাক। সাতসকালে এ কী কান্ড! সব শুনে চাচার চেহারা গম্ভীর। ওরা গরীব মানুষ ভেবে পাচ্ছে না এর পরিণাম কী হবে! চাচা জানালেন যে রাস্তা এক হী হ্যাঁয়। দুরুপতীকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে হবে। বিয়ে হবার পর ওটাই ওর আশ্রয়। ও ঘোর অন্যায় করেছে। ওকে স্বামী শ্বশুরের পায়ে ধরে ক্ষমাভিক্ষে করতে হবে। 

ও চাচার পায়ে পড়ল। বলল তোমরা শাস্তি দাও, যা বল সব মেনে নেব। কিন্তু ওখানে ফিরে যাব না। ওমন আদমী নো হে, জানোয়ার হাবে। জঙ্গলী ভালু হাবে। চাচির মন অজানা ভয়ে কাঁপছিল। ওকে আগে একথালা বোরেবাসি (পান্তাভাত) লংকাপোড়া দিয়ে খাইয়ে ভেতরের ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল যে বাকি কথা পরে হবে। নোনীদিদি কোন কথা না বলে একটা পোঁটলা বাঁধছিল; সন্ধ্যেবেলা ওর স্বামী ওকে নিতে আসবে। ও ফিরে যাবে শ্বশুরবাড়িতে, জাঁজগীর জেলার বলোদা গাঁয়ে। চাচা-চাচি বাইরের ঘরে কথা বলছে। ও কাঁথা জড়িয়ে নোনীর জেরার জবাবে সব কথা খুলে বলল। 

কথা ফুরোয় নি, এর মধ্যে ঘরের সামনে বেশ কিছু লোকের উঁচুগলায় কথাবার্তা শোনা গেল। 

নোনী একবার উঁকি দিয়ে দেখেই দৌড়ে ভেতরে এসে বলল –শীগগির ওঠ। আঁচলে এই দশটা টাকা বেঁধে নে। আর তোর বোঁচকা তুলে পেছনের দরজা দিয়ে পালা। দৌড়ো যত জোরে পারিস। বস্তিএলাকা এড়িয়ে নদীর দিকে যাবি। নদী পেরিয়ে ঝোড়াসিরকি গাঁয়ের দিকে যাবি। কোথায় থাকবি কী খাবি জানি নে। যদি এ যাত্রা কোসগাইদেবীর দয়ায় বেঁচে যাস তো আমার শ্বশুরবাড়ি বলোদা গাঁয়ে পৌঁছে যাস। আমার পতি সরকারি চাপরাশি। আমার কথা ফেলবে না। কোথাও রাস্তা তৈরি কি পুকুরকাটার কাজে লাগিয়ে দেবে। যা বোন, আর দেরি করিস না। 

এদিকে ধুন্ধুমার লেগে গেছে। 

তানাখার গাঁ থেকে দ্রুপতীর শ্বশুর ও বেশ কয়েকজন পুরুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ওদের উঠোনে ঢুকে তড়পাচ্ছে—বের করে দিক দ্রুপতীকে, ওদের খুনি ডাইনি ছেলেবৌকে। ওরা নিশ্চিত যে মেয়েটা পালিয়ে এদিকেই কোথাও এসেছে। ওর চাচি হাতজোড় করছে। কিন্তু ওরা কোন কথা শুনতে রাজি নয়। দ্রুপতীর বর হাঁসুয়ার ঘায়ে রক্তপাতের ফলে অচৈতন্য, অবস্থা ভাল নয়। কাঠঘোরা সদর হাসপাতালে ভর্তি। যদি ওর কিছু হয় তো দ্রুপতীর গোটা খানদান বাড়িঘর সবাই খাল্লাস !ওদের এত স্পর্ধা! নিশ্চয়ই বাপের বাড়ি থেকে ফুসমন্তর দেওয়া হয়েছে। নইলে অতটুকু মেয়ের কী করে এমন আস্পদ্ধা হয়! অথবা মেয়েটার স্বভাব চরিত্র খারাপ, নইলে বিয়ের প্রথম রাতেই কি কেউ সোয়ামিকে মেরে ফেলতে চায়? 

দেখতে দেখতে ভীড় করে এল গোটা পাড়া; এল পাশের সতনামী পাড়া থেকে জোয়ানমদ্দ-বুড়োর দল। এরা প্রথমে এল তামাশা দেখতে। সাতসকালে ওদের জীবনের একঘেয়েমির মাঝে এমন মনোরঞ্জন! সবাই মানল যে এমন অলক্ষুণে কান্ড ছুরিগাঁয়ে না কেউ দেখেছে, না শুনেছে। প্রথমে তো কারও বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ওদের গাঁয়ের নতুন বিয়ে হওয়া বাচ্চামেয়ে দ্রুপতী এমন কিছু করতে পারে। হলেও বা ভালুমার, তা বলে নিজের স্বামীকে? 

দ্রুত পারদ চড়ছিল তানাখারের আগন্তুক দলটির। সবাই সহমত হলো যে দুরুপতীকে ফেরত পাঠাতে হবে আর স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার শ্বশুরবাড়ির আছে এবং ওদের চৌদ্দপুরুষের কপাল ভাল যে ওরা থানায় গিয়ে খুনের মামলা দায়ের না করে ঘরের বৌকে নিজের হাতে শাস্তি দেবে ঠিক করেছে। 

এবার একটাই কাজ বাকি, মেয়েটাকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে তুলে দেওয়া। চোখের জল মুছতে মুছতে চাচি ও তার মেয়ে নোনী গেল ঘরের ভেতর। 

টান টান উত্তেজনা। মেয়েটা অন্যায় করেছে শাস্তি পাবে। ওকে চুলের মুঠি ধরে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাবে তানাখারের ওরা। একটু খারাপ লাগবে, কিন্তু ওর কৃতকর্মের ফল তো ওকেই ভুগতে হবে। কেউ নড়ছে না,কথাবার্তা চলছে নীচু পর্দায়। 

অনেকক্ষণ হলো, ওরা যে ঢুকেছে আর বেরোয় না কেন! 

বধ্যভূমিতে জল্লাদ প্রস্তুত; ভক্ত ও দর্শকেরা আগ্রহে অধীর। কিন্তু ‘বলি’ কোথায়? 

সবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল বলে। শেষে সবাই তাড়া দেওয়ায় চাচা গেল ভাইঝিকে বাইরে বের করে আনতে। কয়েক মিনিট; তারপরেই কান্নার রোল। 

বলি পালিয়ে গেছে। শূন্য হাড়িকাঠ। 

কোথায় গেছে? সকালবেলায় চারদিকেই লোকজনের চলাচল। কারও চোখে পড়ল না? 

এই পাড়ার কাছেই দুটো পুকুর। তবে কী তাতে ডুব দিল? সে সম্ভাবনাও কেউ কেউ তুলল। কালামুহী! জনমজলী! জন্মের সময় মাকে খেয়েছে। কয়েকবছর আগে বাপ কে। আপদ বিদেয় হয়েছে। পরিবার ও গোটা পাড়ার মুখে কালি লেপে দিয়েছিল। 

কিন্তু তানাখার বাহিনী অত সহজে ভোলে না। ওদের বলি চাই। সুর চড়তে লাগল। মেয়ের চাচা জোচ্চোর, ঠগ প্রমাণিত হলো। বিয়ের খরচা নিয়ে এখন পাত্রপক্ষকে বোকা বানিয়েছে। টাকা ফেরৎ দিক, নইলে— 

নইলে থানায় নালিশ হবে। হত্যার চেষ্টা,টাকা হাতানো—গোটা পরিবারকে কোমরে দড়ি বেঁধে গাঁ ঘুরিয়ে জেলে পোরা হবে। পাড়ার সবাই হাতজোড় করতে লাগল। বাচ্চামেয়ের অপরাধে পরিবারকে জেলে পোরা! না,না,এ হতে পারে না; এটা বাড়াবাড়ি। 

এদের দুর্বল ভেবে তানাখারের দল সুর আরও চড়াল। একজন মাত্রা ছাড়িয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলল যে ছুরিকলাঁ গ্রাম হলো জোচ্চোরের গ্রাম; যত ঠগ আর চলতা পূর্জা মানুষের মেলা। সবাই ষড় করে মেয়েটাকে আগেভাগে লুকিয়ে ফেলেছে। 

ব্যস, আতসবাজিতে আগুন লেগে গেল। গ্রাম তুলে কথা! ছুরিকলাঁ কে ইজ্জত কী সওয়াল! 

সতনামী ও রাউতপাড়া থেকে বেরিয়ে এল অনেকগুলো লাঠি। সংখ্যায় তানাখারের লেঠেলদের থেকে আড়াইগুণ। ব্যাপারটা মাথা ফাটানোর দিকে গড়ানোর আগেই প্রবীণেরা মাঠে নামলেন। সরপঞ্চ, রসেলু, কর্মণলাল এঁরা মাঝখানে দাঁড়ালেন। বেগতিক দেখে পাত্রপক্ষের সুর নরম হলো। 

শেষে ফয়সালা হলো যে এই মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি আর ফেরত নেবে না। থানাপুলিশও করবে না। বদলে মেয়ের চাচাকে বিয়ের খাইখরচা বাবদ নেওয়া তিনহাজার টাকা ও দলটিকে ‘বোগরা-ভাত’ খাওয়ানোর জন্যে আরও পঞ্চাশটাকা নগদ গুণে দেবে। আর ওই অলক্ষুণে ‘ডায়ন’ যেন আগামী দু’বছর তানাখার গাঁয়ের ছায়াও না মাড়ায়। এর অন্যথা হলে মেয়েটার ভালমন্দের দায়িত্ব ওর শ্বশুরবাড়ির অথবা ওই গাঁয়ের সমাজের নয়। 

নগদ টাকা ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবার কোথা থেকে দেবে? ডাক্তার চন্দু কাশ্যপ তিনহাজার টাকা গুণে পাত্রপক্ষের হাতে তুলে দিলেন আর কুমারসাহেবের পকেট থেকে বেরোল পঞ্চাশ টাকা। কৃতজ্ঞতায় গলে মুসুরির ডাল হয়ে চাচা ডাক্তারসায়েব ও কুমারসায়েবের পায়ে পড়ল। 

তবে ওকে হাতকাগজে টিপছাপ দিয়ে কবুল করতে হলো যে মাসে দু’পার্সেন্ট হারে ওকে সুদ দিতে হবে। আর খেতের কাজের সময় ওকে ওই দুই ঋণদাতার জমিতে আগে জন খাটতে হবে, পরে অন্যদের জমিতে। 



সাতদিন পর ঘরে ফিরল দ্রুপতী। ও কারও কথা শোনে নি, দিদির শ্বশুরবাড়িতেও যায় নি। সহজবুদ্ধিতে সোজা নদীর ওপারে কোসগাই পাহাড়ের চুড়োয় দেবীমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। পূজারী মহারাজ সব কথা শুনে ওকে মন্দিরে রাত কাটাতে এবং প্রসাদান্ন খেয়ে পেট ভরাতে অনুমতি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, নিরাপদ আশ্রয়। 

বিসরু নাচাওলার সঙ্গে ফিরতি বাসে বসে দ্রুপতী ভাবছিল—সেই পুরনো খেলা আবার! সেই কুমারসাহেবের দয়াভিক্ষা! 

অনেক ভেবেও এছাড়া কোন উপায় দেখতে পেল না দ্রুপতী। বাস ছুরিকলাঁ গাঁয়ের স্টপে থেমেছে।

0 comments: