জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে
Posted in জংলা ডায়েরি
জংলা ডায়েরি- ৩
শিবাংশু দে
৫.
আরো উত্তরে যাবো? বদনাম পলামু? চান্দওয়া,লাতেহার, লেসলিগঞ্জ, গাড়ওয়া। বাঙালি জঙ্গলবিলাসী লেখকদের গল্পে বারবার এসে পড়ে। এখন তো সেসব মুক্তাঞ্চল। সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে থাকা বনজঙ্গল। তবু ডালট্নগঞ্জ থেকে দক্ষিণে যদি গাড়িতে বারোয়াডির দিকে, তবে মাঝামাঝি জায়গায় বেতলার উত্তর গেটটির একটু আগে নর্থ কোয়েলের উপর যে কালভার্ট ব্রিজটি আছে, সেখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বাঁদিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে নদী নেমে আসছে আর ডানদিকে দুতিন কিমি যতোটা চোখ যায়, তার মধ্যে নদী চারটি বাঁক নিয়েছে। অমন বিপজ্জনক মনভোলানো বাঁক আমি দেশেবিদেশে কোনও সুন্দরীতমা নারীর শরীরেও কখনও দেখিনি। খাজুরাহোর পূর্ণদেহী পত্রলেখার পাথরের শরীরে তার একটু ছায়া পাওয়া যাবে হয়তো। তার কাছেই, বাঁদিকের পাহাড়ে পায়ে পায়ে উঠে গেলে কেঁচকি বনবাংলো। অরণ্যের দিনরাত্রি, মনে পড়ে?
তবে 'আহা' বলি, বলতে হয়। আমাদের দলমা পাহাড়, দলমা রেঞ্জ। নিজের বাড়ি। সিংভূম আর মানভূমের মাঝখানে আড়াল করে রেখেছে, সবুজে সবুজ তুমি নীলিমায় নীল। সোজা উত্তরে মানগোয় পেরিয়ে যাওয়া সুবর্ণরেখা। জাতীয় সড়ক ৩৩। আসনবনি থেকে ডান দিকে গাড়ির রাস্তা। খানিকটা অল্প চড়াই। হরিণবাগান, আদিবাসী গ্রাম। ফাগুন আসার আগেই চারদিকে আগুন জ্বলছে পলাশের ডালজোড়া। হেঁটে যেতুম তিরিশ বছর আগে, এখন জীপে। চড়াই, চড়াই, রাস্তা চড়ছে। একদিকে খাই, অন্যদিকে বনময় মাটির উড়ান। শালই রাজা, সঙ্গে আছে বাবলা, শিরিস আর কুলের বন। টানা ফুল ফুটে আছে বুগেনভিলিয়া, দশটা রঙে। মাটির কাছে পুটুস আর আকন্দ আর আকাশছোঁয়া শালপাতার কাঁচা সবুজ। বর্ষাকালে এখানে হাতীর সাম্রাজ্য, আসা মানা। বসন্তকালেই ডাকে এর পূর্ব থেকে পশ্চিমে টানা বনভূমি। পূবদিকে বেলপাহাড়ি, ঝরি, রানিবাঁধ আর ঝিলিমিলি। পশ্চিম পারে দলমা রেঞ্জ মিলে যাচ্ছে চান্ডিল-গামারিয়া রেঞ্জের সঙ্গে। গড়াতে গড়াতে জঙ্গল পৌঁছে যায় সারান্ডা রেঞ্জ। যেতে পারি, কেন যাবোনা? বনবিভাগের বাংলো পিন্ড্রাবেড়ায়, একটু নীচুতে। কিন্তু থাকা যায় ভালো। বেশি বায়নাক্কা না থাকলেই হলো। ডিমের ঝোল আর গরম রুটি। ফাস্ট কেলাস।ঝোলা বারান্দায় বসে দূরে আঁধারে জামশেদপুর শহরে আলোর অমরাবতী। নীল, হলুদ, সোনালি, রুপোলি। গান শোনাবেন রাশিদ খান আর আখতারিবাই। রামকুমারই বা বাদ থাকেন কেন? বাদ যাবে " আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।" বাঙালির মুনলাইট পিকনিকের গান। এতোদিনেও মুগ্ধা জননীর সন্তানেরা গান শুনতে শেখেনি। ভোরবেলা পাকদন্ডি ধরে উঠে যাওয়া একটু দক্ষিণে টাটাবাবার অতিথশালায়। ফির্দৌসে জমিনস্ত। হাত বাড়ালেই আকাশ আর নীচে নেমে যাওয়া স্তরে স্তরে সবুজঘেরা হাজার রঙের ফুলের আগুন। অগোছালো, অসংসারী, অগৃহিণী বনকুমারীর ঘরসংসার। ঢুকতে গেলে পাসপোর্ট লাগে। ব্যাংকের পাসবুক বাড়িতে রেখে আসতে হয়। সবাই পারেনা। মধ্যরাতে আকণ্ঠ দারুপান করে অতিথশালার টানা বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ম্যানেজারসাহেব, তোমাকে আরো একবার জন্মাতে হবে হে।
৬.
"..... বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে,
পরাঙ্মুখ সবুজ নালি ঘাস দুয়ার চেপে ধরে...."
বাংলা কবিতার সঙ্গে সম্বন্ধ নেই এমন বাঙালিরাও এই দুটো লাইন কবিতা শুনলে ঠিক চিনতে পারেন,
তার পর সেই চিরন্তন প্রশ্ন, অবনী কী আমি ? সে কী বাড়িতে আছে? জঙ্গল কি আদৌ 'বাড়ি' হতে পারে? আমার উত্তর, একশোবার হবে। আমি তো সেখানেই থাকি। এমন 'বাড়ি' ছেড়ে কোথায় আর যাবো? এমন বাড়ি তো আমার আরো আছে। সেই কোথায়, কতোদূরে চেরাপুঞ্জি, মোসিনরাম বা বর্ষাকালে কোহিমার জাপফু পাহাড়। আর প্রায় 'পৃথিবী'র অন্যপ্রান্তে পশ্চিমঘাটে ইদুক্কি মুন্নারের কাছে নীলগিরির এই এরাভিকুলম জাতীয় অরণ্য। এখানে রয়েছে হিমালয়ের পর দেশের সব চেয়ে উঁচু আনামুড়ি গিরিশিখর (২৬৯৫ মিটার)। আর 'শোলা'বন। মালয়ালিতে 'শোলা' মানে ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। ইংরিজিতে যাকে বলে ট্রপিক্যাল মন্টেন। যতোদূর চোখ যায়, পাহাড়ে, সমতলে ছড়িয়ে আছে ঝোপজমি, ঘাসজমি আর চা-বাগান। রয়ে্ছে লোক্কোম জলপ্রপাত আর অসংখ্য বিরল বন্যপ্রাণী। এই পাহাড়-অরণ্যময় দৈবী সবুজের রাজপাটকে ঘিরে আছে পশ্চিমে পেরিয়ার নদী আর পূর্বদিকে কাবেরী। এখানে সত্যিই মেঘ মানুষের চারপাশে গাভীর মতো চরে বেড়ায়। না চাইতেই ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আর আদিগন্ত সবুজ ঘাস, আমাদের তাকাবার অপেক্ষায় ভিজে ভিজে চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে। কবি'র অনন্য কল্পনাও যেন প্রকৃতির আয়োজনের বিশালত্বে ফিকে পড়ে যায়।
বাঙালি পর্যটকের পৃথিবী উত্তরে মানালি'র বরফ পাহাড় আর দক্ষিণে মুন্নারকে দিয়ে ঘেরা যেন। মাঝখানে রয়েছে আরো অনেক, অন্তহীন মায়াবী সুন্দরের উপনিবেশ। আমাদের পশ্চিমঘাটে সেই রত্নগিরি থেকে প্রকৃতি দু'হাত ভরিয়ে সুন্দরের সর্বনাম ছড়াতে ছড়াতে নীলগিরি পাহাড়শ্রেণী হয়ে হয়ে নেমে আসছে। তটীয় কর্ণাটকের মঙ্গলুর, উদিপি, মারকারা হয়ে কেরালার ওয়াইনাড়, কোঝিকোড়, পালাক্কাড় হয়ে আরো দক্ষিণে এই ইদুক্কি। সেই উর্দু শ্যয়েরটা মনে পড়ে যায়। এতো সৌন্দর্য দেখার জন্য মাত্র দুটো চোখ যথেষ্ট নয়। অ্যায় খুদা, আরো কয়েকটা চোখ দাও আমাকে, নয়তো কতো কিছু অদেখা থেকে যাবে। কিন্তু যে চোখ এতো কিছু দেখে, তাতো ভিতরে লুকিয়ে। তাকে কী বাইরে ঠাহর করা যায়? এই যে নীলগিরি টানা পাহাড়, এর কাছে মেঘ এসে বলে, বারবারই বলে ' যাবো যাবো', কিন্তু যায়না। যেতে পারেনা। ওড়নার মতো জড়িয়ে থাকে পাহাড়ের সারা গায়ে।
গাড়ি তো নামিয়ে দেবে একটা পার্কিং ঘাটে। তার পর নিজেকে নিয়ে উঠে যাওয়া ঘোরানো পাহাড়ি পথে, জলের সঙ্গে, মেঘের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে। যতো উপরে যাওয়া যায়, মেঘপাহাড় ততো কাছে আসে। শুধু দেখে যাওয়া। বলার মতো কথা কিছু জমতে পারেনা। নৈঃশব্দ্যই শুধু জানাতে পারে আসল ভালোবাসার চুপকথা। মেঘ ঝরে যাচ্ছে, জল ঝরে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে পাগলা ঝোরা আর আকাশ ছোঁয়া জলপ্রপাত। কালোপাথরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রুপোলি জেদি জলের ছোটোবড়ো স্রোত। পাহাড়ে আর পাকদণ্ডি নেই। সবই বাঁধানো পিচের পথ, সিনেমাদুহিতার গণ্ডদেশের মতো মসৃণ। চা-বাগানের ছোটো ছোটো লরি আর ট্র্যাক্টর । নয়তো বনবিভাগের সবুজ জীপ। ফসিল প্রদূষণ ঐটুকুই। বাকি শুধু অক্সিজেন।
হে পথিকবর, কোথাও একদণ্ড দাঁড়িয়ে চোখ ছুটিয়ে দাও। দূরে মেঘের আড়ালে আনামুড়ি শিখরের লুকোচুরি দেখো। নয়তো মাইলের পর মাইল শ্যামলসুধায় টগোবগো উপত্যকা। চারদিকে তিনচারটে জাতীয় অরণ্যপার্ক। মানুষের সঠিক স্পর্শ প্রকৃতিকে কীভাবে আরো রমণীয় করে তুলতে পারে, তার কিছু মিসাল এখানে দেখা যাবে। আমাদের দেশের পক্ষে বিরলই বলা যায়। বনস্পতি থেকে ফার্ন/ অর্কিড, নীলগিরি হরিণ থেকে অসংখ্য রংবেরঙের পাখি, আকাশছোঁয়া পাহাড় থেকে পায়ের তলার ঘাসজমি, সব্বাই সেজেগুজে অপেক্ষা করে আছে সেই সব মানুষদের জন্য, যারা তাদের মর্যাদা দিতে পারে।
চলত মুসাফির, মোহ লিয়া রে পিঁজরেওয়ালি মুনিয়া.....
(ক্রমশ)
ক'জনা তোমার মত দেখতে জানে!
ReplyDeleteএক জন্মে আর এতো দেখা যায়! দেখার সে চোখই বা কোথায়!
ReplyDeleteবড় মায়া রহিয়া গেল!