ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সোয়ানার রহস্যময় মানুষ
নন্দিনী সেনগুপ্ত
১০
সেই নারী কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল যে ফ্রান্সেস্কো সঙ্গত কারণেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। তবে হ্যাঁ! এতে লুসিনোর কিছুমাত্র কোনো দোষ নেই। যাকিছু দোষ তা তার নিজের। হ্যাঁ, অবশ্যই ঈশ্বরের আদেশ সে একাই লঙ্ঘন করেছিল বটে, কিন্তু তাদের দুজনকেই মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ, সে একাই দোষী। লুসিনো সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সে সমস্ত ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলতে পারে, যে অপবাদে তাকে দোষী করা হয়েছে, তাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে, সে সেই দোষে দোষী নয়। এটা ঠিক যে সে সাত্ত্বিক জীবনযাপন করেনি। সে নিজেই জানেনা ঠিক কে এবং কারা তার সন্তানদের পিতা, কারণ সে পেটের দায়ে অপরিচিত মানুষ এবং পাহাড়ের ট্যুরিস্টদের কাছে অনেকসময় নিজের সতীত্ব বিক্রয় করেছে।
অবশ্যই সে অসৎ জীবনযাপন করেছে। সে নিজে তার সন্তানদের সব্বার পিতার নাম জানেনা। কারো কারো জানে। কারণ, সে বহুবার জীবনধারণের জন্য, হ্যাঁ, শুধুই বেঁচে থাকার তাগিদে অচেনা মানুষের কাছে দেহবিক্রয় করেছে।
ফ্রান্সেস্কো ক্রন্দনরতা এই মহিলার স্বীকারোক্তির পেছনে সূক্ষ্মভাবে বোনা মিথ্যের জালটা দেখতে পাচ্ছিলো না এমন নয়। সে দেখতে পেলেও এই মহিলাকে মনে মনে সাধুবাদ না জানিয়ে পারলোনা, কারণ সে কোথাও না কোথাও ঈশ্বরের প্রতি ভয়ে হোক, ভীতিতে হোক, কিছুটা সত্য তার সামনে তুলে ধরেছে। অথচ লুসিনোর কাছ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি তার নিজের সম্পর্কে। এই জায়গাটাতে হয়ত বা এই নারীটি কিছুটা এগিয়ে রয়েছে তার ভাইয়ের তুলনায়।
তবে তার স্বীকারোক্তির মধ্যেই যেন একটা অদ্ভুত খেলা কোথাও কাজ করছে। তার চোখ স্বীকার করছে, অথচ তার ভাষা যেন তার দোষটা আবৃত করতে চাইছে কোনোখানে। আসলে সেইই লুসিনোকে পাঠিয়েছিল ফ্রান্সেস্কোর কাছে। একদিন যখন সে লুগানো থেকে বাজারের দিকে গিয়েছিল, সেখানে সে এই ফ্যাকাসে তরুণ ধর্মযাজককে, ফ্রান্সেস্কোকে দেখেছিল। ফ্রান্সেস্কো চাষিদের মধ্যে, মেষপালকদের মধ্যে চারণভূমির ফসল ফলানোর নিয়মবিধি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছিল। দূর থেকে দেখেই তার মনে হয়েছিল যে এই মানুষটির কাছে যদি তার মূর্খ সন্তানগুলিকে পাঠানো সম্ভব হয়, কিছু একটা গতি হলেও হতে পারে। আসলে সেইই পরিবারের প্রধান এবং ভাই আর সন্তানদের দেখাশোনা সে নিজেই করে।
‘আপনি কত শতাংশ দোষী, - সে দোষ আপনার ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, - নাকি মিথ্যে অপবাদ আপনার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে’ ফ্রান্সেস্কো বলতে থাকে, ‘এই মুহূর্তে এই বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আপনি যদি আপনার সন্তানদের গরুছাগলের মত যাহোক করে বড় করতে না চান, তাহলে আপনাকে আপনার ভাইয়ের থেকে আলাদা থাকতেই হবে। যদি আপনারা একসঙ্গে, এক জায়গায় থাকেন, এই অপবাদ কোনোদিন আপনার পিছু ছাড়বেনা। মানুষের মুখ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তাছাড়া আপনি বুঝতে পারছেন আশাকরি যে এই পাপের পরিণাম ভয়াবহ!’
শব্দগুলি এই মহিলার মনে বিশেষ রেখাপাত করলো বলে মনে হলনা। কারণ সে চুপচাপ ঘরের কাজ করে যেতে লাগলো, কিছুটা ফ্রান্সেস্কোর উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করেই। এই কথাগুলির কোনো উত্তর দিলনা সে। এরই মধ্যে বছর পনেরোর একটি মেয়ে ঘরে ঢুকলো। সে এসে মহিলাটির হাতে হাতে কাজ করতে লাগলো। ছাগলগুলোকে খইলভূষি খেতে দিতে লাগলো। মনে হল যেন দেখতেই পায়নি যে একজন বাইরের লোক এখানে বসে আছে। গুহার মত ঘরটার ভেতরে শুধুই মেয়েটির ছায়া দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা। অথচ এই ছায়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েটি অসাধারণ সুন্দরী।
এই সৌন্দর্য দেখে হঠাৎ ফ্রান্সেস্কোর বুক ছাঁৎ করে উঠলো। সে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। বুঝতে পারছিলো না যে সে আবার সমস্ত উপদেশবাণীগুলি আওড়াতে থাকবে কিনা। সে বুঝতে পারছে যে মেয়েটির জন্মই হয়েছে এক কুৎসিত পাপাচারের মধ্য দিয়ে। শয়তান হয়তো বা তার পাপের ঘড়া উপুড় করে দেয় এরকম মুহূর্তে। অথচ কোথাও যেন এই কন্যার মধ্যে এক অদ্ভুত পবিত্রতা রয়ে গেছে। তার চেহারায়, মুখের গড়নে বোঝা যাচ্ছে যে তার শরীরে কালো মানুষের রক্ত আছে।
অদ্ভুতভাবে গুহার মাঝে এই দুটি নারীর ঘরকন্না, তাদের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে ফ্রান্সেস্কোর মনে হল যে তাদের ঘিরে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে। শয়তানের করাল ছায়া, কুৎসিত পাপের অভিশাপ তাদের ঘিরে আছে অথবা তারা বিবেকদংশনে নিয়ত দগ্ধ হয়ে চলেছে, এরকম কোনো কিছুই মনে হচ্ছিলো না তাদের দেখে। তাদের চারপাশে শয়তানের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিলোনা কোনোভাবেই।
কন্যেটি একবারও ফ্রান্সেস্কোর দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। একবারও চোখাচোখি হয়নি তাদের এর মধ্যে। হ্যাঁ, ফ্রান্সেস্কো নিজেই বরং মেয়েটিকে চশমার মধ্য দিয়ে বারবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখছিল এবং তার মন তোলপাড় হচ্ছিল কেবল এই চিন্তায় যে এরকম পাপাচারের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত সন্তান কীভাবে এত পবিত্র রূপের অধিকারিণী হতে পারে! এ কীভাবে সম্ভব যে শয়তান তার কোনো চিহ্ন রেখে যাবেনা এরকম অনাচারের মধ্য দিয়ে জন্মানো সন্তানের প্রকৃতির মধ্যে? কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি মই বেয়ে ছাদের ঘরে উঠে গেলো এবং ফ্রান্সেস্কো এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে আবার ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন হল।
‘আমি আমার ভাইকে ছেড়ে যেতে পারবোনা’... ঠাণ্ডাস্বরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করলো সেই নারী, ‘অতিকষ্টে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ওকে নাম সই করতে শিখিয়েছি, যদিও খুব বিপদে না পড়লে সে সেটাও পারেনা। কোনো টাকাকড়ির হিসেব বোঝেনা সে। মানুষে যথেচ্ছ ঠকিয়ে নেয়। সে রেলে চড়তে ভয় পায়, পথেঘাটে চলতে ভয় পায়, মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়, শহরে যেতে চায়না। আমি যেখানে যাবো সেখানে সে ভক্ত কুকুরের মত আমার পেছনে পেছনে যাবে। যদি সে আমাকে খুঁজে না পায়, আমি জানি না তার কী হবে। সে বাঁচবে কীভাবে? পথেই মরে পড়ে থাকবে হয়তো বা। তারপর আমাদের কী হবে? কোনো পুরুষ না থাকলে পরিবারে... কে দেখাশোনা করবে আমার সন্তানদের? আমার যৎসামান্য যা সম্পত্তি আছে, কীভাবে সামলাব আমি একা? আমি বাচ্চাদের নিয়ে এখানে একা থাকবার চেষ্টা করতে পারিনা এমন নয়, পারি। তবে এটা তখনি সম্ভব হবে, যদি কেউ আমার ভাইকে মিলানে নিয়ে গিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে জেলে পুরে বন্দী করে রাখে।’
‘হ্যাঁ, সেটাই হয়তো হবে অবশেষে’... দ্রুততার সঙ্গে বলে ওঠে যাজক, ‘যদি আপনি আমার ভালো পরামর্শ মেনে না চলেন, তাহলে শেষ অবধি ওকেই না জেলে যেতে হয়!’
এই কথা শুনে ক্রোধে যেন সেই নারী ফেটে পড়তে লাগলো। সে নিজে তার ভাইকে ফ্রান্সেস্কোর কাছে পাঠিয়েছে, যাতে সে ঈশ্বরের কৃপা থেকে বঞ্চিত না হয়। কিন্তু লুসিনোর যদি শেষ অবধি জেলে ঠাঁই হয়, আর সেরকম দুর্ভাগ্যের জন্য ফ্রান্সেস্কো দায়ী হয়, সেক্ষেত্রে প্রভু যীশুর কৃপাধন্য না হয়ে সমাজে ঘৃণ্য হয়ে বেঁচে থাকাই হয়তো অনেক বেশি কাম্য বলে মনে হল সেই নারীর কাছে।
সেই নারী নিজে একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলো, অথচ চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। যে এভাবে বহিষ্কৃত হয়, সে যেকোনো সময় শয়তানের বশ্যতা স্বীকার করতেই পারে। যে অপরাধ সে কোনোদিন করেনি, অথচ তাকে অপবাদ দিয়ে সমাজে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে, কে বলতে পারে যে আজ সে ঐ অপরাধ করবেনা?
এমন সময় হঠাৎ যেখানে ঐ মেয়েটি ছাদের উপরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা থেকে মিষ্টি গানের সুর ভেসে আসতে লাগলো। এক অদম্য শ্বাসের চলনে সেই সুর যেন স্বর্গীয় বিভার মত ছড়িয়ে পড়ছিল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটির ক্রোধের দহনের বৈপরীত্যে সেই সুর যেন এক অলৌকিকভাবে এসে ফ্রান্সেস্কোর আত্মাকে নাড়া দিলো।
তরুণ যাজক চমকে উঠলো। এক অদ্ভুত তরঙ্গ আন্দোলিত হল তার অন্তরে; এরকম ভাব অতীতে কখনো তার মনে জাগেনি। সুরের প্রভাবে এই গরুছাগল- মানুষের একসঙ্গে বসবাস করবার অপরিচ্ছন্ন অন্ধকূপের মত খোঁয়াড়কে ঐ মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল যেন দান্তে বর্ণিত স্বর্গোদ্যানের স্ফটিকনির্মিত পাহাড়ের গুহা; যে ঠাঁই এক দেবদূতীর সুরেলা গানে আর শান্তির পারাবতের ডানা ঝাপটানো আর কলকাকলির শব্দে আনন্দমুখরিত হয়ে উঠছে।
ফ্রান্সেস্কো দৌড়ে বেরিয়ে গেলো সেই ঘর থেকে। দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে দাঁড়ালো খোলা আকাশের নিচে। সেই বদ্ধ ঘরে থাকা ঐমুহূর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল তার পক্ষে। সুরের এরকম অভাবনীয় অলৌকিক প্রভাবের মধ্যে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না। সেই পাথরের স্তূপ থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের খোলা বাতাসের সামনে গিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। যখন মনে হল যে তার ভেতরটা একেবারে খালি লাগছে, বাতাস ছাড়া আর কিচ্ছু নেই, তখন সে দুচোখ ভরে দেখতে লাগলো পাহাড়ের রূপ। বসন্তের রাজকীয় উজ্জ্বলতায় সামনে পাহাড়ের গভীর অন্ধকার গিরিখাত, দূরে দূরে সাদা বরফঢাকা উত্তুঙ্গ শিখরগুলি, সব মিলিয়ে পাহাড়ের প্রকৃতি এক অদ্ভুত সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলে। তার আত্মা উদ্বেলিত হতে লাগলো সেই সৌন্দর্য দেখে।
সে আবার দেখতে পেলো সেই বিশাল বাদামী বাজপাখির জোড়া পাখিদুটিকে। তারা শূন্যে ডানা মেলে গোল হয়ে উড়ছে সেন্ট আগাথার চূড়া ঘিরে ঘিরে। সে মনে মনে এই অভিশপ্ত পরিবারটির জন্য প্রার্থনা করলো। ভাবতে লাগলো কীভাবে এদের সাহায্য করতে পারে। তারপর ফিরে গেলো সেই ঘরের কাছে, যেখানে চৌকাঠের উপরে ফুটে আছে হলদে ড্যান্ডেলিয়ন। ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সেই ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত নারী।
তার ভাবনার কথা জানিয়ে ফ্রান্সেস্কো তাকে বলল, ‘কিন্তু আপনি কোনোমতেই সোয়ানাতে আসতে পারবেন না; কারণটা ভালোভাবেই জানেন আপনি এবং সেটাই আপনার পক্ষে মঙ্গল!’ নারীটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
-‘আমি যদি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাই, সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে!’ তরুণ যাজক বলে যায়, ‘আমার কাজ, আমার চেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। সব্বাইকে অচ্ছুৎ বলে ঘোষণা করা হবে!’
নারীটি আবার কাঁদতে থাকে। অবশেষে জানায় যে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে এবং বাচ্চাদের সঙ্গে সেন্ট আগাথার উপাসনালয়ের বাইরে হয়ত পরে কখনো যাবে দেখা করতে।
(চলবে)
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা
0 comments: