ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২১.২
“আপনি খামোখা এত সংকোচ করছেন”, বৈদ্যজী এবার মুখ খুললেন, “যে আফিমের চোরাকারবার করে
তাকে কখনও ক্ষমা করতে নেই। এরা দুরাচারী, এরা দেশদ্রোহী”।
দারোগাজী চুপ। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, ‘জিন’ এর গুষ্টির তুষ্টি। আর কখনও বেফাঁস কিছু বলি!
বৈদ্যজী আচমকা প্রশ্ন করলেন, “জোগনাথের ঘর থেকে একটা দেশি পিস্তলও পাওয়া যায় নি, এটা
কীরকম খানাতল্লাসি”?
“ওই যা ভাবেন”, দারোগাজীর নম্র কণ্ঠস্বর। “এখন এত দেশি কাট্টা আর ক’টা আছে যে প্রত্যেক
খানাতল্লাসিতে একটা না একটা ধরা পড়বে”! উনি এবার মনে মনে হাসছেন, সত্যি! জিনের তুলনা নেই।
অভিনয় করতে গেলেও কাজ দেয়।
রূপ্পনবাবু এতক্ষণ খবরের কাগজে মুখ ঢেকে বসেছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন,” কোথায় গেল সব
দেশি পিস্তল? আপনার মালখানার স্টক শেষ”?
দারোগাজী গম্ভীর। “শুনুন, সেবার বৈদ্যজী থানায় এসে যা লেকচার ঝেড়ে গেছলেন—এসব তারই ফল।
শোনার পর যত রাজ্যের বদমাশ তাদের সব কাট্টা এলাকার বাইরে ফেলে দিয়েছে। বেশিরভাগ উন্নাও
জেলার গ্যাং এর কাছে বেচে দিয়েছে”।
বদ্রী পালোয়ান উন্নাও গেছে। এখনও ফেরে নি। বৈদ্যজী চোখ কুঁচকে কিছু ভাবলেন, তারপর ফিক করে
হেসে বললেন, “শিবপালগঞ্জের জলবায়ু বড় উৎকৃষ্ট, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের অনুকুল”।
-“ আমার কাছে আপনিই শিবপালগঞ্জের জলবায়ু”।
দারোগাজী এটা বলার পর আর মনে মনে জিনকে দোষ দিলেন না, বরং প্রাণখুলে হেসে ঊঠলেন। সেই যে
হাসি শুরু হল, আর থামে না। দারোগাজী টের পান নি যে ‘জিন’ শুধু জিভ নয় গলাতেও ভর করে। বৈদ্যজী
দারোগাজীর কথাটা গায়ে মাখলেন না। দারোগাজী উঠে পড়লেন, যেতে হবে। উনি চৌকাঠের বাইরে পা
ফেলতে যাচ্ছিলেন, বৈদ্যজী কোন ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ার ঢঙে বললেন,”জোগনাথের জামিন
বোধহয় আমার নামে লিখেছেন”?
দারোগা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। “অমন হলে তো আপনার দস্তখত করিয়ে নিতাম। চিন্তা
করবেন না, আদালতে জামিন হয়ে যাবে। কাউকে ওখানে পাঠিয়ে দেবেন”।
বৈদ্যজী চুপ, রূপ্পনের সোজা প্রশ্ন,” কেন, এখানে জামিন করাতে কিসের অসুবিধে”?
“চুরির কেস, এতে থানায় জামিন হয় না।
“আর খুনের কেস হলে”?
দারোগাজী হালকা মেজাজে জবাব দিলেন, “আপনি বোধহয় গতবছরের নেবাদা এলাকার কেসের কথা
বলছেন। কিন্তু সেই কেসে অপরাধী টি বি তে ভুগছিল। ওকে থানায় আটকে রেখে কে আরেকটা মৃত্যূর
কারণ হত”?
রূপ্পনবাবু আগেই খবরের কাগজ ফেলে উঠে পড়েছিলেন। “শুনুন, জোগনাথ তো এখন আপনার জিম্মায়।
ওর জেরা টেরা এখানেই সেরে জামিন দিয়ে দিন। ও অসুস্থ; তবে যক্ষ্মা নয়, গনোরিয়া”।
বৈদ্যজী ঠান্ডা আওয়াজে বললেন, “রূপ্পন, ভদ্রভাবে কথা বল। দারোগাজী আমাদের আত্মীয়, যা
করবেন ভেবেচিন্তেই করবেন”।
দারোগাজী ফের বললেন, “তাহলে এবার যাই? আজ্ঞা দিন”।
রূপ্পন, “হ্যাঁ, যান! যান!! থানায় রামাধীন আপনার জন্যে হাপিত্যেশ বসে আছে”।
দারোগাজী মুচকি হাসলেন। ফের আমলাদের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনার ঘটনার উল্লেখ করে বললেন,” কী
বলব রূপ্পন বাবু, এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। নইলে অনেক বড় বড় লোক হাপিত্যেশ করে বসে থাকত”।
দারোগা চলে যাবার পর রূপ্পন নিজের মনে বললেন—যাকে আটার তাল ভেবেছিলাম, ও যে দেখছি
মুস্কিপাতি জর্দা!
তারপর বৈদ্যজীকে বললেন—বড্ড অপমান করে গেল!
বৈদ্যজীর চেহারায় বেশ শান্ত সমাহিত ভাব। ফের রঙ্গনাথকে উঠে বাইরে যেতে দেখে শাস্ত্র
আলোচনার ঢঙে বললেন,”লাভালাভ, জয়-পরাজয়, মান-অপমান—এসব সমবুদ্ধির দৃষ্টিতে দেখা উচিত”।
আরে পিতাজী এখন গীতা আওড়াচ্ছেন! রূপ্পনবাবু বুঝলেন –তাহলে এই দারোগা ব্যাটার রেহাই নেই।
বাবু রামাধীন ভীখমখেড়বীর ঘরে আজ ভাঙ ঘোটা হচ্ছে, সামনের একটা চালের নীচে জুয়োর আড্ডা
জমজমাট।দুটোতেই নিস্পৃহ রামাধীন চাতালের উপর একটা চারপাইয়ে শুয়ে লঙ্গড় বা ল্যাঙ্গড়ার কথা
শুনছিলেন। লঙ্গড় চাতালের নীচে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রঙ্গনাথ আর শনিচর ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল। বাবু রামাধীন ওদের হাঁক পেড়ে ডেকে নিলেন। নিজে
খাটিয়ার এক কোণে সরে গিয়ে ওদের মাথার দিকে বসতে দিলেন। শনিচরকে উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন
না, শুধু ‘দাঁড়িয়ে কেন প্রধানজী, বসে পড়’ বলে কর্তব্য সারলেন।
রঙ্গনাথের জন্য এটা দ্বিতীয় সুযোগ। প্রথমবার যখন রামাধীনের ঘর পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন
এখানে কোন ভাঙ বা জুয়োর আসর চোখে পড়েনি। আজ এখানকার পরিবেশ ভারি আনন্দময়। রঙ্গনাথ
লঙ্গরের দিকে ইশারা করে বলল—এর কী খবরটবর?
“বাহাদুর বটে! ধরে নাও ও বলদের দুধ দুইয়ে এসেছে”।
রামাধীন হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিলেন বলদের দুধ দোয়ার চেষ্টায় হাত ঠিক কোনখানে যায়।
রঙ্গনাথ বেশ চ্যালেঞ্জের আওয়াজে বলল—হয়েছেটা কী? মহকুমা অফিস ত্থেকে নকল পাওয়া
গেছে”?
লঙ্গর বৈষ্ণব মহাপুরুষদের নিরীহ ভঙ্গিতে উত্তর দিল,”হাঁ বাপু, ধরে নাও পেয়ে গেছি। আমার
দরখাস্ত মহকুমা সদর থেকে ফেরত এসেছে। এমনিতে সদরে জমা দেয়া বেশিরভাগ দরখাস্ত হারিয়
যায়, আমারটা হারায় নি। এসব তো আপনাদের পদধূলির মহিমা”।
শনিচর বুদ্ধিমানের মত বলল, “বহুত আচ্ছা, লঙ্গর। দরখাস্ত যখন ফেরত এসেছে, তখন নকল পেতে
দেরি নেই”।
“আরে কবে আসবে”? রঙ্গনাথ কিঞ্চিৎ অধৈর্য।
লঙ্গড়ের এইসব ছটফটানি পছন্দ হল না। রঙ্গনাথকে আশ্বস্ত করে বলল, “নকল-বাবু বলেছেন
তোমার নম্বর এল বলে”!
রামাধীন বললেন,”যাও লঙ্গড়, ওদিকে গিয়ে কিছু ঠাণ্ডাই-টান্ডাই (ভাঙ) খেয়ে নাও”। তারপর উনি
খানিকটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে রঙ্গনাথকে প্রশ্ন করলে, “শুনলাম আজ জোগনাথ গ্রেফতার হয়েছে”!
রঙ্গনাথ এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল। পালটা প্রশ্ন করল, “ জোগনাথ আবার কে”?
রামাধীন অবাক হয়ে খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শনিচরকে
বললেন,“প্রধানজী, একে বলে দাও জোগনাথ কে”।
শনিচর বলল,”বাবুসাহেব, তুমি আমাকে এখন থেকেই প্রধান ট্রধান নাই বললে! যেদিন তোমার
মহামূল্য ভোট মঙ্গলদাস পিতা দুলারেলালকে দেবে সেদিন আমি পঞ্চায়েত প্রধান হব। এখন থেকে
টিকির-টিকির করা বেকার। কিগো বাবু রংগনাথ, ঠিক বলেছি”?
ভাঙের গেলাস রঙ্গনাথকে ধরে দেয়া হয়েছে। রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে বলল,”আমি তো এসব খাই না”।
রামাধীনের এমন অপমান! এর অন্তিম পরিণাম তো হলদিঘাটির সংগ্রাম। উনি গরগরিয়ে উঠলেন, “তুমি
কেন ভাঙ ছোঁবে ভায়া! এসব তো দুষ্টুলোকেরা খায়”।
রামাধীনের সামনে এক ব্যাটা ‘গঞ্জহা’ (শিবপালগঞ্জের নিবাসীদের চালু নাম) বসে ছিল। রঙ্গনাথ ওর
চেয়ে সাফ-সুতরো পরিচ্ছন্ন। তাই ওর চোখে রঙ্গনাথ হল স্বাভাবিক শত্তুর। ও বলে উঠল, “ইনি তো
শহুরে, তাই ভাঙ খাবেন না। এনার জন্যে একটা বোতল বের করে দাও বাবুসাহেব”!
রামাধীন রঙ্গনাথকে নিপাট ভালমানুষের মত তাকিয়ে বললেন, “না না, ইনি বোতলটোতল খাবেন না,
বামুন ঘরের যে”! তারপর রঙ্গনাথকে আদরমেশা সুরে বললেন, “আর যদি আপনার চলে তো হুকুম
করুন, বোতল এসে যাবে”।
বামুন বলে দেয়ায় রঙ্গনাথ খানিক বেকায়দায় পড়ে গেল। কিন্তু তক্ষুণি শনিচর বিনা কোন রাখঢাক না
করে বলে দিল , “তুমি কেন বোতল আনিয়ে দেবে? এই ব্যাটা চিমিরিখিদাস আনিয়ে দিক না! বোতলের
কথাটা তো ওই তুলেছে”!
তারপর ও লোকটার দিকে ঘৃণাভরে দেখে বলল, “ছ্যাঁচোড় কোথাকার”! তারপর ও ইতরভাষায় একটা
স্থানীয় প্রবাদ বলল যার মোটামুটি মানে—ষোল শ’ শুয়োরকে নেমন্তন্ন করে এনেছে অথচ পাছায়
একফোঁটা গু নেই।
রঙ্গনাথের মনে হল এবার এখান থেকে সরে পড়া দরকার। কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
“এবার যেতে আজ্ঞা দিন রামাধনজী। হাঁটতে বেরিয়েছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
“পায়চারি তো ঘোড়ী করে, জোয়ান পুরুষকে মানায় না”। তারপর বেশ ঘনিষ্ঠ সুরে বলল, “ ফটাফট
পাঁচশো ডন বৈঠক! দেখবেন, লোহালক্কড় সব হজম”।
ওরা দু’জন চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে জুয়াড়িদের ঠেকে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল।
খেলা চলছে দুটো আলাদা দলে। একপাশে কয়জন বসে ‘কোটপিস’ খেলছে। বাহান্ন তাসের খেলা। তাসগুলো
বড্ড পুরনো, রঙচটা আর এমন ছেঁড়াখোঁড়া যে ঘাগ খেলাড়ি বাইরে থেকেই বুঝতে পারবে এটা কোন
তাস।একটু দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে খেলছে আটজন মিলে। চারজনের হাতে তাস, ওরা গম্ভীর এবং মাথা
বুকের উপরে ঝুঁকে রয়েছে। বাকি চারজন একেকটি খেলুড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে খেলার ধারাভাষ্য দিয়ে
চলেছে এবং যখন চুপ থাকা দরকার তখন কিছু না কিছু বলছে।
শুধু তাই নয়, এরা খেলুড়েদের জন্য খৈনি ডলা, বিড়ি ধরানো, জল নিয়ে আসা, তাস পড়ে গেলে তুলে গুছিয়ে
দেয়া গোছের সব কাজ করে দেয়। আর খেলা শেষ হলে হার-জিতের হিসেব চুকলে দেনা-পাওনার সময়
খুচরো পয়সার জোগান দেয়া, বিজয়ীর পয়সা থেকে পান নিয়ে আসা—সবকিছুর দায়িত্ব এদের উপর।
বেঁচে যাওয়া তাসগুলো গুণে হেরে যাওয়ার পক্ষ নিয়ে কোন না কোন অজুহাতে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়ার
কাজটাও এরাই সুষ্ঠুভাবে করে থাকে। সামনে বসে থাকা খেলুড়েকে কোন তাস খেলতে হবে সেটা ইশারায়
বলে দেয়া এবং সেই ইশারা ধরা পড়ে গেলে গলাবাজি করা –কোনটাই বাদ যায় না।
রঙ্গনাথের মনে হল –এই খেলাটা মহা ফালতু বাজে খেলা, সিদ্ধির নেশার মত। কিন্তু, অন্য দলের
খেলাটায় উঁকি দিতেই ওর শিবপালগঞ্জের জুয়োর ব্যাপারে ধারণাটাই পালটে গেল।
ওরা খেলছিল ‘ফ্ল্যাশ’, যা ল্যান্টার্নকে “লালটেন” বলার নিয়মে “ফল্লাস” হয়ে গেছে। এখানে ধুন্ধুমার
হচ্ছিল। একদিকে ‘ব্লাফ’ নামের অটোমেটিক অস্ত্র গণহত্যায় মগ্ন, অন্যদিকে একজন বিশুদ্ধ দেশি
পদ্ধতিতে চাল চেলে এগোচ্ছিল। আচমকা ওর আক্কেল কোথায় পালিয়ে গিয়ে ওকে হতভম্ব করে দিল।
ও আত্মসমর্পণ করে হাতে্র তাস ফেলে দিল। আর অন্য খেলুড়েটি ফড়ের থেকে একমুঠো পয়সা তুলে
নিজের উরুর নীচে চেপে রাখল।
হেরো খেলুড়েকে রঙ্গনাথ দু’দিন আগে বৈদ্যজীর ঘরে দিনপ্রতি আট আনা মজুরিতে কাজ করতে
দেখেছিল। সে এখন শান্তভাবে একটা বিড়ি ধরিয়ে পরের বাজির জন্য ফেটতে থাকা তাসের দিকে নিস্পৃহ
ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। রঙ্গনাথ মনে মনে ওর ধৈর্য এবং সাহসের তারিফ করতে লাগল।
ঋষি দত্তাত্রেয় আজ জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই এই খেলুড়েকে নিজের পঁচিশতম গুরু বলে স্বীকার
করতেন। রঙ্গনাথের মাথা ওই হেরো নির্বিকার খেলুড়ের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হল, তবে সত্যি কথা
বলতে কি, ওর হাতের তাস দেখার ইচ্ছেটাও মাথা নীচু করার একটা কারণ।
খেলুড়েদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এরা ‘পেয়ার’কে বলে ‘জোড়,’ ‘ফ্ল্যাশ’কে বলে ‘লঙ্গড়ি’,
‘রান্’কে ‘দৌড়’, ‘রানিং ফ্ল্যাশ’কে ‘পাক্কি’, আর ‘ট্রেইল’কে ‘টিরেইল’। রঙ্গনাথ বুঝতে
পারল—ইংরেজি শব্দকে হিন্দির ছাঁচে ঢেলে সাজানোর এটাই সহজ উপায়।
স্বাধীন ভারতে দেশজুড়ে শব্দকোষ রচয়িতার এবং ওদের সমিতির জাল বিছিয়ে রয়েছে। এঁরা ইংরেজি
শব্দ নিয়ে হিন্দি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তার প্রতিশব্দ রচনায় ব্যস্ত। কাজটা বেশ মজার।
একদিকে কামরার ভেতর একটি নতুন ভাষা জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে এটা করতে অনেক সময় লাগছে।
অর্থাৎ নতুন শব্দের নিমার্ণকর্তা প্রায় পেনশন পাওয়ার যোগ্য হয়ে যাচ্ছেন।
এটা এই জন্যেও মজার যে এভাবে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করার কোন মানে হয় না। কেবল এইটুকু বলা যায়
–নাও ভাই, যেসব শব্দাবলী শুধু ইংরেজিতে আছে সেসব এখন তোমার ভাষাতেও এসে গেছে। এখন ভাই
সেটা নেবে কি নেবে না—তাতে কারও কিছু এসে যায় না।
রঙ্গনাথ এই ফালতু সমস্যার বিষয়ে কখনও কখনও চিন্তা করত, কিন্তু কোন সমাধান চোখে পড়ে নি।
এখন বার বার শুনছে “পাক্কি”, “টিরেইল” আর “লঙ্গড়ি” শুনতে শুনতে আজ ওর মাথায় একটা আইডিয়া
এলঃ যদি চার-পাঁচ ‘গঁঞ্জহা’র এক সমিতি বানিয়ে দিল্লি পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? এরা বড় বড়
পরিভাষার শব্দের জায়গায় নিজেদের স্থানীয় ভাষার ঝুলি থেকে সেরেফ সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত কিছু
শব্দ পেশ করবে। কিছু না হলেও ট্রেইল কে টিরেইল করে দিতে কতক্ষণ?
খেলুড়েগুলো যে আত্মবিশ্বাসের জোরে জুয়ো খেলে চলেছে এবং পাছার চামড়া পর্যন্ত বেচে দিয়ে
অনেক আশায় ‘ব্লাফ’ কল করছে, তা দেখে রঙ্গনাথ ধাঁধায় পড়ে গেল। এটা স্পষ্ট যে বিদেশ থেকে
কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডেফিসিট ফাইনান্সের ইকনমিক মডেলের ওকালতি করা বড় বড় রাজনীতি
এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও এমন কলজের জোরের দেখা পাওয়া ভার।
রঙ্গনাথ ভাবলঃ এই মজুর আর রাখালের দলের জীবন দেখার পর আমি দিল্লির মসনদে বসে
স্বপ্নদেখা মানুষের উপর রাগ করা ছেড়ে দিলাম।
ও সামনে তাস হাতে বসা লোকটাকে মন দিয়ে দেখতে লাগল। লোকটা আরেকটি বিড়ি ধরিয়েছে এবং
নির্বিকার চেহারায় এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। রঙ্গনাথ আর শনিচরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে এক
নজর দেখে লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক মজদুরকে হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারায় টাকা
চাইল। মজদূরটি মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, --না। তখন ও উঠে সোজা বাবু রামাধীনের কাছে গেল আর
চটপট ফেরত এসে আগের জায়গায় বসে পড়ল। চেহারা তেমনই নির্বিকার। তাস তুলে আধপোড়া বিড়ি
দূরে ছুঁড়ে ফেলে একটা ঢেকুর তুলল। তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট ফেলে বাকি টাকা না তুলে চটপট
একটা চাল দিল। উলটো দিকের এক খেলুড়ে বলল, “মনে হচ্ছে এবার হাতে কোন বড় তাস এসেছে”।
রঙ্গনাথ ঝুঁকে ওর তাস দেখল। নাঃ, আগের মতই সেরেফ ‘ব্লাফ’!
বিদেশি সাহায্য কেন, কখন এবং কেমন মুখের চেহারা বানিয়ে চাইতে হয়—তার পাঠ রঙ্গনাথের চোখের
সামনে খোলা রয়েছে!
ওরা দু’জন এবার একটা ফাঁকা মাঠে পৌঁছে গেছে। রঙ্গনাথকে একা ছেড়ে দিয়ে শনিচর একটু দূরের
একটা ছোট ডোবার দিকে যাচ্ছিল। রঙ্গনাথ ওকে জিজ্ঞেস করল,”বাকি সব তো ঠিক, কিন্তু একটা
কথা মাথায় ঢুকছে না। ছোটে পালোয়ান জোগনাথের বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হয়েছে—এটা কি ভাল হল?
শনিচর রকেটের গতিতে ডোবার দিকে এগিয়ে চলেছে। এবার আন্ডারওয়ারের গিঁট খুলে ফেলল। এই
তাড়াহুড়োর কারণ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু যেতে যেতে ও সাতটা শব্দে উত্তর দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল,
“দেখতে থাক রঙ্গনাথ বাবু, এসব ‘গঁঞ্জহা’দের এঁড়েপনা”।
তারপর যেন কোন বিশ্বসুন্দরী ওকে শয্যায় আহ্বান করেছে এমন আতুর হয়ে ও আন্ডারওয়ার ছুঁড়ে
ফেলে রঙ্গনাথের সামনে একেবারে ন্যাংটো হয়ে ডোবার পাড়ে ঝটপট মোরগের লড়াইয়ের খেলুড়ের
ভঙ্গিমায় উবু হয়ে বসে পড়ল।
(চলবে)
0 comments: