গল্প - রঞ্জন রায়
Posted in গল্প
১
আমাদের অনেকেরই একজন করে ঝন্টুদি থাকে। আমারও ছিল, সেই ছোটবেলা থেকেই। ওকে দেখলেই আমার দিন ভালো হয়ে যেত। গোমড়ামুখো মেঘলা দিন রোদ্দুরে ঝলমলিয়ে উঠত। প্রথমবার ঝন্টুদিকে দেখি বোকারোয়। ঝাড়খন্ডের হাজারিবাগ জেলার বোকারো। আজকের নামজাদা ইস্পাতনগরী বোকারো নয়। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের একটি ছোট্ট পাওয়ার হাউস, তার কু-ঝিক-ঝিক রেলস্টেশন। সেখানে পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা একটা ছোট্ট জনপদ।
পাওয়ার হাউসের মজদুরদের লেবার পাড়া। অ্যাসবেসটসের শেড, গায়ে গায়ে লাগা দুটো ছোট্ট কোয়ার্টার। একটায় মৈত্র জ্যেঠু, জ্যেঠিমা ও তাঁর দুই মেয়ে। ছ’বছরের তোতন, আর চোদ্দ বছরের ঝন্টুদি।
অন্যটায় বাবা-মা আর আমি-- চার বছরের ছোট্ট চন্দন।
ওদের দুটো ঘর আর একচিলতে রান্নাঘর। আমাদের একটা ঘর আর এক চিলতে রান্নাঘর। ওদের একটা লম্বাটে বারান্দা আমাদের একটু ছোট বারান্দা। দুই বারান্দার মধ্যে পাঁচিল তোলা।
কিন্তু, দুই বাড়ির জন্য একটাই বাথরুম-পায়খানা । ঢোকার জন্য দুই দিক দিয়ে দুটো দরজা। যে আগে ঢুকবে সে ভেতর থেকে দুটো দরজাতেই ছিটকিনি তুলে দেবে, যাতে অন্য কেউ ঢুকতে না পারে।। ও’বাড়ির জ্যেঠিমা ঘন ঘন বাথরুমে যান। বেরোতে সময় লাগে। মা বিরক্ত হয়, বলে –বড্ড ছুঁচিবাই!
আমার বড়-বাইরে পেলে সত্যি সত্যি বাইরে যেতে হয়। কোয়ার্টারের পেছনে পাকা নালায় জল বয়ে যায়। সেখানে ইজের খুলে উবু হয়ে বসতে হয়। চারদিক শুনশান। কেউ কোথাও নেই। কিন্তু কোন কোন দিন ঝগড়ু জমাদার এসে দেখে ফেলে। বিরক্ত হয়, আমাকে ধমকায়।–ইঁহা কিঁউ? যাও, ময়দান মেঁ জা কর বৈঠো!
তখন আমার লজ্জা করে। চোখে জল আসে। কোথায় যাব? মা তো এখানেই বসতে বলেছে। একটু পরে বালতি-মগ নিয়ে এসে ধুইয়ে দেবে। কবে যে বড় হব, সবার মত পাকা বাথরুম পায়খানায় যাবো!
দুপুরবেলা বাবা বাড়িতে খেতে আসে। কাজের জায়গা থেকে সাইকেলে চড়ে। মা রান্নাঘরের এক কোণায় আসন বিছিয়ে আমাদের দু’জনকে ভাত বেড়ে দেয়। বাবার জামায় দুটো পকেট, তাতে দুটো কলমের মত। একটার পেটে কালি ভরা, সেটা দিয়ে লেখা যায়। কাটাকুটি খেলা যায়। অন্যটায় কালি নেই। কিন্তু মাথা টিপলে ভেতরে আলো জ্বলে ওঠে। মা বলল, ওটা কলম নয়। ওটাকে নাকি টেস্টার বলে। বাবা ইলেকট্রিকের কাজ জানে। তাতে ওটা কাজে লাগে।
আমি দুই বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট, তোতন আমার থেকে দু’বছরের বড়। ও আমায় চিমটি কাটে, থুতু দিয়ে গা ভরিয়ে দেয়। ঝন্টুদি দেখতে পেলে ছুটে এসে আমাকে কোলে নেয়, চোখের জল মুছিয়ে গালে চুমো খায়। চোখ পাকিয়ে ওকে ধমকায়, --লজ্জা করে না? ও যে তোর ছোট ভাই!
-- ও তো পাশের বাড়ির। শিগগির আমার সত্যিকারের ভাই হবে, এইটুকুনি ভাই। মা বলেছে।
আমি অবাক হই। ঝন্টুদির দিকে তাকাই। ঝন্টুদি মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বাড়িতে এসে নতুন খবরটা মাকে দিই - জান মা, তোতনদের বাড়িতে নতুন ভাই আসছে। আমাদের বাড়িতে কবে আসবে?
মা মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে—পাকা পাকা কথা বলবি না। তোকে আর ওদের বাড়ি যেতে হবে না। কোলকাতা থেকে বাবা তোর জন্যে ধারাপাত এনেছে না? সেগুলো খুলে নামতা মুখস্থ কর। সেলেটে এক থেকে একশ’ লেখ। সহজ পাঠ খুলে ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’ পড়তে থাক। এমনি সুর করে, দুলে দুলে।
বুঝতে পারি, মা পাশের বাড়ির মৈত্র জ্যেঠিকে পছন্দ করে না। কখনও ওদের বাড়ি যায় না। উনিও আসেন না। মা একদিন বাবাকে বলছিল—গায়ের রঙ ফর্সা বলে বড্ড গুমোর।
গুমোর কাকে বলে? খারাপ কিছু হবে। বুঝতে পারি ঝন্টুদির গুমোর নেই। ও সময় পেলেই আমাদের বাড়ি আসে। স্কুল থেকে ফিরে একবার তো আসবেই। ওর গলায় ‘কাকিমা’ ডাক শুনলে মায়ের মুখেও হাসি ফোটে। কিছু না কিছু খেতে দেয়। তরকারি চাখতে দেয়। আর একটা ব্যাপার আছে। ঝন্টুদি এলে মা কেটলিতে চায়ের জল চড়িয়ে দেয়। তারপর মা আর ঝন্টুদি হুসহাস—সলপ্--সলপ্ করে চা খায়। কখনও কখনও জ্যেঠিমার চড়া গলায় শোনা যায়—ঝন্টা-আ-আ!
ঝন্টুদির বড় বড় চোখের পাতা ভয়ে ফরফর করে। সাড়া দেয়—আসছি-ই-ই। তখন গরম চা ডিশে ঢেলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে কোনরকমে গিলে ফেলে। তারপর এক দৌড়ে নিজেদের ঘরে।
মাঝে মাঝে বাবা যখন রুই মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত মেখে হাপুস হুপুস করে খায় তখন মা নীচু গলায় বলে- অন্য কোন একটা কোয়ার্টার দেখ না, যেখানে আমাদের আলাদা বাথরুম হবে। তোমার তো ইউমিয়নের সঙ্গে খুব ভাব।
ইউনিয়ন কাকে বলে? আমার ভাব ঝন্টুদির সঙ্গে।
সেদিন রোববারের দুপুর। বাবা গেছে বন্ধুদের বাড়ি তাস খেলতে। আমার হঠাৎ বড় বাইরের জন্য পেট মুচ্ড়ে উঠল। কী মনে হল একবার আমাদের চানের ঘরের দিকে উঁকি দিলাম, দেখি দরজাটা খোলা। ব্যস্, যেন স্বর্গের চাবি হাতে পেলাম। সোজা ভেতরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে বসে পড়লাম। ছিটকিনি লাগাতে পারিনি, বড্ড শক্ত। সবকিছু সেরে কোনরকমে নিজেকে ধুয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম—যেন যুদ্ধ জয় করেছি। আরে, ওদের দিকের দরজাতেও ছিটকিনি নেই!
তারপর ভাবলাম যাই, বাথরুমের ওদিকের দরজা পেরিয়ে ঝন্টুদির সঙ্গে দেখা করে আসি। কাটাকুটি খেলব, বি-কুইক খেলব। আর ওদের বাড়িতে সুন্দর সুন্দর পুতুল আছে। সেগুলো দেখব। একটা আবার চোখ পিটপিট করে। একটা ছোট্ট বাঁদর খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে পেছন ঘসে ঘসে এগিয়ে যায়—ভারি মজার।
আমাদের বাড়িতে কোন পুতুলের বাকসো নেই। ওদের চান করানো, চুল আঁচড়ানো, বিয়ে দেয়া—এসব নেই। মা বলেছে—মেয়েরা পুতুল খেলে, ছেলেরা মাঠে গিয়ে খেলে; আর আমি তো ছেলে।
এটা বলার সময় মায়ের চোখমুখ কেমন ঝলমলিয়ে ওঠে। আমার ভাল লাগে।
তোতন কক্ষণও ওর পুতুলের বাকসো ছুঁতে দেয় না। ঝন্টুদি থাকলে কোন চিন্তা নেই।
বাথরুমে ওদের দিকের খোলা দরজাটা ঠেলে ওদের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। ঘরটায় আলো জ্বালায় নি কেন? ঝন্টুদি তোতন ওরা কোথায়? বোধহয় সামনের ঘরে। ভেতরের দরজাটা কোনদিকে? আলোর সুইচ অনেক উঁচুতে। আমি হাত পাই না।
কী করব বুঝতে পারছি না। অন্ধকারে ভয় ভয় করছে। একটা চাপা আওয়াজ। কেউ যেন কাঁদছে, নাকি ব্যথায় কোঁকাচ্ছে। একবার মায়ের হাতে শিঙিমাছের কাঁটা ফুটে গেছল। জ্বর এসেছিল। তখন মা বিছানায় শুয়ে অমনি করে কোঁকাতো। অন্ধকার একটু সয়ে এসেছে। টের পাচ্ছি চৌকির উপর বিছানায় দুটো মানুষ—একজন জ্যেঠিমা। অন্যজন কি জ্যেঠু?
জ্যেঠিমার কি জ্বর হয়েছে? অমন করছে কেন? আমার মুখ থেকে ভয়ে ভয়ে একটা ডাক বেরোল—ঝন্টুদি!
বিছানার উপর পায়রার ডানা ঝাপটানোর মত ফরফর। লাইট জ্বলে উঠল। আমার গালে পড়ল প্রচন্ড এক থাপ্পড়। আর কিছু মনে নেই।
কারখানার কাছে একটা ছোট হাসপাতাল। সেখানে আমার জ্ঞান ফিরল। মুখটা অসম্ভব ফুলে গেছে। আমার বিহানার কাছে বাবা-মা আর বাবার বন্ধু শিউনারায়ণ দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক তাকালাম- না, ঝন্টুদি আসেনি।
একদিন বাবা ফিরল একটু তাড়াতাড়ি। সঙ্গে বাবার তিন বন্ধু। একটা ফুলের মালা আর কিছু তোড়া। বাবার মুখে হাসি, মা’ও হাসছে। বাবা একটা ছোট্ট মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসেছে। একজন কাকুর হাতে একটা বড় ঠোঙাভর্তি ==বাবাদের ক্যান্টিন না কী বলে, সেখানকার গরম সিঙাড়া। সবাই হাসছে, জোরে জোরে কথা বলছে।
সবচেয়ে খুশি মা। চড়ুইপাখির মত ছটফট করছে। রান্নাঘরে যাচ্ছে আর আসছে। সবাইকে সিঙাড়া, মিষ্টি ছোট্ট প্লেটে করে সাজিয়ে দিচ্ছে। আর কাপের পর কাপ চা।
রাত্তিরে শোয়ার সময় মা আমার কপালে চুমো খেয়ে বলল—তোর বাবা অন্য শহরে কাজ পেয়েছে। মাইনে এখানকার চেয়ে বেশি। তোর বাবা সেখানে লেবার নয়, চার্জম্যান হবে। আমাদের আর ছোটলোকদের মত বাথরুম পায়খানা ভাগাভাগি করে থাকতে হবে না। সবার আলাদা আলাদা কোয়ার্টার। তোকে আর বাইরে যেতে হবে না সোনা। ওখানে ভাল স্কুল আছে, ভর্তি করে দেব।
সবটা না বুঝলেও এইটুকু বুঝলাম –আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি, শিগগির । নতুন জায়গায় ঝন্টুদি যাবে না।
জিনিসপত্তর বাঁধাছাঁদা হল। একদিন বাবা একটা ভাড়ার জীপ নিয়ে এল। তাতে বাবার বন্ধুরা হাতে হাতে মালপত্র তুলে দিল। পাড়ার অনেকে ভীড় করে এল। বাবা আর মৈত্র জ্যেঠু কোলাকুলি করল। মা বলল-- দিদি, আমি আপনার ছোটবোনের মত। না জেনে যদি কিছু দোষঘাট করে থাকি মাপ করে দেবেন।
কী আশ্চর্য! দুজনেই চোখ মুছছে। তোতন এসে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে, কোন কথা বলছে না।
ঝন্টুদি একটু আড়াল করে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিল। --কাকিমা, কে আর আমাকে আদর করে ডেকে চা খাওয়াবে! চিঠি লিখো কিন্তু।
তারপর চলে যেতে যেতে যেন হঠাৎ মনে পড়ল, এমনি ভাবে ফিরে এসে আমায় কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমো খেয়ে বলল---আমাকে ভুলে যাস না রে ছোটু। তুই একদিন বড় হয়ে যাবি, অনেক লম্বা হবি। তখন কি আর ঝন্টুদিকে মনে পড়বে?
আমার গলায় ভাতের দলা আটকে গেছে। ঝন্টুদির গায়ে আজ একটা অন্যরকম সুন্দর গন্ধ। হ্যাঁ, গন্ধটা মনে থাকবে।
২
কয়েক বছর কেটে গেছে।
কোলকাতা শহর। পার্কসার্কাস বাজারের সামনে একটা বড় দোতলা বাড়ি। ইংরেজ আমলে কোন খানদানি মুসলমান পরিবার বানিয়েছিল। চারদিক বারান্দা দিয়ে ঘেরা। তাতে রেলিং এবং ছাদ থেকে নেমে আসা টুকরোতে কলকেদার নকশা। যেমন মসজিদের দেয়ালে থাকে। দরজা এবং জানলায় কাঠের খড়খড়িগুলো সবুজ রঙের। গায়ে গায়ে লাগা ফ্ল্যাটের মালিক পরিবার অন্য পাড়ায় থাকে।
দেশভাগের পর বাড়ির মালিকানা হাত বদল হয়েছে। ঢাকার শাঁখারিটোলার কোন হিন্দু ব্যবসাদার অতবড় বাড়িটা কিনে নিয়েছে। রাস্তার দিকে অনেকগুলো দোকান, সব ভাড়ায়। আর গোটা দোতলা চারটে ফ্ল্যাটে ভাগ করা। নীচের দোকানদারেরা মুসলমান আর দোতলার ভাড়াটেরা সব হিন্দু। গোটা বাড়িটার ছাদে রয়েছে চার ফুটের প্যারাপিট ওয়াল। তবে ছাদের মেজেতে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই না করে দুরমুশ করে জলছাদ করা। তাই ছাদের মেজে দেখলে মনে হবে পোস্তদানা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফ্ল্যাটের হিসেবে ছাদটাও মাঝখানে দেয়াল তুলে ভাগ করা। খালি কাঁটাতার লাগানো বাকি। আমরা, মানে চারটে ফ্ল্যাটের ছেলেমেয়েরা, গরমে হাঁসফাঁস করা ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে ছাদে আসি। আমরা হিন্দুস্তান-পাকিস্তান মানি না। অনায়াসে বুকে হেঁচড়ে বর্ডারের পাঁচিল টপকে এপাশের ছাদ থেকে ওপাশে যাই।
একটা ভাঙা হাঁড়ির খোলামকুচি বা চক স্কুল থেকে চুরি করে আনা চক দিয়ে দাগ কেটে এক্কা-দোক্কা খেলি, মার্বেল খেলি, লাট্টু খেলি। এভাবেই পরিচিত হই খেলার পরিভাষার সঙ্গে। কাকে বলে লেত্তি, হাত-লেত্তি, গাইপার, সাইপার অথবা নট নড়ন -চড়ন, নট কিস্যু। কখনও কখনও অন্যরকম দাগ কেটে চু-কিত-কিত, কবাডি-কবাডি, চড়াই -চড়াই। কোনদিন কেউ নিয়ে আসে একটা চার আনার রবারের বল। সেই নিয়ে কিং-কিং বা পিট্টু খেলা হয়। আমরা প্রায় জনা বারো ছেলেমেয়ে। বুড়ো, মন্টা, স্বপন, খেপু, দীপু, ছায়া, কণা, বাবলু, হাবু, বিজু আর আমি চন্দন; এবং ঝন্টুদি।
ঝন্টুদিকে সবাই ডাকে হেনাদি, কিন্তু আমি ঠিক চিনেছি—ও হল ঝন্টুদি। হ্যাঁ, হেনাদি যখন ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ছাদের সিঁড়ির ধাপে পা ঝুলিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে গল্প করে তখন আমি সেই পরিচিত গন্ধটা পাই। আর তখনই হেনাদি হয়ে যায় ঝন্টুদি।
ছাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হল চোর-চোর। যে চোর হয় সে অন্যদের তাড়া করে ছুঁয়ে আউট করার চেষ্টা করে। সবাই পালায়, লুকিয়ে পড়ে চিলেকোঠায়, ছাদের জলের ট্যাংকির পেছনে, সিঁড়ির বাঁকে। তাড়া খেলে উর্ধশ্বাসে ছোটে। হার্ডল বা অবস্ট্যাকল রেসের মত টপকে যায় পাঁচিল।
আমি পারি না, আমি দুর্বল, আমার হাঁফ ধরে যায়। সবাই আমাকে খেলা থেকে বাদ দিতে চায়, দুধভাত করে বসিয়ে রাখতে চায়, শুধু ঝন্টুদির জন্য পারে না। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি, ঝন্টুদি টেন।
সবাই বাঁধাগতে গোণে।
উবু, দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ---- একশ’। ব্যস, তুই এবার চোর।
ঝন্টুদি গোণে কত রকম ছড়া কেটেঃ
“এক লাঠি, চন্দনকাঠি, চন্দন বিনে কা কা।
ইজি-বিজি-সিজিটা, প্রজাপতি উড়ে যা”! আউট!
বা,
“দার্জিলিং পাহাড়ে/ বসেছিল/ একটি মেয়ে/
আমি তাকে/বললাম/ তোমার নাম/কী
সে বললে/ আমার নাম/ পদ্মজা নাই/ডু-উ-উ”! আউট!
আবার,
“অব দা ফোর, ডব দা ফোর,
মাংকি চুজ এ ব্ল্যাক বোর,
হোয়াট কালার ডু ইউ চুজ”?
--অ্যাই চন্দন, লেবু কোথাকার! তোকে বলা হচ্ছে। একটা রঙের নাম বল।
স্বপন বলে সবচেয়ে গুন্ডা ছেলেটা চেঁচায়। ও আমাকে দেখতে পারে না। খালি পেছনে লাগে। বলে –তুই এত ল্যাবা কেন রে? তোর হাত পা এত নরম কেন? একেবারে লেবু-লেবু, মেয়েদের মত। নাঃ তুই মেয়েদেরও অধম। তোর নাম এখন থেকে চন্দন নয়, লেবু। সবাই এখন থেকে ওকে লেবু বলে ডাকবে।
ব্যস, অনেকে মজা পেল। ফলে আমার লেবু নাম চালু হয়ে গেল। তবে ঝন্টুদির সামনে কেউ বলে না।
এবার ঝন্টুদি বলে—কী হল, চন্দন? চটপট একটা রঙ বল।
--নীল।
-ধেৎ, ইংরেজি নাম বল।
--ব্লু।
-- বি, এল, ইউ, ই। আউট।
এবার স্বপন আউট। সবাই হাসে। ও রেগে গিয়ে বলে—এতক্ষণ ধরে ভেবে বললে চলবে না। দান এলে চটপট বলতে হবে। এই লেবু ছেলেটা মিচকে শয়তান। আমাকে আউট করবে ফন্দী করে ব্লু বলেছে। কেন? রেড, গ্রীন, ইয়েলো বলেনি?
ঝন্টুদি ধমকে ওঠে—অ্যাই, লেবু-টেবু বলবি না। বাপ=মা যা নাম দিয়েছে তাই বলতে হবে।
সেদিনের মত খেলা ভেঙে যায়।
স্বপনের মুখের ভাষা অন্যরকম। হাফ ইয়ার্লিতে ফেল করেছে। স্বপন বলল==গাড্ডু মেরেছি।
দীপু কয়েকদিন ছাদে আসে নি। সেদিন এল। স্বপন বলল—এখানে কেন? ফোট্, পার্কে গিয়ে মালের পেছনে ভাগ্!
বিজু বলল—ওর না হয় মাল আছে। তোর তো তা’ও নেই। নিজের খোমা দেখ।
ব্যস্ হাতাহাতি জাপটাজাপটি শুরু। আমি কাট্।
তবে স্বপন অনেক মজার ছড়া জানে। সবাই হাসে, আমিও হাসি—তবে সবটা বুঝি না।
সেদিন ছাদে মেয়েরা কেউ নেই। স্বপন আমাকে ধরল।
--এদিকে আয় লেবু। ক্লাসে মন দিয়ে পড়াশুনো করিস?
--করি তো।
--আচ্ছা? গুল্লি মানে জানিস?
আমি মাথা নাড়ি।
--মাল মানে?
--জানি না।
--তো কী জানিস, ল্যাবেণ্ডিস কোথাকার!
--ল্যাবেণ্ডিস কী?
--তুই, তুইই ল্যাবেণ্ডিস।
আমার চোখে জল আসে। ওরা অমন করে কেন?
বুড়ো বলে—ওকে ছেড়ে দে স্বপন।
মন্টা বলে—হ্যাঁ ছেড়ে দে। হেনাদি জানতে পারলে ঝাড় দেবে।
--আচ্ছা, এই লাস্ট। একটা ধাঁধার উত্তর দিক, তারপর।
আমি তৈরি। ক্লাসে কত ধাঁধা পেরেছি।
--ঠিক আছে স্বপনদা। জিজ্ঞেস কর।
--মন দিয়ে শোন।
“বল হরি, হরি বোল,
একটা লম্বা, দুটো গোল,
কোনটা নিবি জলদি বোল”।
সবাই হেসে ওঠে।
আমি হতাশ, এটা আবার কী ধাঁধা! একটা লম্বা, দুটো গোল!
বুঝেছি, ট্রানজিস্টর রেডিও! লম্বা এরিয়েল আর দুটো বোতাম, আওয়াজ বাড়ায় আর কাঁটা ঘুরিয়ে স্টেশন ধরে।
--হয় নি, হয় নি।
--আচ্ছা, আমাদের সংস্কৃতের পণ্ডিত স্যার। মাথায় লম্বা টিকি আর গোল গোল কাঁচের চশমা।
--দূর বোকা! টিকি তো খাড়া লম্বাটে নয়, বরং ঝোলা মত, তাতে একটা গিঁট বাঁধা।
এটাও না? তাহলে? আমি সবার মুখের দিকে তাকাই।
ওরা কোরাসে গায়ঃ
“বল হরি, হরি বোল----“।
স্বপন বলে—যা, গিয়ে তোর হেনাদিকে জিজ্ঞেস কর।
আমি ছাদের অন্য কোণে গিয়ে দাঁড়াই, মন দিয়ে আকাশে ঘুড়ির প্যাঁচ দেখতে থাকি। এই সময় কণা ও ছায়াকে নিয়ে হেনাদি ছাদে এল।
আমি দৌড়ে গিয়ে বলি—দিদি, একটা ধাঁধার উত্তর বলে দেবে? স্বপনদা জিজ্ঞেস করেছিল। বলল তুমি নাকি জান।
হেনাদির কপাল কুঁচকে ওঠে।
--কী ধাঁধা?
আমি আবার ধাঁধাটা বলি, ওদের কোরাসের মত একটু সুর করে দুলে দুলে।
ছাদের উপর হাওয়া বইছে না।
হেনাদির চোখ বড় বড়।
তারপর দুপ্দাপ্ করে গিয়ে স্বপনকে ঠাঁটিয়ে দুটো থাপ্পড় কষায়।
তিনদিন আর ছাদে খেলতে যাই নি।
তারপর গুটিগুটি হাজির। সেদিন ছাদে মাদুর পেতে হেনাদি গল্প বলছে। নতুন দেখা সিনেমার গল্প। --“পথে হল দেরি”। এখানকার সবার বাড়িতে ছোট ছেলেপুলের সিনেমা দেখা পাপ। তাই সবাই হাঁ করে গল্পটা গিলছে।
গল্প শেষ হলে বুড়ো বলল—দিদি, নামটা অমন কেন? দেরি কোথায় হল?
হেনাদি জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেল। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে। আমি জানতে চাই—নায়িকার আসল নামটা কী?
সবাই চেঁচিয়ে ওঠে। সুচিত্রা সেন! সুচিত্রা সেন! কী লেবু রে! উত্তম-সুচিত্রা জুটির নাম শুনিস নি!
আজ হেনাদিও মুচকি হাসল।
আমার ভ্যাবলা মুখ দেখে ছায়া বলল—ওগো সুচিত্রা সেন! শিগগির এস। চন্দনকে বিয়ে করে তোমার বাড়ি নিয়ে যাও।
স্বপন ঝেঁঝে ওঠে।
--ধ্যাৎ , এই লেবুকে বিয়ে করবে সুচিত্রা সেন? আর মেয়েরা বিয়ে করে না, ওদের হয়। ছেলেরা বিয়ে করে। দেখিসনি, উত্তম সুচিত্রাকে বিয়ে করে। উল্টোটা নয়।
হেনাদি আবার ঝন্টুদি হয়ে মুচকি হেসে বলে—শোন, এত ভাবার কী হয়েছে? একদিন তো চন্দনের বিয়ে হবে। যার সঙ্গেই হোক, সেই চন্দনের সুচিত্রা সেন।
কাঠ বাঙাল মন্টা বলে ওঠে—হ, অইব। ততদিনে তুমার দুইলা ছেড়ি হইয়া যাইবো।
ঝন্টুদি গোলাপি হয়ে হাসে আর মন্টার কান মূলে দেয়।
ক’দিন পরে আমি ছাদে বসে “ যখের ধন” পড়ছি হেনাদি চলে এল। দিব্যি ছাদের ছোট পাঁচিল টপকে। এসেই ঝন্টুদি হয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলল—শোন চন্দন। একটা কথা বলব কাউকে বলবি না তো! আমার গা ছুঁয়ে বল।
হেনাদির গায়ে সেই গন্ধ। ঝন্টুদির গন্ধ। আমি ওর গলায় হাত দিয়ে বলি—দিব্যি করে বলছি, কাউকে বলব না। তুমি যা বলবে তাই হবে।
--সত্যি বলছিস? যা বলব তাই করবি?
--হ্যাঁ, তুমি যা বলবে।
ঝন্টুদি আরও ঘন হয়ে আসে।
--আমি না এখান থেকে চলে যাব।
--তো? কবে আসবে?
--আর আসবো না। আমাকে ভুলবি না তো?
আমি কেঁদে ফেলি। যেও না ঝন্টুদি! আমি কার সঙ্গে-- । ফোঁপাতে থাকি।
ঝন্টুদি আমার চোখের জল মুছিয়ে গালে চুমো খায়।
--একদিন সবাইকে যেতে হয় রে!
সাতদিন পর আমাদের সমস্ত ফ্ল্যাট যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। হেনাদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। কড়েয়া থানায় ডায়েরি হয়েছে।
মহিলারা ফিসফাস করছেন। কেউ কেউ বলছেন –আমরা আগেই জানতাম। ও মেয়ের চালচলন মতিগতি—
ছাদের আড্ডায় স্বপন বলল –হেনাদি পাপ করেছে। ইলোপ করেছে, তাও নীচের স্টেশনারি দোকানের মালিকের ছেলে আনোয়ারের সঙ্গে। মুসলমান! ও মুসলমান হয়ে গেছে। বাবা বলেছেন যে ওকে আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হবে না। অপবিত্র!
ইলোপ মানে কি খুব খারাপ কিছু? নাঃ, ঝন্টুদি কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।
দু’দিনের মাথায় ঝন্টুদি ফিরে এল। পুলিশ ধরে এনেছে। আনোয়ার ভাই হাজতে। রাত্তির বেলায় চিল চিৎকারে সবাই জেগে উঠল।
--আর মেরো না বাবা। লাগছে, লাগছে—আঃ আঃ আঃ!
এ তো হেনাদি’র গলা!
জানলার খড়খড়ি খুলে দেখি জ্যেঠু হেনাদিকে জুতো পেটা করছেন। উনি যেই হাঁফিয়ে উঠে ছাড়লেন জ্যেঠিমা এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান!
আর দেখতে পারি নি। মা এসে জানলা বন্ধ করে গালে এক চড় কষিয়ে বলল -শুতে যা বলছি!
তিনদিন পর। আমাদের ছাত খালি। কেউ আর খেলতে আসে না। কাল আবার পুলিশ এসেছিল। ওদিকের অনেকের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। সবাই ভয়ে ভয়ে রয়েছে। আমার দমবন্ধ লাগছে। একা ছাদে উঠেছি, হাতে নতুন শুকতারা। পাতা ওল্টাচ্ছি, মন লাগছে না।
আজ বিশ্বকর্মা পুজোর ছুটি। আকাশ জুড়ে কত ঘুড়ি উড়ছে। প্যাঁচ খেলা চলছে। কাটা ঘুড়ি লাট খেয়ে ভেসে চলছে। নীচের রাস্তা থেকে ঘুড়ি লুটের চেষ্টায় আঁকশি হাতে পাগল ছেলের দল দৌড়ুচ্ছে। ওদের হো-হল্লা শুনতে পাচ্ছি।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার চোখ টিপে ধরেছে। হাত ছাড়াতে পারছি না। কিন্তু গায়ের গন্ধটা চেনা চেনা লাগছে। ঝন্টুদি! তুমি?
-চুপ, কেউ শুনতে পাবে।
আমি ঝন্টুদির দিকে তাকাই, মুখটা ফোলা ফোলা। কিন্তু হাসছে, চোখ মুখ হাসছে। অমন করে গোটা শরীর দিয়ে হাসতে পারে একজনই।
--কী দেখছিস, চন্দন?
--তুমি খুব সুন্দর।
--আকাশের দিকে তাকা। এবার বল কী দেখছিস?
--ঘুড়িগুলো, কেমন হাঁসের মতন ভেসে যাচ্ছে।
--আর?
--আর ওই মোমবাত্তি ঘুড়িটা দেখ, কেমন পায়রার মতন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে।
--তোর ইচ্ছে করে না?
--কী?
--অমন ডানা মেলে আকাশে উড়তে—উঁচুতে, অনেক উঁচুতে?
--ধ্যাৎ, তাই আবার হয় নাকি? আমরা তো মানুষ। আমাদের ডানা নেই।
--আমি একটা মন্তর জানি, সেটা বললে ডানা গজাবে।
--গুল দিচ্ছ!
--না রে, সত্যি বলছি; তোকে ছুঁয়ে। দেখতে চাস?
--হ্যাঁ ঝন্টুদি, তোমার আমার সবার ডানা হবে? দেখাও দিকি।
--হবে পাঁচ মিনিটের জন্যে। আমার উপর ভরসা আছে তো?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। হ্যাঁ, বিশ্বাস করি বইকি!
--আয় আমার হাত ধর। আমার সঙ্গে প্যারাপিট ওয়ালের উপর উঠে দাঁড়া। চোখ বুঁজে থাক, নইলে মন্তর খাটবে না।
আমার ঘোর লেগেছে। দেখিই না একবার।
==আমার ভয় করছে।
--ভয় পাস না, একদম না। চোখ বন্ধ কর। ওয়ান, টু, থ্রি---
আমাদের ডানা গজিয়েছে। আমরা হাত ধরাধরি করে উড়ে চলেছি। উঁচুতে, আরও উঁচুতে—মহাশূন্যে।
(শেষ)
0 comments: