0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















৯.
'আত্মঘাতী বাঙালির' কাছে অচেনা নীরদ সি চৌধুরী




সুপ্রিয়বরেষু

সুস্মি,

তোমাকে যখন এই চিঠি লিখতে বসেছি বাতাসে তখন বারুদের ঘ্রাণ। দেশভাগ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, স্বাধীনতা অনেক কিছু নিয়েই লেখা যায় তোমাকে, ভারত পাক যুদ্ধ নিয়ে লিখতে মন চাইলো না। বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো তোমাকে বেলুচিস্তানের কথা লিখি তাদের স্বপ্নের কথা বলি। বহুবছর পর আত্নঘাতী বাঙালি নিয়ে বসেছি, পড়েছো নিশ্চয়। নীরদ সি চৌধুরীর লেখাগুলো সাহিত্যের ভুবনে খ্যাতি পাওয়ার পরেও জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে কেন উত্তীর্ণ হলো না, তা একটি ভাববার মতো বিষয়। তার অধিকাংশ রচনাবলীতে বিমর্ষতা হল এই প্রশ্নের উত্তর। নীরদের সাহিত্যকর্মে বিমর্ষতার লক্ষণগুলো অতটা সুস্পষ্ট নয়; অর্থাৎ, তাকে মূলধারার বিমর্ষ সাহিত্যিকদের কাতারে ফেলা যাবে না। নীরদ সি চৌধুরীর চাঁছাছোলা গদ্যরীতি আর বিমর্ষতা তার সাহিত্য চর্চায় সম্ভবত এক ধ্রুপদী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁর বোধে মার্ক্সীয় দর্শন এ যুগের নিরিখে অপ্রাসঙ্গিক। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রশংসা করছেন এক দিকে, অন্য দিকে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে তা যে হীন, তা বলতেও ছাড়ছেন না। তাঁর কাছে রেনেসাঁ হল মোগলযুগের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নতুন করে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মহত্ত্বকে অনুভব করা। হিন্দুদের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিকতার গালভরা বড়াই নিতান্তই ভুয়ো অর্থহীন, নীরদ চন্দ্র তাঁর ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে দৃষ্টান্ত দিয়ে তা দেখিয়েছেন।

নীরদ চন্দ্র চৌধুরীকে তুমি কিভাবে দেখো জানিনা তবে আমার মনে হয় নীরদ সি চৌধুরী জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা দিকের প্রশস্তি গাথা রচনা করে। ইংরেজদের তিনি তাদেরই তৈরি করা খেলায় হারিয়েছেন- নীরদ বাবুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই। তবে আগাগোড়া উদ্ধত, ভয়ানক, দ্বন্দ্বমুখর ব্যক্তিত্ব নীরদ চন্দ্র চোধুরীর বিষয়ে মূল্যায়ন করাও একটি দন্ধ মুখর কাজ, যা করতে যোগ্যতা, ধৈর্য, জ্ঞানের গভীরতা এবং নির্মহ হওয়ার চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তাকে তাই মূল্যায়ন করা যায় না, তার বর্ণিল জীবন শুধু উপভোগ করা যায়, তার সাহিত্যকর্মের গভীরে পৌঁছে ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বকে আয়েশ করে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, তবে তার জীবন ও কর্মের বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানো, স্বাস্থ্যহীন জীর্ণ-শীর্ণ মানুষের হিমালয় বিজয়ের আকাঙ্খার মতো।

দ্বান্দ্বিক নীরদ চন্দ্র তার প্রথম লেখা ইংরেজি বই দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান লেখার সময় ভূমিকায় বলেছেন, আমি জীবনের প্রথম পঞ্চাশটা বছর মুছে ফেলে নতুন করে বাঁচতে চাই। বন্ধুরা মনে করেন আমি এক ব্যর্থ মানুষ, আর এই বই লিখে সেই ব্যর্থতার এক অজুহাত খাড়া করতে চাইছি। তবে আমি সেই তথাকথিত পরাজয় এবং সেই পরাজয় স্বীকারের মাঝখানে একটা সরু, নোনা জলের দুরতিক্রম্য নদী বইয়ে দিতে চাইছি। রণে ভঙ্গ আমি দিচ্ছি না। তার এই স্বগতোক্তি আবার বাঙালি পাঠকদের মনে তার সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেক করে। প্রথম পঞ্চাশটি বছর যা তাকে বিশ্ব জগতকে দেখার সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছে, যে সময়ে তিনি একাডেমিক লেখা পড়ার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন মেধা সম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে নুতন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছেন, সেই সময়কে তিনি মুছে ফেলতে চান। এরকম উক্তি তার মতো পন্ডিত ব্যক্তির মুখে যখন শোনা যায়, তখন তার দিকে সন্দেহ মিশ্রিত দৃষ্টিতেই তাকাতে হয়। আভিজাত্য, শ্রেণি-উত্তরণ, জ্ঞানের স্বীকৃতি, উন্নত জীবন অর্জনের জন্য যে আত্মঘাতী হতে হয়, তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই কথাটি পাঠকদের স্মরণ করে দিতে তিনি বাধ্য করেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী-র লেখা ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’তোমার পড়া আছে কিনা জানি না। বইটি আত্মজীবনী হলেও পড়তে পড়তে মনে হবে এক জন ইতিহাসবিদের চোখে দেখা ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ পড়ে এ দেশের মানুষ অসন্তুষ্ট হলেও বিদেশিরা বইটির প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমন দু’জন ছিলেন যাঁদের প্রশংসা পাওয়াটা বিরল ব্যাপার। এক জন বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নায়পল, অন্য জন উইনস্টন চার্চিল। ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ এক জন ভারতীয় বালকের বেড়ে ওঠার কাহিনি। সেটা গত শতকের গোড়ার দিককার কথা। যে জগতে ক্রমশ তিনি আর তাঁর নিজের পথ খুঁজে নিতে পারছেন না, ছটফট করছেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বরাতের লেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে। সেই সন্ধিক্ষণের কথা সমাজ ইতিহাসের পাতা থেকে নীরদ চৌধুরীর অটোবায়োগ্রাফির পাতায় উঠে আসছে সৎ স্বচ্ছ অবিকৃত বিবরণে। বইটির বিভিন্ন অংশে রয়েছে লেখকের পিতৃভূমি এবং মাতুলালয়ের গ্রামের কথা। বয়ঃসন্ধিকালে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জাগৃতি, কলকাতার মানুষ আর জীবনের কথা। শেষাংশে লিখছেন তাঁর ‘আইডিয়াজ় অব অ্যান এপিটাফ’—‘হিয়ার লাইজ় দ্য হ্যাপি ম্যান হু ওয়াজ় অ্যান আইলেট অব সেন্সিবিলিটি সারাউন্ডেড বাই দ্য কুল সেন্স অব হিজ় ওয়াইফ, ফ্রেন্ডস অ্যান্ড চিলড্রেন’। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ বইটি তিনি উৎসর্গ করলেন ‘টু দ্য মেমারি অব দ্য ব্রিটিশ/ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া,/ হুইচ কনফার্‌ড সাবজেক্টহুড/ আপঅন আস/ বাট উইথহেল্ড সিটিজ়েনশিপ।’ ‘অটোবায়োগ্রাফি’-র এই উৎসর্গ ক্রুদ্ধ করল কতিপয় ভারতীয় তথা বাঙালিকে। যারা বরাবরই নীরদ সি-র ভাব-ভাবনা অপছন্দ করে আসছেন। তাঁকে এর জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের শেষ সমর্থক, ব্রিটিশভক্ত দালাল ইত্যাদি বাণ ছুড়তে কসুর করেননি তারা। তারা খেয়াল করল না ভারতীয়রা ইংরেজদের কাছ থেকে ‘সাবজেক্টহুড’ পেলেও ‘সিটিজ়েনশিপ’থেকে বঞ্চিত বলে নীরদচন্দ্র কী ভাবে ইংরেজদের শ্লেষবিদ্ধ করলেন। অটোবায়োগ্রাফির জন্য নীরদ সি-র বিলেত ভ্রমণের আমন্ত্রণ এল ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে। মাত্র ছ’সপ্তাহের জন্য। সেই প্রথমবার, তাঁর স্বপ্নের ‘স্বদেশযাত্রা’। তাঁর বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখলেন ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল’ প্রাপ্তিতে কতিপয় খ্যাতনামা ইংরেজ তাঁর যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রুষ্ট নীরদচন্দ্র ইংরেজদের বুদ্ধিভ্রম সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হন। এক সময়ের সভ্যতার ধারক বাহক আর্যদের উত্তরপুরুষ ব্রিটিশদের যে বৌদ্ধিক অবনমন ঘটেছে, সে কথা তাঁর ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ সার্স’ গ্রন্থে বিধৃত আছে।

নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। তার চিন্তা ধারা ও রচনা আমাদের আঠারো শতকের সংঘটিত ও প্রাজ্ঞ সমালোচক ড. জনসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নীরদ চন্দ্রের পড়াশোনা ছিলো সীমাহীন ও ব্যক্তিত্বের ধরন ছিলো স্বতন্ত্র। সেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালিসুলভ আবেগ, একগুঁয়েমি ও পান্ডিত্য গৌরব, যা তাকে এক অনন্য পরিচিতি দিতে সক্ষম হয়েছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখনী সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস যাহা লিখিয়াছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য: 'নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিচিত্র মানুষ। বেঁটে খাটো মানুষটি অথচ বিদ্যার জাহাজ। সাত সমুদ্র তেরো নদীর খবর তাহার নখাগ্রে ছিল, ফরাসী সাহিত্যের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সারা পৃথিবীর সামরিক বিদ্যার তিনি ছিলেন মনোয়ারী জাহাজ। তাহার ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগা গুরু মোহিতলালের মতই অতি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল; একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন, বিপুল সমারোহে কাজ আরম্ভ করিয়া শেষ করিতে জানিতেন না, গাছে উঠিয়া নিজেই মই ফেলিয়া দিতেন।' কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রাম থেকে অক্সফোর্ড নগরীর ২০ ল্যাদবেরি রোডের তিনতলা বাড়িতে পৌঁছুনোর যাত্রা পথ সহজ ছিলোনা। এই যাত্রা পথে তিনি যতনা কুসুম কুড়িয়েছেন, কন্টক কুড়িয়েছেন অনেক বেশি। তিনি অধিকাংশ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অপছন্দের তালিকার মানুষ। নীরদ সিকে বাঙালি পাঠকেরা প্রথমে অবজ্ঞা করেন এবং এরপর সযত্নে তাকে এড়িয়ে চলেন। তার সম্পর্কে বাঙালির প্রবল অবজ্ঞার কারন হলো বাংলা ছেড়ে তিনি দীর্ঘদিন দিল্লি এবং পরে রানীর দেশে থিতু হয়েছেন সুতরাং এই ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগীর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। এছাড়া বিদ্যার বহর জ্ঞানের চাকচিক্য দেখাতে তার কোন কার্পন্য ছিলো না। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘বিদ্যার বহর দেখাইতে তাহার বড় আনন্দ।’ উপরন্তু তিনি বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ মনে করেন, পূর্বতন ঔপনিবেশিক প্রভুর দেশে বসে তিনি বাঙালিকে ভর্ৎসনা করেন। অথচ দেখো কলকাতাতে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে একই মেসের বাসিন্দা ছিলেন। ভাবতে কেমন অবাক লাগে, তিনটি মানুষ তিন ভূবনের বাসিন্দা।

নীরদ সি চৌধুরী নিজেকে যতই সাম্রাজ্যবাদী বলুন আদতে তিনি সত্যিকারের একজন বাঙালি তার জীবনাচরণ, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অগাধ জ্ঞান এবং লেখালেখিতে ইউরোপিয়ান এবং ভারতীয় জ্ঞানের প্রতিফলন কূয়াশাচ্ছন্ন করে তোলে তার সমালোচকদের, তার স্বরূপ খোঁজে পাওয়া অনেক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো মনে হয় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই বোধ হয় সব চেয়ে বড় আত্মঘাতী। আমার মনে হয় উনার কোনো কোনো লেখায় ব্যক্তি ও সমষ্টি আহত হয়েছেন। যুক্তিকে আমলে না নিয়ে, প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে দাঁড় করা হয়েছে বৈরী ব্যাখ্যা। কিন্তু সত্যিই সদর্থক অর্থে যদি বিশ্লেষণ করা হয় উনার লেখালেখি ও গবেষণা, তাহলে মতদ্বৈততা হয়তো দেখা দিতে পার, কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখানেই নীরদবাবুর স্বার্থকতা। । দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তিনি আমাদের জন্য এমন সত্য উন্মোচন করেছেন। আবিস্কার করেছেন অনির্ণেয় এমনসব সম্পদ যা এ জাতিকে ধন্য ও গৌরবান্বিত হওয়ার পাথেয় যুগিয়েছে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জাতিগত ভিত্তি ও শক্তি-সাহস এবং সৌন্দর্য নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন, যার জন্য এ জাতি ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারে। ৯৭ বছর বয়সে তুখোড় স্মৃতি নিয়ে লিখলেন ‘থ্রি হর্সমেন অব দ্য নিউ অ্যাপোক্যালিপ্স’ নামক বহুদর্শীর আলেখ্য। বাঙালির নৈতিক অবক্ষয় আর রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের যে চিত্র সেখানে অঙ্কিত, তা আজকের প্রেক্ষাপটেরই যেন নির্ভুল পূর্বানুমান। মননে একজন খাঁটি বাঙালি না হলে এইভাবে পূর্বানুমান করা কি সম্ভব? এই প্রশ্ন বারবার আমাকে ভাবায়। নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখার বড়গুণ হলো তাতে বহুকৌণিক দৃষ্টি রাখার সুযোগ থাকে অবারিত। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব-ভূগোল ও জাতীয়তার আলোচনায় উনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যদ্বাণীসমূহে কতটা নির্মোহ সত্য জারি রয়েছে, সেসব বিচারে ও পর্যবেক্ষণে বাঙালি নীরদচন্দ্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজী লেখক নীরদ সি-র মধ্যে অনুরূপ এক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হয়ে এসেছে। নীরদবাবু সেটা মানেননি, কিন্তু তর্কটাকে ক্রমাগত উস্কে গেছেন। শেষ দিকে অঢেল সমালোচনাও করেছেন ব্রিটিশদের। তাতে হয়তো ওঁদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। কিন্তু এ দেশে? যুক্তি, প্রশ্রয় ও ভালবাসা দিয়ে পড়লে নীরদচন্দ্র ও নীরদ সি কিন্তু অবলীলায় এক হয়ে যেতে পারেন আমাদের ভাবনাচিন্তায়। মনে রাখা জরুরি নীরদ সি চৌধুরীকে নিয়ে গভীর পাঠের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি যদি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার বিষয় হন তাকে নিয়ে আলোচনার দরকার তার চেয়ে বেশি। পাঠককে শুধু সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো নয়, খোঁচা মেরে মাঝে মাঝে রক্তাক্ত করাও যদি লেখকের কাজ হয় নীরদ সি চৌধুরী সে তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। তার খোঁচায় আমরা রক্তাক্ত হই, কষ্ট পাই-কিন্তু খোঁচার প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করতে পারি? লেখাটার শেষ টানছিনা। শেষ টানা সবসময়ের কাজ নয়। শুরু করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তারপর তাকে টেনে নেয়াও বড় কাজ। আমি বিশ্বাস করি নীরদ সি চৌধুরীকে ভবিষ্যৎ হয়ত আরো ভালো করে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করবে। কারণ নীরদ সি চৌধুরীকে শত্রু মনে করে এমন লোকের সংখ্যাই বাঙালি পাঠকে বেশি। আর বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে গভীর অধ্যয়ন করা কত গুরুত্বপূর্ণ এটা বাঙালী এখন না বুঝলেও ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকই বুঝে নিবে। যদিও লেখক নীরদ সি চৌধুরী মনে করেন তাকে এক বিদেশী ভদ্রলোক ভালো ধরতে পেরেছেন। ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ তে বাঙালি পণ্ডিতেরা যে তাকে কম ধরতে পেরেছে এর উল্লেখ করে বলেন: “কিন্তু একজন বিদেশী পণ্ডিত আমার ব্যক্তিত্বের আসল রূপ চিনিতে পারিয়াছেন। তিনি শিকাগো ও কেমব্রিজের অধ্যাপক এডোয়ার্ড শিলস্। তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরিয়া আমাকে জানেন। কিছুদিন আগে তিনি ‘আমেরিকান স্কলার’ বলিয়া যে একটি পত্রিকা আছে তাহাতে আমার সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন। উহার এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন,- “Mr Chaudhuri’s being an Indian and a Bengali, and a European and Englishman, all at the same time is unique. He is perhaps the only one of his kind and there is no established name for the likes of him. Perhaps the old designation of “citizen of the world’ is the only one available…Mr. Chaudhury is the real thing.

একটা কথা মনে রাখতে হবে বন্ধুকে ঠিকমত অধ্যায়ন না করলে সমস্যা নাও হতে পারে। কারণ তার থেকে কোন উপকার না পেলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তুকে শত্রুকে যতি ঠিকমত আবিষ্কার না করি তাহলে ব্যক্তি শুধু ভোগবেনা, ভুগবে সমাজ, দেশ ও জাতি! নীরদ সি চৌধুরী এমন এক ব্যক্তি যার কথায় কানে তুলা দিয়ে থাকা যাবেনা। কারণ কানে তুলা দিলেই তো ঝড় থেমে যায়না। নীরদ সি চৌধুরী একটি ঝড়ের নাম এবং তাকে খুবই মনোযোগ ও যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে! নীরদ সি চৌধুরী ভবিষ্যতের আলোচ্য বস্তু হওয়া উচিত। তোমার কি মনে হয়?

ইতি-

বাসু

১ জুন,২০২৫

পুনশ্চ: নীরদ সি চৌধুরীর ভাষায় ‘বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র’। রবীন্দ্রনাথের হাতে এ বিশেষ প্রেমের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয়। এঁদের এই বইপত্র পড়েই নব্য কালো-ইংরেজ শ্রেণি নতুন সাদা প্রেম শিখেছে। আয়ত্ত করেছে প্রেমের ভাষা-সম্ভাষণ; দুই তরফা (নর–নারী) প্রেমের ব্যাকরণ।

0 comments: