0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১২

-‘আপনি দেখবেন… ‘ চার্লস বকবক করে যায়… ‘আমার বন্ধু আপনি। একবার জেরাল্ডকে দেখলেই বুঝবেন… ওঁকে দেখে, ওঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বুঝতে পারবেন যে সবাই কেন ওঁর উপরে এত ভরসা করে! রবার্ট কিম্বা অন্য কারো উপরে কেউ এতটা ভরসা করে না। জেরাল্ড অবশ্য সেই অর্থে আমাদের বন্ধুবৃত্তের ভেতরের কেউ নন; বাইরের… কিন্তু বেশ অদ্ভুত! অবশ্য রবার্ট সম্বন্ধেও আমি সেই একই কথা বলেছি আপনাকে, তাই না? ফলে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না যে অদ্ভুত বলতে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি। আসলে আমি খুব তাড়াতাড়ি পুরো বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। রবার্ট এমনিতে বিশাল কেউকেটা নয়। তবে ও জেরাল্ডের বন্ধু এবং সেটাই একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জেরাল্ড সন্ধেবেলা প্রায়ই রবার্টের কাছে আসেন এবং আমরাও সেই কারণে রবার্টের কাছে যাই। রবার্ট এমনিতে খুব দিলদরিয়া; তাছাড়া আমাদের সবার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু তাঁর কিছু দুর্বলতা আছে, ফলে সে খুব কষ্টভোগ করে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলা চলে যে মিকার সঙ্গে ওঁর প্রেমের সম্পর্ক আছে। ওই যে মিচকে রোমানিয়ান মেয়েটার কথা বলছিলাম না? মেয়েটা এমনিতে বাইরে বেশ নরমশরম, মিষ্টি… কিন্তু ভেতরে ভেতরে একদম ভিজে বেড়াল। অবশ্য সেটা তত জরুরি কথা নয়। কারণ আমরা সবাই মেয়েটার স্বরূপ জানি এবং আমরা কেউই সেভাবে মেয়েটাকে বিশ্বাস করি না। কিন্তু জেরাল্ডের কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। বুঝে দেখুন যে ওই মিকার আবার জেরাল্ডের উপরে বেশ ভাল প্রভাব আছে। জেরাল্ডের সঙ্গে যদি একবার আপনার পরিচয় হয়, তো বুঝতে পারবেন যে জেরাল্ড একদম অদ্ভুত মানুষ! তিনি একটাও মিথ্যে বলেন না, ফালতু কথা বলেন না এবং ওঁর মতামত একদম অব্যর্থ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে এক আধজন মেয়ে কিম্বা ছেলেকে পছন্দ করে চিহ্নিত করেন তিনি। প্রথমে অনেকেরই মনে হয় যে ওঁর পছন্দ বা মতামত হয়তো ভ্রান্ত। কিন্তু শেষ অবধি দেখা যায় যে সেই মতামত ভুল নয়। যাদের জেরাল্ড পছন্দ করেন, তারা সত্যি সত্যি বিশেষ প্রতিভার অধিকারী কিম্বা অধিকারিণী। ফলে আপনি বুঝতেই পারছেন যে ওঁর মতামতের গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম এবং সেই কারণেই সবাই ওঁর উপরে ভরসা করে থাকে।’

-‘তিনি কি আপনাকে পছন্দ করেন?’

-‘আমি ভেবেছিলাম সেরকমই কিছু একটা হবে।’… চার্লস মরিয়া ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়… ‘কিন্তু আমি মূর্খ… আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে উনি আমায় পছন্দ করেন। আমি ওঁর বাড়িতে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম যে ওঁকে জিজ্ঞেস করব যে আমার জন্য কোন পেশা ভাল হবে, ভবিষ্যতে কী করা যায়। কারণ সম্প্রতি সব জায়গা থেকে আমায় বিফল হয়ে ফিরতে হচ্ছে। এদিকে আমার তো পয়সার দরকার। সত্যি দরকার। আমি লেখালেখির কাজ ছাড়াও এদিক ওদিক নানা কাজের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সব জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আবার আমার শরীরটাও সুবিধের নয়। দেখুন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। লোকে বলে যে আমার নাকি যক্ষ্মা হয়েছে, আমার নাকি স্যানাটরিয়ামে ঠাঁই হয়েছে। সন্দেহ আছে এ বছর আমি পরীক্ষায় পাশ করব কি না! শিক্ষকেরা কেউ আমার প্রতি সদয় নন। তাঁরা মনে করেন যে আমি খুব খারাপ এবং বিপজ্জনক মানুষ। আমি আর পারছি না… হাঁপিয়ে উঠেছি। সেইজন্য আমি জেরাল্ডের কাছে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম তাঁর উপদেশ নেব। হতে পারে এখন আবার হয়তো মিকা বসে রয়েছে তাঁর কাছে, যেভাবে গতকাল সে তাঁর হাঁটুর উপর বসেছিল!’

-‘হাঁটুর উপরে?’

-‘হ্যাঁ, হাঁটুর উপরে বসেছিল ওই বদ নেকুপুষু মেয়েমানুষটা! আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। তার উপর ওই বারের গায়িকা মেয়েদুটো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমার ভাল লাগেনি। অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে চুপ করে থাকার বদলে আমি এক দুটো কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম ওদের। হয়তো খুবই কটু কথা বলেছিলাম। আসলে অপমানজনক কথা, নাকি কটু কথা… সেটাও এখন ঠিক মনে নেই। তারপর আরও অসুস্থ বোধ করছিলাম আমি। দৌড়ে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। কেঁদেছিলাম। ফিরে ভেতরে গিয়ে দেখি মিকা তখনো জেরাল্ডের হাঁটুর উপরে বসে আছে। উনি ওকে এমন ভাবে ধরে আছেন যেন কচি খুকি। কিন্তু মিকার বয়স ষোল। তারপর খুব শীতলভাবে উনি আমায় বললেন, ‘চার্লস, আপনার নেশা হয়ে গিয়েছে!’ ব্যস, আর কিচ্ছু না। তারপর মিকা বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল আর ওঁর কানে কানে কিছু বলতে শুরু করল। নিঃসন্দেহে আমার নামেই কিছু বলছিল… আর সেগুলো নির্ঘাত খুব খারাপ কথা; কারণ উনি মিকাকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু রবার্টকে? আমার শরীর খারাপ করছিল বলে রবার্ট একটা চায়ের পট নিয়ে এসে আমায় এক কাপ চা দিচ্ছিল। উনি তাকেও একই রকম শীতল কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘তুমি বরঞ্চ চার্লসকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও! এখানে বসে ওঁর কাজটা কী? উনি এখনও ছাত্র… তাছাড়া উনি খারাপ ব্যবহার করছেন।’ শুনে সবাই চুপচাপ হয়ে গেল, আর আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন আমি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছি। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে জেরাল্ডের মতামতের উপরে সবাই অনেকখানি গুরুত্ব দেয়। তিনি আবার বললেন, ‘আপনি বাড়ি চলে যান, চার্লস!’ আমি চলে এলাম; অবশ্য তাছাড়া আর কী বা আমি করতে পারতাম?’

বিষণ্ণ এবং বিরক্ত চার্লস একদৃষ্টে তাঁর বড় হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বের্নহার্ড বেশ বিচলিত বোধ করছে; সে অন্যরকম কিছু ভেবেছিল। সে ভেবেছিল যে হয়তো সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা ঘটেছে। সে ভেবেছিল যে চার্লস খুব অসম্মানজনক, বিশ্রী কিম্বা অসাধু কোনও অপকর্ম করেছে হয়তো বা; এরকম ভেবে সে একটু ভীত ছিল, কারণ সে এইধরনের ঘটনা শুনতে চায় না। কিন্তু এখন চার্লসের বিষণ্ণতা তাকে স্পর্শ করছে এবং সে বিচলিত বোধ করছে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে চার্লস কতখানি অপমানিত বোধ করেছে জেরাল্ডের ব্যবহারে। ‘বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া’র ব্যাপারটা যথেষ্ট অপমানজনক পরাভবের পর্যায়ে পড়ে। সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা শুনবে বলে সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করছিল; কিন্তু সেসব নাটকীয় ঘটনার তুলনায় এই ব্যাপারটা কম অসহনীয় নয়।

-‘আমি দুঃখিত!’ বের্নহার্ড বলে… ‘আপনার সঙ্গে যেটা ঘটেছে সেটা মোটেই ভাল হয়নি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে জেরাল্ড যা বলেছেন, সেটা আপনাকে অপমান করবার জন্য নয় এবং সেরকম কিছু গুরুগম্ভীর অর্থ নেই সেই কথার।’

-‘তিনি যে কথা বলেন, অর্থ বুঝেই বলেন। না বুঝে কিছু বলেন না।’

-‘সেক্ষেত্রে আমার মতে সবচেয়ে ভাল হবে আলাদাভাবে জেরাল্ডের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। অবশ্যই যখন তিনি একা থাকবেন, তখন কথা বলতে হবে। রবার্টের সামনে নয়, কিম্বা ওই গায়িকাদের সামনেও নয়, কারণ তারা আপনাকে বিরক্ত করবে এবং মিকার সামনেও নয়, কারণ সে আবার হাসাহাসি শুরু করবে।’

-‘তাহলে আমায় জেরাল্ডের বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যাবার সাহস আমার নেই।’

-‘আপনি যদি চান, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি।’

-‘আপনি যাবেন?’ চার্লস অবাক হয়েছে বোঝা যায়। সন্দিগ্ধচোখে তাকায় সে বের্নহার্ডের দিকে। টেবিলের উপর থেকে হাতদুটো সরিয়ে নেয়। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে বের্নহার্ডের কাছে গিয়ে… ‘আমি জানতাম যে আপনি আমায় সাহায্য করবেন।’ তার চোখে শিশুর সারল্য… ‘আমি বিশ্বাস করি আপনাকে… আপনি একজন ভাল মানুষ।’




(চলবে)

0 comments: