প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধযার কথা বা যাদের কথা এই প্রবন্ধের বিষয়, সে আলোচনা শুরুর আগে অন্য দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খন্ড) যে প্রত্যন্ত গ্রামটি আমার পৈতৃকভূমি, সেই গ্রামের অধিবাসীরা দুটি ভাগে বিভক্ত—এক অংশ হলেন কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার, অপর অংশটি হল স্থানীয় আদিবাসী পরিবার। এই আদিবাসী পরিবারগুলি হলেন কুর্মী, মাহাতো, রাজোর, ভূমিজ, সাঁওতাল ইত্যাদি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় ও ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া সেই গ্রামে আর অন্য কোন জাতির মানুষ সেখানে বসবাস করেন না। বলা বাহুল্য, ব্রাহ্মণ পরিবারগুলির বাড়িতে এই আদিবাসী পরিবারের মানুষেরাই সাংসারিক সবরকম কাজে সহায়তা করে থাকে। সুতরাং সেই শিশুবেলা থেকেই তাদের দেখে এবং শুনেই বড় হওয়া। পরবর্তীকালে রামায়ণ এবং আদিবাসী ও অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষের মধ্যে রামায়ণের প্রভাব নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে গিয়ে এদের স্মৃতি ও শিক্ষা যে আমার বিশেষ সহায়ক হয়েছে, একথা বললে ভুল কিছু বলা হয় না।
শিশুবেলা থেকে বিহারের গ্রাম্য সমাজ-সংস্কৃতিতে রামলীলা, রামগান, নৌটঙ্কি এসব দেখে বড় হওয়া। আশ্চর্য্য হতে হয় যখন দেখি তথাকথিত এই অশিক্ষিত মানুষগুলির মনেও রামায়ণ এবং তার ভাবনা ছড়িয়ে আছে। অঞ্চল বিশেষে তার ব্যাখ্যার তারতম্য হয়,কাহিনিরও হয়ত কিছু পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু ভক্তি ও বিশ্বাসের তারতম্য ঘটে না কোথাও। একই প্রকাশ দেখেছি বাংলার বিভিন্ন আদিবাসী অভ্যূষিত জেলা বা অঞ্চলগুলিতেও। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম,বর্ধমানের একাংশ অর্থাৎ যে সকল স্থান আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চল সেই সকল গ্রামগুলিতেও তার প্রমাণ মেলে। এবং আশ্চর্য্যের বিষয়, কিছু কিছু আদিবাসী ঘটনা, রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে সকল আদিবাসীদের ধ্যান ও ধারণা প্রায় একই রকমের। সম্ভবত আদিবাসীদের গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজব্যাবস্থার কারণেই তা সম্ভব। আরো একটি বিষয় হল, সমাজের মূল কাঠামোটির অপরিবর্তনীয়তা, যা সকল স্থানে একই রকম ভাবে প্রযোজ্য এবং অপরিবর্তিত। আদিবাসী সমাজের এটি মূল বৈশিষ্ট্য।
.
আমরা জানি, আদিবাসী সমাজের মধ্যে অধিক হল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষগুলির নিতান্তই তাদের নিজস্ব কোন নিয়ম বা নীতির উল্লেখ না থাকলে অনেকেই তাই আদিবাসী সমাজ বলতে সাধারণতঃ সাঁওতাল সমাজকেই বুঝে থাকেন। হয়ত বা এই সম্প্রদায়ের মানুষ অধিক বলে আদিবাসী মানেই সাঁওতাল এইরকম একটি ধারণা থাকলেও থাকতে পারে। বলাবাহুল্য, আমার পৈতৃকভুমিতে সাঁওতাল ব্যতীত অন্যান্য আদিবাসী সম্পদায়ের বসবাস থাকলেও ছোটবেলায় ‘আদিবাসী মানেই সাঁওতাল’ এই ভুল ধারণা আমারও ছিল।
‘Tribes of India’ (Indian Museum থেকে প্রকাশিত) বইতে বলা হয়েছে জনজাতি ও জনগোষ্ঠীগুলির অবস্থান কয়েকটি অঞ্চল ঘিরে, যার মধ্যে একটি হল নদীকেন্দ্রিক অঞ্চল। আবার তারা যাযাবর। অর্থাৎ নানা দেশে নানা জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়। আদিবাসী সমাজের আদি বাসস্থান নিয়েও আছে নানান মত। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়ের ‘আদিবাসী সমাজ ও পাল পার্বণ’ বইতে পাচ্ছি, সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত কিছু গান, যা তারা শ্রুতির আকারে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনে শুনে স্মরণে রেখেছে। এই গানগুলিতে জানতে পারি যে, একসময় জনজাতি-জনগোষ্ঠীগুলির বসবাস ছিল চাম্পাগড়ে। অন্যান্য কিছু ব্যাখ্যাতেও পাচ্ছি, এই চাম্পাগড় হল পঞ্জাব প্রদেশে, যাকে সাঁওতালরা বলে থাকেন ‘মঁড়ে গাড়া রেয়াঃক দিশম’ অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ। সুতরাং,অনেকের মতেই জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষদের বাসস্থান ছিল এই অঞ্চলটি ঘিরে এবং তাদের আগমন দেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে।
আবার এই মতটির পাশাপাশি 1910 সালে প্রকাশিত Santal Parganas—Bengal District Gezetteers –এ অন্য একটি মতও আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাঁওতালদের অধিকাংশই যে চাম্পা থেকে উঠে আসার কথা বলে থাকেন, এই চাম্পা হল হাজারীবাগের কাছে। সেটি কি বিহারের চম্পারণ জেলা? জানা নেই। এইমতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই চাম্পা প্রদেশে বাসস্থানের কারণে হাজারীবাগ, দুমকা, রাজমহল, ছোটোনাগপুর ইত্যাদি অঞ্চল ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে এদের বসতি লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরের আরো কিছুটা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতিও লক্ষ্য করা যায়।
যারা চাম্পা অর্থাৎ পঞ্জাব প্রদেশের চাম্পা নগরীতে সাঁওতালদের আদি বসতি বলে মনে করেন, তাঁদের কাছে এই আদিম অধিবাসীরা ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার কারিগর বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায় অর্থাৎ সোরেন, হাঁসদা, মান্ডি, কিস্কু, হেমব্রম ইত্যাদি গোষ্ঠীর প্রত্যেকের নিজস্ব ‘গড়’ ছিল এমনই ধারণার ব্যাখ্যা সেখানে করা হয়েছে। এবং শুধু যে তাদের নিজস্ব গড় ছিল তাই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাজও নির্দিষ্ট ছিল। চতুরাশ্রমের কালে যেমন সকল বর্ণের জন্য কাজ নির্দিষ্ট করা ছিল অনেকটা তেমনি। কিন্তু এখানে জাতিভেদের কথা উল্লেখিত নেই। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য সমাজের নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব ছিল। যেমন---
সরেন--সরেনরা একসময় সৈনিক হিসেবে কাজ করতো। সেইকারণে তাদের সরেন সেপাই বলা হত।
কিস্কু রাপাজ-- কিস্কু সম্প্রদায় ছিল রাজ্য পরিচালনায় সুদক্ষ । এই কারণে এদেরকে এই নামে অভিহিত করা হতো।
মাণ্ডি কিসাঁড়া বা কিলিপসাড়-- মাণ্ডিরা কৃষিকাজ করতো বলে এদেরকে এই নামে উল্লেখ করা হত।
মুর্মু ঠাকুর—মুর্মু সম্প্রদায়ের কাজ ছিল পৌরহিত্য করা। পৌরহিত্য করতো বলে, এদেরকে এই নামে অভিহিত করা হতো।
এই সম্প্রদায়গুলি ছাড়াও আরো অনেকেই বিশেষ কাজে পারদর্শী ছিলেন বলে তাদের উপর ছিল সমাজের সেইসব বিভাগের দায়িত্ব। যেমন, হেমব্রমরা ছিলেন দেওয়ান, বাস্কে সম্প্রদায় ছিলেন ব্যাবসার কাজে যুক্ত ইত্যাদি। এসব আলোচনা ও তথ্য কতখানি সত্য বা উপযুক্ত তা জানা যায় না। কিন্তু আদিবাসীদের নিয়ে আলোচনা, গবেষণা করতে গেলে এর মূল্য যে অপরিসীম একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবই গেল আলোচনার গোড়ার কথা। যে দুজন আদিবাসী মানুষকে নিয়ে আজকের প্রতিবেদন এবার তাদের কথায় আসি। এই দুজন মানুষের নামকরণের আড়ালে রয়েছে ব্জাত্যাভিমান, সামাজিক পরম্পরার প্রতি আনুগত্য এবং রামায়ণের প্রভাব। উপরোক্ত আলোচনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সেইকারণেই। এই দুজন মানুষ হলেন সরেন মান্ডি ও রাবণ হেমব্রম।
সরেন মান্ডি--- সরেন মান্ডির পিতার সঙ্গে পরিচয় বর্ধমানে। একজন শিক্ষিত মানুষ, পেশায় সরকারী কৃষিবিভাগের কর্মী ছিলেন। নিজের সন্তানদেরও শিক্ষিত করেছেন। সরেন মান্ডি পরিবারের প্রথম সন্তান, পেশায় চিকিৎসক। এ পর্যন্ত আদিবাসী সম্বন্ধে অতি অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত আমার ধারণা ছিল ‘সরেন অথবা সোরেন’ আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি সম্প্রদায়, কিন্তু কারও নামও যে হতে পারে তা জানা ছিল না। সরেন মান্ডির কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি, ‘সরেন’ কথাটির অর্থ। আদিবাসী সমাজে ‘সরেন’ সম্প্রদায় ছিল সিপাহী বা সেপাই অর্থাৎ সৈনিক যারা নিজেদের গড়, সমাজ ইত্যাদিকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। প্রয়োজনে অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধেও লিপ্ত হতেন। মনে প্রশ্ন ছিল, ডাক্তার পুত্রের এই ধরণের নামের পিছনে যুক্তি কি? সেকথা জানাতেই উত্তর পাই---পিতার মনে পুত্র জন্মাবার পর থেকেই তাকে চিকিৎসক হিসাবে তৈরি করয়ার কথা ভেবেছেন। তাঁর মতে, একজন চিকিৎসকও তো সমাজের সৈনিক যার কাজ হল মানুষের দেহের সব রকম অ-সুখ বা রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা, মানুষের দেহের রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। তিনি নিজে যদিও মান্ডি সম্প্রদায়ের মানুষ, কৃষিকাজই পিতা-পিতামহদের জীবনের অঙ্গ, তবু সমাজের এই দুরূহ কাজটিকেই তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া তিনি নিজে শিক্ষিত মানুষ, তাই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসীদের ‘জড়ি-বুটি-ভেষজ’ চিকিৎসা অপেক্ষা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার কথা যুক্তিসম্মত মনে করেন। আর সেই উদ্দেশেই পুত্রের নাম ‘সরেন’, সরেন মান্ডি।
রাবণ হেমব্রম---
রাবণ হেমব্রমের সঙ্গে দেখা বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বীরভূমের কয়েকটি আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামে যাবো, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলব। এই সব আদিবাসী গ্রামের মানুষদের মধ্যে রামায়ণের কোন প্রভাব আছে কিনা, থাকলেও তা কতখানি, তাঁরা রামায়ণের কাহিনি জানেন কিভাবে, কি কি কাহিনি জানেন এসব তত্ত্বতালাশ করতেই যাওয়া। যে রিক্সাটিতে উঠে বসলাম তার চালক একজন আদিবাসী পুরুষ। চেহারা দেখে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয়না। সেই কালো গায়ের রং, শক্ত-সবল চেহারা, কোঁকড়ানো চুল ও ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখে মানুষটিকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু যেটি আমায় অবাক করল তা হল, এর আগে আমি আর কখনো কোনো আদিবাসী মানুষকে রিক্সা চালাতে দেখিনি। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানলাম তার নাম রাবণ, রাবণ হেমব্রম অর্থাৎ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। বইয়ে পড়ে জেনেছি ‘হেমব্রম’ কথার অর্থ—মসীজিবী অর্থাৎ যারা লেখালেখি করেন, যেমন ‘সোরেন’ শব্দের মানে জেনেছি—সৈনিক। আবার হেমব্রম শব্দের অর্থ ‘দেওয়ান’,সেও পড়েছি। তার মানে, হেমব্রম সম্প্রদায়ের লোকেরা মসীজীবী অথবা দেওয়ান যাই হোক না কেন, আদি সমাজে, এই হেমব্রমরা কি লেখালেখির কাজ করতেন? মসীজীবি হলে তো তাই বোঝায়। দেওয়ানদেরও খানিক এই কাজ করতে হয়। কেন জানিনা, আমার মন চলে গেল সেই কোন প্রাচীন সভ্যতার যুগে যেখানে এইসব আদিম অধিবাসীরাই ছিলেন প্রধান কারিগর। সেখান থেকে আজ অবস্থার বিপাকে পড়ে রিক্সাচালক...বেঁচে থাকার তাগিদে। আদিবাসী সমাজের মানুষেরা তো সেই কোন যুগ থেকে বিতাড়িত হতে হতে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গেছেন...ক্রমে ক্রমে যুগের পর যুগ ধরে তারা নিজেদের এই সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। রাবণ হেমব্রম কি তাদেরই একজন নয়?
কিন্তু রাবণ নাম কেন? এর সঙ্গে কি রামায়ণের যোগ আছে?
বোলপুর—শান্তিনিকেতনের কাছে ‘দ্বারন্দা’ নামের গ্রামে এক ভরত মারডির দেখা পেয়েছি, কিন্তু রাবণ নামে কখনোই কাউকে পাইনি। না আদিবাসী সমাজে, না বর্ণহিন্দু সমাজে। রামায়ণে আবিষ্ট মনুষ্যসমাজ রাবণ নামের প্রতি ঠিক সদয় নন, হয়ত সেকারণে কাহিনির পাতাতেই এই নাম সীমাবদ্ধ। তাই একটু অবিশ্বাসের সুর ছিল গলায়। আমিও বিস্ময়ে বলে উঠি—রাবণ!’
জিজ্ঞেস করি তাঁকে তিনি কি রাবণ কে জানেন? রিক্সাচালক মানুষটি সামান্য হাসিমুখে জানান তিনি জানেন। তাঁর ভাষায় রাবণ হলেন সেইজন যিনি ‘সিতাকে লিয়ে গিয়েছিলেন। রাম কি করবে, যুদ্ধই করতে হবে তাইলে’। যেন সমস্যার সমাধান করে দিলেন এক নিমেষে। তারপরেই কিন্তু তিনি জানান, রাবণ কিন্তু মস্ত বীর ছিল। আদিবাসী সমাজে রামের চেয়ে রাবণের মাহাত্ম্য বেশি, সেটি জানা ছিল। তার কথাতেও যেন তারই প্রতিধ্বনি। ‘রাবণ কিন্তু মস্ত বীর’ একথার অর্থ কি, রামকে রাবণের সঙ্গে লড়তে গেলে বেগ পেতে হবে? আবার জানতে চাই, তার ‘রাবণ’ নামকরণের পিছনে ইতিহাস কি? তাঁর বাবা-মা কি রামায়ণের গল্প জেনে তার নাম রেখেছেন? এবারেও অবাক হলাম তাদের নামকরণের রীতিনীতি জেনে। না, রামায়ণে প্রভাবিত হয়ে মানুষটির পিতা তার নামকরণ করেননি, তিনি নামটি পেয়েছেন ঠাকুরদাদার উত্তরাধিকার সূত্রে। রিক্সাচালক আদিবাসী পুরুষ রাবণ আরো জানালেন যে, গ্রামে-গঞ্জে এখনকার থেকে আগেকার দিনে রামায়ণ গান হত অনেক বেশি। মানুষ রামায়ণের গল্পও জানত তাদের চেয়ে বেশি। তারাও ঠাকুরদাদা-ঠাকুমায়ের মুখে শুনে শুনে যতটুকু রামায়ণ জেনেছে, তাও এখন স্মরণে থাকছে না। রাবণ মস্ত রাজা, আদিবাসী সমাজে তাঁর ব্যাপক সম্মান, হয়ত তার ঠাকুরদাদার নাম তার পূর্বপুরুষ সেই রামায়ণের কাহিনি শুনে রেখেছিলেন, কিন্তু ইনি নামটি পেয়েছেন তার ঠাকুরদাদার সূত্রে।
কি রকম?
সাঁওতাল সমাজের নিয়ম অনুসারে বাড়ির প্রথম সন্তান যদি পুত্র হয়, তার নাম হয় ঠাকুরদাদার নামে, আর যদি কন্যা সন্তান হয়, তার নাম হয় ঠাকুমার নামে। মাথায় চিন্তা ভর করে, তবে কি এ সেই গোষ্ঠীকরণ...বা গোত্রকরণ? এক একটি গোষ্ঠীর নাম অনুসারে কে কোন গোষ্ঠির তা সনাক্তকরণের জন্য বহুযুগ আগে ছিল এই পদ্ধতি...যেমন মাঠে গরু চরানোর সময় আমরা দেখি গরুগুলির গায়ে নানারকমের চিহ্ন। কে কোথা থেকে, কোন বাড়ির জানার সুবিধের জন্য রাখালরা এইরকম চিহ্ন দিয়ে থাকে তাদের গায়ে। গরুর সঙ্গে তুলনা হয়ত অনেকের কাছে অন্যায় বা খারাপ মনে হবে, কিন্তু এই রীতি আমি গ্রামে দেখেছি বলেই আমার এটির কথা মনে পড়ল।
আমি বিস্ময়ে অভিভূত ...যেন সেই আদিযুগের মসীজীবি অথবা দেওয়ান বংশোদ্ভুত সন্তান রাবণ হেমব্রম আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যিনি আমাকে সযত্নে এনে হাজির করলেন এক আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামে এক পাড়ায়, যেখানে আমি গিয়েছি তাদেরই সংবাদ যোগাড় করতে। সেদিনের সভ্যতার কারিগর এক গোষ্ঠী আজ নিজেদের জীবনরক্ষার তাগিদে রিক্সা চালাতেও বাধ্য হন। রাবণ হেমব্রমকে আমি ভুলিনি।
0 comments: