0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




আমাদের ক্ষমা কর বিলকিস - আমরা হেরে গেছি।


স্বাধীনতা দিবসের ঘটনাটি---

বিগত ১৫ই অগাস্টে আমাদের দেশ ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ছিল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লার র‍্যামপার্ট থেকে দেশবাসীকে আহ্বান জানালেন নারীশক্তির সম্মান রক্ষার্থে আমরা যেন দৈনন্দিন আচারব্যবহারে মেয়েদের অপমান অনাদর করার অভ্যাস ত্যাগ করি, ঠিক তখনই তাঁর গৃহরাজ্য থেকে আসা একটি খবর এবং কিছু ভিডিও ফুটেজ আমাদের হতবাক এবং বিষণ্ণ করল।

একটি গণধর্ষণ, সেই পরিবারের চোদ্দ জনের নির্মম হত্যা এবং ৩ বছরের মেয়েকে পাথরে আছড়ে মারার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা প্রাপ্ত ১১ জন অপরাধীকে গুজরাত সরকারের নির্বাচিত জেল পরামর্শদাতা প্যানেল, তাদের ১৪ বছর অব্দি কারাবাস পূর্ণ হওয়ায়, নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে।

আমরা আরও হতবাক, যখন তারা গোধরা উপ-জেল থেকে বেরিয়ে এল তখন তাদের ফুল-মালা-চন্দনে বন্দনা করে যেন বীরের সমবর্দ্ধনা দেওয়া হল। এই কাজটি যারা করলেন তাদের মধ্যে আছেন তাদের আত্মীয় পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দফতরে ফুল মালা পরিয়ে যেভাবে ওদের সম্মানিত করা হয়, তার ভিডিও সবাই দেখেছেন।[1]

অপরাধী শৈলেশ ভট্ট বলেন গ্রেফতারের সময় উনি বর্তমান শাসক দল বিজেপিরর জিলা ইউনিটের পদাধিকারী ছিলেন। রাধেশ্যাম শাহ বলেন –আমরা নির্দোষ, মতাদর্শএর কারণে ফাঁসানো হয়েছে।

গুজরাতের বিজেপি বিধায়ক এবং দশজনের প্যানেলের সদস্য সি কে রাউলিজী বলেন—কয়েকজন অভিযুক্ত তো জাতিতে ব্রাহ্মণ, তাঁদের উত্তম সংস্কার রয়েছে। [2] এদের পক্ষে এমন জঘন্য অপরাধ করা কঠিন। ওঁর মতে, ওঁরা হয়ত তাদের পুরনো রাজনৈতিক কাজকর্মের জন্য শাস্তি পেয়েছেন।

তাহলে কি আমাদের বুঝতে হবে যে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় আদৌ বিলকিস গণধর্ষণের স্বীকার হন নি? তাঁর তিন বছরের মেয়ে সালেহাকে কেউ আছড়ে মেরে ফেলে নি? তাঁর সামনে উন্মত্ত ভীড় তাঁর পরিবারের চোদ্দজনকে নির্মম ভাবে হত্যা করেনি? সিবি আই , হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট সবাই এত বড় ভুল করে নির্দোষদের শাস্তি দিয়েছে!

আমাদের বিবেক পাগল মেহের আলি হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর বলবে – তফাৎ যাও! সব ঝুঠ হ্যায়!

কিন্তু গুজরাত সরকারের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব (গৃহ) মিঃ রাজ কুমার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে সবকিছু নিয়ম মেনে এবং আইন মেনে হয়েছে। সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। সেই মত প্যানেল গঠন করে তার অনুশংসা অনুযায়ী রাজ্য সরকার বন্দীদের ছেড়ে দিয়েছে।

আমরা একবার দেখে নেব ঘটনা-পরম্পরা এবং সুপ্রীম কোর্ট ঠিক কী বলেছে। তারপর দেখব, রেমিশন বা শাস্তি মকুব করার অধিকার কার আছে এবং কী তার গাইডলাইন।

বিলকিস বানুর ভয়ংকর সত্য

গুজরাতের দাহোদ জেলার একটি গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন ২১ বছরের বিলকিস বানু ।বাবা বাড়ি বাড়ি দুধের যোগান দেন।

সন ২০০২এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি। সাবরমতী এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরায় গোধরা স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বীভৎস সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা গুজরাত রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

দাঙ্গার আঁচের উত্তাপ টের পেয়ে বিলকিস এবং তাঁর পরিবারের লোকজন পরের দিনই বসতবাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে থাকেন। কিন্তু মার্চ মাসের ৩ তারিখে দুটো গাড়ি ভরে ধাওয়া করে আসা ২৫/৩০ জনের উন্মত্ত ভীড় তাদের কেশরপুর গাঁয়ের কাছে ধরে ফেলে। গর্ভবতী বিলকিস গণধর্ষণের শিকার হলেন। তাঁর চোখের সামনে তিন বছরের মেয়ে সালেহাকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলা হল। তাঁর চোখের সামনে নিহত হলেন পরিবারের সবাই, চোদ্দ জন। শুধু বিলকিস কোন মতে প্রাণে বাঁচলেন, কিছু সাধারন মানুষের সাহায্যে।

পরের ঘটনাগুলো

· দু’দিন পরে রিলিফ ক্যাম্পের আশ্রয়ে থেকে বিলকিস পুলিশের কাছে তাঁর জবানবন্দী দিলেন।

· ৬ নভেম্বর, ২০০২। পুলিশ আদালতে কেস বন্ধ করার আর্জি দিলে আদালত খারিজ করে তদন্ত চালাতে বলল।

· ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। পুলিশ ফের কেস বন্ধ করার আর্জি দিলে ম্যাজিস্ট্রেট সেটা মেনে নিলেন।

· বিলকিস হাল ছাড়েন নি। সুপ্রীম কোর্ট ৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ তারিখে সিবিআইকে তদন্ত করতে বলল।

· অগাস্ট ২০০৪। সুপ্রীম কোর্ট ‘ফেয়ার ট্রায়াল’ সুনিশ্চিত করতে গুজরাতের বদলে মুম্বাইতে বিচার শুরু করতে বলল। অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়ে বিচার চলাকালীন মুম্বাইয়ের জেলে রইল।

· ২১ জানুয়ারি, ২০০৮। মুম্বাইয়ে সি বি আইয়ের স্পেশাল কোর্ট গণধর্ষণ, হত্যা, দাঙ্গা আরও অনেক অভিযোগের বিভিন্ন ধারায় ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করল এবং তাদের মধ্যে ১১ জনকে আজীবন কারাবাসের শাস্তি ঘোষণা করল।

· মে, ২০১৭। মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্তদের আপীল খারিজ করে শাস্তির আদেশ বহাল রেখে দিল। উলটে অন্য ৭ জনকে যথেষ্ট প্রমাণাভাবে ছেড়ে দেওয়ার আদেশও খারিজ করল।

· জুলাই ২০১৭। সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল খারিজ করল এবং ৩ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে গুজরাত সরকারকে নির্দেশ দিল বিলকিস বানুকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে এবং চাকরি ও একটি বাড়ি বানিয়ে দিতে।

· বিলকিসের অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ টাকা এসেছে, বাড়ি ও চাকরি নয়।

বিলকিস ভাবলেন ন্যায়বিচারের জন্যে তাঁর লড়াই এবার শেষ। পরের মেয়েদের পড়াশুনো ইত্যাদি করিয়ে উকিল বানানোর স্বপ্ন দেখছিলেন। নিজের গ্রাম থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন।

কিন্তু এ’বছর স্বাধীনতা দিবসে হঠাৎ অভিযুক্তরা ছাড়া পাওয়ার খবর পেয়ে উনি দিশেহারা। বলছেন আমি যে বিশ্বাস করেছিলাম। দেশের আইন ব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি ভরসা করেছিলাম।[3]

গুজরাত সরকারের কাছে তাঁর একটিই আর্জিঃ আমাকে নির্ভয়ে শান্তিতে এবং সসম্মানে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দাও।



এবার আমরা একটু অভিযুক্তদের পরিচয় দেখব।

ওরা সবাই প্রতিবেশি।

· রাধেশ্যাম শাহ, উকিল এবং চুড়ির দোকান, বাড়ি বিলকিসের মাত্র ৫০ মিটার দূরত্বে ।

· নরেশ কেশরভাইঃ সাক্ষীরা দেখেছেন দাঙ্গার সময় পেট্রলের ক্যান হাতে।

· প্রদীপ মোডিয়াঃ মসজিদের পাশের দোকানটি তার।

· যশবন্ত নাই, গোবিন্দ নাই, নরেশ মোডিয়াঃ দুই ভাই এবং তাঁদের কাকা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জোর করে মহিলার কাপড় ছিঁড়ে ধর্ষণ করার।

· শৈলেশ ভাটঃ বিলকিসের ৩ বছরের মেয়ে সালেহাকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলার অভিযোগ। ইনি বিজেপি কার্যকর্তা। প্যারোলে জেল থেকে বেরিয়ে দাহোদে বিজেপির সভায় মঞ্চে থাকার লিখিত অভিযোগ রয়েছে।

· বিপিন জোশীঃ গ্রামের ডাক্তার, বিলকিসের বাবার চিকিৎসা করেছেন।

· রাজুভাইঃ ঘটনার এক দশক আগে থেকেই গ্রামের দোকানদার।

· বক্কাভাই বোহানিয়াঃ হাতে কুড়ুল ছিল।

· রমেশ চন্দানাঃ সরপঞ্চের স্বামী। যে দুটো গাড়িতে চড়ে গুণ্ডারা বিলকিসদের ধাওয়া করেছিল তার একটির রেজিস্ট্রেশন স্ত্রীর নামে।

সবাই প্রতিবেশী, অনেকে একই পরিবারের। তাহলে কি বুঝতে হবে ঘৃণার শক্তি অপরিসীম?

রেমিশন বা শাস্তির বকায়া সময় মকুব বা কম করাঃ

বলা হয় যে আদালতের কোন রায় বদলে দেবার অধিকার সরকারের বা প্রশাসনের নেই, কিন্তু রেমিশন বা শাস্তির অবধি মকুব বা কম করার অধিকার আছে। তাই ফাঁসির আসামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি দেয়। সংবিধানে রাজ্যপালকেও সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে।

এর মানে এই নয় যে অপরাধীকে নির্দোষ বলা হল। এতে শুধু শাস্তির পরিমাণ কিছু শর্তের বিবেচনায় কম করা হয়।

আর জেলের ভেতরে লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকলে জেল কর্তৃপক্ষ, বকলমে রাজ্য সরকার, হিসেব করে জেলের মেয়াদ কমাতে পারে। ১৫ই আগস্ট , ২৬ জানুয়ারি বা গান্ধীজির জন্মদিনে সেসব হিসেব করে বিভিন্ন সময়ে অনেককে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সেটাও মর্জিমাফিক নয়। তারও লিখিত যুক্তি দেখাতে হয়।



ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড (সি আর পি সি) ধারা ৪৩২ অনুযায়ী রাজ্যসরকারকে রেমিশনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে ধারা ৪৩৩ বলছে যে হত্যা বা যাবজ্জীবন কারাবাসের অপরাধীর ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন অন্ততঃ ১৪ বছর জেলে থাকার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে।

এর থেকে অনেকের ধারণা, যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি মানে জেল থেকে ১৪ বছর পরে ছাড়া পাওয়া। কিন্তু এটা ভুল। সুপ্রীম কোর্ট বারবার বিভিন্ন রায়ে বলেছে যে যাবজ্জীবন মানে ‘যাবজ্জীবন’, অর্থাৎ অপরাধীর মৃত্যু পর্যন্ত।

সুপ্রীম কোর্ট একটি মামলায় রেমিশনের যোগ্যতা বিচারে পাঁচটি লক্ষণ দেখার কথা বলেছে।[4]

I. অপরাধটি একান্ত ব্যক্তিগত, নাকি সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে,

II. ছাড়া পেলে আবার অপরাধ করার সম্ভাবনা,

III. অপরাধীর অপরাধ করার ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে কিনা,

IV. আর জেলে আটকে রেখে কোন লাভ হবে কিনা,

V. পরিবারের আর্থিক অবস্থা।

রেমিশনের জন্যে কারা বিবেচনার যোগ্য কারা নয়, এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত গাইডলাইন রয়েছে। সেগুলো সময় সময় বদলেও যায়।

তিনটি প্রাসঙ্গিক গাইডলাইন

গুজরাত সরকার ১৯৯২ সালে একটি গাইডলাইন বানায় তাতে অপরাধের গুরুত্ব, বয়স, জেলে আচার আচরণ ইত্যাদি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন অগ্রাহ্য করা উচিত এ নিয়ে কোন কথা বলা নেই।

সুপ্রীম কোর্ট ওই গাইডলাইন ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়। কেন্দ্র সরকার সেই নির্দেশ সব রাজ্য সরকারকে দিয়ে তাদের নতুন করে সামঞ্জস্যপূর্ণ পলিসি বানাতে বলে।

গুজরাত সরকার সে’ অনুযায়ী ২০১৪ সালে নতুন গাইড লাইন বানায়। তাতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে তিনটি ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন বিবেচনা করা হবে নাঃ

এক, যে অপরাধের তদন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা (সি বি আই) করেছে,

দুই, ধর্ষণ করে হত্যা, এবং তিন, গণধর্ষণ করে হত্যা।

এ বছর স্বাধীনতার ৭৬ বছর উদযাপন উপলক্ষে ভারত সরকারও তিন বিন্দু নির্দেশিকা জারি করেছেঃ

· অপরাধী তার নির্ধারিত শাস্তির অন্ততঃ অর্ধেক সময় জেলে কাটিয়েছে।

· অপরাধী এমন রোগে আক্রান্ত, যাতে তার শেষের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

· অপরাধী পুরুষ হলে ৬০ বছরের বেশি আর নারী হলে ৫০ বছর।

এছাড়া সুপ্রীম কোর্ট আগেও স্পষ্ট করেছে যে ‘ডিউ প্রসেস অফ ল’ মেনে নির্ণয় নিতে হবে। অর্থাৎ একটি অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করে তার রায় নিতে হবে এবং যে আদালত শাস্তি দিয়েছিল সেই আদালতের মতামত শুনতে হবে। আর যদি রেমিশনের সিদ্ধানটি যুক্তিযুক্ত না মনেহয় তবে তার জুডিসিয়াল রিভিউ হতেই পারে।



তাহলে তো প্রথমে মনে হবে অপরাধীরা প্রচলিত নিয়ম এবং পলিসি অনুযায়ী কখনই ছাড়া পেতে পারে না।

কিন্তু হল কী করে?

, মুম্বাইয়ের স্পেশাল সিবি আই আদালত অভিযুক্তদের ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০২, ৩৭৬(২)(ই)(জি) এবং সহপঠিত ধারা ১৪৯ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে ১ জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে রায় দেয়।

মে এবং জুলাই ২০১৭ সালে অভিযুক্তদের আপীল, যথাক্রমে মুম্বাই হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট খারিজ করে শাস্তি বহাল রাখে।

রাধেশ্যাম শাহ ১৪ বছরের উপর জেলে রয়েছে যুক্তিতে ধারা ৪৩২ এবং ৪৩৩ অনুযায়ী রেমিশনের আবেদন পেশ করে। গুজরাত হাইকোর্ট আবেদন খারিজ করে বলে ৪৩২(৭) অনুযায়ী appropriate government’ হল মহারাষ্ট্র রাজ্য, সেখানে যাও। কিন্তু মুম্বাই হাইকোর্ট আবেদন শুনতে রাজি না হয়ে বলে—মহারাষ্ট্র নয়, গুজরাত সরকার। অপরাধ ওখানেই হয়েছে।

তখন রাধেশ্যাম শাহ সুপ্রীম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ে।

আশ্চর্য্যের বিষয়, সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস অজয় রাস্তোগী এবং জাস্টিস বিক্রম নাথের ডিভিশন বেঞ্চ গুজরাত হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বলে যে গুজরাত সরকারই হল appropriate government, কারণ অপরাধ তো ওই রাজ্যেই হয়েছে। এবং রেমিশনের বিচার গুজরাত রাজ্য সরকার ওদের ওখানে প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী দু’মাসের মধ্যে সম্পন্ন করুক।

গুজরাত সরকার ওদের ৯ জুলাই ১৯৯২ সালের রেমিশন পলিসির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিল, কারণ ২০০২ সালে অপরাধ ঘটিত হবার সময় এবং রায় যখন বেরোয় , জানুয়ারি ২০০৮, ওই পলিসিই বলবৎ ছিল। সেই পলিসিতে কী ধরণের অপরাধে ওই পলিসি প্রযুক্ত হবে, কিসে হবে না সে নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। [5]

কিন্তু ওই পলিসি সুপ্রীম কোর্ট ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়।

যদিও জানুয়ারি ২০১৪ সালে গুজরাত সরকার যে নতুন গাইডলাইন জারি করে তাতে এই ছাড়া পাওয়া মুশকিল ছিল। সেটা অনুযায়ী যে অপরাধের তদন্ত সি বি আই করেছে বা ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করে হত্যার দোষীরা এই পলিসিতে ছাড়া পাবে না।[6]

তাহলে ইস্যু হল দুটোঃ

এক, রেমিশন নিয়ে বিচার করার ‘appropriate government’কে? গুজরাত না মহারাষ্ট্র?

দুই, রেমিশনের সিদ্ধান্ত কোন গাইডলাইন মেনে হবে? বাতিল করা গুজরাত ১৯৯২এর পলিসি? নাকি ২০১৪ সালের সুপ্রীম কোর্টের গাইডলাইন মেনে তৈরি পলিসি।

উপরের দুটো বিন্দুতে যদি কোন একটায় পরের বিকল্পটি মেনে নেওয়া হয়, যেমন গুজরাতের বদলে মহারাষ্ট্রের পলিসি অথবা গুজরাতের ১৯৯২এর বদলে ২০১৪ সালের পলিসি, তাহলেই অপরাধীরা ছাড়া পায় না।

এই অপরাধীদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি আইন মেনে হয়েছে?

এটা বুঝতে আমাদের আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

এক, ধারা ৪৩২ (৭) অনুযায়ী ‘appropriate government’ কে? গুজরাত সরকার নাকি মহারাষ্ট্র?

দুই, মকুবের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত নেওয়া কি জরুরি ছিল?

তিন, শাস্তি ঘোষণার আদালতের মতামত নেওয়া কি জরুরি?

চার, সুপ্রীম কোর্টের আগের রায়গুলোর সঙ্গে এই রেমিসনের সিদ্ধান্ত কি সংগতিপূর্ণ?

এক এক করে দেখা যাক।

· ‘appropriate government’ কে? Cr Pc section 432(7) স্পষ্ট ভাষায় বলছে যে রাজ্যের অধীনে আদালত বিচার করে রায় দিয়েছে সেই রাজ্যের সরকার হল ‘appropriate government’। তবে তো গুজরাত নয়, মহারাষ্ট্র সরকার হল ‘উপযুক্ত’।

এই যুক্তিতেই গুজরাত হাইকোর্ট অপরাধী রাধেশ্যাম শাহের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। কিন্তু মে ২০২২ সালে অপরাধী রাধেশ্যাম শাহ বনাম গুজরাত রাজ্য আপীলে সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ বলল—না, গুজরাতে অপরাধ হয়েছিল। বিচার সেখানেই হত, বিশেষ পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। অতএব, গুজরাত।

সিনিয়র অ্যাডভোকেট রেবেকা জন এবং আরো অনেকে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। সেই বিশেষ পরিস্থিতিই তো আসল বিবেচনার যোগ্য। কারণ , তখন সুপ্রীম কোর্ট নিশ্চিত ছিলেন যে গুজরাত সরকার এই কেসে নিরপেক্ষ নয়। সরকারের যে এস আই টি এই কেসের প্রাথমিক তদন্ত করেছিল মুম্বাই সিবি আই কোর্ট তার করা সমালোচনা করেছে।

উল্লেখযোগ্য, মামলায় জাস্টিস ইউ ইউ ললিত, যিনি ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হবেন, একটি মামলায় বলেছিলেন, “ এই ধারা অনুসারে (৪৩২/৭) যদি ‘ক’ রাজ্যে অপরাধটি ঘটিত হয়ে থাকে, কিন্তু ‘খ’ রাজ্যে বিচার হয়ে রায় দেওয়া হয়, তাহলে ‘উপযুক্ত সরকার’ হবে পরের রাজ্যেরটি” (বাংলা অনুবাদ লেখকের)। [7]

এছাড়া মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বনাম রতন সিং (১৯৭৬) এবং হনুমান্ত দাস বনাম বিজয়কুমার (১৯৮২) মামলাতেও সুপ্রীম কোর্টের স্পষ্ট অবস্থান ছিল যে Cr Pc section 432(7) অনুসারে ‘appropriate government’ মানে যেখানে দোষীকে শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছে সেই রাজ্যের সরকার।

· কেন্দ্রের সম্মতির প্রশ্নটি

Cr Pc section 435 অনুসারে যে কেসের তদন্ত কোন কেন্দ্রীয় আইনের অধীনে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা করেছে (যেমন বিলকিস প্রকরণে CBI), সেখানে রাজ্য সরকার শাস্তির সময় কম করার কোন একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি নিতে হবে।

আলোচ্য কেসের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন দিয়েছে এমন কোন খবর আমাদের জানা নেই। আরও খেয়াল করার ব্যাপার, কেন্দ্রীয় সরকার ১৫ অগাস্ট, ২০২২, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ এবং ১৫ অগাস্ট ২০২৩ এ বন্দীদের স্পেশাল সাজা মকুবের জন্য বিশেষ গাইডলাইন জারি করেছে।

তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি ভোগ করা এবং ধর্ষণের অপরাধী এই সুবিধের যোগ্য নয়।[8]

· শাস্তির রায় দেওয়া বিচারকের অভিমতঃ কতটুকু গুরুত্ব?

Cr Pc section 432(2) যে রেমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের উচিত যে আদালত শাস্তি দিয়েছে তার মুখ্য বিচারকের অভিমত নেওয়া—রেমিশনের আবেদন গ্রাহ্য করা অথবা খারিজ করা। অবশ্যই বিচারক এ’ব্যাপারে তাঁর যুক্তি স্পষ্ট করে বলবেন।

সুপ্রীম কোর্ট তার সংগীত বনাম হরিয়ানা রাজ্য মামলায় বলেছে এই ধারাটি ‘appropriate government দ্বারা রেমিশন নিয়মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের মত।

আবার, ভারত সরকার বনাম হরিহরন মামলায় সুপ্রীম কোর্টএর এক সাংবিধানিক বেঞ্চ এটাও বলেছে যে 432(2) অনুযায়ী রায়দানকারী বিচারকের অভিমত নেওয়া’ম্যান্ডেটরি’। এটি রাজ্য সরকারকে সঠিক নির্ণয়ে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। কারণ, সেই অভিমত অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধীর পৃষ্ঠভূমি এবং অন্যান্য প্রাসংগিক বিন্দুর উপর আলোকপাত করবে।

এপ্রিল ২০২২ সালে একটি সাম্প্রতিক রায়ে জাস্টিস চন্দ্রচুড় এবং জাস্টিস অনিরুদ্ধ বোস বলেন--এটা না করলে রাজ্য সরকারের রেমিশন নিয়ে ডিউ ডিলিজেন্স মাত্র নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। [9]

বর্তমান কেসটিতে যেটুকু জানা গেছে যে মুম্বাই সিবি আই কোর্টের বিচারক( যিনি অভিযুক্তদের বিচার করেছিলেন) এই রেমিশনের বিরুদ্ধে অভিমত দিয়েছিলেন। কিন্তু দশজনের রিভিউ প্যানেলের সমস্ত সদস্য , যাতে ২ জন বিজেপি বিধায়ক এবং অন্য ৩ জন বিজেপি সদস্য রয়েছেন, একবাক্যে সেই অভিমত গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি।[10]

· সুপ্রীম কোর্টের আগের রায়গুলোর সঙ্গে বর্তমান সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য



সাধারণভাবে বলা হয় যে রাজ্য সরকার তার বিবেক এবং বিচক্ষণতার জোরে যে কোন রেমিশনের আবেদন গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এতে কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে রামচন্দর বনাম ছত্তিশগড় রাজ্য মামলায় সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস চন্দ্রচুড়ের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিয়েছে যে আদালতের সেই ক্ষমতা রয়েছে যার বলে সে পরীক্ষা করে দেখতে পারে রাজ্য সরকারের রেমিশন নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত এবং আইনানুগ। তারপর সে চাইলে রাজ্য সরকারকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আদেশ দিতে পারে।

উল্লেখযোগ্য যে ৬০০০ নাগরিক, মানবাধিকার কার্যকর্তা সুপ্রীম কোর্টে [11] সংযুক্ত আবেদন পাঠিয়েছেন । সুপ্রীম কোর্টের নতুন প্রধান বিচারপতি বিলকিস বানো কেসে গুজরাত সরকারের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরীক্ষা করার রিট আবেদন বিবেচনার জন্য স্বীকার করেছেন এবং গুজরাত সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছাড়া পাওয়া ওই ১১ জন অপরাধীদের শো কজ নোটিস পাঠিয়েছেন যে কেন তাদের মুক্তির সিদ্ধান্ত খারিজ করা হবে না?

আমরা এখনও আশায় বাঁচি।

আমাদের কি আর কিছুই করার নেই?

আইনের প্রসংগ এবার থাক।

এটা স্পষ্ট যে আমরা সংস্কৃতিবান সুসভ্য নাগরিকেরা হেরে গেছি। আমাদের চারদিকে মানবমূল্যের অবনমন নিরন্তর। নইলে কিছু ধর্ষক, শিশুঘাতী ও খুনিদের প্রকাশ্যে বরমাল্য পরিয়ে কপালে টিকা দেন কিছু মহিলা?

আর শাস্তির পর গোধরা সাব-জেলে থাকাকালীন অপরাধীরা বছরে তিন থেকে ছ’মাস করে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে বাড়ি গেছে, বাড়ি বানিয়ে গৃহপ্রবেশ করেছে। বৌয়ের হাঁটুর অপারেশন করিয়েছে , সন্তানদের বিয়ে দিয়েছে। এতে গুজরাত হাইকোর্টের বিচারকও স্তম্ভিত।

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে রাজসভার প্রাজ্ঞজন মাথা হেঁট করে নিশ্চুপ ছিলেন। ফল যে কী ভীষণ হয়েছিল তার বর্ণনা আমাদের মহাকাব্যে আছে।

এখনও সময় আছে। সেই অপমানিতা লাঞ্ছিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বলতে চাই—ক্ষমা কর। আমরা হেরে গেছি।

না হয় এভাবেই শুরু হোক।

==============================






[1] আজ তক পোর্টালে গোপী নায়ারের রিপোর্ট, ১৭ অগাস্ট, ২০২২।


[2] টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২২ অগাস্ট, ২০২২।


[3] ঐ, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯।


[4] লক্ষ্মণ নস্কর বনাম ভারত সরকার (২০০০) এবং স্টেট অফ হরিয়ানা বনাম জগদীশ।


[5] দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।


[6] সি এন বি সি টিভি ১৮ ডট কম, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।


[7] ভারত সরকার বনাম ভি শ্রীহরন (২০১৫)।


[8] লাইভ ল, ২২অগাস্ট, ২০২২।


[9] রামচন্দর বনাম ছত্তিশগড় রাজ্য, ২২ এপ্রিল, ২০২২।


[10] স্ক্রল ডট ইন, ১৮ আগস্ট, ২০২২।


[11] হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯ অগাস্ট, ২০২২।







ReplyForward

0 comments: