0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যেয়, কার্তিকের হিমে ডুবে থাকা ধান খেত থেকে উড়ে যাওয়া পেঁচার পাখায় ভেসে ওঠে প্রদীপের নরম আলো। সে আলোর কোনো ঔদ্ধত্য নেই। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা নেই। সে জানে এই অনন্ত চরাচরের আদিম আঁধারকে দূর করার শক্তি সে ধরেনা। সে শুধু নিজের বুকের মধ্যে একটি শিখা জ্বালিয়ে রাখতে পারে। মাঝে মাঝে তার শিখায় একটি কৃষ্ণ রেখা দেখা যায়। সে বোঝে অজ্ঞানতা আসলে আমাদের নিম্নমুখী করে। তমস। তারপরই লাল উজ্জ্বল আলোয় সে জ্যোতির্ময় হয়। যেটুকু শক্তি আছে তাই দিয়ে নিজেকে জ্বালাতে চায়। এই কর্মপ্রবৃত্তিই রজঃ। অবশেষে একটি নীল শিখা। নীল জগতচৈতন্য। তখন তার স্পষ্ট অনুভব, জগতচৈতন্যের আধার তার ক্ষুদ্র মাটির শরীরও। সত্ত্ব। বিশুদ্ধ সত্ত্ব। তারপরই একটি শূন্যতা সেই নীলচৈতন্যের মধ্যে। নির্গুণ। গুণাতীত। মাটির প্রদীপ তখন লীন হয়ে গিয়েছে তুরীয়তে।

উপরোক্ত সব কটিই আসলে আমাদের দেহের অবস্থা। তিনটি গুণ আমাদের দেহাভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তিকে চালিত করে। কিন্তু গুণাতীত অবস্থায় আমাদের চৈতন্য আর দেহে বদ্ধ থাকেনা। মাটির ঘট যেমন অনন্ত সমুদ্রে ভেসে যায়।

ছোট পরিসরে একটি তুলনামুলক আলোচনায় দেখে নেব আদিকাল থেকে প্রচলিত ধর্মে আলোর ভূমিকা কী।

আলো পবিত্রতার প্রতীক। আলো অর্থে তমোনাশ। “করো তমোনাশ হও হে প্রকাশ”। আলো যেন অন্ধকারের প্রতিপক্ষ। সে যুদ্ধে জেতে। কিন্তু জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যা জানাচ্ছে, অন্ধকার আসলে আলোর অভাব। যে আলো আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণে অক্ষম, সেই আলো আমাদের কাছে অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান। প্রকৃতপক্ষে অন্ধকার বলে কিছু নেই।

আলো প্রাণের প্রতীক। সেই অর্থে সূর্য। আমাদের একমাত্র প্রাণশক্তির উৎস। সূর্যালোক এ পৃথিবীর প্রাণের কারণ। আত্মিক অনুভবে আলোময় একটি পথ অনেকেই দেখেছেন। সেই জ্যোতির্ময় পথটি যেন এক আনন্দময় শান্তির পথে দ্রষ্টাকে নিয়ে যায়। ধর্মে এই জ্যোতিকে ঈশ্বর বলা হয়েছে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষকে এমন অনুভবের কথা বলতে শোনা যায়। আরও আশ্চর্যের, এই আলো যেন এক দেহাতীত প্রেমের অনুভূতি দেয়। আমরা আশ্বস্ত হই। মৃত্যু তবে এক আলোকিত প্রেমময় পথ।

আমরা দেখতে পাবো, বৈদিক, ইসলাম, খৃষ্ট, ইহুদি, সব ধর্মেই এই পরমজ্যোতিকে ঈশ্বর বলা হয়। আমাদের পক্ষে এই আলোর ভালোবাসা, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরা, কল্পনা করা অসম্ভব।

আমাদের দীপাবলী আলোর উৎসব। আমরা নত হয়ে সেই নির্গুণময়ীর কাছে প্রার্থনা করি—আলো দাও। আমার এই ক্ষুদ্র শরীরের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিয়ে আমাকে তোমার মধ্যে লীন করো।

ইহুদিদের আটদিন ধরে আলোর উৎসব, হানুকাহ, খৃষ্ট ধর্মের মোম জ্বালিয়ে বড়দিন এরকমই এক আনন্দের উৎসব। প্রেমের উৎসব। এই আলো আমাদের পথপ্রদর্শকও বটে। মহাপ্রস্থানের পথ এই আলোকিত পথ।

আলো জ্ঞানের প্রতীক। গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস দিনের উজ্জ্বল আলোয় মানুষের মুখে দীপ তুলে ধরতেন। বলতেন, মানুষ খুঁজছি। তাঁর সেই সপাট কৌতূহল থেকে সম্রাট অ্যালেকজান্ডারও বাদ যাননি। অর্থাৎ অন্তরে জ্ঞানদীপ জ্বলছে এমন মানুষ তিনি খুঁজছেন। এই যে আমরা অসংখ্য প্রদীপ জ্বালাই, এ আসলে অসংখ্য মানুষের দেহ। প্রতি দেহে যেন জ্ঞানদীপ জ্বলে ওঠে, এই প্রার্থনা।

বাগদাদের মনসুর আল হাল্লাজ বলেছিলেন, আমিই সত্য। আন আল হক। এর জন্য প্রাণদণ্ড হয়েছিল তাঁর। ইসলামে হক বা সত্যস্বরূপ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। তাহলে কি মনসুর ইসলামবিরোধী? না। তিনি সেই সত্যস্বরূপ জ্যোতির্ময়কে অন্তরে দর্শন করেছিলেন। জেনেছিলেন, এই আলোকিত ‘আমি’ আসলে ক্ষুদ্র আমি নয়। এ ‘আমি’ উত্তম পুরুষ, আল্লাহ স্বয়ং। মনসুর কই? এক আল্লাহই তো আছেন তাঁকে আপ্লুত করে!

একবার দেখি প্রাচীন ধর্মে আলোকে কিভাবে দেখা হয়েছে।

ঘন অন্ধকার ভেদ করে, অতল জলের মধ্যে থেকে ভেসে উঠল ধরিত্রী। এক অলৌকিক ধ্বনি ভাষাহীন স্বরে বলে উঠল-চরাচর আলোকিত হোক। বিশ্বচরাচর আলোকিত হলো। জেনেসিসের তৃতীয় পয়ারে এই পংক্তিটি আছে। ইলোহিম, ঈশ্বর যেন ঘোষনা করলেন, আর আলো ছড়িয়ে পড়ল।

বেদান্তে আছে অনুরূপ একটি শ্লোক। হে জগতপোষক সূর্য, তোমার সুবর্ণ আবরণ অপসারণ করো, তোমার কল্যাণময় মুখ দেখাও, আমরা তোমার করুণা লাভ করি। সূর্য এখানে জগদাত্মার প্রতীক। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক প্রাণসূর্য আছে। এখানে তাঁকেই প্রার্থনা করা হয়েছে।

জেনেসিসের হিব্রু ভাষায়, প্রার্থনা নয়, একটি ঘোষনার কথা আছে। বেদান্তে আছে প্রার্থনা।

মোজেস যখন মিশর থেকে এলেন প্যালেস্টাইনে তখন সিনাই পর্বতে তিনি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন। আলো কি কথা বলতে পারে? অথচ মোজেস সেই আলোকেই ঈশ্বর বলে জেনেছিলেন। কিন্তু বাকি আত্মজনের বিশ্বাস হয় কিসে? তাই তাঁর প্রার্থনায় আত্মজনেরা রইলেন পর্বতের সানুদেশে, আর দেখলেন, সত্যিই এক জ্যোতিপুঞ্জ যেন অলৌকিক উপায়ে তাদের নির্দেশ দিচ্ছে। মোজেশের দশ নির্দেশ ওই আলো থেকেই উৎসারিত।

মহম্মদ এক গুহায় ধ্যানস্থ থাকতে থাকতে গ্যাব্রিয়েলকে দেখেছিলেন। গ্যাব্রিয়েল তাঁকে রেশমের পর্দার আড়ালে সূর্য দর্শন করান। ইসলাম তাঁকেই আল্লাহ বলে। জ্যোতিস্বরূপ।

নানা ধর্মবিশ্বাসের জন্ম এমনই সব অনুভূতি থেকে।

মিশরের বহুদেবতার দেশেও সূর্যদেবতা ‘রা’ প্রধান দেবতা।

কিন্তু কতিপয় মহাপুরুষের অনুভূতি তো আর বিশ্বজনীন হতে পারে না। তাই সমাজে সৃষ্টি হয় কিছু প্রতীক উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষ পৌঁছতে চায় সেই শাশ্বত আলোকে। সাজাতে চায় তার আপন হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে।

আমাদের দীপাবলি এমন আলোর উৎসব। আমাদের কবি তাই গেয়ে ওঠেন--

“দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।"

এই আলোকিত হৃদয় আমাদের কী দিতে পারে? দিতে পারে আশা, দিতে পারে বিশ্বজোড়া তমসার নিবৃত্তি।

"…যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো–
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥

দেবতারা আজ আছে চেয়ে– জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥"

একবার দেখে নিই উৎসবের আলোর মহিমা।

শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের জন্মদিবস পালিত হয় দীপালোকে সজ্জিত শিখ পল্লীতে।

এমনতরো উৎসব বড়দিনের মোমবাতি থেকে ইসলামের শবেবরাত হয়ে ভারতে দীপাবলির সাথে যেন এক অদৃশ্য যোগসূত্র স্থাপন করে।

ফিরে তাই আমাদের প্রাণের উৎসবে। দীপাবলি উৎসব পালিত হয় ঘন অমাবস্যার যামিনীতে। কার্তিকের হিমে যখন কুয়াশা জড়ানো অন্ধকার এক ভীতিকর মায়া সৃষ্টি করে তখন আমরা দিকে দিকে নম্র দীপের আলো জ্বালাই। সে আলো অন্ধকারকেই প্রকট করে। আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা কি এমনই চান? আলো অন্ধকারে মিশিয়ে থাকা সেই অধরা মাধুরী আমাদের ঈশ্বরী। তিনি জ্যোতির্ময় নিরাকারা নন। অদ্ভুত সেই ঈশ্বরী তমসাবৃতা সাকারা।

মাতৃকা। আমাদের দেহ। দেহের মধ্যে অনন্ত অন্ধকার আছে। নিছক একটি দীপালোক যতটুকু প্রকাশ করতে পারে, আমাদের মনের আলো ঠিক ততটুকুই অজ্ঞানতা দূর করতে পারে।

আলোর দীপ তাই আমাদের প্রার্থনাকে মূর্ত করে। আমাদের মনের অন্ধকার দূর হোক। আমরা যেন ক্ষুদ্রতার অন্ধকের স্বার্থান্ধ না হই। অন্ধকার তো অন্ধ করে। পাশের মানুষকেই আমরা প্রতিপক্ষ ভাবি। যা চিরকালীন নয় তার জন্য আমরা বিরোধ করি। এ বিরোধ সেদিন দূর হবে যেদিন আমাদের অন্তরদীপ প্রজ্জ্বলিত হবে। আমরা একের সঙ্গে অপরের কোনো পার্থক্য দেখব না। একেই তো ব্রহ্মচেতনা বলেছে বেদান্তে। একেই ইসলাম বলছে—ঈশ্বর এক, একত্বই ঈশ্বর। আমরা তো কেউ খণ্ডিত চেতনা নই। আমরা সেই অখণ্ড চেতনার শরিক।

প্রার্থনা করি, আমাদের অন্তরদীপ প্রজ্বলিত হোক। প্রেমের পথ আলোকিত হোক। আমাদের দৃষ্টির আঁধার দূর হোক। আমরা যেন অন্ধকারে উৎস হতে উৎসারিত সেই আলোকে অনুভব করতে পারি। শুভমস্তু।

[সাহিত্য আর সংবাদ দীপাবলী ২০২১]

0 comments: