0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

২১

ওরা আবার নিচ থেকে তার পা চেপে ধরল। সে আর্তনাদ করে উঠল, কারণ সে কামান, বন্দুক ইত্যাদি দেখতে পেয়েছে। গোলাগুলি চলার আওয়াজ পেয়েছে। ট্রাকের ভেতরের গুঞ্জনটাও আরও জোরদার হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে কামানের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল। যেসব গোলাগুলির শব্দ ভীষণ সামনে থেকে শোনা যাচ্ছিল, সেগুলো অনেকখানি দূর বলে মনে হল।এবার যে দিকে গোলাগুলি ছোঁড়া হচ্ছে, তারা সম্ভবত সেই দিকেই এগোচ্ছিল। আবার অনেকগুলো ট্যাঙ্ক দেখা গেল। আবার এক বিশাল বাহিনী। আবার গোলাগুলি, তবে এবার ছোটখাট লড়াই।যারা গোলা ছুঁড়ছিল, তারা একটা কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসা আগুনের হল্কায় কুয়োর উপরের কপিকল, দড়ি ইত্যাদি আলোকিত হয়ে উঠছিল। তারপর অনেকক্ষণ আর কিছু দেখা যায়নি। বেশ কিছু সময় তারা একটা বাহিনীর দেখা পেল। তারপর অনেকক্ষণ শান্তি। তারপর ফিঙ্ক আবার মেশিনগানের শব্দ পেল। যেদিক থেকে শব্দ আসছে, ট্রাক সেদিকে চলতে লাগল।

ট্রাকটা হঠাৎ এসে একটা গ্রামে থামল।ফিঙ্ক বাকি সবার সঙ্গে ট্রাক থেকে নেমে এল। গ্রামে চারদিকে হুলস্থূল কাণ্ড চলছে। সব জায়গায় গাড়ি, ট্রাক এসব পার্ক করা আছে। লোকজন চিৎকার করছে। সৈন্যরা ইচ্ছামত রাস্তা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। মেশিনগানের শব্দ বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে। ফাইনহালস অপেশাদার অফিসারের পেছন পেছন গিয়েছিল। সেই অফিসার তার সঙ্গে একটা বিশাল স্যুটকেস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার চেহারা এতটাই ছোটখাট যে কাঁধের রাইফেলের বাটটা মাটিতে ঠেকে যাচ্ছে বার বার। ফাইনহালস নিজের ব্যাগটার ফিতে শক্তভাবে কাঁধের সঙ্গে আটকে লম্বা লম্বা পা চালিয়ে ওই অফিসারকে ধরে ফেলল।

‘ওর মধ্যে কী?’ স্যুটকেসটা দেখিয়ে সে প্রশ্ন করল… ‘কোথাও রেখে দাও।’

‘ওয়াইন আছে। আমার বসের জন্য।’ ছোটখাট মানুষটি হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল।

‘যতসব ফালতু ব্যাপার। রেখে দাও এখানে।’ ফাইনহালস বলে… ‘এই স্যুটকেস নিয়ে কদ্দুর যাবে? গাড়িতে উঠলে সামনে তুলতে দেবেনা।’

ছোটখাট লোকটা মাথা নাড়ল গোঁয়ারের মত। লোকটা এত ক্লান্ত যে হাঁটতেই পারছেনা। স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে খালি লাট খাচ্ছে এদিক ওদিক। বিমর্ষ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ফাইনহালসকে ধন্যবাদ বলল লোকটা, যেহেতু সে স্যুটকেসের হাতলটা ধরেছে। ফাইনহালসের কাছে স্যুটকেসটা অসম্ভব ভারি বলে মনে হল।

তাদের ডানদিকে মেশিনগানের শব্দটা বন্ধ হয়েছে। তবে ট্যাঙ্কগুলো গ্রামে ঢুকে গোলা ছুঁড়তে শুরু করেছে। তাদের পেছনেই একটা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। আবছা আগুনের হল্কায় নোংরা গ্রামের পথটা আলোকিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত লোকজন এদিক ওদিক ছুটে পালাতে লাগল।

‘ওই বোঝা ফেলে দাও!’ বলে ওঠে ফাইনহালস… ‘তুমি উন্মাদ!’ লোকটা জবাব দেয় না। উল্টে স্যুটকেসের হাতলটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। তাদের পেছনে পর পর দুটি বাড়িতে আগুন জ্বলতে থাকে।

হঠাৎ তাদের সামনে যে লেফটেন্যান্‌ট ছিলেন তিনি থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাড়িটার সামনে দাঁড়াও!’ তারা যে বাড়িটার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, সেই বাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। ছোটখাট সেই সার্জেন্ট খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে সেই বাড়িটার দেওয়ালের সামনে গিয়ে সেই স্যুটকেসটাকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বামদিকের মেশিনগানের কোনও আওয়াজ আসছে না আর। যে লেফটেন্যান্‌ট ওই বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন লেফটেন্যান্টকে নিয়ে বাড়িটার থেকে বেরিয়ে এলেন।

ফাইনহালস এই লেফটেন্যান্টকে চিনতে পেরেছে। তাদের সেই লাইনে দাঁড় করানোর দিন থেকেই সে চেনে তাঁকে। ইনি এখন যা কিছু করছেন যাতে তার বুকে আরেকটা পদক শোভা পায়, সেইজন্য। ইতিমধ্যেই তিনি আরেকখানি পদক পেয়ে গিয়েছেন। এখন সত্যিকারের একটা পদক, লাল, সাদা এবং কালো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ভাবছিল ফাইনহালস, যে তিনি এই পদক পেয়ে গিয়েছেন। লেফটেন্যান্ট মুহূর্তের জন্য পদকের দিকে চেয়ে তার মৃদু হাসিটা খেয়াল করেছেন। তার পর আবার বলে উঠলেন… বেশ!’ তারপর নিজেও হেসে বলে উঠলেন… ‘ভাল? তাই না?’ বলে তার পেছনের লেফটেন্যান্টের দিকে তাকালেন। কিন্তু পেছনের জন কিছু জবাব দিলেন না। পেছনের মানুষটিকেও এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট, ফ্যাকাসে চেহারা। বয়স খুব কম নয়। তার মুখটা অপরিষ্কার এবং গম্ভীর। বুকে একটাও পদক নেই।

‘হের ব্রেশট!’ পিছনের লোকটিকে লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘দুজন লোককে নিয়ে নিন আপাতত। অ্যানটি ট্যাঙ্ক বন্দুকও রাখবেন। বাকিদের উনডলফের কাছে পাঠাতে হবে। চারজন, আমার মতে… বাকিদের আমি আমার কাছে রাখছি।’

‘দুই’ বলে উঠলেন ব্রেশট, ‘হ্যাঁ, দুই, আর বন্দুক আপনার সঙ্গেও রাখুন।’

‘একদম ঠিক!’ বলেন লেফটেন্যান্‌ট … ‘আপনি জানেন কোথায় কী আছে।’

'হ্যাঁ সত্যিই!’

‘আধা ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট করুন, প্লিজ!’

‘হ্যাঁ!’

প্রথম যে লেফটেন্যান্ট ছিলেন তিনি ফাইনহালস এবং ফিঙ্ককে বুকে টোকা দিলেন। দ্বিতীয় পেছনের জন বললেন, ‘আসুন’। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে একবারে হাঁটতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে তাল রাখবার জন্য তাদের তাড়াহুড়ো করতে হয়েছিল। ছোটখাট ওই সার্জেন্ট তার স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, ফাইনহালস তাকে সাহায্য করল এবং তারা যত দ্রুত সম্ভব লেফটেন্যান্টকে অনুসরণ করে বাড়ির পিছনে গেল। বাড়িটার ডানদিকে একটা সরু গলি বেড়া আর ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে সোজা একটা খোলা মাঠে চলে গিয়েছে। তারা যখন সেখানে যাচ্ছিল, জায়গাটা কিছুটা শান্ত ছিল; কিন্তু তাদের পিছনে সেই ট্যাঙ্কটা এখনও গ্রামে সমানে গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছে। শেষবার তারা যে ছোট ট্যাঙ্কটা দেখেছিল, সেটা এখন ডানদিকে গোলা ছুঁড়ছে এবং তারাও মোটামুটি সেই দিকেই এখন যাচ্ছে।

ফাইনহালস হঠাৎ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। চেঁচিয়ে বাকি দুজনকে বলল, ‘হুঁশিয়ার!’

স্যুটকেসটা ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে বেশ বড় একটা শব্দ হল। তাদের সামনের লেফটেন্যান্টও মাটিতে শুয়ে পড়ল। সামনের দিকে যে জায়গাটা থেকে মার্চ করে এসেছে তারা, সেখানে বেশ কিছু গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে গ্রামে। তারা এখন মুহুর্মুহু ছুঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শেষ নেই। গ্রেনেডের ফুল্কি হাওয়ায় উড়ছে। বাড়িগুলোর দেওয়ালে এসে লাগছে। বড় টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের অবস্থান থেকে খুব দূরে নয় এই আক্রমণের স্থান।

‘উঠে পড়ুন!’ বলে উঠলেন সামনের লেফটেন্যান্ট… ‘এগিয়ে চলুন!’

‘এক মিনিট!’ বলে ওঠে ফাইনহালস। সে হাল্কা মৃদু কাচ ভাঙার শব্দ পেয়েছে এবং শব্দটা শুনে তার ভয় বেড়ে গেছে। গ্রেনেডের ফুল্কিটা ফিঙ্কের স্যুটকেসে পড়ামাত্র বিকট একটা বিস্ফোরণের শব্দ পেল। স্যুটকেসের ঢাকনাটা খুলে বেরিয়ে গেল উড়ে। অজস্র কাচের টুকরো বাতাসে উন্মাদ পাখির ডানার ফোয়ারার মত ছিটকে পড়ল। ফাইনহালসের মনে হল ওয়াইনের ফোঁটা এসে লাগলো তার গায়েও। সে ভয়ে নিচু হল। এটা কোনও বন্দুকের গুলি থেকে নয়। গ্রেনেডের ফুল্কি স্যুটকেসে পড়েই এই কাণ্ড। সামনের মাঠের আলের উপরে বিকট আওয়াজ। একটা খড়ের গাদা দুই ভাগ হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। সেটার মধ্য থেকে গলগল করে আগ্নেয় পাহাড়ের মত আগুনের শিখা উঠতে শুরু করল।

লেফটেন্যান্ট ঢালু জায়গাটা দিয়ে নেমে এলেন, ‘যাচ্ছেতাই!’ ফিসফিস করে ফাইনহালসকে বললেন, ‘এসব ক্কী হচ্ছে?’

‘ওর স্যুটকেসে ওয়াইন ছিল’ ফাইনহালস ফিসফিস করে বলল।

‘ওহে, শুনছো!’ লেফটেন্যান্ট ফিঙ্ককে মৃদুভাবে ডাকলেন; স্যুটকেসের পাশে একটি কালচে দলা হয়ে সে পড়ে আছে। একেবারে নড়ছে না। ‘উফফ… কোনও মানে হয়’ লেফটেন্যান্ট মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি আর উঠবে…’

ফাইনহালস দু পা হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল ফিঙ্কের কাছে। নিজের মাথাটা ঠেকল লোকটার পায়ে। তারপর কনুইতে ভর দিয়ে এগিয়ে গেল তার পাশে… এই ঢালু জায়গাটা একদম অন্ধকার। পাশের খড়ের গাদা থেকে আগুনের আলো এই অবধি পৌঁছাচ্ছে না। অথচ পাশের খোলা মাঠ আলোতে সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত হয়ে আগুনের হল্কায় স্নান করছে।

‘ওহে, শুনছ!’ ফাইনহালস শান্তভাবে বলল। সে ওয়াইনের শক্তিশালী, মিষ্টি বাষ্পের গন্ধ পেয়েছিল। নিজের হাত পিছনে টেনে নিয়েছিল সে, কারণ চতুর্দিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছিল সে জুতো ঘষে ঘষে। ফিঙ্কের কাছে গিয়ে তার ছোটখাট চেহারা দেখে সে অবাক হল। এই অফিসারের পা ভীষণ ছোট, খুব রোগা শরীর।

‘ওহে, শুনছ!’ সে মৃদুভাবে আবার ডাকল, ‘শুনছ বন্ধু?’ কিন্তু ফিঙ্ক উত্তর দিল না।



(চলবে)

0 comments: