2

কবিতা - কৌশিক মিত্র

Posted in





ডিসেম্বর,১৯৬২।২৩ নং ফিৎজরয় রোড(লন্ডন), একটি ফ্ল্যাট। দুটি শিশু আর তাদের মা। বিবাহবিচ্ছিন্না, নিঃসঙ্গ, নির্জন সিলভিয়া প্ল্যাথ লড়ছেন, নিজের সঙ্গে! খাতার পাতায় আঁকিবুকি, আর যে সময় নেই...১১ই ফেব্রুয়ারি,৬৩। প্ল্যাথ হেরে গেলেন। এ পরাজয়ের প্রস্তুতি তার জীবনভোর, তিনি বেঁচে থাকলেন তাঁর কবিতায়, তাঁর যন্ত্রণা মূর্ত হল অক্ষরে, হাতে এসেছে “দ্যা কালেকটেড পোয়েমস অব সিলভিয়া প্ল্যাথ ”। এ বইয়ের সম্পাদনা করছেন টেড হিউজেস(হাঘস), প্ল্যাথের প্রাক্তন স্বামী, যিনি নিজেও কবি। বইয়ের প্রকাশকাল ১৯৮১।

সেই ডিসেম্বরে লেখা কবিতা ড্যাডি, সে লেখা আলোয় আসবে ১৯৬৫ তে 'অ্যারিয়েল' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে। পিতা অটো প্ল্যাথ, ছায়া যুদ্ধ, মৃত্যুর নীল বিষ, ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।

দীর্ঘ কবিতা "ড্যাডি", ১৬ টি স্তবকে নির্মিত এ কবিতার ছায়াশরীর। আসলে এ কবিতার উদাত্ত আহ্বান উপেক্ষা করা কঠিন। অনুবাদ করে ফেলা গেল, নাহ আক্ষরিক অনুবাদ নয়, মূলাশ্রয়ী ভাবানুবাদ! রাখা হল নীচে।।


ড্যাডি


করেননি আপনি, না করেননি
আপনি কিছুই,
তিরিশটা বছর কাটিয়ে ফেলেছি আমি।
যেন একটি কৃষ্ণ পাদুকার মধ্যে পা খানা, দারিদ্র্যে ধূসর
শুধুমাত্র শ্বাস্টুকু নেওয়ার স্পর্ধা অথবা একটা হাঁচি।

পিতা, হত্যা করতে পারতাম আপনাকে।
যথেষ্ট সময় পাওয়ার আগেই আপনি অনন্তের যাত্রী-
এক থলি ঈশ্বর, গুরু-ভার,
বীভৎস সে মূর্তি, ধূসর অঙ্গুলি
ফ্রিস্কো সীলের মত বৃহৎ।

অদ্ভূত অতলান্তিকে জেগে থাকা মাথা এক,
নীল রঙে উজাড় সবুজ
নসেট [১] এর অপূর্ব জলরাশির মধ্যে
আপনাকে উদ্ধারের চেষ্টায় আমি প্রার্থনারত আমি।
আহ! আপনি।


=২=

জর্মন জিহ্বায়, পোলিশ নগরীতে
রোলারের পেষণে বিদ্ধস্ত সমতল,
যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধেরা।
কিন্তু শহরের নামখানা বড় পরিচিত।
হে পোলিশ বন্ধু আমার।

বলা যায়, এক ডজন কিম্বা দুই।
কখনই বলতে পারিনি আমি,
এলেন আপনি কোথা হতে,
আপনার উৎস, আপনার অবস্থান
নাহ! শুধাতে পারিনি আপনাকে আমি।
আমার জিহ্বা চোয়ালে অবরুদ্ধ হয়েছে।

আটকে পড়া কাঁটাতারের বাঁধনে।
ইক,ইক,ইক,ইক।
সম্ভব নয় কথা কওয়া
আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক জার্মানের প্রতিনিধিত্ব করেন আপনিই।
এবং ভাষ্য অশালীন এক।

একটি ইঞ্জিন, ইঞ্জিন এক
কোনও ইহুদির মতই মুখ থেকে উদগত ক্রোধসিক্ত অসন্তোষ
ইহুদি এক, পথ গিয়েছে বেঁকে ডাচাউ, আউজভিৎজ, বেলসেনের[২] দিকে
আমার কথা বলা সেই ইহুদির মতই
ভাবছি আমি, বিধিমত ইহুদি হয়ে ওঠাই আমার ললাটলিখন।

টাইরলের তুষার, ভিয়েনার শ্বেত ভল্লুক
নয় কোনভাবেই বিশুদ্ধ, নয় নিখাদ।
সঙ্গে আমার বাদিয়া পুর্বজের উত্তরাধিকার এবং মন্দভাগ্য
জন্মছক, জন্মছক আমার
ইহুদি খানিক ত হয়ে ওঠাই সম্ভব।

আপনাকে ঘিরেই ত শঙ্কাকুল যাপন আমার,
আপনার বিমানপোত,অকথ্য গালিগালাজ।
সুসজ্জিত গুম্ফের সারি
আর্য-চক্ষু, উজ্জ্বল নীল।
হে গোলন্দাজ-মানব, গোলন্দাজ-মানব, উফ! আপনিই------

নয় কোন ঈশ্বর,তবুও স্বস্তিক
কৃষ্ণবর্ণ ঘোর,আকাশ যায় না দেখা।
প্রত্যেক নারীই ভালোবেসে ফেলে কোন ফ্যাসিস্টকে,
পদাঘাত আপনার মুখে,বর্বর
বর্বর আপনার হৃদয়, ঠিক আপনারই সদৃশ।


=৩=

হে পিতা, ঐ যে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি,
আলোকচিত্রে দেখি আপনাকে,
আপনার চিবুকে খুর একখানা
যা থাকা উচিৎ ছিল পায়ে
শয়তানের চেয়ে কোন অংশে নয় কম,
আলকাতরার মত হৃদয় যে মানুষের তার চেয়েও নয় কম,
যে আমার তুচ্ছ ক্ষুদ্র রক্তাক্ত হৃদয়কে
বিভাজিত করেছিল দুই ভাগে।

আপনাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল,আমি তখন দশ
মৃত্যুর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা আমার,তখন আমি কুড়ি
ফিরতে চেয়েছি আমি, ফেরা, আপনার কাছেই।
ভেবেছি তবুও আমি, হয়ত অস্থিই ফেরাবে আমাকে।

ওরা আমাকে সেই থলির মধ্যে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এল,
বাঁধলে আমায় অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
আমার কর্তব্য স্থির।
আপনার প্রতিমূর্তি নির্মাণ করি।
মাইনক্যাম্ফ সদৃশ দৃষ্টি, ঘোর কৃষ্ণ অবয়ব।

মধ্যযুগীয় অত্যাচারের প্রতি প্রণয়।
এবং ঘোষণা আমার, পেরেছি আমি, আমি পেরেছি।
সুতরাং হে পিতঃ, আমার কাজ সম্পূর্ণ।
কালো দূরভাষ বিচ্ছিন্ন উৎস হতে,
কোন কণ্ঠস্বর আর ওকে উষ্ণ করে তুলবে না।

যদি হত্যা করে থাকি কাউকে, তাহলে সে সংখ্যা দুই
সেই শোণিতভুক, বলে গিয়েছিল আমায়,সে আপনিই
এবং একবছর ধরে আমার রুধিরে সিক্ত আপনার অধর,
সাতটি বছর, যদি জানতে চান আপনি।
পিতা, এখন সময় শয়ানে যাবার।

আপনার কৃষ্ণ হৃদয়ে প্রোথিত শক্ত খুঁটিখানা
এবং গ্রামবাসীরা, পছন্দ করেনি আপনাকে কোনোদিন
নৃত্যরত তারা এঁকে চলেছে ছাপ অবয়বে, আপনার।
তারা ত জানত, এ আপনিই।
পিতা, পিতা, বেজন্মা আপনি
তর্পণ সমাপ্ত আমার।



***

পাদটীকা- =৪=

[১] নসেট- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ম্যাসাচুয়েটসের সমুদ্রতীর।

[২] ডাচাউ, আউজভিৎজ, বেলসেনের- ডাচাউ, বেলসেন এ দুটি জার্মানির এবং আউজভিৎজ পোল্যান্ডের কুখ্যাত কনসেনট্রশন ক্যাম্প।

2 comments:

  1. চমৎকার!!

    ReplyDelete
  2. চমৎকার হয়েছে। খুব সাবলীল অনুবাদ। মূল কবিতাগুলি খুঁজে নিয়ে পড়ে তারপর মন্তব্য করলাম।

    ReplyDelete