0

গল্প - সুদীপ ঘোষাল

Posted in


মাধব শীতকালের সকালে উঠে পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে দোকানে আসছে। সে আজকে পাশের ছেলেটাকে বলছে, পোষলা করতাম পৌষ মাসে। নবগ্রাম ছাড়িয়ে বাঁদিকে অজয় নদী বাঁক নিয়েছে ইংরাজী অক্ষর এসের মতো। সেখানে বন্ধু,বান্ধবীরা একসাথে পোষলা করতে যেতাম শীতকালে পৌষ মাসে। নদীতে চান করতাম। বাড়িতে শুধু নিষেধের বেড়া। বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যেমন পাগলের মতো ছুটে ছুটে বেড়ায় স্বাধীনতার আনন্দে। ঠিক তেমনি আমরাও কি করবো ভেবে পেতাম না। শুধু খেলা, ছোটা আর উল্টোপাল্টা চিৎকার, চেঁচামেচিতে নদী উচ্ছল হতো। চিৎকারের প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসতো বারে বারে। এত খোলা জায়গা, এত আকাশ, নদী,  জল আমরা সহজে তো পাই না। তাই মুহূর্তের আনন্দ আজও হৃদয়ে রং ধরায়, চোখ ভেজায় নব আনন্দে। স্মৃতি রোমন্থনেও অনেক সুখ।
ছেলেটি বললো, ঠিক বলেছো মাধবদা। আমার একটু কাজ আছে, বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। 
মাধব দেখে দোকানের সামনে মানুষের মল। খুব রাগ হলো তার। দোকানের সামনে দুর্গন্ধের চোটে দাড়ানো যাচ্ছে না।

গতকাল দোকান বন্ধ করে রাতে বাড়ি ফেরার সময় পালবাবুর বাড়ির পাঁদারে একটা ছেলেকে মলত্যাগ করতে দেখে মাধব প্রতিবাদ করেছিলো। হয়ত তারই কাজ এটা। আবার তা না হতেও পারে। সে ভাবে।

নির্মল ভারত অভিযানের একটা মিছিল আসছিলো। সমবেত স্বরে সবাই বলছে, "মাঠে ঘাটে পায়খানা, মৃত্যুর পরোয়ানা"। কে শোনে এসব কথা। মাধব বিড় বিড় করে বলে। আর কিছু ছাই এনে মল ঢাকা দিয়ে কোদালের সাহায্যে দোকানের সামনে টা পরিষ্কার করে।তারপর ঝাঁপ খুলে জল এনে আঁচ ধরিয়ে দিলো। মিছিলটা চলে গেলো। উনুনে তেল ফুটছে । এবার তৈরি আলুরগোলা, বেসনে মাখিয়ে ফুটন্ত তেলে ছাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানে ভিড় হয়ে গেলো।

মাধবেরর চপ একবার যে খাবে তাকে আবার আসতে হবে। তারপর দোকানে পেয়ে যায় জনপ্রিয় পত্রিকা। তাছাড়া সুকুমার বাবুর লেখা নতুন নতুন বই রেখে দেয় চায়ের দোকানে। লোকে চা খায় আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সুকুমার বাবুর গল্প। দোয়েলের শিস, উত্তরকথা এই সব বই মাধব দোকানে রাখে সবার পড়ার জন্য। আবার তার লেখা কাব্যগ্রন্থ, ছাই হতে চাই, মাধব বার বার পড়ে। অন্য লোকেও পড়ে। এই সব ব্যবসার কায়দা। তারকেশ্বর চট্টরাজ, ভবরঞ্জন বিশ্বাস প্রভৃতি লেখকের লেখা বই ওসে রাখে দোকানে। খদ্দের টানার ট্যাকটিস আর কি, সে হাসিমুখে বলে। আর তার ব্যবহার মানুষের একস্ট্রা পাওনা। সে দেখলো গতকাল যে ছেলেটার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে সেও এসেছে। বসে কাগজ পড়ছে। ভবরঞ্জনবাবুর গল্পের বইটার দিকে লোভের চোখে তাকিয়ে আছে। সকলে চলে যাওয়ার পর ছেলেটি বললো, মাধবদা, একটা কথা বলবো ।
____বল বল, তাড়াতাড়ি বল ।

____দেখো আমাদের তো বাড়িতে পায়খানা নাই, তাই কাল..

___আমার দোকানের সামনে অপকর্ম কে করলো বল তো ?

_____তা বলতে পারবো না। আমি নই। তুমি কত ভালো লোক। তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে।

____বেশ, অমরবাবুও পুরবোধিবাবুর সংগঠন সকলের উপকার করে থাকেন। তোরাও আবেদন কর। ঠিক পেয়ে যাবি। সমাজসেবি অমর চাঁদ বাবু, পুরোবোধি বাবু,অসীম ডাক্তার, অজয় আচার্য এনাদের চিনিস তো। তুই তোর অসুবিধার কথা অনিলদা,পল্লবদা,অশোকদা,জয়দেবদা প্রভৃতি উপকারী সমাজসেবী মানুষকেও জানাতে পারিস। ওনাদের মিলিত সংগঠন সমাজে অনেক ভালো কাজ করে থাকেন। দীপ্তিবাবু,তারকেশ্বরবাবু এইসব গণ্যমান্য লোকের শরণাপন্ন হলে একটা উপায় হয়ে যায় বুঝলি।

ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে বললো,একবার বইটা পড়বো। মাধব বললো,এখানে বসে পড়তে হবে কিন্তু। জানিস তো ভাই, বউ আর বই বাইরে গেলে আর ফেরে না। আমার দাদু হাসতে হাসতে বলতেন। তিনি বলতেন, পুরোনো প্রবাদ আর কি।

-----ঠিক আছে,আমি বসেই পড়বো। বই নিয়ে যাবো না। 
ছেলেটি বসে বই পড়তে শুরু করলো। একজন বললো, বই পড়ো ভালো ভালো। আর এখানে, সেখানে মলত্যাগ করো কেন। ছেলেটি চুপ করে থাকলো।

মাধব বললো, শুধু একা ওর দোষ নয়। একা কেউ সমস্যার সমাধান করতে পারে না। শুধু ও নয়, সমস্ত জনগণকে সচেতন হতে হবে ।

সামান্য চপের দোকানের মালিক হয়ে সে স্বপ্ন দেখে, ছেলেদের জন্য সে স্কুল করেছে। কত ছেলে মেয়ে লেখপড়া শিখছে। আর তার চোখের সামনে ভারতের সমস্ত ছেলেমেয়ে স্কুলের পথে পা বাড়িয়েছে। আর্থিক সঙ্কট চলছে। ঠিক একদিন আলো পরশ পাবোই। এইসব ভাবতে ভাবতে মাধব ভাবুক হয়ে যায়।

___ও মাধবদা তোমার চপ ছাড়ো। পোড়া গন্ধে আর ছেলেটার চিৎকারে গোবিন্দ সম্বিত ফিরে পেলো।

___দেখেছিস একটু অন্য মনস্ক হয়েছি আর ...

_____দাও আমাদের চপ, মুড়ি দাও। আচ্ছা দাদা, তুমি কি এত চিন্তা করো। মাঝে মাঝেই তুমি কেমন জানি হয়ে যাও ।
----জানি না রে। কেন যে মনটা উড়ু উড়ু করে।
মাধব জানে না ও কেন ওই রকম হয়ে যায় ।সে বলে, কত অভুক্তজন একমুঠো নুনভাতের জন্য কাঁদে। তাদের কান্না আমার অন্তরে দুঃখের ঝড় তোলে।

সে কেঁদে ফেলে।

____মাধবদা,তোমার চোখে জল কেন ?

_____ও কিছু না, এই উনুনের ধোঁয়ায় এই রকম হয়েছে ।

খরিদ্দার সবাই চলে গেলে, ঠিক দুপুর একটার সময় চারজন ভিক্ষুক আসে। তাদের খাবারের জন্য টাকা পয়সা দিয়ে সে গান করতে করতে নিজের বাড়ি যায়। অনেকে তার দয়ায় খেয়ে, পরে বেঁচে আছে। কিন্তু মাধব খুশি নয়। আরও অনেক মানুষের সেবা করতে চায় সে।

তারপর বাড়ি গিয়ে দুপুরে স্নান, খাওয়া সারা হলে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটের সময় আবার দোকান খোলে। এইভাবে বেশ চলে যায় দিনগুলো । মাধবের বয়স বেড়ে ষাটের দরজায় কড়া নাড়ে।

মাধব গান জানে। তাই মন খারাপ হলেই সে গান করে। খরিদ্দারও আনন্দ পায়। সকলেই তাকে ভালোবাসে।

পানুহাটে র আর দাঁইহাটের অনেক গরীব মানুষ দুপুরে খেতে যায়  কোনো টাকা পয়সা লাগে না । ওখানে হীরকবাবু, ভবরঞ্জন মাষ্টারমশাই, আদিত্য কবিয়াল, সুকুমারবাবু, বিবেকানন্দ ডাক্তার, তাপসদা, জয়দেবদা, জহরদা, বিকাশদা, পল্লবদা, অনিলদা,  প্রবীরদা, অলোকদা, প্রলয়, দিলীপ দা ও আরও অনেক ভবা পা গলার ভক্তরা ভবা পাগলা সেবাশ্রম, দেখাশোনা করেন। প্রত্যেক দিন প্রায় পাঁচশো অভুক্ত লোক ওখানে খাওয়া দাওয়া করেন। সবাই খায় কিন্তু কার টাকায় এই ব্যবস্থা কেউ জানে না। জানে শুধুমাত্র কমিটির লোকজন ।

আজ রিপোর্টার এসেছেন। কমিটির লোকের কাছে জানতে চাইছেন, কার টাকায় এই সেবাশ্রম চলে বলুন তো ?

সেক্রেটারি রণেশবাবু বললেন, মাধবদার টাকায় এই সেবাশ্রম চলে। তার চপ ও মুড়ির দোকান আছে শহরে।

রিপোর্টার যখন মাধবের চপের দোকানে গেলেন তখন সে চা দিতে দিতে গান ধরেছে, "ও মন সওদাগর বিদেশে বাণিজ্যে এসে কেন বাঁধিস বসতঘর, দেশের মানুষ দেশেই ফিরে চল"।

রিপোর্টার প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, কবি অসীম সরকারের গান। খুব ভালো করেনতো আপনি। আপনি এতবড় সমাজ সেবক। সামান্য চপের দোকান থেকে আয় করে আপনি এই অসম্ভব কাজ কি করে করলেন। মাধব বললো,
কোনো কাজই, ইচ্ছা থাকলে, অসম্ভব নয়। শুধু প্রয়োজন অদম্য ইচ্ছা শক্তি। নিজের খরচ কম করে অর্থ বাঁচিয়েছি তিরিশ বছর। আমি যা সঞ্চয় করেছি আর লোকের কাছে সাহায্য পাওয়া অর্থ একত্র করে, আমি এই আশ্রম গড়ে তুলেছি। আমার জীবনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমি আজ খুব খুশি। কত সমাজসেবী মানুষ আমাকে এই কাজে সাহায্য করেন তার ইয়ত্তা নেই। রোজ আমার কাছে অনেক অনেক টাকা আসে সাহায্যবাবদ। সব টাকা ওই আশ্রমের নামেই সঞ্চিত হয়। আমার কিছুই নয়। সব মানুষের। ভব বাবু,সুকুমার বাবুর মতো কত লোক যে টাকা পয়সা দান করেন তার ইয়ত্তা নাই।

এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে তার চোখে অশ্রুধারা। আনন্দের অশ্রু । 
জীবনের সবকিছু সকলের জন্য উজাড় করে নিঃস্ব হওয়ার আনন্দ একমাত্র দাতারাই অন্তরে অনুভব করেন,সাংবাদিক গম্ভীর হয়ে বলেন।

এতকিছু করেও মাধব কিন্তু নির্বিকার। এই সেবাশ্রমের কাজ সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় সে স্বপ্ন দেখে। একদিন নিশ্চয় সে একাজে সফল হবে। সে স্বপ্ন দেখে ভারতমাতার সমস্ত সন্তান গরম ভাত খাচ্ছে পেট ভরে। শত শত সমাজ কর্মি এগিয়ে আসছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। সবুজ ধানক্ষেতের ঢেউয়ে ফুটে উঠেছে ভারতের মানচিত্র। মাধব স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। সে দেখতে পায়, তরুণদের হাতে লাঙলের বোঁটা। তারা চাষ করছে।

রঞ্জন একদিন এসে বললো, মাধবদা তোমাকে নিউ আপনজন ক্লাব পুরস্কৃত করবে। সে গম্ভীর হয়ে বললো, কেন রে, কি করেছি আমি।আমি এখনও কিছুই করিনি।

তবে আমি বিশ্বাস করি," আমাদের হবে জয়,নিশ্চয়... "

রঞ্জন বলে, এ কথার কোনো উত্তর হয় না, দাদা। কারণ সবাই জানে তুমি কি করেছো।

ক্লাবের ছেলেরা এলে মাধব তাদের বললো, তোরা আমার সঙ্গে থাকিস তা হলেই হবে। মানুষের ভালো করাই হোক আমাদের জীবনের ব্রত। সকলকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের সাহায্য নিয়ে গোবিন্দ পাশের গ্রামে গড়ে তুললো আর একটি সেবাশ্রম। তার নামও দিলো জয়ভবা সেবাশ্রম। এমনি করে সদিচ্ছার জোরে তিনটি আশ্রম আজ চলছে মাধবের দয়ায়। মানুষ আজ জাতিবিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত। 
পরশ পাথরের পরশে অনেক তরুণ দীক্ষা নিয়েছে মানব সেবার ব্রতে।

বাংলার সরকার সেবা মনোভাবের স্বীকৃতি স্বরূপ মাধবকে সম্মানিত করতে চায়।
আনন্দ সংবাদটা সবাই মাধবকে জানাতে গিয়ে জানতে পারলো, সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে রাস্তায়,অসংখ্য, অভাবি মানুষের পাশে, তার হৃদয় কুসুম ফোটানোর আশায়।

0 comments: