ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক২৪
পৃথিবীতে কোনো মুহূর্ত চিরস্থায়ী হয় না। মানুষ যতই চেষ্টা
করুক, যতই প্রবল আশঙ্কায় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকুক তীব্র আনন্দের মুহূর্ত অথবা পরম
তৃপ্তির সময়কে, চিরদিনের জন্য তা ধরে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। ফ্রান্সেস্কো অনুভব করছিল
সে কথা। নিজের ভাবনাগুলি ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছিল সে, যে
তাঁর জীবনের বর্তমান রহস্যময় মুহূর্তের শিখরে সে কীভাবে ধাপে ধাপে উঠে এসেছে। এই
মুহূর্ত একটু পরেই ফুরিয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। একটু পরে কোথায়, কীভাবে তুমি বেঁচে থাকার
জন্য শ্বাসপ্রশ্বাস নেবে? সেই মুহূর্তগুলি যদি আরও সুন্দর হয়, সেই সময়টাকেও তুমি
আঁকড়ে ধরে স্থির করে, কিম্বা নিজে স্থাণু হয়ে থাকতে পারবেনা। কিন্তু নিজের অন্তরের
নিভৃত স্বর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
অন্তঃসারশূন্য অস্তিস্ত্বের মধ্যে কীভাবে একটা মানুষ বেঁচে থাকবে? পরিতৃপ্তির
ঐশ্বরিক সুখের এই অনিত্যতা অনুভব করে তাঁর হৃদয় বেদনায় পরিপূর্ণ হল। তাঁর মনে হল
সে এক অমৃতময় মাধ্বীরসের পানপাত্র খালি করে সমমাত্রার তীব্রতার এক অমৃতময় তৃষা
নিবৃত্ত করেছে। কিন্তু পানপাত্র কখনোই শূন্য ছিল না এবং তাঁর তৃষ্ণাও কখনোই চরম
তৃপ্ত হয়নি। তাঁর অতৃপ্ত তৃষ্ণা থেকে জন্ম নিলো হাহাকার এবং ক্রোধ, কারণ সে কখনোই
পানপাত্রের একদম শূন্য তলদেশ দেখতে পায়নি।
দ্বীপের চারপাশে নদীর তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের মাঝে, জোনাকিদের
মৃদু আলোর নাচের মাঝে সেই কুটিরের পাতার বিছানায় বিশ্রাম করছিল রতিক্লান্ত
প্রেমিক-প্রেমিকা। রাতের তারারা জ্বলজ্বল করছিল কুটিরের উপরের আকাশে। আগাথার শরীরের উন্মোচিত রহস্যের মাঝে
বুঁদ হয়ে গেলো সে। অদ্ভুত এক মায়াজাদুতে
আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সে; কখনোই ভাবেনি যে এরকম কোনো মুহূর্ত আসবে তার জীবনে,
যখন সে আগাথাকে শরীরে মনে একান্ত আপনার করে কাছে পাবে। আগাথার উন্মুক্ত কেশরাজির
ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছিল সে, আগাথার ঠোঁটে ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার ঠোঁট। দৃষ্টি আপনা থেকেই
বুজে গেলো তার গভীর চুম্বনের মুহূর্তে। আরও উৎসাহী সাড়া উঠে এলো যুবতী শরীরের মধ্য
থেকে। আরও অবশ করে দেওয়া সুখে ভরে উঠছিল চৈতালি রাত। রাতের উষ্ণতা যে এরকম সীমাহীন
আনন্দ নিয়ে আসতে পারে, একথা কোনোদিন ফ্রান্সেস্কোর ভাবনার মধ্যে ছিল না।
চরম সুখানুভূতির মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে থেকেও এক অদ্ভুত
অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল ফ্রান্সেস্কোর মন। পরিতৃপ্ত হয়েও সে যেন সম্পূর্ণ
ঘটনাটিকে বাস্তব বলে মেনে নিতে পারছিল না। তার আঙুল প্রথম কোনো রক্তমাংসের
নারীশরীর স্পর্শ করেছে, সর্বশরীর দিয়ে অনুভব করেছে এই নারীর অস্তিত্ব। পরিতৃপ্তির
আধিক্যের সঙ্গে সঙ্গে তার আগাথার প্রতি এক অদ্ভুত অধিকারবোধ জন্ম নিচ্ছিল। আগাথা
যেন তার কাছে শুধুই এক নারী নয়; সে যেন এমন কেউ, যাকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। যে
চিরকাল তারই ছিল, অথচ কোনো এক দৈবদুর্বিপাকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার থেকে। সে
যেন তারই আত্মার অংশ, যাকে সে আবার ফিরে পেয়েছে।
আগাথাকে ছাড়া সে এতদিন অপূর্ণ, অতৃপ্ত এক অর্ধেক প্রাণী হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে
ছিল; মিলনের ফলে সে এখন পরিপূর্ণ এক মানুষ। আগাথা যেন ঈশ্বরী, কোনো সাধারণ মানবী
নয়। ফ্রান্সেস্কো ঘেঁষে আসে, আবার কান পাতে সেই ঈশ্বরীর উন্মুক্ত বক্ষে, শুনতে পায়
সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আনন্দময় হৃদস্পন্দন।
অবশ করে দেওয়া তন্দ্রা নেমে আসে প্রেমিকযুগলের শরীরে।
রতিসুখের পরিতৃপ্তি তাদের আর জেগে থাকতে দেয়না। পরস্পরের বাহুবন্ধনে থাকতে থাকতে
ঘুমিয়ে পড়ে তারা। কুমারী আগাথা লাজুক হলেও কী পরম নিবেদনে, কী অদ্ভুত দক্ষতায় শরীর
নিবেদন করেছিল ফ্রান্সেস্কোর কাছে। ঘুমের মধ্যে এক শিশুসুলভ হাসি খেলা করছিল তার
মুখে, অথচ তার শরীর পূর্ণ যুবতীর। ফ্রান্সেস্কো আধঘুমে দেখছিল তাকে। ঘুমন্ত এই
নারীকে দেখেও এক অদ্ভুত সুখ পাচ্ছিল সে। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরছিল যখন সে, মনে
হচ্ছিল সমগ্র বিশ্বের প্রাণশক্তি অনন্ত বিশ্রামে রত। স্বপ্নের মধ্যে অস্ফুটে কথা
বলে উঠছিল আগাথা। অদ্ভুত ভুবন ভোলান হাসিটি কখনোই তার মুখ থেকে মুছে যাচ্ছিল না। তন্দ্রার
মধ্যেও ফ্রান্সেস্কোর মনে হচ্ছিল যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হৃদস্পন্দন থেকে নির্গত
প্রাণশক্তি এসে মিশে যাচ্ছে তাদের দুজনেরই শরীরে। মধুর আনন্দময় অনুভব মিশে যাচ্ছে
তাদের নিদ্রায়।
এই
অনুভব আর কিছুই নয়, এ সেই বৃক্ষ, যা স্বর্গের উদ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে
আছে, সেই বৃক্ষের ফলের স্বাদ। জীবনবৃক্ষের ফলের স্বাদ, যা অন্তরের এবং শরীরের
প্রাণশক্তি দ্বারা অনুভূত হয়। না, এই ফল ভালোমন্দ বিচারের জ্ঞানের বৃক্ষের নয়, যে
বৃক্ষের কাণ্ডে পাকে পাকে নাগ জড়িয়ে ছিল এবং ইভকে প্রলুব্ধ করেছিল। বরঞ্চ, এই ফলের
স্বাদ সবাই যাতে সমানভাবে পায়, ঈশ্বর এমন ব্যবস্থা করেছেন। ফ্রান্সেস্কোর মনে
উচ্চকোটির ভিন্নগোত্রের পরম আনন্দ লাভের ইচ্ছে ছিল; ছিল, এখন নেই। কারণ, স্বর্গে,
মর্তে কোথাও এমন আনন্দময় অনুভবের তুল্য সম্পদ, জ্ঞান আর কিছুই নেই। কোনো রাজা
কিম্বা ঈশ্বর, কারো কৃপাপ্রার্থী নয় সে এই সম্পদের নিরিখে। না, সে ভিখারি নয়। তার
ভাষা, তার ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা সবকিছুই স্তব্ধ হতে শুরু করেছিল, যখন সে প্রথম
আগাথার অধর স্পর্শ করেছিল। সে পান করেছিল তার অশ্রু। অন্তরে অন্তরে তারা স্পর্শ
করেছিল একে অপরের আত্মাকে। না, এই স্পর্শসুখ শুধুই কামনাবাসনা চরিতার্থ করা এবং
আনন্দ উপভোগ নয়; এই স্বাদ, এই অনুভব এমনকিছু, যা মনুষ্যনির্মিত ভাষা দ্বারা প্রকাশ
করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
*-*-*
ফ্রান্সেস্কো যথাসময়ে ভোরের উপাসনাসভার পৌরোহিত্যে নিজের
কর্তব্য পালন করেছিল। সে যে রাতে নিজের ঘরে ছিলনা, এই ব্যাপারটা কেউই খেয়াল করেনি;
পেট্রোনিলাও নয়। তাড়াহুড়ো করে সে পৌঁছে গিয়েছিল ঈশ্বরের বেদির সামনে, যেখানে
সহকারী পুরোহিতেরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রার্থনাসভায় ভক্তসমাগম শুরু হয়ে
গিয়েছিল। প্রার্থনার শেষে নিজের ঘরে ফিরবার পরে যখন পেট্রোনিলা তাকে
প্রাতঃরাশ পরিবেশন করেছিল, তখন ধীরে ধীরে সে নিজের চেতনায় ফিরেছিল। কিন্তু এরকম
ভাবলে ভুল হবে যে এই সচেতনতার ফলে সব মোহ
আবরণ কেটে গিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতির গুরুত্ব সে নিজেও স্বচ্ছভাবে বুঝতে পেরেছিল।
বরঞ্চ এই গির্জার সীমানার মধ্যে একান্তে তার ঘরের পরিবেশ, বেলা বাড়তে থাকা দিন-
সবকিছুই তার কাছে একদম অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছিল। নাকি গতরাতের ঘটনা যা
ঘটেছে- সেটাই অবাস্তব? স্বপ্নের মত? নাহ, কোনোকিছুই স্বপ্ন নয়। যা ঘটেছে এবং ঘটছে
সব সত্যি, বাস্তব। যতই সবকিছুকে ঘিরে ফ্রান্সেস্কোর মনে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি
হোক না কেন, পরিস্থিতিটা সে অস্বীকার করতে পারেনা। তার পতন ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এই পতিত অবস্থা থেকে তার আদৌ কোনো
উত্থান সম্ভব কিনা! তার মনে পড়ছিল যে সে নিজে আকুল হয়ে নগরপালের কাছে ছুটে গিয়েছিল
আল্পসের উপত্যকায় বসবাসকারী হতদরিদ্র স্কারাবোটা পরিবারের জন্য। পতিত পরিবারটির
উদ্ধারের জন্য, শিক্ষার জন্য, ধর্মবোধের দীক্ষা ইত্যাদি সাহায্যের জন্য সে নানা
আবেদন নিবেদন করেছিল একসময়। কত গর্বের সঙ্গে, ধর্মের গরিমার গজদন্তমিনার থেকে
কৃপাবর্ষণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সে। আর এখন? হা ঈশ্বর! সে নিজেই পতিত।
লজ্জায় সে অধোবদন হল। সে এখন এক ভণ্ড সাধু ছাড়া কিছু নয়। তার বিবেকের কাছে সে
উলঙ্গ হয়ে গেছে। সে সবার সঙ্গে তঞ্চকতা করছে। সোয়ানার সমস্ত নারী, গৃহবধূ, কুমারী
কন্যা, সবাই তাকে এক সম্মানের আসনে বসিয়েছে। সবকিছু নষ্ট হয়ে গেলো। ব্যর্থ হয়ে
গেলো সব।
সে এই সোয়ানা গ্রামটির অদ্ভুত আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন করতে
সক্ষম হয়েছে। যারা উপাসনা ইত্যাদিতে জন্মে যেতো না, তারা গির্জায় আসছে আবার। একটা
ভালো পরিবেশ সে গড়তে পেরেছে। পেরেছে, নাকি পেরেছিল? সে নিজেই এখন সব নষ্ট করে
দিয়েছে। তার পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সে সব্বার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা
করেছে; ঈশ্বরের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, গির্জার সঙ্গে, নিজের পরিবারের সঙ্গে, নিজের
অস্তিত্বের সঙ্গে, হ্যাঁ, এবং সর্বোপরি সেই হতদরিদ্র, পতিত, দুর্ভাগ্যপীড়িত
স্কারাবোটা পরিবারের সঙ্গেও, কারণ ঐ প্রাণীগুলিকে
অভিশাপ থেকে উদ্ধার করবার সংকল্প নিয়েই সে নিজে এই পতনের পঙ্কিল অন্ধকারে নিমজ্জিত
হয়েছে।
ফ্রান্সেস্কোর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। তিনি একজন গর্বিত মা। নিজের সন্তান সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী যে তাকে জীবনের পথে সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছেন। মা শিশুকাল থেকে কঠোরভাবে তাকে মানুষ করবার চেষ্টা করেছেন। খুব নরমশরম মানুষ তিনি নন। যা করেছেন, সন্তানের ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্য করেছেন। তার এই কঠোর পুরুষালী আচরণের বাতাবরণের পিছনে এক মাতৃত্বপূর্ণ স্নেহময়ী কোমল হৃদয় লুকিয়ে আছে। তার সেই হৃদয় ভয়ানক আহত হবে যদি তার সন্তানের চরিত্রে তিলমাত্র কালির ছিটে লাগে। যেভাবে তার পতন ঘটেছে, একথা যদি তার মা জানতে পারেন, তার হৃদয় মন ভয়ানক আহত হবে। সেই ক্ষত নিরাময় করা সম্ভব হবে না। আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রকৃত ঘটনাবলী যেরকম তীব্র গতিতে তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, এই সত্য এবং বাস্তবের কণামাত্র মা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না।
(চলবে)
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা
0 comments: