ধারাবাহিক - প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জী
Posted in ধারাবাহিকঅন্তিম পর্ব
মগধে প্রত্যাবর্তনের পর নিজের কাজে মননিবেশ করার চেষ্টা করেন সহদেব। পরে সংবাদ পেয়েছিলেন, ওখানের মহারাজ নিরুদ্দেশ হবার পর সম্রাট উজ্জয়িনীর শাসনভার গ্রহণ করেছেন। জলের মত তার কাছে পরিস্কার ছিল, সেইদিন অত সৈন্য থাকার প্রকৃত কারণ।
কিছু বর্ষ পরেই মহারাজ ফিরে আসেন মগধে। সম্রাট অশোককে দেখলে মনেই হবে না, এত শয়তানী খেলা তিনি খেলেছেন। শান্তিপূর্ণ ভাবে কিছুসময় কেটে যাবার পর হঠাৎ সম্রাট ঘোষণা করেন
---আসমুদ্র হিমাচল, আমার সাম্রাজ্য হবে। উত্তরভারতের সকল ছোট বড় রাজ্য আমার সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হলেও কলিঙ্গ কিন্তু আমার রাজ্যভুক্ত নয়। তাই আমাত্য সহদেব তুমি ওদের পত্র পাঠিয়ে দাও এই মর্মে যে কলিঙ্গরাজ যেন আমার বশ্যতা স্বীকার করে।
সহদেব স্তব্ধ হয়ে যায়। 'কলিঙ্গ রাজ্য' ও প্রভুর বর্ণিত পদক্ষেপ ,তার মাথায় ঘুরতে থাকে। সহদেব বোঝানোর চেষ্টা করলেও সম্রাটের নির্দেশ বদলায় না।
কলিঙ্গরাজ নতি স্বীকার করেন না। মহারাজের মুখে খেলে যায় আবারো নিষ্ঠুর হাসি, এক অদ্ভুত খেলা খেলছেন তিনি।
সহদেব সৈন্য সংগ্রহ ও বিশেষ কারণে রাজ্যের বাইরে যাবার আগে সঙ্গোপনে মারীচকে সংবাদ পাঠান ।
শ্বেত অশ্বের পিঠে ধাবমান এক পুরুষ, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর, তবু সব কিছু উপেক্ষা করে সে ছুটে চলেছে, তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। হিমালয়ের কঠিন পর্বত নদী অগ্রাহ্য করে সে অগ্রসর হয়েছে। দূরে দেখা যায় পর্বতের কোলে কিছু কুটির । দ্রুত বেগে অশ্বচালনা করে সেই স্হানে পৌঁছেই কুটিরের দরজায় ঠক ঠক করেন। কাষায় বস্ত্র পরিহিত এক কিশোর দরজা খুলে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে তার দিকে, কি অদ্ভুত বেশভূষা। ঠিক এই সময়ে সেই কিশোরের পাশে এসে উপস্থিত হন আরেক যুবক, কিঞ্চিত অবাক হয়ে বলেন
---সহদেব তুমি?
---মারীচ কি এখানে আছেন?
---আমায় চিনতে পারেন নি, আমি মারীচ।
সহদেব হতবাক হয়ে যান, দীর্ঘদিনের ব্যবধানে, মনুষ্য চেহারার বদল ঘটে।
সহদেব কুটিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন, মারীচ উষ্ণ পানীয় দিয়ে তাকে সাদরে আপ্যায়ন করেন। সহদেবের অবসন্ন শরীরে যেন শক্তি আসে, সেই পানীয় পান করে। ধীরে ধীরে সকল ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন সহদেড়। মারীচের মুখ কঠিন হয়ে যখয়। তিনি বলেন
---আমরা পরশু যাত্রা করবো।
দুদিন বিশ্রামের পরে তারা একত্রে পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন সেই অজানা গ্রামের উদ্দেশ্যে।
মারীচের সাথে এগিয়ে চলেছে সহদেব। দিনের পর দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে অশোক, সবার কাছে সে চন্ডাশোক বলেই পরিচিত।
--আর কতদূর মারীচ?
--সহদেব দুই দিবস এক রাত্রির যাত্রাপথ।
শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার ন্যায় তুষারপাত আঘাত করছে চোখেমুখে। হিমের চাদরাবৃত হিমালয় যেন ধ্যানস্তব্ধ প্রতীক্ষারত। শীতের প্রকোপ উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় অশ্বগুলিও ক্লান্ত, অগ্রসর হতে চাইছেনা। বিগতকয়েক মাস যাবৎ শুধু এই যাত্রা করে চলেছে সহদেব । শরীর মন অবসন্ন।
যে ভয়ঙ্কর বিপদ আগত, তা হতে রক্ষা করার এই যে একমাত্র উপায়।
অবশেষে কিন্নর উপত্যকায় এসে পৌছলেন সহদেব। স্বল্প কিছু মানুষের বসবাস। হিমশৈল ঘেরা চন্দ্রতাল হ্রদকে কেন্দ্র করে এক সমতল ভূমি।গগনচুম্বী পর্বতগুলি প্রহরারত দ্বাররক্ষীর মত উপত্যকাকে যেন রক্ষা করছে । গত দুই দিবসে ক্ষুধা তৃষ্ণা আর শীতের জন্য তারা মৃতপ্রায়। গ্রামে পৌঁছানোর আগেই তার সংজ্ঞা লুপ্ত হয়।
চেতনা ফিরলে সহদেব দেখে জলচৌকির ওপরে সে শায়িত, গায়ের ওপরে মোটা কম্বল, অদ্ভূত তার গন্ধ। কিছু সময় পরেই এক স্থূল মহিলা এসে কাষ্ঠ নিমৃত বাটিতে উষ্ণ পানীয় দিয়ে ইশারায় পান করতে বলেন। ঈষৎ কষাটে স্বাদযুক্ত সেই দুগ্ধজাতীয় পানীয় পান করার পরে শরীর বেশ সবল বলেই মনে হল সহদেবের। মারীচ প্রবেশ করে বলে
---এখন কেমন বোধ করছেন?
এই শ্রমণের ভালবাসা তার মনকে স্পর্শ করে।
মারীচ এক অদ্ভূত ভাষায় কথা বলে ঐ মহিলার সাথে । তারপর বললেন
---প্রভু সামনের এক গুহায় সাধনারত। আমি যাব তথায়।
অস্থির হয়ে পদচারণা করছেন সহদেব। কপালে ভ্রুকুটি। মারীচ বললেন
-- গত তিনদিনের প্রচেষ্টায় ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে প্রভুর।
--প্রভু আপনাকে স্মরণ করেছেন।
সহদেব এই ক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষারত। পদ্মাসনা সাধক উপগুপ্তর চক্ষু মুদিত। তার মুখে স্মিত হাসি। প্রভুকে প্রণাম করে বললেন
--প্রভু রক্ষা করুন। সম্রাট কলিঙ্গ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
বৌদ্ধ শ্রমণের চক্ষের দৃষ্টি পালটে গেছে। তিনি বললেন
--এই মুহূর্তে মগধে যাওয়া প্রয়োজন। নরকবাসিনী মার তার প্রচন্ড তান্ডব নৃত্য শুরু করেছে, শ্মশানে পরিণত হবে। সম্রাট অশোকের শরীরকে অধিকার করে সে নিজের ইচ্ছা পূরণ করছে।
সহদেব মগধে ফিরেই রওনা দেন কলিঙ্গ যুদ্ধে। এক ভয়াবহ যুদ্ধ। কলিঙ্গের সৈন্যরা যুদ্ধে পারদর্শী হলেও অশোকের রণনীতির কাছে তারা পর্যুদস্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দেশভক্তি সত্য অতুলনীয়। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। স্বয়ং শয়তান যেন নৃত্য করছে রণভূমিতে। গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন। সাধারণ মানুষ মাতৃভূমি রক্ষার্থে প্রাণ দিতে দ্বিধা বোধ করে নি। কিন্তু হায়, ভাগ্য তাদের সহায় নয়। চন্দ্রভাগা জল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রাজ্যবাসীর হৃদয় এই নিষ্ঠুরতায় কেঁপে উঠেছে। মহারাজের চৈতন্য হয় নি। তিনি শয়তানের পূজায় ব্যস্ত, সাধারণের রক্তে স্নান করে যুদ্ধ করছেন। তাদের আর্তনাদ তাকে উদ্বুদ্ধ করছে যেন, মায়া মমতা, ভালবাসার লেশমাত্র অবশিষ্ট নাই তার শরীরে। অবশেষে মহারাজ অধিকার করলেন কলিঙ্গ, অগণিত সাধারণ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। শ্মশানে পরিণত হয়েছে সেই রাজ্য। মৃতদেহের স্তুপ। পঁচাগন্ধে ভরে গেছে সব স্থান। শকুন চিলেরা খুবলে খাচ্ছে মৃতদেহ।
সেইসময়েই :
উপগুপ্তের নির্দেশ অনুসারে মারীচ এলেন তক্ষশীলায়। কলিঙ্গে তখন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হব হব করছে। মারীচ বৌদ্ধবিহারে মহাদেবীকে বলেন
---মহারাণী আপনাকে প্রয়োজন। আপনি পারেন এই তান্ডবের শেষ করতে।
---আমি!
--আচার্য সেই নির্দেশ দিয়েছেন। মহারাজ যে ধ্বংসের যজ্ঞ শুরু করেছেন, তা থামার নয় দেবী। আপনি ফিরে চলুন।
মারীচের করুণ আর্তি শুনে মহাদেবী এলেন কলিঙ্গে। চন্দ্রভাগার জল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চারিদিকে শুধু মৃতদেহ। আর্তের প্রাণফাটা হাহাকার। গ্রামের পর গ্রাম শূণ্য। শিশুরা মৃত মায়ের উপরে বসে কাঁদছে, কোথাও কোনো মাতা তার নাড়িছেঁড়া ধনকে বাঁচানোর তাগিদে পাগলিনী মত ছুটছে। কেউবা শোকে পাথর। বিলাপ ও আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তারা প্রাণ দিতে পিছপা হয়নি।
যুদ্ধের এই ভয়ালতা দেখে স্তম্ভিত মহারাণী মহাদেবী।
--আজ অমাবস্যা, সেই বিশেষ তিথি দেবী
--আমি প্রস্তুত মারীচ।
আজ বলির পরেই নরকবাসিনী পাবে তার পূর্ণ রূপ।
বায়সের কা কা রবে চিৎকার, রাত্রির অন্ধকার রূপ সব যেন ভয়াল পরিবেশ রচনা করেছে। সহদেব ও মারীচের সাথে উপস্থিত হলেন আচার্যের বর্ণিত সেই বিশেষ স্থানে। রক্ত দিয়ে সেই এক চিত্র অঙ্কিত মাটির মধ্যে। এক বৃত্ত এবং তারি মাঝে পঞ্চভুজ । পাঁচ বিন্দুতে পাঁচ প্রদীপ জ্বলছে। হাত পা বেঁধে এক নারী ঐ স্থানের এক কোণে বর্তমান।
সহদেবের মন শঙ্কিত।
মহাদেবীকে দেখে চমকে গেলেন মহারাজ। হিংস্র মুখে বললেন
--- তুমি, কেন এসেছ এ স্থানে?
--আপনার কার্য পরিসমাপ্ত করতে।
--আমার?
--আজ অমাবস্যা, সেই তিথি, বলির জন্য রাজরক্ত প্রয়োজন আপনার, তাই এসেছি।
---কি বলতে চাও
নবম বর্ষীয়া এক বালিকাকে ঐ স্থানে এনে মহাদেবী চিৎকার করে বললেন,
--এই নিন রাজরক্ত, বলি দিন মহারাজ!
বালিকার শান্ত সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে মহারাজ স্তব্ধ, বললেন
---কে এই বালিকা?
--মহারাজ, একদিন এই সন্তানদের হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, আজ নিজের আপন আত্মজাকে চিনতে পারছেন না?
মহারাজ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো মনে্য য়ধ্যের এক পিতা উঁকি মারতে চাইছিল, কিন্তু শয়তানের বশীভূত সেই পিতা বড়ো অসহায়। শয়তানের উপাসনার সময় তিনি নিভৃত স্থান পছন্দ করেছেন। একাকী করেছেন সেই সাধনা। লোকসমাগম তার অপছন্দ।
সম্রাটের অন্তরস্থ শয়তান জাগ্রত হতেই সে তার তরোয়াল নিয়ে ছুটে যার মহাদেবীর দিকে। ঠিক সেই সময়ে আচার্য উপগুপ্ত উপস্থিত হয়ে তার মাথায় হাত রেখে বীজমন্ত্র জপ করতে শুরু করেন। তার বিশেষ কিছু শ্রমণ উপস্থিত হয়ে, দুর্বোধ্য ভাষায় জপ করতে থাকেন কিছু মন্ত্র এক সাথে এক সুরে। শব্দের এক মায়াজাল, সুরের এক মায়াজাল বারবার মহারাজের শক্তি যেন কমতে থাকে, দুই হাতে কান চাপা দেয় মহারাজ, তাঁর গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে।
সম্রাট সমগ্র শক্তি একত্রিত করে, প্রবল শক্তিতে আচার্যকে ধাক্কা দেন। কিন্তু সাধন বলে বলীয়ান আচার্যকে তিনি আঘাত করতে পারেন না। প্রচন্ড ঘৃণায় তার মুখ কুঁচকে যায়। সহদেব ও মারীচ দুইদিক থেকে সম্রাটকে ধরলেও তার সাথে পেরে উঠছিলেন না। সুযোগ বুঝে সহদেব তার অঙ্গুলি থেকে ঐ অঙ্গুরীয় খুলে নেয়। সম্রাটের অন্তরস্থ শয়তান বলতে থাকে
---আমাকে শেষ করা সম্ভব নয়। স্বয়ং কৃষ্ণ পারেন নি আমায় শেষ করতে। আমি ফিরে আসবো আবার। আবার শুরু করব নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তার।
পরিশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েন রাজন। শ্রমণেরা শ্রুতিমধুর সুরে গাইতে থাকেন
---অসতোমা সদগময়
তমসোমা জ্যোতির্গময়
সব শেষে মৃতবৎ মহারাজ লুটিয়ে পড়েন ভূমিতে। তার শরীর হতে এক পুঞ্জীভূত অন্ধকার নির্গত হয়ে প্রবেশ করে অঙ্গুরীয়র মধ্যে। এই সময় আচার্য কিছু ছাই ঐ অঙ্গুরীয়তে মাখিয়ে, হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। খন্ড, বিখন্ড হয়ে যায় অঙ্গুরীয়। সব খন্ড একত্র করে, ধাতব নির্মিত কৌটোয় বিল্বপত্রের মধ্যে করে সহদেবের হাতে তুলে দিলেন আচার্য। বলেন
--আমার কাজ শেষ। একদিন রাজনকে নিয়ে বিহারে আসুন দেবী।
কিছুসময় পরে, সেবা ও শুশ্রূষা করায় জ্ঞান ফিরে আসে সম্রাটের। তীব্র অনুশোচনার আগুন জ্বলে তার হৃদয় মধ্যে।অপশক্তি শরীর অধিকার করলেও তার চেতনা ছিল, তাই সব কিছুই স্মৃতিতে আছে। কলিঙ্গ রাজ্যের অবস্থা দেখে তিনি হাহুতাশ করেন। মহাদেবীর সাথে বৌদ্ধবিহারে গিয়ে আচার্য উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা নেন। এরপরের বাকি জীবন জনগণের স্বার্থে নিয়োজিত করেন।
একবৎসর পরের ঘটনা:
এক গোপনীয় সভার আয়োজন করেছেন সম্রাট। তাঁর সভার নবরত্ন , এবং গুণীজনেরা অংশ নিয়েছেন এই সভায়। সম্রাটের ইচ্ছানুসারে বিভিন্ন গুণীজনেরা ছড়িয়ে পড়ে দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে, এমনকি বিদেশেও যায় বহু মানুষ। প্রত্যেকের হাতে থাকে ধাতব নির্মিত বিশেষ কৌটো।
সহদেব এবং মহামতি অশোক কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তাঁরা। বহু খণ্ডে বিভক্ত অঙ্গুরীয় পাঠিয়ে দিয়েছেন দেশে বিদেশে। চেষ্টা করেও সমগ্র অঙ্গুরীয় একত্রিত করা অসম্ভব।
দুর্দান্ত ভাবে শেষ হয়েছে গল্পটা... খুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম... গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা ছিল... জাস্ট কোনো কথা হবে না... Awesome গল্প... খুব তাড়াতাড়ি এরকম গল্প আরো পড়তে চাই...
ReplyDelete