0

ধারাবাহিক - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





















৪ 

It is as reasonable to represent one kind of imprisonment by another, as it is to represent anything that really exists by that which exists not. 


সুনন্দদা, আমি সুকৃত বলছি। একটু কথা বলা যাবে? 

সুনন্দ চক্রবর্তী এখন মধ্যবঙ্গের এক আধামফস্বলে আছেন। কলেজে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দ একটা এনজিওর সঙ্গে যুক্ত। এসব করতে হয়। বিদেশে লেকচার পেতে গেলে এগুলো দরকার হয়। সোশ্যাল কমিটমেন্ট কতটা দেখতে চায় সকলে। সুনন্দর এসব কাজের কভার করে দেয় অতসীর পত্রিকা। বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে। লিটেরারি মিটে সুনন্দর আলোচকের ভুমিকা পাকা। সারা পৃথিবীর একাডেমিক জগত থেকে আমন্ত্রিত বিদ্বজন আসেন। যদিও সুনন্দ আর অতসী বহুদিন একসঙ্গে থাকেন না। সুনন্দর ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কগুলো এত ছড়িয়েছে যে অতসী বিরক্ত। ওরা তাই দুজনে দুজায়গায় আলাদা থাকে। অথচ সমঝোতায় কোনো অভাব নেই। 

সুনন্দর প্রাচী ট্রাস্ট অনগ্রসর এলাকায় স্বাস্থ্য আর শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। মূলত তথ্য সংগ্রহ করে। নানা দেশবিদেশ থেকে রিসার্চাররা আসে এসব তথ্যের জন্য। সুনন্দর কথাবার্তায় এই অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য মমতা থাকে। মানুষ শ্রদ্ধা করে। একাডেমিক মহলে এ নিয়ে দুরকমের কথাই হয়। তবু প্রাচী নামী প্রতিষ্ঠান। ইদানীং শহরাঞ্চলে বস্তিগুলোতেও ওরা স্টাডি চালাতে শুরু করেছে। কলকাতা শহরের পাঁচটি স্লাম বাছা হয়েছে এর জন্য। তার মধ্যে একটি বারো নম্বর গলি। 

সুকৃতের গলা পেয়ে সুনন্দ স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে বলে -আরে বলো? কী ব্যাপার? আমার মতো গেঁয়ো লোককে হঠাৎ মনে পড়ল? সুকৃত অবশ্য এই মজার উত্তর দিলো না। সুনন্দর একটা মেকি সফিসটিকেশান আছে। হয়তো ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে, বা, আগেও ছিল, গভীরে লুকোনো, সুকৃত বোঝেনি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সেও কি আর পাল্টায়নি? এখন শুধু বলল -সুনন্দদা, কলকাতার খবর জানেন? সুনন্দর স্বচ্ছ গলা ভাসে -নাহ, জানার দরকার নেই। প্রাচী ট্রাস্টের খবর থাকলে আমি পেয়ে যেতাম। বাকি কোনো খবর জানতেও চাইনা। কেন হঠাৎ এমন প্রশ্ন? সুকৃত এবার সময় নেয় -গতকাল রাতে মানে মধ্যরাতে সুপ্রতীক চক্রবর্তী, মানে আপনার ছেলে মারা গেছে। আপনি জানেন না বলছেন? এখন সকাল সাতটা। 

সত্যিই এখনও কোনো ফোন আসেনি। সুনন্দ এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। একটা অদ্ভুত অবশ অবস্থা। হাত পা নাড়তেও পারছেন না। কথা বলা দূরের কথা। কাছেই ট্রাস্টের দুজন ছেলেমেয়ে ছিল। তারা যেহেতু ফোনের কথা কিছুই শুনতে পায়নি তাই বুঝতে পারলনা তেমন। শুধু সুনন্দকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ওর ফোন থেকে লাস্ট কল দেখে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সুকৃত সান্যালের গলা। এসিপি সুকৃত সান্যাল। “স্যার, আপনার ফোনটা পেয়ে সুনন্দদা কিরকম হয়ে গেছেন। একটু বলবেন আমাদের? কি করব বুঝতে পারছিনা”। এবার সুকৃতের গলা পরিষ্কার -ওনার ছেলে আজ ভোর রাতে মারা গেছে। ওনাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কারফিউ না থাকলেও একসঙ্গে অনেকে এসো না। রাস্তায় গোলমাল হবে। বেশি হইচই কোরো না। লোক জানাজানি যত কম হয় আর কি। এখন তো মিডিয়া কভারেজ মোটামুটি বন্ধ। 

সুকৃত সান্যাল মাথার দুপাশে হাত রেখে বসেছিলেন। সুনন্দদা, সেই সুনন্দদা। কী ছিল আর কী হল। অতসীদিও! ইউনিভার্সিটির ভালো ছাত্রছাত্রী। তখন কত আদর্শ! সেই ভাঙিয়ে এখনও চলছে। সুনন্দদার ট্রাস্ট তো অনেকের কাছেই মোহের কারণ। কোথাও তো আদর্শকে অনুসরণ করছে! আর অতসীদি? কী অসম্ভব কম্প্রোমাইজ! নয়তো ‘পত্রিকা’র এই দুর্দিনে অতসী চক্রবর্তী বহাল তবিয়তে! একটি দলীয় খোঁচাও খেলো না! আর সত্যি! একটা অদ্ভুত সময় কিন্তু। লোকাল থানার অফিসার করিৎকর্মা। ঠিক কি করে জেনেছে সুকৃত সুনন্দ চক্রবর্তীর বন্ধুলোক। খুব তাড়াতাড়ি খবর দিয়েছে। এসব মিটলে লোকটার খবর করতে হবে। একদিকে অবশ্য ভালো হয়েছে, এই লক ডাউন এই এপিডেমিক, এসবের মাঝে খবরটা চাপা পড়ে যাবে। যদি না কেউ ভাসিয়ে তোলে। ওদিকে আবার চিরজিত সেন মারা গিয়েছে। হাসপাতালের গাফিলতি থেকে নাকি ইনফেকশান ছড়িয়েছে। বাঁচতে পারতেন। পারলেন না। বডি ক্রিমেশান নিয়েও ভীষণ কথা হয়েছে। ‘এইদিন’ এ নিয়ে একটু অসন্তুষ্ট। পুলিশ কেন ঠিকমতো হ্যান্ডল করল না? আরে বাবা, পুলিশের মাইনে কি তোরা দিস? সরকার চামড়া আস্ত রাখবে? অতসীদিকে তো এখনই কিছু বলাই যাবে না। নয়তো কাগজে কিছু লিখে দিতে পারত। হাসপাতালের গাফিলতি, সরকারের তরফে পাত্তা না দেওয়ার ভাব, সব একটি কলমের খোঁচায় চাপা পড়ে যেত। এদিকে লোকাল নেতাও অন্য সময় হলে চিরজিত সেনের বাড়ি চলে যেত। কিন্তু এখন তো এপিডেমিকের বিধিনিষেধ চলছে। নেতার কি আর প্রাণের ভয় নেই? 

চারপাশ থেকে একটা অদ্ভুত কেমিক্যাল স্মেল এই রাস্তাটাকে ঘিরে থাকে। এটা রেড জোন। ফলে দিনে বেশ ক বার কেমিক্যাল স্প্রে করা হয়। গিজগিজে বস্তিতে ভরা ফুটপাথ আর হকারস কর্নারের এক পাশে থানা। বাসব দত্তগুপ্ত এখন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন -ইয়েস স্যার, ইয়েস। না কেউ আসেনি কভার করতে। হ্যাঁ, আমরা একটা বাইট টিভি নিউজে দিয়ে দিয়েছি। ওই হলো গ্রাউন্ডে ছেলেটি পড়ে যায় কোনোভাবে। হ্যাঁ স্যার। আনফরচুনেট। কোয়াইট আনফরচুনেট। এক্সিডেন্ট। হ্যাঁ স্যার, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট চাপা থাকবে। কেস উঠছে না এখনই। ইয়েস স্যার। মাই প্লেজার স্যার। 

ফোনটা রেখে দত্তগুপ্ত বেলটা সজোরে টিপলেন। শালা বখে যাওয়া ছেলেপিলে! নামজাদা প্রফেসর আর সমাজসেবীর ছেলে! নিজের ছেলেকে মানুষ করতে পারে না? ওদিকে মা তো দারুন ব্যাপার। শহরের কালচারাল হায়ারার্কির ঠেকা নিয়ে রেখেছে! ওনার কাগজ তো শেষ কথা! কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও দত্তগুপ্তর মনটা খচখচ করছে। আচ্ছা? ওই যে ডাক্তার অর্ণব গুপ্ত, উনি নাকি বেশ দরদী লোক। একটা মরাল নিয়ে চলেন। ডাক্তারি মহলে নাম আছে ভালো লোক বলে। তার ছেলেটাই বা এরকম হলো কি করে? হঠাৎ দত্তগুপ্তর মনে পড়ল। সিভিকের ছেলেগুলো গিয়েছিল ‘এইদিন’ কাগজের চিরজিত সেনের বডি নিতে। ওরা রিপোর্ট দিয়েছিল, এই অর্ণব গুপ্ত নাকি খুব মন খারাপ করে বসেছিলেন। ওনাদের হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন চিরজিত সেন। সো আনলাইক! ডাক্তার কেন এমন হবেন? এতদিনে তো নিঃস্পৃহ হয়ে যাওয়ার কথা! শুধু তাই নয়, ওই যে ছেলেগুলো পাশের বস্তিতে কাজ করে, স্কুল চালায়, ওরা বলেছিল, এই ডাক্তারের ভাই ওদের সঙ্গে আছে। সেও উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু মাথায় পোকা। বস্তি উন্নয়ন হবে। ইন ফ্যাক্ট বস্তির সব ইনফেক্টেড লোকের চিকিৎসা করেছেন ওই ভদ্রলোক। বস্তিতে এসে দেখে গিয়েছেন। যতটা সম্ভব ক্লিনলিনেস মেনটেন করা যায় বুঝিয়েছেন। প্রিভেনশান বলেছেন। এর মধ্যেও কিভাবে আইসোলেশান সম্ভব সবই দেখিয়েছেন। এ সত্ত্বেও বস্তিতে লোক মরেছে। তবে অনেকেই বেঁচে উঠেছে। ওদের ওই তন্ময় আর শিবু বলেছিল, ডাক্তারবাবু নাকি নিজেই খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন এই লোকগুলো কি করে এইটুকু অক্সিজেন সাপ্লাই পেলেই বেঁচে যাচ্ছে! এমন লোকের এমন ছেলে! নাহ। দত্তগুপ্ত মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ান। এই কেস নিয়ে আর ভাবার দরকার নেই। ক্লোজড কেস। বরং এখন ড্যামেজ কন্ট্রোলে পুলিশকে অনেক সময় দিতে হচ্ছে। রোজকার খুচরো কেসগুলো কমেছে বটে, সঙ্গে বেড়েছে অন্য কাজের বহর। অভিজাত পাড়ায় গিয়ে মাইকে মিষ্টি করে বোঝাতে হচ্ছে, কেন কেউ বাড়ির বাইরে আসবেন না। কখনও বিখ্যাত গানের প্যারোডি করে গেয়ে সেখানে মানুষকে একটা ফলস সেন্স অফ প্রিভিলেজ দিতে হচ্ছে। এখন অবশ্য লাশ পুড়িয়ে ফেলার সমস্যাটা কমেছে। এমনিতে প্রবলেম নেই। একটাই সমস্যা হয়েছে, রাতের ঘুম কেন যেন উড়ে গেছে। নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে শুয়েও ঘুম হয়না। 

সাহিল তন্ময় শিবু আর সরিতা চারটে সাইকেল নিয়ে বেশ দূরত্ব রেখেই চলছিল। তন্ময় প্রথম বলল -সাহিল, ঝুম্পাদির একটা খোঁজ দরকার রে। অনেক দিন হয়ে গেছে কিন্তু। এবার তো বেরিয়ে আসুক। কেউ তো নেই আর ও পাড়ায়। সাহিল একটু অন্যমনস্ক ছিল। সেভাবেই বলল -ঝুম্পাদির জন্য অতীনদার কথা অনুযায়ী বেশি রাতে যাই আমি। ওই বাড়িটার পেছনে এই গলিটার পাঁচিল আছে। বস্তিতে তো কেউ ঢুকবে না। কেউ তো যায়না। ওখান দিয়ে যাই আমি। ঝুম্পাদির জন্য সব পৌঁছে দিই। একটা ব্যাগ রাখা থাকে বাইরে। আমি তাতে সব ভরে দিয়ে আসি। ওই ব্যাগেই তো সেদিন ওই লাল খাতাটা পেলাম। কস্তুরীদিকে দিয়ে দেবো। কস্তুরীদি তো এ নিয়ে অনেক কাজ করছে। সরিতা সাইকেলে জোর প্যাডেল মারতে মারতে ওদের ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আজ রেশনে দারুন লাইন। ফ্রি চাল তুলতে হবে ওকে। যেতে যেতে বলে গেল -আমি যাবো আজ রাতে। আমায় নিয়ে যাস সাহিল। 

সুনন্দ চক্রবর্তী বসেছিলেন ঘরের মেঝেতে। অনেকদিন এভাবে এখানে বসেননি। সামনে শোয়ানো ছেলের শরীরটা। অতসী পাথরের মতো বসে। কেউই কারোর দিকে দেখছেন না। যেন অচেনা দুটো মানুষ। শুধু মাঝে শোয়ানো শরীরটা দুজনেরই চেনা। একটা দেওয়াল যেন ভেঙে পড়ছে। সুনন্দ একবার চোখ তুলে অতসীকে দেখলেন। কটা বছরই বা হবে? কুড়ি বছর আগেও দুজনে সহপাঠী ছিলেন। মাঝখানে কি একটা অন্ধকার সরণি? আলোহীন হেঁটে গেছেন? হাতও ধরেননি কেউ কারোর? অতসীর মুখে এখন ভারি ভাব একটা। বয়সের তুলনায় বেশিই দেখায়। তুলনায় সুনন্দ এখনও স্মার্ট হ্যান্ডসাম। একটা কেয়ারলেস ভাব আছে চেহারায়। এখনই বা তার এসব মনে হচ্ছে কেন? সুনন্দ নিজের ওপরে বিরক্ত হচ্ছেন। এটা তার একটা রোগ। খুব অল্পেই মুভড হয়ে যান। এখন যেমন হচ্ছেন। সুপ্র কেন এরকম করল? যা শুনেছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ কম। মত্ত অবস্থায় একতলায় পড়ে গিয়েছে। কতদিন অতসীকে বলেছেন! কোম্পানিকে বলো! ওটা রিস্কি! হয়তো অতসী বলেছে। তিনি জানেননা। অতসী তার মতন অল্পে দিশেহারা হয়না। স্থির। কিছুই টলাতে পারে না। এখন যেমন দেখে বোঝার উপায় নেই সত্যি ঝড়ের মুখে পড়েছে কিনা। 

এ বাড়ির সবসময়ের কাজের মহিলা শুক্লা খুব অবাক হয়। এরা কি অদ্ভুত! সে নিজে আছাড়ি পিছাড়ি কেঁদেছে। ছেলেটা খুব ভদ্র। কখনও উঁচু গলায় কথা বলত না। কথা আর বলতই বা কতটুকু? বাপ থাকেনা। মা ব্যস্ত। সদাব্যস্ত। ছেলেটা একাই তো বড় হলো। এই সময়ে খুব একা থাকতে হচ্ছে সকলকে। ফ্ল্যাটটা একটা করিডোর দিয়ে জোড়া। একদিকে মা আর একদিকে ছেলে। ওইটুকু ছেলে। স্কুল থাকলে তবু বন্ধুরা থাকে। এখন একদম একা। শুক্লা ভাবত ছেলেটার কথা। কিন্তু অতসী নিজেই বলেছিলেন -বড় হচ্ছে। থাকুক নিজের মতো। এখন শুক্লা নীরবে চেয়ে আছে। মাথায় একটা ঘিনঘিনে ব্যাথা। মা কেমন পাথর। এরা কাঁদে না। সে সরে যায়। এখন তো কেউ শোক জানাতেও চট করে আসবে না। তবু অতসীর বোন ভগ্নীপতি, সুনন্দর তিন চারজন ছাত্রছাত্রী এসেছে। সুনন্দ দেখছিলেন ছেলের মুখের দিকে। সুকৃত জানিয়েছে ঠিক কী হয়েছিল। পাঁচজন বন্ধু মিলে নাকি পড়াশুনো করছিল। ফ্ল্যাটের লেফট উইংটা ছেলের এক্সক্লুসিভ ছিল। অতসী নিজের ঘরে নিজের মতো ছিলেন। কিছুই নাকি টের পাননি। মাঝরাতে একটা ভারি কিছু পড়ার শব্দ হতে বেরিয়ে আসেন। 

বডিটা তখন করিডোরের ওপাশে ফাঁকা ল্যান্ডিং দিয়ে নীচে পড়ে ছিল। 

বাড়ি ঢুকে অর্ণব নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। মনীষা সমানে দরজা ধাক্কিয়ে গেছে -প্লিজ খোলো। খোলো দরজা। আমার ভয় করছে অর্ণব। কিন্তু অর্ণব দরজা খোলেনি। সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল তুতুন। মায়ের এমন পাগলের মতো কান্না আর দরজা ধাক্কানো দেখে কাছে এসে হাতটা ধরতে গিয়েছিল। মনীষা ছিটকে সরে গিয়েছে -ছুঁস না! ছিঃ! আমার ঘেন্না করছে তোকে! ভীষণ ঘেন্না করছে! তুতুন মাথাটা নীচু করে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। কোনো উপায় না দেখে নিজের ফোন থেকে সে ফোন করেছে -কাকামনি, তুতুন বলছি। -বল! বাবা কি ভাগ্য রে আমার! -কাকামনি একবার বাড়িতে এসো প্লিজ। ওপাশের গলাটা দ্বিধা জড়ানো -কেন রে? তোদের বাড়ি যাবো? মানে হঠাৎ? দাদার সঙ্গে দেখা হয় আমার। বউদি জানে তুই ফোন করছিস? -কাকামনি দেরি কোরো না। এখনই এসো। দেরি হয়ে যাবে। -কী হয়েছে বল তো? বাবা ঠিক আছে তো? হাসপাতালে যা অবস্থা! এবার ভেঙে পড়তে পড়তে তুতুন বলে -খুব খারাপ ব্যাপার। তুমি এসো। 

অতীন যখন এলো তখনও মনীষা থামেনি। অর্ণবও দরজা খোলেনি। ভেতরে এসে অতীন তুতুনের ঘরে উঁকি দিলো। 

-কিরে? এসব কী? দুজনে কি হাতাহাতি হল নাকি? 

তুতুন এরকম কথার ধরনে অভ্যস্ত নয়। কাকামনি খারাপ ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু এখন কিছুই মাথায় আসছেনা। সে চোখ তুলে মায়ের দিকে ইশারা করল শুধু। অতীন এগিয়ে এসে মনীষার হাত দুটো চেপে ধরল -কি হয়েছে বউদি? ঠাণ্ডা হও দেখি আগে। কি হয়েছে টা কি? মনীষার অতীনকে দেখে চমকানোর কথা। কিন্তু এখন সেসব মাথায় এলো না। মাথায় এলো না যে অতীন নিজেকে স্যানিটাইজ করেছে কিনা। বস্তিতে বস্তিতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাকে অন্য সময় হলে বিশ্রী করে বলা যেত। শিখিয়ে দেওয়া যেত যে এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। কিন্তু এ কথাটা এখন দারুন ঠাট্টা হয়ে গেছে। থমকে কান্না গিলে সে শুধু বলতে পারল -তোমাকে কে খবর দিলো অতীন? তোমার দাদা দেখো না দরজা খুলছেনা। অতীন মনীষাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো -আমি দেখছি বউদি। আমাকে কে আর খবর দেবে। তুতুন ফোন করল তো। তোমরা ঝগড়া করছিলে নিশ্চয়। মনীষা আবার উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল -ওই ছেলেটা ফোন করেছে? ছিঃ! তুমি ওর সঙ্গে কথা বললে? ছিঃ! 

অতীন বুঝতে পেরেছে ভয়ানক কিছু ঘটেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাদাকে বের করে আনা দরকার। ও দরজায় মৃদু নক করল -দাদা? একবার খুলবি? সরিতার মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রে। পুরনো রোগ যদিও। তবু। তুই একটু দেখে দিবি? নাকি ওষুধ দিবি? 

অতীনের কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল। দরজা খুলে গেল। বিধ্বস্ত অর্ণবকে দেখে চমকে উঠল অতীন -দাদা! কী হয়েছে তোদের? 

অর্ণব একটা কথাও বলছে না। যেন বোবা হয়ে গেছে। অতীন মনীষার দিকে চেয়ে বলল -বউদি, প্লিজ একটু চা দাও। খাই। তারপর দাদাকে নিয়ে যেতে হবে আমায়। রুগি সিরিয়াস। কই দাও? মনীষা প্রায় টলছে। টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকল। নীচে তুতুনের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছে অতীন। -কি হয়েছে বলবি? মা কেন তোর ওপরে এত রেগে? -সেটা মা বলবে তোমায়। নয়তো বাবা। -ঘটনাটা তাহলে তোকে নিয়েই! খুলে বল তুতুন। বড় বিপদ ডেকে আনিস না। -কাকামনি, তুমি আমার পার্সোনাল মোবাইলটা নিয়ে যাও। আমি এখন ওটা আর ইউজ করবনা। তুতুন বাড়িয়ে দেয় ওর ফোনটা। -ওতে আছে সব। দেখে নিও প্লিজ। দরকারে প্রিন্ট আউট নিয়ে রেখো। দরকার হতে পারে। 

-কি সব বলছিস বল তো? অতীন বুঝতেই পারছেনা। হঠাৎ পেছনে বহুকাল পর ও মনীষার গলা শোনে -অতীন, চা খাবে এসো। 

অর্ণবকে বাইকের পেছনে বসিয়ে অতীন যখন বারো নম্বরে এলো তখনও অর্ণব একটা কথা বলেনি। ও কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। সরিতাদের ঘরের সামনে একটুকরো ফাঁকা জায়গায় খাটিয়ায় শুয়ে আছে সরিতার মা। কত বা বয়স! মনীষাদের বয়সীই হবে! কিন্তু গরীব মানুষের বোধ হয় যৌবন বলে কিছু হয়না। সরাসরি কিশোরী থেকে বুড়ি। অর্ণব সরিতার মায়ের হাতটা হাতে নিলো। অতীন লক্ষ করল এ যেন একটা অন্য মানুষ। তুতুনের বাবা বা মনীষার স্বামী নয়। একদম অন্য মানুষ। 

সরিতার মায়ের সত্যি সত্যি সর্দি জ্বর। কাশি আছে। ওষুধপত্র যা চলবে বলে দিয়ে ওরা যখন বাইরে এলো তখন অতীনই জিজ্ঞেস করল -দাদা হসপিটালে যাবি? পৌঁছে দেবো? 

অতীনের থাকার একটা ছোট ফ্ল্যাট আছে। বারো নম্বরের বাইরেই একপাশে আস্তাকুঁড় আর একপাশে একটুকরো পার্ক। সেখানে একটুকরো জমির ওপরে ঘরটা ওদের সেবা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যোগাড় করতে হয়েছে জমিটা। সরকারি জমি। ক্লাবের জন্য পাওয়া সোজা। এরকম একটা কাজের জন্য নয়। প্রথমে সাহিল শিবু ওরা এটাকে ক্লাবঘর বলেই দরমার ঘর তুলেছিল। ক্যারাম খেলত একটা লম্বা তারে ঝুলোনো হলুদ আলোর নীচে। তারপর অতীন এলো। ঝুম্পার কলেজের দাদা। ওরা একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করল। সাহিল সরিতা শিবু তন্ময় নিতু সুবল সব ধীরে ধীরে জড়ো হতে শুরু করল। নাইট স্কুল হলো। তখনও অতীন ওদের পুরনো বাড়িতে দাদা বউদির সঙ্গেই থাকত। তারপর তো বউদির সাধের ফ্ল্যাট। সেখানে অতীনের থাকার জায়গা কই? অগত্যা বাড়ি বেচার টাকা পেয়ে অতীন বারো নম্বরের সামনে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ছোট ফ্ল্যাট নিলো। দরমার ঘরটা ওই পাকা করে দিলো। অতীন ফ্রিল্যান্স প্রফেশানাল রিসার্চের কাজ করে। একার জন্য ওর চেয়ে বেশি লাগেনা। 

আজ অর্ণবকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ও মনীষাকে ফোন করেছিল। একটা সেডেটিভ দিয়েছেন স্বামীনাথন। মা আর ছেলে দুজনেই যেন খায়। সেটা জানিয়ে দিয়ে বারবার বলেছে মনীষাকে শান্ত থাকতে। 

এখন নিজের ঘরে বসে ও তুতুনের মোবাইলটা খুলল। ছেলেটা লক সরিয়ে দিয়েছে। সব খোলা যাচ্ছে। নাড়তে নাড়তে অতীন হোয়াটসঅ্যাপ খুলল। খুব বেশি মিশুকে ছেলে তো নয়। কয়েকজনই আছে শুধু কনট্যাক্টে। একটা দুটো গ্রুপ আছে। একটা বেশি ব্যবহার হয় দেখা যাচ্ছে। স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ। অতীন কখনও তুতুনের খুব কাছের মানুষ হয়নি। মনীষা সরিয়ে রেখেছে চিরকাল। তাই ছেলেটার মনের ভেতরটা অত পড়তে পারেনা ও। তাই বলে এত অচেনা? আজ ওর মোবাইলের ওই স্কুল গ্রুপে ঢুকে শিউরে উঠল অতীন। এসব কি? এ কি দেখছে ও? স্ক্রল করতে করতে ছবিটা স্পষ্ট হয়। ক্রমে কিছু ছবিও বেরিয়ে আসে। একটা অস্পষ্ট চলমান ছবি ভেসে ওঠে অতীনের সামনে। 

কয়েকটা চোদ্দ পনেরোর কিশোর। সামনে কোনো মহৎ আদর্শ নেই। শুধু নিজের স্বার্থে পড়াশুনো করছে। অন্য কোনোভাবে পয়সা রোজগারের উপায় থাকলে তাই করত। এরা করে কি? নিজেদের নিয়ে কি করে দিন কাটায়? এরকম ফুর্তি মজা এসব শব্দগুলো আগে তোলা থাকত সমাজের নীচের তলার যারা আলো পায়নি তাদের জন্য। যারা সময়ের আগেই বড় হয়ে যেত। কিন্তু এখন তো চিত্র উলটে গেছে! এতক্ষণে অতীনের কাছে পরিষ্কার হয়। দাদা বউদি কেন তুতুনকে ওভাবে সরিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ অতীনের মনে হলো, একটা অন্য কি মেসেজ দেখল না ও? কাকে যেন তুতুন লিখছে, সুপ্র ওর একমাত্র হেডেক। ওটা না থাকলে বেঁচে যেত। ও দ্রুত সরিয়ে দেয় মেসেজটা। স্বামীনাথন বলেছিলেন। থানা থেকে ওকে আনতে গিয়েছিলেন দাদার সঙ্গে। দুঃখ করে মাথা নাড়ছিলেন -ভেরি স্যাড ইনডিড। ওনার কাছ থেকে অতীন শুনেছে খানিকটা। কিন্তু মানুষটাই এমন যে কারোকে ছোট করে কথা বলেন না। ইন ফ্যাক্ট ঘটনাটা এভাবেই বলছিলেন যে মনে হচ্ছিল ওনার কোনো পেসেন্টের সাডন ডেথ হয়ে গেছে, বা...বা...আরোগ্যহীন কোনো ব্যাধি...কিন্তু ব্যাধিটা সংক্রামক নয়? 

নাহ, আর মেসেজ দেখতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা বন্ধ করে অতীন নিজের ফোন খোলে। প্রাচী ট্রাস্টের সঙ্গে ওর একটা প্রোজেক্ট ছিল। সুনন্দ চক্রবর্তী কী পারসন। এমনিই অসুখজোয়ার ওদের কাজটাকে থামিয়ে রেখেছে। তার ওপরে এ আর এক অসুখ। 

রাতে ভালো ঘুম এলো না। কখনও কখনও মনে হয় এই এপিডেমিক ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কত কাজ! এত এত কাজ! আর বাঁচিয়ে দিয়েছে ওই চালচুলোহীন ছেলেমেয়েগুলো। আজ একটু অপরাধী লাগছে নিজেকে। আত্মীয় পরিজনহীন জীবনে অভ্যস্ত হলেও মনে মনে জানে যে দাদা আছে। খুব বেশিরকম আছে। অতীন কি নিজেও জোর করে তুতুনের সঙ্গে কথা বলতে পারত না? নাকি ওর মধ্যেও একটা উন্নাসিকতা কাজ করেছে? বড়লোকেদের সঙ্গে বেশি মিশতে নেই। প্রাইড অফ আ মিডলক্লাস ইউথ! 

সারাটা রাত মনীষা নিজের ঘরে গুম হয়ে বসে রইল। তুতুনও তাই। দুঘরে দুটো ভুতের মতো। মনীষার সাধের গাছে জল পড়ল না। ভোর হলে ময়লা ফেলার গাড়ির সিটি বাজিয়ে চলে গেল। কিচেনে কারোর শব্দ পাওয়া গেল না। মনীষা ভাবছিল, এসময়ে এই অসুখে মারা গেলে যেমন অসম্মানের সঙ্গে দাহ করা হয় ঠিক তেমনই ওরাও যেন অপমানে পোড়া লাশ। ভেতরটা মরে গেছে। শরীরের নড়াচড়াটা বেঁচে থাকা নয়। বাবার কথা মনে পড়ছে। মনীষা একেবারেই যেত না ও বাড়িতে। বাজে লাগত। বাবার কেবল ধমক। নিজের কথাকেই গুরুত্ব দেওয়া। ভালো লাগত না। পাড়াভর্তি অভিভাবক। সবাই শাসনের অধিকার রাখে। আজ মনীষার মনে হলো, ভালোই ছিল সেদিনগুলো। 

শুধু তুতুন ল্যাপটপ খুলে দেখতে পেলো স্কুলের অনলাইন ক্লাস থেকে তাকে রিমুভ করা হয়েছে। মাথাটা কাজ করছিলনা তাই প্রথমে বুঝতে পারল না। কেন হল এমন? তারপর ধীরে ধীরে পরিষ্কার হল। সুপ্রতীক তো নেই। বাকি যারা সেদিন ওখানে ছিল তাদের প্রত্যেককেই ক্লাস থেকে রিমুভ করা হয়েছে। তুতুন অস্থির হয়ে পড়ল। ফোন নেই আর। এই ফিক্সেসান থেকে বেরোতেই কাকামনিকে ফোন দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন? ও তাড়াতাড়ি সেদিনের গ্রুপের সকলের ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠালো। কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করল, কেউই মেসেঞ্জারে নেই। অথচ ও জানে সেদিন ও একা নয়, সকলকেই থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের বাবা এসে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অভিভাবকেরা কেউ কারোর সঙ্গে একটা কথাও বলেননি। মাথাগুলো সব নীচুই ছিল। একটা মানসিক ক্লান্তি এমন চেপে ধরল যে ও গুটিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল। 

কলিং বেলের শব্দে মনীষার প্রথম ঘোর কাটল। তবে কি অর্ণব ফিরল? ইস, ছিঃ! এত ভালো লোক, এত বড় ডাক্তার, মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলো ছেলেটা! তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতে গেল মনীষা। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মাধু। 

-কি গো বউদি? ফোন করলে না? আমি তো রোজ ভাবছি বউদি এবার ফোন করবে। ইস কত কষ্ট হল তোমার! সরো, ঢুকি। আমি সব সঙ্গে এনেছি। ছাদে যাই। জামাকাপড় ছেড়ে কেচে দেবো। মাস্ক কাচব। হাতপা ধুয়ে আসছি দাঁড়াও। মনীষা কথা বলতে পারছে না। মাধু একবার তুতুনের ঘরের দিকে উঁকি দেয়। আহা গো, ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদা তো হাসপাতালে ও জানে। মাঝে মাঝে বারো নম্বরে গেলে দেখাও হয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মাধু ফিরে চাইল -বউদি চা আনব? মনীষা ঘাড় কাত করে। মাধু মনীষার মুখের মধ্যে খুঁজতে থাকে কিছু। বউদি এরকম হয়ে আছে কেন? যেদিন বাবা মারা যায় সেদিনও তো এমন চেহারা ছিল না? সারাটা দিন মাধু ঘরদোর গুছোতে থাকে। এটা পরিষ্কার ওটা গুছনো। গাছের স্প্রে। রান্নাঘরের তাক। বাড়িটা যেন শুধু মাধুর আসার অপেক্ষায় ছিল। একটা মানুষ এতটা প্রাণ নিয়ে আসতে পারে? মনীষার বুকের ভার হালকা হয়। 

স্বামীনাথন এসে অর্ণবের পাশে পাশে হাঁটছিলেন। -সি? হাও ইরেস্পন্সিবল দিজ ডক্টর তপাদার ইজ? নাও দ্যাট দুবে ক্যান সি হিজ অনকো পেসেন্টস, দিজ জেন্টলম্যান ইজ নট কীন অন স্টার্টিং ওপিডি রাইট নাও! এন্ড হোয়াট এবাউট ইয়োর কার্ডিয়াক পেসেন্টস? তোমার কি মনে হচ্ছেনা ওদের এবার ডেকে নেওয়া দরকার? 

অর্ণবের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। স্বামীনাথন যেন একটা ভরসা দেওয়াল। তাই শুধু পাশে থাকাটাই অনেক মনে হচ্ছে। এর মধ্যে শঙ্খর ফোন এসেছিল -এই, রাগ করিস না। আয়াম সরি। সত্যি রে। বাবা তো জানিস। দুবেই তো দ্যাখে। কিছু হয়ে গেলে কি করতাম বল। এন্ড হার্ড এবাউট ইট। প্যাথেটিক। ছেলেরা এ বয়সে এরকম করতে পারে। নো নো আয়াম নট এট অল জাস্টিফাইং। বাট সেয়িং কি এরকম ভুল হতে পারে। বাট দ্যা চাইল্ড ডায়েড, দ্যাট ইজ আ স্যাড কেস, কোয়ায়েট আনফরচুনেট। ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখিস। আমি আসছি। বিকেলে চেম্বার করব। কাল থেকে পেন্ডিং ওটি শুরু। ডান? কিরে? কথা বলছিস না? স্বামীনাথন কাঁধে হাত রাখেন। অর্ণব খুব কষ্টে বলে -হুঁ। 

সন্ধ্যের আকাশে তারাগুলো খুব উজ্জ্বল। যেন অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। পলিউসান লেভেল এত কমেছে যে আকাশটা ঝকঝক করছে। মনীষা ওর গন্ধরাজ গাছটার পাশে রট আয়রনের চেয়ারটায় বসেছিল। উলটো দিকের টাওয়ারে ওদের মুখোমুখি ডুপ্লের ছাদে কমবয়সী বউটি হাঁটছে। ছাদে একটা জিম করেছে ওরা। জগ করছে। হঠাৎ মনীষার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল -হাই মিসেস গুপ্ত। হ্যালো। মেয়েটা খুব প্রাণবন্ত। অনেকদিন পর কথা হল। মনীষা হাত নাড়ল। হাসি মুখে বলল -হ্যালো। কেমন আছো? খিলখিল হাসির সঙ্গে উত্তর এলো -ভালো। একদিন আসুন না। জিমে আপনিও ওয়ার্ক আউট করবেন। আর আমিও একদিন আপনার গন্ধরাজ গাছ থেকে ফুল নিয়ে গন্ধ শুঁকব। হা হা হা। সাবলীল হাসে মেয়েটা। মনীষা হেসে ফ্যালে -নিশ্চয়, এনি ডে। -যাবো কিন্তু। মেয়েটা হাত নাড়তে নাড়তে নেমে যায়। মনীষা চুপ করে বসে থাকে। মাধু আসার পর আর এই মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে। মাধু এখন থাকবে। ওদের ওখানে এখন বাইরে থেকে সব ফিরে আসছে। ওইটুকু তো সব ঘরদোর। শিবুদের দুই দাদা পরিবারসহ ফিরছে। নিতাইয়ের বাবা। কালিপিসির ছেলের পুরো পরিবার। এরা সব এক এক জায়গায় কাজ করত। চাকরি চলে গেছে। ফিরে আসছে। ওদিকে তো দাদা বলেছেন দূরে দূরে থাকতে। মাধু তাই নিজের ঘরটা ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ও একা মানুষ। ছাদের ওপরে চিলেঘরটায় থেকে যাবে। মনীষা হাতে চাঁদ পেয়েছে। থাকুক মাধু। লোকের মুখ দেখতে না পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছিল। 

মাধুর ডাকে ও এখন ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে। রাত হল। তুতুনকে মাধু ঘরেই খাবার দিয়ে এসেছে। ভালোই হয়েছে। কী যে হয়েছে মাধু বুঝতে পারছেনা। মা ছেলে এমন বোবা হয়ে আছে কেন রে বাবা! -দাদা কি আসবে বউদি? মনীষা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দেখে মাধু নিজেই ফোন করে -দাদা আমি মাধু। -বুঝেছি। কি হয়েছে রে? কে কে ফিরল? -এখনও কেউ ফেরেনি। হাঁটতে শুরু করেছে মাত্র সাতদিন তো। এত রাস্তা। আরও সময় লাগবে দাদা। -তাহলে? কেউ অসুস্থ? -হ্যাঁ দাদা। বউদি অসুস্থ। বাড়ি আসুন। 

বাড়ি তো ফিরতেই হবে। অতীনও ফোন করেছিল -দাদা, বাড়ি ফিরে যা। আমরা বসে ভাবব কি করা যায়। এরকম ভেঙে পড়িস না প্লিজ। -অসুখটার কোনো কিওর বেরোয়নি, জানিস। নো রিমেডি। -দাদা, কিওর থাকবেই। শুধু আমরা এখনও জানতে পারিনি। ইন ফ্যাক্ট আমাদের আরও আগে খোঁজা উচিত ছিল। তুতুনের দিকে দেখা উচিত ছিল। একটু ধৈর্য ধর। -বলছিস? নতুন ওষুধ তো দেখতে হবে কাজ করছে কিনা? -হ্যাঁ। দেখতে হবে। ট্রায়াল এন্ড এরর বেসিসে। -কোল্যাটারাল ড্যামেজের কি সুরাহা হবে? -দাদা, আমরা মানুষ নিয়ে কথা বলছি। জীবাণু নিয়ে নয়। -জানি তো! আমিও তো মানুষ নিয়ে কথা বলছি! ড্যামেজ হ্যাজ অলরেডি বিন ডান অতীন।

0 comments: