ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকচিকেন রোল, মাসালা দোসা আর চিলি চিকেন
সময়টা গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি। হুগলীর নাপিত পাড়া লেনের পাট চুকিয়ে আমরা পাকাপাকি এই মহানগরের বাসিন্দা। বাবা বাড়ি ভাড়া নিলেন দক্ষিণ কলকাতার দুর্গাপুর ব্রিজ সংলগ্ন গোবিন্দ আড্ডি রোডে। আমরা চার ভাইবোন, মা-বাবা আর আমাদের ঠাকুমা, যাকে আমরা বড়মা বলে ডাকতাম। আমি ভর্তি হলাম চেতলা বয়েজ হাই স্কুল-এ। সত্যি বলতে প্রথমদিকে কলকাতার পরিবেশ আমার একেবারেই ভাল লাগত না। আশৈশব কাটিয়ে আসা জায়গা, বন্ধুরা, স্কুল – সবকিছুর জন্যই তখন এক অদম্য টান অনুভব করছি। এইসময়েই তৈরি হল কিছু নতুন বন্ধু – স্কুলে ভাস্কর, স্কুলের বাইরে বুবু আর বুঢঢা। এই নতুন বন্ধুত্ব খুলে দিল এক নতুন দিগন্ত। শুরু হল কলকাতার রাস্তায় হাঁটা। আমাদের স্কুলের লাগোয়া চেতলা ব্রিজ ধরে রাসবিহারি অ্যাভেন্যু ধরে রাসবিহারি মোড়, লেক মার্কেট, দেশপ্রিয় পার্ক হয়ে গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে বালিগঞ্জ স্টেশন। এই পথেই রাসবিহারি মোড়ে রেকর্ডের দোকান মেলোডির ঠিক সামনে বুবু একদিন দাঁড়াল একটা ছোট্ট দোকানের সামনে, যার নামটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। চলার পথে। বুবু জিগ্যেস করল, ‘রোল খাবে?’। কিছু না ভেবেই আমি বললাম খাব। সেই প্রথম। জানতাম না নিজের অজান্তেই আমি এক আশ্চর্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছি। পরোটার মধ্যে কয়েক টুকরো কাটি (অথবা কাঠি) কাবাব আর তার সঙ্গে টাটকা পেঁয়াজ, কুচোনো কাঁচালঙ্কা আর ওপর দিয়ে আলতো করে ছড়িয়ে দেওয়া একটা মসলা – তার শেষ পরিনতি যে এমন স্বর্গীয় হতে পারে, তা একমাত্র ভোগী মানুষই জানেন। ১৯৩২ সালে শুরু হওয়া নিজাম রেস্টুরেন্ট এই সুখাদ্যটির জন্মদাতা – যার উদ্ভব শোনা যায় খানিকটা আকস্মিকভাবেই। কলকাতার ‘স্ট্রিট ফুড’ পরিবারের মুকুটে যোগ হল এক স্বর্ণ-পালক – ক্রমে ক্রমে যার খ্যাতি ছড়িয়ে গেল কলকাতার বাইরেও, এমনকি দেশের গণ্ডীও অতিক্রম করল। যদিও একথা বলতেই হচ্ছে যে প্রথম খাওয়া সেই রোলের স্বাদ ছিল অনেকটা বাঙালি রসনার কাছাকাছি। শহর কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা অজস্র রোলের দোকানের মধ্যে যাদের রোলের স্বাদ কখনও ভোলা যাবে না, তাদের মধ্যে নিজাম ছাড়া পার্ক স্ট্রিটের ‘কুসুম’, গড়িয়াহাটের ‘নবাব’ বা ‘বেদুইন’ এর নাম উল্লেখ করতেই হয়। আর এই রোল কত অসংখ্য প্রকারের হয়, সেকথা বলতে গেলে আলাদা পরিসর দরকার। তবে এ প্রসঙ্গে একটা বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হয়। নিউ এম্পায়ার –এ ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ দেখতে গেছি, হঠাৎ আমাদের এক বন্ধু বলল, ‘বিফ রোল’ খাবি? ‘বিফ রোল’? যে পরিবারে জন্মে বড় হয়ে ওঠা, সেখানে বিফ শব্দটির উচ্চারণও একসময় নিষিদ্ধ ছিল বলা যায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই গোমাংসের আস্বাদন যারা করেছেন, তাঁদের মুখে এই বস্তুটির বিশেষ প্রশংসা শুনেছি। তাই সেদিন এককথায় রাজি হয়ে গেলাম আর অনতিদূরে ‘বিহার রেস্টুরেন্ট’-এ হাজির হলাম সদলবলে। অতঃপর সেই ঘটনাটি ঘটলো। পরোটার খোলের মধ্যে এল গোমাংসের পুর ভরা সেই অনাস্বাদিতপূর্ব ‘বিফ রোল’। জীবনে প্রথম। এরপর বহুবার বহু জায়গায় ‘বিফ রোল’ খেয়েছি; কিন্তু ওই স্বাদটি আর কখনও খুঁজে পাইনি।
এইসময় অন্য যে খাদ্যবস্তুটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তার সঙ্গে ফরাসি রান্নাঘরের নিবিড় যোগ। ফরাসি ক্রেপ – এর ভারতীয় সংস্করণ (নাকি বলব দক্ষিণ ভারতীয়) মাসালা দোসা। তখন রোজই প্রায় আমি আর বুঢ্ঢা বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরতাম। সেইরকমই কোনও একদিন আমরা হাজির হলাম প্রেমভিলা–য়। আলাপ হল মাসালা দোসার সঙ্গে। এক কাপ চাল আর সিকি কাপ বিউলির ডালের গুঁড়োর একটু দানা দানা ব্যাটার তৈরি করে আলাদা আলাদাভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। পরে দুটিকে নিয়ে পরিমাণ মত জল আর নুন মিশিয়ে একটু তরল করে নিলেই মিশ্রণটি তৈরি। এরপর সামান্য তৈলাক্ত তাওয়াতে মিশ্রণটি সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে তার মাঝে দিতে হবে সরষে-পেঁয়াজ-কারিপাতা ফোড়ন দেওয়া আলু-পেঁয়াজের একটা অপূর্ব সুন্দর মাখামাখা তরকারি গোছের জিনিস। ততক্ষণে তাওয়াতে নরম আঁচের মধ্যে থাকা পাতলা রুটির মত জিনিসটি মুচমুচে হয়ে উঠেছে। এইবার সেটিকে খামের মত মুড়ে দেওয়ার পালা। এতক্ষণে মাসালা দোসা তৈরি। দক্ষিণ কলকাতায় ভাল দোসা পাওয়া যায় এমন জায়গাগুলির মধ্যে একটি ছিল হিন্দুস্তান পার্কের ‘সাউথ ইন্ডিয়ান ক্লাব’, যেটি এখন আর নেই। তবে এই জায়গাগুলির বাইরে সেরা দোসার স্বাদ পেয়েছি আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। সে আরেক গল্প।
কলকাতায় আসার পর আমরা থাকতে শুরু করেছিলাম দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে, যার অন্যপ্রান্তে ছিল নিউ আলিপুর। ব্রিজ যেখানে শেষ, সেখানে বাঁদিকে ঘুরলেই একটা ছোট চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কওলুন, যা আজও আছে। মনে পড়ে, চিনা খাবারের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় এরও অনেক আগে, যখন আমরা, বিশেষত আমরা দুই ভাইবোন যখন বাবার অফিসে যেতাম, বাবা মাঝেমাঝে আমাদের নিয়ে যেতেন পার্ক স্ট্রিট-এর পিপিং রেস্টুরেন্ট এ। শৈশব-কৈশোরের গন্ধমাখা সেই খাবারের স্বাদ এখনও ভুলিনি। কওলুন-এর অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের বাইরে সেই প্রথম চিনা খাবারের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত। কওলুনে আমরা কখনও বসে খাইনি, খাবার নিয়ে আসা হত আর যে বিশেষ বস্তুটি এই খাদ্যতালিকায় সবসময়েই থাকত, তা হল চিলি চিকেন। ইন্ডিয়ান চাইনিজ বলে যে পৃথক একটি রন্ধনশৈলীর সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্তর্গত একটি বিশেষ পদ হল এই চিলি চিকেন। জনপ্রিয়তার নিরিখে অন্য আরেকটি খাদ্যের কথা ভাবা মুশকিল যা চিলি চিকেনের সঙ্গে তুলনীয়। আর এই ইন্ডিয়ান চাইনিজ–এর জন্ম আমাদের এই শহরেই। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইউ চু এখনও এই শহরেই বিদ্যমান। মধ্য কলকাতা আর ট্যাংরা অঞ্চলে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন অনেক অনামি রেস্তোরাঁ, আজও যাদের রান্না খেয়ে চমকে উঠতে হয়। আর সর্বত্রই কলকাতার খাদ্যরসিক যে পদটি অজান্তেই খোঁজ করেন, তার নাম যে চিলি চিকেন, একথা লেখার জন্য পরিসংখ্যানের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। হাড়সমেত অথবা হাড়ছাড়া মুরগির মাংস প্রথমে নুন-মরিচ, কাঁচা ডিম, রসুনবাটা, সয়া সস, কর্ণ ফ্লাওয়ার দিয়ে মেখে রাখতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর কড়াইতে তেল গরম হলে মাংসের টুকরোগুলি বাদামি করে ভেজে তুলতে হাবে। এরপর কড়াইতে আবার তেল গরম হলে পেঁয়াজ (একটু বড় করে কাটা) আর রসুনকুচি দিয়ে মিনিট খানেক ভেজে তাতে দিতে হবে কাঁচালঙ্কা কুচি। পেঁয়াজ-রসুন- কাঁচালঙ্কার সম্মিলিত সুবাস নাসিকা রন্ধ্রে প্রবেশ করামাত্র ভাজা মাংসের টুকরোগুলি তাতে দিয়ে ক্রমে ক্রমে দিতে হবে সয়া সস আর ভিনিগার। এই পুরো সময়টি জুড়ে কিন্তু গ্যাসের আগুন কমানো যাবে না একেবারেই। চিনা রান্নার সারমরম হল স্টার ফ্রাই – যা ছাড়া প্রত্যাশিত স্বাদ কখনও আসতে পারে না। এইবার ক্যাপসিকামের টুকরো আর আদাকুচি দেওয়ার দেওয়ার পালা আর শেষে অল্প জলে সামান্য কর্ণ ফ্লাওয়ার গুলে মিশিয়ে দেওয়ার সময়। রান্না চলবে আরও মিনিটদুয়েক আর দেখতে দেখতে চোখের সামনে বদলে যেতে দেখব সামনে গ্যাসের ওপরে কড়াইয়ের মধ্যে থাকা মাংসের টুকরোগুলির চেহারা – এক সুঘ্রাণ ততক্ষণে গ্রাস করেছে রাঁধুনিকে।
0 comments: