0

গল্প - দিলশাদ চৌধুরী

Posted in


- কে? কে? চোর...চ..চ..চোর... চোর..
- সে কি মশায়! ভদ্রলোকের ছেলে, চোর হতে যাব কেন? চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি! চোর চুরি করতে এসে কি চেয়ার পেতে বসে থাকে! দেখেছেন কোনদিন?!
- আ...আপনি কে? ঢুকলেন কি করে?!
- যেভাবে আপনি ঢুকেছেন... বাড়ির মালিক জানে আপনি এখানে?
- আরে আশ্চর্য! এটা আমার পিসিমার বাড়ি।
- হ্যা। তাকে তো বিকেলে ন্যাড়াপাড়ার শ্মশানে ঠাঁই দিয়ে এলেন। সে কি করে জানবে আপনি এখানে? এখন আপনিও যা আমিও তাই...

রঞ্জনবাবু অবাক হয়ে গেলেন। এ ব্যাটা জানল কি করে! বাড়ির উপর নজর টজর রাখছে নাকি?! আধঘুম ভেঙে যদি কেউ দেখে বিছানার পাশে চেয়ার পেতে কেউ বসে আছে তাহলে যে খুব ভালো অনুভূতি হয়না বলাই বাহুল্য। রঞ্জনবাবুরও তাই। আজ সকালে হন্তদন্ত হয়ে এ বাড়ি এসেছেন মন্দ পিসির মৃত্যুর খবর পেয়ে। পিসির নাম মন্দাকিনী, ছোট করে সবাই ডাকত মন্দা। রঞ্জনবাবু আর তার বোন রমিতা ডাকত মন্দপিসি। রমিতা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল গত বছর। আর মন্দপিসি পরপারে চলে গেলেন কাল রাতে। ফোন করে খবরটা দিয়েছিল বাড়ির ছুটা কাজের মহিলাটি। অবস্থা খারাপ হওয়ায় মহিলাটি রাতে থেকে যায়। মন্দপিসি নিঃসন্তান বিধবা। তাই, রঞ্জনবাবুকেই শেষ কাজ করতে হলো। সন্ধ্যায় উকিলবাবু এসেছিলেন, শোক জানিয়ে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। হিসেবমতে মন্দপিসির মফস্বলের এই বাড়ি, বাড়ির সব জিনিসপত্র, ব্যাংকে ৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা আর পুরনো কিছু গয়না সবই এখন পাবে রঞ্জনবাবু। রঞ্জনবাবুর বয়স ৩৬, একটা রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ করেন। বিয়ে করেন নি, করার ইচ্ছাও ছিলনা। কিন্ত আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ করে এতকিছুর মালিক হয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে বিয়েটা করে ফেলাই উচিত। রাতে শোয়া অব্দি সব ঠিকই ছিল। সবগুলো দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করেই শুয়েছিল। বাড়িতে অন্য আর কেউ নেই। মাঝরাতে কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, ডিমলাইটের হলদে আলোয় উঠে দেখেন এই লোক চেয়ার পেতে ঘরের মধ্যে বসে আছে। বেটেমতো মোটাসোটা লোকটি, পোশাকে আশাকে তো ভদ্রলোকই মনে হয়। কি চায়! কেন এসেছে! পাগল নয় তো! হোক পাগল, কিন্ত ঢুকল কি করে?!
- আপনি বেরিয়ে যান, যান বলছি।
- বেরোব, কাজে এসেছি। কাজ শেষে বেরিয়ে যাব। তার আগে এক কাজ করুন তো। গোটা তিনেক সন্দেশ নিয়ে আসুন।
- সন্দেশ! রাত বিরেতে সন্দেশ পাব কোথায়!
- কেন? মরা বাড়িতে তো উনুন জ্বলেনা। যারা মরা দেখতে আসে, তারাই তো নিয়ে আসে সন্দেশ। 
- এই দেখুন, আপনি কে জানিনা। তবে যেই হোন, বেড়িয়ে যান। আমি নইলে পুলিশ ডাকব!
- আরে বললুম তো কাজে এসেছি!
- কি কাজ শুনি?! রাত-বিরেতে অন্যের বাড়িতে কাজ কেবল চোর ডাকাতদের থাকে, বুঝেছেন?!
- বুঝেছি। তবে আমি চোর ডাকাত নই। আমি কবি, কাব্য লিখি। জীবনানন্দ দাশ, নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?! অবশ্য নাও শুনতে পারেন, বলা যায়না। রবি ঠাকুর তো নই আমি যে সবাই চিনবে..োল

রঞ্জনবাবু এবার নিশ্চিত হলেন, এ ব্যাটা নির্ঘাত পাগল। তার মনে আছে, ছোটবেলায় পূবপাড়ার যে বাড়িটায় থাকতেন, তার দুটো বাড়ি পড়েই ছিল নান্টুদের বাড়ি। নান্টুর ভালো নাম আফজাল, রঞ্জনবাবু রোজই ওদের বাড়ি যেতেন ওর সাথে খেলতে। সেই নান্টুদের বাড়িতে একবার পাগল ঢুকে পড়ল। আরোগ্য সুধা নিকেতন থেকে দেয়াল টপকে পাগলটা পালিয়ে এসেছিল। দিব্বি ভালোমানুষের মত এসে জল খেতে চাইল। নান্টুর মা যেই না জল আনতে ভেতরে গেলেন, অমনি ঘরে ঢুকে নান্টুর বুড়ো দাদীমার লাঠি ছিল বসার ঘরে, সেখানা নিয়ে ঘরের জিনিসপত্র পিটিয়ে পিটিয়ে ভাঙতে লাগল। তারপর হঠাৎ গায়ের সব জামাকাপড় খুলে... ছিঃ ছিঃ, সে এক ভয়ংকর অবস্থা! তবে মনে হয়না এ ব্যাটা তেমন ডেঞ্জারাস। যাই হোক, চটানো যাবেনা। কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে সুযোগ বুঝে চট করে পুলিশ ডাকলেই হবে।

- আপনি জীবনানন্দ? 
- আজ্ঞে। 
- তাহলে একটা কবিতা মুখস্থ শোনান দেখি।
- আ মশাই... কি বলছেন! জীবনে কোনদিন দেখেছেন কোন কবিকে নিজের কবিতা মুখস্থ করে ঘুরতে? আর যদি মুখস্থ থাকেও, আপনি বুঝবেন কি করে ঠিক না ভুল? 
- কেন? বুঝব না কেন?
- এমন ভাব করছেন যেন আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে... অত সোজা নয়, বুঝেছেন? পড়েছেন আমার কবিতা? আমার কবিতা হলো স্বর্গের পুষ্পবৃষ্টির মত, মাথায় হুট করে হয়ে যায়। শশীর মিষ্টি খেয়েছেন? মুখে দিলে চট করে মিলিয়ে যায়। আমার কবিতা তেমন, পড়লে বুঝবেনই না কি পড়লেন... কিন্ত স্বাদ রয়ে যাবে। 
- তাই নাকি?!
- তবে আর কি! আজকাল তো দুলাইন লিখেই সবাই ছাপতে বেড়িয়ে পড়ে। ভরা পেটে আর খালি মনে কি আর কাব্যি হয়?! যাই হোক, শুনুন... যে কাজে এসেছি। আপনার পিসিমার একটা ট্রাঙ্ক আছে, কোথায় আছে খুঁজে বার করতে হবে। চলুন।
- মানে? পিসিমার ট্রাঙ্ক আপনি জানলেন কি করে? 
- ওমা! জানতে পাবোনা কেন?
- জানতে পাবেনই বা কেন?
- ট্রাঙ্কটা আমার।
- মামাবাড়ির আবদার! এতদিন মনে পড়েনি, আজ এসেছেন ট্রাঙ্ক নিতে।
- শুনুন, নিতে আসিনি। দেখতে এসেছি। চলুন,খুঁজে দেবেন।
- আপনি কি করে বুঝলেন ট্রাঙ্ক আপনার?
- আরে মশাই.. আচ্ছা শুনুন, চুপিচুপি বলছি। কেউ জানলে আবার চুরি হয়ে যাবে। ট্রাঙ্কে লেখা আছে।
- কি?! কার লেখা? কিসের লেখা?
- তা জানিনা... কিন্ত ট্রাঙ্কে রাখা যেহেতু, মনে তো হচ্ছে আমারই।
- ইয়ার্কি করছেন?! অ্যা!! বেরোন, বেরোন বলছি ঘর থেকে... 
- আরে, খুঁজেই দেখুন না... জীবনানন্দের কবিতা, জানলে হইচই পড়ে যাবে। অবশ্য আজকাল যারাই ভালো লেখে, একদিক থেকে সবই আমার। জীবনানন্দ না পড়ে তো আর কেউ ভালো লিখিয়ে হয়নি, নয় বলুন? যারা লিখছে সবার লেখাতেই আমার ছাপ আছে।
- জানিনে, আমি জানিনে।
- সে না জানুন, থাকগে। চলুন এখনি, খুঁজে দেবেন।
- এ কি বিপদ হলো!
- এখনি চলুন, নইলে প্রতিদিন এসে জ্বালাব! আমাকে তাড়াতে পারবেন না, এই বলে দিলুম।

রঞ্জনবাবু কাঁদোকাঁদো মুখ করে বিছানা থেকে নামলেন। তারপর দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছনে ফিরে দেখলেন, একি! ঘর তো সম্পূর্ণ খালি... কোন অন্য মানুষ নেই। হতভম্ব হয়ে ডানদিকের দেয়ালে হাত দিয়ে এলইডি বাল্ব জ্বাললেন। নাহ, কোথাও কেউ নেই। এক পলকের মধ্যে এভাবে এখান থেকে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। গেল কোথায় তবে লোকটা! সাইড টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধু অশোককে ডায়াল করতে গিয়েও করলেন, এতরাতে এসব বললে নির্ঘাত বলবে যে সে স্বপ্ন দেখছিল।
বাকি রাতটা রঞ্জনবাবু বিছানায় বসেই কাটালেন। পরের দিন সকাল হওয়ার সাথে সাথে চলে গেলেন পিসিমার ঘরে। একটু খোঁজ করতেই খাটের নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কের ডালা খুলে ভেতরে দেখা গেল দিস্তা দিস্তা কাগজ। রঞ্জনবাবু কাগজগুলো বের করে আনলেন, প্রত্যেকটিতেই কবিতা লেখা। শিরোনামের পর গোটা গোটা অক্ষরে লেখকের নাম, মন্দাকিনী সেন। রঞ্জনবাবু একের পর এক কবিতা পড়তে শুরু করলেন। 

" বিস্তৃত সুখের পালা শেষ 
আজকাল আর সুখের নহবত
বাজেনা তেমন। ডেকে নেয়না
আর কেউ বারান্দায়। এসো, দেখো
পক্ষীমাতা কেমন বেঁধেছে বাসা,
দেখে যাও, খুঁজে নাও সুখ
ওই নতুন বাসার খড়কুটোর 
ভাঁজে ভাঁজে। তুমিও ইচ্ছে হলে
স্বপ্ন দেখে ফেলো এক নতুন আঙিনার
যেখানে বয়স হয়েছে নাকি হয়নি
সে আক্ষেপ থাকবেনা। সময় হয়েছে
নাকি হয়নি, কেউ খবর রাখবেনা।
নিখোঁজ হয়ে যাওয়াই এখন সাধ,
আর চাইনা কেউ খুঁজে দেখুক অন্তর,
নিখুঁত হতে চেয়ে চেয়ে অনৈক্য
হয়েছে প্রাণের সাথে। আজ তাই
চাচ্ছি প্রাণ হোক খড়কুটো যেমন।"

কবিতা পড়া শেষ করে রঞ্জনবাবু ভাবতে বসলেন। কবিতার ভালো মন্দ সে তেমন বোঝেনা। অনার্স করেছেন ফিজিক্সে, সাহিত্যের প্রতি টান কোনদিনই তেমন বোধ করেননি। রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন কিছু কিছু, জন্মদিনের উপহারে পাওয়া। আচ্ছা, কবিতাগুলো ছাপলে কেমন হয়! বই ছাপাতে কি খুব বেশি টাকা লাগে? লাগলেও সেটা কত? ফোন হাতে নিয়ে বন্ধু অশোককে ফোন দিলেন।
- হ্যারে অশোক..
- হ্যা বল, কাজ সব মিটল?
- হ্যা মিটেছে। আচ্ছা শোন, কবিতার বই কোথায় ছাপে রে? পিসিমার কিছু কবিতা খুঁজে পেয়েছি, ভাবছি ছাপব। পিসিমা বেশ কিছু টাকাও রেখে গেছেন।
- ছাপবি ভালো কথা। কিন্ত ছেপে লাভ নেই। জ্যন্ত মানুষের কবিতাই কেউ পড়েনা, আর ইনি তো মরেই গেলেন। আর ইনি তো আর রবি ঠাকুর বা জীবনানন্দ নন!
- তা হোক। তবু ছেপে রাখি।
- এখন আবেগে বলছিস, পরে পস্তাবি।
রঞ্জনবাবু ফোন নামিয়ে রাখে। অশোক কিছু ভুল বলেনি। আজকাল কেই বা পড়ে কবিতা! থাক, ছাপিয়ে কাজ নেই। উঠে দাড়িয়ে ট্রাঙ্ক দুহাতে তুলে এনে যে ঘরে শুয়েছিলেন সেখানে রাখেন। তারপর ভাবতে বসেন... যে এসেছিল, সে কে... মনের ভুল? কিন্তু মনের ভুল কি এতখানি হয়! তবে কি? স্বপ্ন? কল্পনা? কিন্তু জীবনানন্দ কেন? তিনি তো তার চেহারাও দেখেননি কোনদিন। নাহ... আর ভাবতে পারছেননা তিনি... আরও কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে হবে, ট্রাঙ্কের খোঁজে যদি জীবনানন্দ বাবু আসেন তবে তাকেই জিজ্ঞেস করা যাবে! এছাড়া কিই বা আর করার...

0 comments: