0
undefined undefined undefined

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in



গাড়ি থেকে নেমে হাত পা একটু ছড়াতে ছড়াতে চারদিকে চেয়ে দেখে অপরূপা।

অবশেষে।…অ্যাটলাস্ট।

বরিশাল।

দাদা কতবার আগে বলেছে, ‘এখন তো ভিসা পাওয়া সহজ হয়েছে। চল্ না, একবার ঘুরে আসি। ঠাকুমার কাছে এত গল্প শুনেছি। প্লাস, আফটার অল দেশ তো। কোনোদিন না গেলেও, একটা টান তো থেকেই যায়। কী বলিস?’

‘মন্দ বলিসনি। গেলে হয় একবার।‘

কিন্ত ঐ পর্যন্তই। নানা কাজের 

চাপে এইসব ইচ্ছে টিচ্ছেগুলো কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছে।

মাস তিনেক আগে, ঢাকা উৎসবে কবিতা পড়ার ইনভিটেশন পাওয়ার পর থেকেই, আইডিয়াটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

নেটে একটু খবরাখবর নিতেই জানা গেল যে, বরিশাল এখন আর 'আইতে শাল, যাইতে শাল' নয়। ট্রেন, প্লেন সব ই যাচ্ছে। 

তখন থেকেই মনের মধ্যে বাজতে লাগলো, 'গেলে হয়…গেলে হয়।‘

আর এমন যোগাযোগ, কবিতা উৎসবেই আলাপ হয়ে গেল, কবি সিরাজ আহমেদের সঙ্গে। 

উৎসবের শেষদিনের ডিনারের সময় একটু ইতস্ততঃ করে কথাটা তুলেই ফেললো অপরূপা।

‘ আপনি কখনো বরিশালে গেছেন?

‘হ্যা, গেছি কয়েকবার। তবে আমার বাড়ি তো চিটাগাং, তাই তেমন ভাবে থাকা হয়নি কখনো। কিন্ত কেন বলুন তো? আপনার চিনা কেউ থাকেন?’

‘না, না', একটু বিব্রত হেসে তার গোলাপী পাড় তসর শাড়ির আঁচল টা একটু ঠিক করে নেয় অপরূপা।

এই প্রায় মধ্যবয়সেও অপরূপার দৃষ্টিতে, হাবেভাবে কোথাও যেন এক কিশোরী উঁকি দিয়ে যায়।

ইচ্ছে হলেই চশমাপরা মুখটাকে সে যেমন টিচার সুলভ করে ফেলতে পারে, যা দেখে তার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বাঘা বিচ্ছুগুলোও ভয় পেয়ে যায়; তেমনি একবার দন্তরুচিকৌমুদী দেখিয়ে ফেললেই চারদিকটা যেন আলো আলো হয়ে যায়।

‘আসলে আমাদের দেশ এক সময়ে ছিল বরিশালে। আগরবাড়ি। ঠাকুমার কাছে এত গল্প শুনেছি! খুব দেখার ইচ্ছে।‘

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা চলে যান না। ঘুরে আসেন। ঢাকা থেকে ফ্লাইটে গিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে ই একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিবেন।‘

সিরাজের কথায় আরো উৎসাহ পেয়ে যায় অপরূপা।

গানের সুরের মতো মাথায় বাজতে থাকে, যেতে হবে…যেতে হবে।

আর দেরি না করে, হোটেলে ফিরেই ট্র্যাভেল ডেস্ক থেকে পরের দিনের ফ্লাইটের টিকিটটা কেটেই ফেলে অপরূপা। 

মোটামুটি এক ঘন্টার মতো ফ্লাইট।

তার অচেনা দেশে, রূপকথার রাজত্বে পৌঁছোনোর উত্তেজনায়, আনন্দে, কোথা দিয়ে যে সময়টা কেটে গেল, সে যেন টের ই পেলনা।

আর এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসতেই একটা অল্পবয়সী ছেলে, অপরূপার মেয়ে কুর্চির থেকেও বোধহয় ছোট, এগিয়ে এসে বলল,'কোথায় যাবেন দিদি?’ 

‘আগরবাড়ি। চেন তুমি?’আগরবাড়ি? না আগরপাড়া?’- ছেলেটির পরবর্তী প্রশ্ন। 

একটু ঘাবড়ে যায় অপরূপা। মরেছে, এতসব স্পেসিফিকেশন! ঝোঁকের বশে চলে এসে ভুল করলো নাকি! 

মাথার ভেতর ঠাকুমার কাছে শোনা কথাগুলো আর একবার ঝালিয়ে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে অপরূপা,

-‘না, পাড়া নয়। আগরবাড়ি। ঝালকাঠি সাবডিভিশন'

‘ওঃ, তাই বলেন। ঝালকাঠি। চলেন সেখানে। তারপর আপনার জায়গাখান আপনে খুঁজে নিবেন।'

খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। 

‘আমার নাম রতন’- সুটকেস টাকে ডিকিতে রাখতে রাখতে ছেলেটি বলে।

তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে গাড়িতে উঠে বসে অপরূপা।

‘আপনে চাইলে সারাদিন ও গাড়িটা রাখতে পারেন।

তবে রেট আলাদা। আমিই আপনেরে সব দেখিয়ে দেবো।

আর কিইবা আছে তেমন দেখার! আপনের কেউ থাকে নাকি ঝালকাঠিতে দিদি?’ গাড়ি চালাতে প্রশ্ন করে রতন।

'না ভাই কেউ থাকেনা', বলে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে অপরূপা। 

আসলে তার এখন কথা বলতেই ইচ্ছে করছেনা। 

রতন ছেলেটি যথেষ্ট চালাক। অপরূপার মুড বুঝে আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।

গাড়ির জানালা থেকে বাইরের রাস্তাঘাট, মানুষজন, গাছপালা- সব যেন দুচোখ দিয়ে গিলতে থাকে অপরূপা। 

আর ধীরে ধীরে তার নিজের অভিজ্ঞতাহীন, স্মৃতিহীন স্মৃতির রূপকথায় একটু একটু করে ডুবে যেতে থাকে ।


(২)

“পূজা পাঠ তো সব হইয়া গ্যালো গিয়া। চলো না ঘুরিয়া আসি। আইজ রাত্তিরেই যাইবা… তুমি কিন্তু কথা দিসিলা।“—

কথাগুলো বলে অক্ষয়ের দিকে হালকা

রাগ ভরা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে হিরণশশী।

হিরণশশী। বাসন্ডার সমাদ্দার বাড়ির মেয়ে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়।

সেই কোন্ আড়াই বছর বয়সে আগরবাড়ির ভটচাযদের বৌ হয়ে এসেছে। 

সেসব কথা অবশ্য কিছুই হিরণশশীর, মা বাবার আদরের 'হিরুণি'র মনে নেই।

তবে সে গল্প শুনেছে যে বিয়ের লগ্ন বেশি রাতে থাকায় সে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল।

অনেক ঠ্যালাঠ্যালি করেও তাকে ঘুম থেকে তোলা যায়নি।

তাই ওই ঘুমন্ত অবস্থাতেই কাঁসার নতুন পরাতে করে তাকে সাতপাক ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তার অজান্তেই।

অক্ষয় মাঝে মাঝে ই এই ব্যাপারটা নিয়ে তাকে খ্যাপায়। 

অক্ষয়। ভটচায বাড়ির ছোটছেলে। 

অক্ষয়ের বয়স তখন বছর বারো।

আর তার কিছুদিন বাদেই অক্ষয় নবদ্বীপে চলে গেছিলো। টোলে পড়তে।

হিরণশশী তখন বাপের বাড়িতে। মায়ের কোলে।

পরে এসব গল্প সে শুনেছে শিষ্যবুড়ির কাছে।

শিষ্যবুড়ির নাম যে কী কে জানে!

তবে সে তার শ্বশুরের শুধু মন্ত্রশিষ্যই ছিলনা, অক্ষয় ও তার দাদাকে কোলেপিঠে করে মানুষ ও করেছে।

পতিপুত্রহীনা এই আশ্রিতা মহিলার অকুণ্ঠ স্নেহ হিরুণিও বরাবর পেয়ে এসেছে। 

সেই যে নবদ্বীপে গেল অক্ষয়, আর এই মাস ছয় হলো ফিরেছে পড়া শেষ করে।

হ্যাঁ, মাঝখানে পালা পার্বনে এসেছে দুয়েক বার।

আর বাপের বাড়ি থেকে হিরুণিকে তখন আনানোও হয়েছে, কিন্তু হিরুণি অক্ষয়ের ধারে কাছেও যায়নি। 

শাশুড়ি মায়ের কাছে কাছেই ঘুরে বেড়িয়েছে। তাঁর ই সঙ্গে শুয়েছে।

মেয়ে না থাকায়, সেই অজাত মেয়ের জন্য জমানো সবটুকু স্নেহ হিরণশশীর ওপর উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন শাশুড়ি মা।

আর বড়জা ও তাকে ছোট বোনের মতো আগলে রাখতো।

সবাই বলতো 'হিরুণির কপাল টা ভালো।'

অক্ষয়কেই একটু যা ভয় পেত হিরুণি। 

অক্ষয় ধারেকাছে না থাকলেই, হিরুণির দুষ্টুমি বাধা মানতোনা।

আর কিছু মনোমত না হলেই দুখানা কাপড় বগলে নিয়ে, 'থাকমুইনা তগো বাসায়' বলে বাপের বাড়ির পথে রওনা দিত হিরুণি। 

আর তার রাগ দেখে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়তো। 

তাতে অবশ্য তার রাগ বাড়তো বই কমতোনা।

অনেক সময় অক্ষয় কাছে থাকলে, সেও হেসে কুটিপাটি হত। 

আর তখন সমস্ত ভয়ডর ভুলে, তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকতো হিরণশশী।

তারপর কাঁদতে কাঁদতে অক্ষয়কে ভেংচি কেটে দৌড়ে চলে যেত সেখান থেকে।

অক্ষয়কে হিরণশশী ঠিকঠাক মতো দেখলো এই ছ'মাস আগে।

যখন পড়াশুনো শেষ করে, নবদ্বীপে র পাট চুকিয়ে অক্ষয় বরাবরের জন্য বাড়িতে ফিরলো।

ইচ্ছে, গ্রামে নিজের একটা টোল খোলে। 

যাতে টোলে পড়ার জন্যে গ্রামের ছেলেদের আর দূরে যেতে না হয়।

এবার অক্ষয় আসার পর কেমন যেন অন্যরকম লাগলো।

একটু ভয় করছিল কিন্তু অন্য একটা কী যেন অনুভূতি! 

সেই প্রথম অক্ষয়কে দুচোখ ভরে দেখলো হিরণশশী।

কেমন সে দেখা হতে পারে! ঠিক কেমন তখন দেখতে ছিল ভটচায বাড়ির ছোটছেলেকে! 

মন বাতাসের থেকেও অধিক গতিশীল। মহাভারত না কোথায় লেখা আছে না?

অপরূপার মনটাও সব দূরত্ব পেরিয়ে টালিগঞ্জের পুরোনো বাড়ির, বসার ঘরে চলে এলো একেবারে। আর দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুর্দার ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো ।

রীতিমতো সুপুরুষ ছিলেন তার ঠাকুর্দা।

শ্যামবর্ণ রঙ।

যাকে বলে শালপ্রাংশু মহাভুজ’, তেমন চেহারা।

মায়াময় বড় বড় চোখ, তীক্ষ্ণ নাক, ঢেউ খেলানো চুল।

ঠিক যেন সিনেমার হিরো।

বাবা, জ্যেঠা কেউই এই চেহারাটা পায়নি।

সবাই ঠাকুমার মতো ধপধপে ফরসা।

'দিদি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’-রতন জিজ্ঞেস করে।

‘নাঃ’-একটু অন্যমনস্ক হেসে বলল অপরূপা।

তারপর ধীরে ধীরে তার রূপকথার জগতে আবার ডুবে যায় সে।

সত্যি, কতটা যে তার ঠাকুমার কাছে শোনা, আর কতটা যে তার কল্পনা! এতো বছর হয়ে গেছে, ঠিকমতো যেন বোঝাও যায়না।

তবে এর মধ্যে আর একটা ব্যাপার ও তো আছে।

সেটা তো ভুললে চলবেনা।

ঠাকুরদার লেখা চিঠি।

যেটা ঠাকুমা মারা যাবার পরে ঠাকুমার গোলাপ ছাপ দেওয়া তোরঙ্গ থেকে সে পেয়েছিল।

আগরবাড়ির হিরণশশীকে সেই চিঠি লিখেছিল, কোনো একটা কাজে ঢাকায় যাওয়া যুবক অক্ষয়।

আর সেই চিঠিতেই ছিলো ভেজা জ্যোৎস্নার রাত, পানসির মৃদু ছপছপ আওয়াজ, দুপাশের গাছপালা আর হিরণশশী-অক্ষয়ের গোপন নৌকো অভিসার। ওঃ, আল্টিমেট রোমান্টিকতা—সেই চিঠি পড়ে বলে উঠেছিল আপ্লুত অপরূপা।

আকুল আবেগে চোখের পাতা জলে ভারী হয়ে উঠেছিল।

আর সেই দিন থেকেই , কী এক আশ্চর্য কারণে অপরূপার মনে হারিয়ে যাওয়া সেই রাত, যা তার উপলব্ধি তে না থেকেও ভীষণ ভাবে রয়ে গেছে। তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই থেকে।

কেমন করে যেন সেই কোজাগরী রাত আর আগরবাড়ি-

ঠাকুমার ভাষায় 'দ্যাশ',

একেবারে মিলে মিশে গেছে।

সেই রূপকথার মতো রাত আর আগরবাড়ি যেন আলাদা নয়।একাকার। যেন এক।

এক ই রকম অপ্রাপনীয়। যা কিছু মোহময়, সুন্দর- তার চূড়ান্ত সীমা।

ম্যাজিকাল…!

চোখদুটো আস্তে বন্ধ করে ফেলে অপরূপা, আর সেই বন্ধ চোখের পাতায় ফুটে ওঠে--হিরণশশীর আগ্রহভরা মুখখানা, যার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অক্ষয়।

অন্ধকারের মতো ঘন লম্বা চুলেঘেরা একটি বুদ্ধিমতী মুখ।

একটু চাপা নাকের পাটায় আটকে থাকা, সোনার বেলকুঁড়িটি, একটু রাগী-একটু অভিমানী দৃষ্টি…অক্ষয় যেন আর চোখ ফেরাতে পারেনা।

এই ছলছল অভিমানী মুখখানা দেখে এখন বোঝার উপায় নেই, এই ছোট্ট মেয়েটার কতটা উপস্থিত বুদ্ধি।

কতটা মনের জোর।

অক্ষয় শুনেছে, আগের বর্ষায় যখন একরামআলীর বুড়ো আঙুলে সাপে কামড়েছিল, তখন হিরণশশীই প্রথমে পায়ে বাঁধন দিয়েছিল।

আর তারপর' ঠাকুররে খবর দাও, ঠাকুররে খবর দাও' বলে রহমতকে দিয়ে ঘোষাল বাড়ি থেকে শ্বশুর মশাইকে ডাকিয়ে আনিয়েছিল। 

তাতেই তো সে যাত্রা একরাম বেঁচে গেছিল।

আর সেই থেকে এই পুঁচকে মেয়েটাকে মা বলে ডাকে।

কী ভালোই না বাসে।

“ কী হইলো? কিসু কওনা যে?”- হিরণশশীর আওয়াজে যেন সম্বিত ফেরে অক্ষয়ের।

“হ্যা, যাবো তো। কিন্ত মা?”

“ তেনার লগে আমার কথা হইয়া গ্যাসে”

‘মা রাজী হয়েছে?’-

নবদ্বীপে এতগুলো বছর কাটিয়ে আসার পর অক্ষয়ের ভাষায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

হিরণশশীর সাথে সে নবদ্বীপ ঘেঁষা ভাষাতেই সাধারণতঃ কথা বলে।

“হ, হইসেন। তবে কইয়া দিসেন, ফিরিয়া আইয়া তেনারে যেন্ না জাগাই”

“তুমি তো আমার সাথে ঘুমাওনা। মায়ের সঙ্গে ঘুমাও। তোমার অসুবিধা হবেনা?”- প্রশ্নের সাথে সাথে অক্ষয়ের আকর্ষনীয় চোখদুটি কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

“রাখেন তো আপনের ফ্যাতরামো। তাড়াতাড়ি চলেন”- উত্তেজনায় হিরণশশীর মুখ থেকে ছোটবেলার 'আপনি' সম্বোধনটা চলে আসে।'আবার? বলেছি না, তুমি। আপনি নয়'।’ অক্ষয়ের চোখে মজার আভাস। যদিও গলায় বানানো রাগ। “ হ, হ, বুজছি। যাইবা কিনা কও।“

‘হ্যাঁ, চলো। কারুর চোখে পড়ে গেলে কিন্ত কপালে দুঃখ আছে।‘

স্বামীর কৌতুক ভরা মুখখানা একবার দেখে নিয়ে হিরণশশী তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে কস্তাপেড়ে শাড়িখানা পরে আসে। যত ই এখন গ্রামের রাস্তায় কেউ না থাকুক, তবু বাইরে তো আর এভাবে যাওয়া যায়না, তাই তসরের চাদরটাও সে গায়ে জড়িয়ে নেয়।

হেমন্তের শুরু। হালকা শিরশিরানি ভাব। চাদরখানা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে স্বামীর সাথে পা চালিয়ে ঘাটের দিকে রওনা দেয় হিরণশশী। এ এক আশ্চর্য সময়। চেনা জায়গাগুলো কেমন অচেনা লাগছে! গ্রাম, নদী, গাছ গাছালি, রাস্তা সব যেন হালকা রেশম চাদরে ঢাকা। আকাশে সম্পূর্ণ চাঁদ। কী মিহিন অভ্ররঙা জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। যেন কোনো রূপকথার জগত! দু এক বাড়িতে এখনো হালকা আলো দেখা যাচ্ছে বটে, মেয়ে বৌরা সে রাতের মতন কাজকর্ম সেরে নিচ্ছে। কিন্ত অধিকাংশ বাড়িই গভীর অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। কেবল দূরে রায় বাড়ি থেকে তখনো আওয়াজ ভেসে আসছে। রায় বাড়িতে শুধু দুর্গাপুজো নয়, লক্ষ্মীপুজো ও খুব বড় করে হয়। কত লোকজন, আলো…


হিরুনির মনে হল, রায় বাড়ির আলোর দিকে তাকিয়ে সে যেন ধুপধুনোর গন্ধ ও পাচ্ছে। অক্ষয় কে সেকথা বলাতে, সে কৌতুকের হাসি হেসে বললো, ' জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ'। “ কী কইলা? কী লখ্খ?”

“কিছুনা। পা চালিয়ে চলো”-হাসতে হাসতে বলে অক্ষয়।

সরু একখানা খাল চলে গেছে। ঘাটে একখানা পানসি বাঁধা। অক্ষয় আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। বৌ কে নিয়ে জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে বেড়ানো- এ শখ যে অনেকদিন ধরে তার ও। 

কিন্ত রাতের বেলা নিতাইদা পাটখেতের মাচাতেই শুয়ে থাকে। একবার যদি দেখতে পায় , আর রক্ষে নেই। তবে আজ অন্য অনেকের মতো নিতাইদার বাড়িতেও পুজো।

এদিকে বাবা, দাদা দুজনেই দূরের গ্রামে পুজো করতে গেছে।আর বাড়ির পুজোর জন্যে কাউকে তো থাকতে হবে। তাই অক্ষয়ের উপর ই এই বছর সে দায়িত্ব পড়েছে।

অক্ষয়ের পুজোপাঠ তো প্রদোষেই সারা। সুতরাং হিরণশশীর আবদার রাখার আজ ই তো সুবর্ণ সুযোগ! 

তার ছোটোবেলার নানারকম দুষ্টুমির গল্প শুনেইনা হিরণশশীর এমন ইচ্ছে টা হয়েছে। কাজেকাজেই এই ইচ্ছে পূরণ করা তো তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। না কি?

এইসব ভাবতে ভাবতে খুব ভারিক্কি চালে বলে ওঠে অক্ষয়,

‘এসো, হাতটা ধরো।‘

’হাত ধরণ লাগব কিয়ের লইগ্যা?’’

'আঃ, একটু মুখখানা বন্ধ রাখো তো। ধরো।‘

হিরণশশীর হাত ধরে সাবধানে নৌকোয় তুলে নৌকোর রশিটা খুলে দিতেই নৌকো টা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। জলে স্রোত নেই। বাতাসের বেগ ও নেই। আলগা করে বৈঠা ধরে থাকাই যথেষ্ট। 

জলের দুপাশের পাটগাছের সারি নৌকোর ধাক্কায় নববধূর মতো লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে।

সূক্ষ্ম মসলিনের মতো জ্যোৎস্না মেশানো হিম, তাদের কী এক আহ্লাদে জড়িয়ে ধরেছে।

যেন বাস্তব নয়।

যেন এক রূপকথার জগত!

দাঁড়ের হালকা ছপছপ্ শব্দ ছাড়া, আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। 

অক্ষয়ের চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় হিরুণি। যেন তার এক্ষুনি সত্যিকারের শুভদৃষ্টি হলো ।


হয়তো এই মুহূর্তটাতেই প্রথম খুব কাছাকাছি এসেছিল তারা…। কে বলতে পারে! -ভাবে অপরূপা। আর এক হাতে বৈঠা সামলে অন্য হাতে হিরনশশীকে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপা স্বরে অক্ষয় গেয়ে উঠেছিল,- 'তোমার তুলনা তুমি প্রাণ'..

যে গান হিরণশশীর গলায় বারবার শুনেছে তাঁর নাতি নাতনী রা। বিশেষ করে অক্ষয় চলে যাবার পরে।

‘তুমি এত সুন্দর গান গাও! ক্যামনে শিখলা?’

‘ওখানেই শিখেছি। ওই একটু আধটু'।

আর কয়েক বছর বাদেই গায়ক হিসেবে অক্ষয়ের নাম ছড়িয়ে পরবে। কাজী নজরুল, সুরেশ চক্কোত্তি, ভীষ্মদেব সবার সাথে যে অক্ষয়ের গানের সূত্রে এতো সখ্যতা হবে, তা সেই রাত্রে তারা কেউই জানতোনা। সেদিন শুধু হিমভেজা আধো জোছনায় অক্ষয় তার অনেক দিনের পুরোনো অথচ নতুন বউকে গান শুনিয়ে গেছিলো আর হিরণশশী মুগ্ধতায় মরে যেতে যেতে হয়তো নিজের অজান্তেই পাগলের মতো অক্ষয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছিল। 

পৃথিবীর বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে অনেক দূরে, তাদের নিজস্ব পৃথিবীতে।


অপরূপার ভাবনার মাঝেই ঝাঁকুনি দিয়ে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে পরে। 

‘দিদি, এসে গেছি’। 

রতনের কথায় যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে অপরূপা।

‘ও, আচ্ছা,’- বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে আসে ।

‘আঃ, আ্যটলাস্ট'…খোলা হাওয়ায় হাতদুটো ছড়িয়ে বলে ওঠে সে।

‘এইটাই ঝালকাঠি?’

‘হ্যাঁ দিদি। এই তো কাছেই ঝালকাঠি ইস্কুল'.

চারদিকটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে দেখে অপরূপা।

কিন্ত কোথায় সেই খাড়ি! কোথায় ই বা সেই সব পাটগাছ! কিছুই তো নেই এখানে। রতন তাকে ঠিক জায়গায় এনেছে তো!

‘এ কোথায় নিয়ে এলে রতন? এতো সেই জায়গা নয়। নদী, পাট গাছ, ঘন সবুজ আশপাশ, কিছুই তো দেখছি না।‘

“দিদি এটাই তো ঝালকাঠি। তবে বললাম তো আপনি যে জায়গাটা খুঁজতেছেন, মানে আগরবাড়ি না কি বললেন, সেটা আমি চিনিনা।…কাউরে জিগাস করবো?” 

‘দেখো, জিগ্যেস করে।‘

রতন দুয়েক জন পথচলতি লোক, দোকানদার সকলকেই জিজ্ঞেস করলো। কিন্ত, কী কান্ড! কেউই আগরবাড়ি নামে কোনো গ্রামের কথা বলতে পারেনা। তাদের কথা শুনে সে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, ঝালকাঠি আর বরিশাল এখন দুটো আলাদা সাবডিভিসন। বরিশালে আগরপাড়া বলে একটা জায়গা থাকলেও, ঝালকাঠি তে আগরবাড়ি নামে কোনো জায়গার অস্তিত্ব নেই।

হ্যাঁ, সে শুনেছিল বটে যে পার্টিশনের সময় বাবার জ্যাঠামশাই গৃহদেবতা গোপালকে ঝামেলা মিটলে ফিরে এসে উদ্ধার করবেন এই আশায়, বাড়ির সামনের পুকুরে লুকিয়ে রেখে এক কাপড়ে দেশ ছেড়েছিলেন। ঠাকুর্দা অবশ্য তার অনেক আগেই ঠাকুমা ও বাবা, জ্যাঠাদের নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। মূলতঃ ঠাকুমা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার চিকিৎসা ও ঠাকুর্দার নিজের গানবাজনার নেশার জন্যে। দেশভাগের কিছুদিন পরে ঠাকুমা ঠাকু্যদা জানতে পারেন যে তাঁদের ফেলে আসা বাড়ি আর নেই। ভাঙা পড়েছে। 

কাজেকাজেই আগরবাড়ি তে গিয়ে নিজেদের বাড়ি দেখতে পাবে, এ আশা কখনোই অপরূপার ছিলনা। কিন্ত তা বলে একটা গোটা গ্রাম লোপাট হয়ে যাবে! তার ছোটোবেলার স্বপ্ন, রূপকথা সব একটা মস্ত বড় না হয়ে গেল! 

এমন নিঃশেষে মুছে গেল! যেন ম্যাজিক! এই আছে। এই নেই। এমন আবার হয় নাকি!

গাড়ির দরজাটা খুলে সীটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে অপরূপা।

মনে হয় তার শিকড়টা এক্ষুনি যেন কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। নিজেকে কেমন রুটলেস লাগে। শিকড়বিহীন।

আগরবাড়ি কে ঘিরে ছোট থেকে তার যত কল্পনা, যত উত্তেজনা- সব কেমন অলৌকিক অবাস্তব বলে মনে হতে থাকে। 

কিছুক্ষণ চুপ চাপ বসে থাকার পর ক্লান্ত গলায় সে রতনকে বলে, “ এয়ারপোর্টে ফিরে চলো রতন, এখানে আর কিছু নেই।

গাড়িটা এয়ারপোর্টের পথ ধরে।

জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে অপরূপা আর তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরতে থাকে। যেন খুব প্রিয় কেউ আজ তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল।

হঠাৎ একটা বাড়ির সাইনবোর্ডে চোখ আটকে গেল অপরূপার।

চিৎকার করে বলে ওঠে, “ শিগগির গাড়ি থামাও রতন, শিগগির”।

রতনের গাড়ি যেখানে থেমেছে তার ঠিক সামনে একটা বাড়ি। সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা-“ আগরবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”।

সে দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অপরূপা। এক আশ্চর্য কষ্ট আর আনন্দে বুক ভেসে যেতে থাকে। না থাক পাটপাতার নুইয়ে নুইয়ে পড়া, না থাক চাঁদের আলোয় ভেসে চলা পানসি, না থাক মায়াময় সেই সব বাড়িঘর; কিন্তু অন্ততঃ নামটা তো আছে, তার স্বপ্ন, সুখ, ভালোবাসা, শৈশবের রূপকথা।তার দেশ।

“দ্যাশ” -ঠাকুমা বলতো।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে অপরূপাও পরম মমতা ভরে সাইনবোর্ডের লেখাটার দিকে তাকিয়ে পরম ভালোবাসায় বলে,-

“দ্যাশ। আমার দ্যাশ।"

0 comments: