1

প্রবন্ধ - রিজোয়ান মাহমুদ

Posted in


উপনিবেশত্তোর বাংলা কবিতা উপনিবেশিক সময়ের কিছু চেহারা নিয়ে দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পেয়েছিল। ঔপনিবেশিক সময়ের মনন শাসন ও সাংস্কৃতিক জটিলতা, সর্বোপরি চিন্তার অস্থির দরিদ্রতায় কবিতা স্বজাতিক ইচ্ছা থেকে অনেক দূরবর্তী ছিল এবং কিছু ভিন্ন অবয়ব স্বীকার করে নিয়েও, কবিতা ভাষা ও প্রকরণ শৈলীতে এগিয়েছিল কিন্তু মাটি ভর্তি ঘ্রাণ থেকে অবস্থান ছিল দীর্ঘ দূরে। এটি বুঝেছিল কবি বোদ্ধা ও কবিতার শিল্প শ্রমিকরা। যারা এসব বিষয়ে অনেক পরে এসে বুঝেছিল, তাদের উপর ছিল এই মানসিক চাপ অনেক লম্বা ও দীর্ঘস্থায়ী। ততদিনে রাষ্ট্র ও সমাজ জন মানসের বিকলাঙ্গ চিন্তা নিয়ে আমাদের সামনের দিকে যেতে হয়েছিল। এ দেশে উপনিবেশ আসে শুধু সংস্কৃতিকে আঘাত করবার জন্য নয়। এখানকার অন্যান্য সম্পদ লুণ্ঠনের একটি সুদীর্ঘ চিন্তন প্রক্রিয়াও এতে যুক্ত ছিল। কবিতার গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্নের মতোন এদেশ ও জাতি ছিল নানা অর্থকরী ফসলে সমৃদ্ধ একটি জাতি। নদী বিধৌত এ অঞ্চলের মানুষ ছিল সহজ সরল। এ কারণে একটি প্রভুত্ব অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক শাসন এ অঞ্চলে সফলকাম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সাংস্কৃতিক বহু স্তরবাদকে আপন করে সোল্লাসে উচ্চারণ করেছিল। দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে। এই আকাক্সক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল উপনিবেশবাদ। আধিপত্যবাদী ধারণা নিযে সাংস্কৃতিক জন মানসের একতাবদ্ধ চিন্তাকে খর্ব করে উপনিবেশিক সংস্কৃতি চালু করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের মিলনের পথকে প্রকৃত অর্থে সহজ করে দেয় নি। ড. হান্টার, ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। একটি বিভাজন রেখার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে হত্যা করে নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিল করেছিল উপনিবেশের লক্ষ্য। একজন বাঙালি হিন্দুর কাছে একজন মারাঠি ছিল একজন বাঙালি মুসলমানের চেয়েও প্রিয়। আর একজন বাঙালি মুসলমানের কাছে একজন আফ্রিদি মুসলমান ছিল একজন বাঙালি হিন্দুর চেয়েও প্রিয়। অথচ বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি, কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী ছিল না। ভিন্ন সুরে ব্যঞ্জনা থাকলেও কোন এক মোহনায় মিলিত হয়ে নব সুরের অবিধীত হয়ে উঠতে পারতো। আমাদের ছিল সুফী ও বৈষ্ণবের প্রেম ধর্ম, উদার প্রীতি, উদার মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ধারায় বিকশিত জাতিসত্তা। উপনিবেশবাদ হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি ভেতরে দূরত্ব সৃষ্টি করে আমাদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করেছে। প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিভঙ্গির হীন মানসিকতার দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের কারণে এখানে জাতীয়তাবাদের চেহারাটি ভঙ্গুর হয়ে যায়। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয় যে, সব উপনিবেশিক ব্যক্তিত্বের একই চেহারার হয় না। আবার জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটি কথা উক্ত হতো যে, আরব জাতীয়তাবাদ বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ জিনিসটি কারো কল্পনাতে ছিল না, আরব জাতি ধর্মমতে সাধারণ মুসলমান। অথচ আরব জাতীয়তার গোড়াপত্তন করেছিল আধুনিক প্রথায় শিক্ষিত দুজন খ্রিস্টান মনীষী, নাজিফ এজিফি ও বেতেরাস বোস্তানি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এ দুই মনীষী জাতীয়তার এক অভূতপূর্ব আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তারা খ্রিষ্টানদের প্রতি আরব জাতির সম্প্রীতি সাধন করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন; মূঢ়তা গোচাতে না পারলে মানুষের গোঁড়ামি ঘুচবে না। আরবে শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা করা হলো। সে শিক্ষা নিকেতন হলো জাতীয় বিদ্যালয়। আরব প্রেমকে কেন্দ্র করে ধর্ম বিদ্বেষ ত্যাগ করে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা হলো। এতে করে একটি বিষয় দাঁড়ালো যে, বিপুল সাধনায় আরব জাতি ক্ষুদ্রতা ভুলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখল। একটি অখ- জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের জন্য পরমত সহিষ্ণুতা একটি বড় বিষয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা ভারতবর্ষে ফেলে যাওয়া উপনিবেশ থেকে সে শিক্ষা পাই নি। 

উপনিবেশ থেকে আমরা পেয়েছি সাংস্কৃতিক পরাধীনতার গ্লানি ও দুর্বিনীত রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং আধুনিকতার নামে নির্লজ্জ ক্ষমতার আস্ফালন, শ্রেণি বৈষম্যের প্রসারণে নগ্ন উদ্বাহ। এটা ক্ষমতাবানকে আরো ক্ষমতা দিয়েছে এবং সংস্কৃতি করেছে উম্মুল। 

উপনিবেশত্তোর সংস্কৃতিক চর্চা : 

সৃজনশীলতা ধারণ করে স্বকীয় চারুময় স্বভাবের ভেতর দিয়ে উপনিবেশত্তোর সংস্কৃতিক চর্চা শুরু হওয়া উচিত ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উপনিবেশবাদী দেশগুলো স্বাধীন হলেও, তার অবকাঠামো উপনিবেশকে সমর্থন করেছে বেশি, ফলে শিক্ষা সংস্কৃতি সমাজ বিনির্মাণে যেকোন ভাবে উপনিবেশের জায়গাটি বয়ে যায়। উত্তর উপনিবেশ এই ধারণার জন্ম দেয় পশ্চিমা সমাজ। যেহেতু এই তত্ত্বের জন্মদাতা, পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী সে কারণে এর স্বভাব ও ব্যবহারিক পর্যায়ে পশ্চিমের একতরফা জ্ঞান ও শৃঙ্খলার গন্ধ লেগে থাকে। প্রাচ্যের চিন্তার জগতের দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে ঊনিশ শতকে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্ব এবং ক্ষমতার উগ্র বাসনার মত ইউরোপীয় মনন, আমাদের প্রতিবাদী চেতনায় আঘাত হানে। আমরা ব্যর্থ হয়েছি উপনিবেশত্তোর নতুন ভাষা তৈরিতে। সমাজ বিবর্তনের ধারায় নতুন মানবিক সমাজের দর্শন নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণায় চিন্তার বৈকল্য নিয়ে প্রান্তে পড়ে আছি। উত্তর উপনিবেশের তীরে দাঁড়িয়েও উপনিবেশ এর মনন চাষে, সংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছি। মূলতঃ চারটি স্তম্ভের অভাবের কারণে উত্তরউপনিবেশ শক্তি অর্জনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এক. জাতীয়তাবাদ বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়ার তৈরি হয়েছে, এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়. অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, তৃতীয়. দারিদ্রতার কারণে মানবিক বৈকল্য। চতুর্থ. রাজনৈতিক দূর দৃষ্টির সীমানায় আশাবাদের অভাব। সবশেষে প্রাচীন অথচ বতর্মানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন মূল্যবোধকে গ্রহণ না করা। উত্তর উপনিবেশবাদ কী? পশ্চিমা প্রবণতাকে যদি বাদ রেখে বলি, তা হলে ওঠে আসে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্বে স্বদেশ সংস্কৃতির এক বর্ণাঢ্য মহামিলন, যাতে ধরা দেয় নিজের যা কিছু আছে, তার অহংকার, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি, পুরানো মূল্যবোধের আলোকে সমগ্র মানবতাবাদের সৃজনশীল ক্ষমতা। উপনিবেশবাদ ধর্মকে হাতিয়ার করে ভারতবর্ষীয় জীবন ও মানবতাকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করেছে। অথচ উপনিবেশ পর্ব আমাদের একটি সম্মিলিত বহুত্ববাদ সংস্কৃতি ছিল, যেমন মঙ্গলকাব্য, আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যের যে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ক আখ্যান কাব্য, সেটিই মঙ্গলকাব্য। 

ডাঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, এটি বাংলা ভাষা-ভাষী অঞ্চলের একটি বিশেষ যুগের সাহিত্য সাধনা হলেও এটি সৃষ্টির প্রেরণা কোন এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক ধর্ম বিশ্বাস থেকে আসেনি। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে বাংলাদেশের লৌকিক ও বহিরাগত বিভিন্ন ধর্ম মতের সে অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে, মঙ্গল কাব্যগুলো তারি পরিচয় বহন করে। হিন্দু কবিগণ সচরাচর মুসলমান সমাজের চিত্র শ্রদ্ধার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। আবার মধ্য যুগে একজন মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় অসামান্য কর্তৃত্ব অর্জন করেন। 

সে কালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারায় মুসলমান কবিদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও উদারতা আমাদের অবাক করে। এমন কি সৈয়দ আলাওল ও দৌলত কাজী তাঁদের বিশুদ্ধ রচনার ফাঁকে ফাঁকে বৈষ্ণব পদও রচনা করেছিলেন। সে যুগে কবি শায়ানুর সৈয়দ ভগবান কে প্রিয়া রূপে দেখেছেন, তিনি লিখেন, “হিন্দুরা বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা। রাধা বলে ডাকিলে মুল্লা মুন্সিতে দেয় বাঁধা”। 

শুধু সাহিত্যে কেন? প্রাত্যহিক জীবনের আচরণ ও জীবন চর্চার মধ্যে হিন্দু শৃঙ্খলা সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। বাংলায় হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়কারী এ সম্পর্ক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরও বিদ্যমান ছিল। এটি স্বীকার করতে দোষ হবার কথা নয় যে উভয়ের মিলিত মোহনায় এ অঞ্চলে এক শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বেনিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার শাসন ভার এবং পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র ভারতে আধিপত্যবাদ বিস্তারে সক্ষম হলে, এই মধুর সম্পর্কে চিড় ধরে। 

এক্ষুণি আমাদের একটি সুচিন্তিত প্রস্তাবনা দরকার। পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত একটি উত্তর উপনিবেশ কাঠামো চয়ন করা যেখানে শাসনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো নিজস্ব সম্পদ ও উৎস থেকে আহরিত হবে এবং সক্রিয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে প্রথমে নিজে বেঁচে পরবর্তীতে বিশ্বমানবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। 

আমার ধারণা একটি এশিয়াটিক গ্রাম ও নগর ধারণা কার্যকরী সংমিশ্রণ ঘটলে উত্তর উপনিবেশের তাত্ত্বিক ধারণাটি শক্তিশালী হবে। 

ইংরেজ উপনিবেশ পূর্ব ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের স্বরূপ শ্রেণীবিন্যাস, উৎপাদন ব্যবস্থা, নগর ও শহরের প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে এশিয়াটিক সমাজ এর মডেল নির্মাণ করেছিলেন। কাল মার্কস এর মতে, “পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের গ্রামের কৃষি ও শিল্পের জন্য শ্রমশক্তি যৌথভাবে নিয়োজিত হতো। গ্রামীণ সমাজে যা গড়ে উঠেছিল জমির যৌথ মালিকানার উপর।” সার্ক যদিও ইউরোপীয় সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ হিন্দেস ও হান্ট একে অমূলক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত, সামন্তবাদী অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তৎপরবর্তী ভারতীয় ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব, এশিয়াটিক উৎপাদন প্রণালীকে নাকচ করে তার জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। হাবিব জমির মালিক কে ছিল এনিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করতে গিয়ে দফারফা করতে পারেন নি। মার্কসের বক্তব্যই যা সবাই সঠিক বলে মান্য করে। জমির কোন রকম ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। তবে জমির উপর ব্যক্তিগত ও যৌথ অধিকার ও ব্যবহার ছিল। রোমিলা থাপ্পার ও এ সত্যকে উদঘাটন করেন। যে জমির মালিকানা কখনো সামন্ত প্রভুদের মধ্যে ছিল না, রাজা বা রাষ্ট্র ছিল। উত্তর উপনিবেশের মধ্যে আমরা দেখতে চাই রাজা ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার দুর্গ ভেঙে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক। আমাদের সংস্কৃতির উৎস জমি, কৃষিজীবী মৎস্যজীবী এবং নিম্নবর্গীয় মানুষের বেলাভূমি। এখানে জমির সাংস্কৃতিক মালিকানা শাসন থাকবে জনগণের। সব বর্গ সব ধর্মের কল্যাণের নির্যাস নিয়ে হবে মম ফাল্গুনী। কারণ পশ্চিমাদের রসায়ন আমাদের জানা আছে এরই মধ্যে উত্তর উপনিবেশের ফাঁক ফোকরে খোলা বাজার ও বিশ্বায়নের ভিতরে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো সাপটি ইতিমধ্যে তারা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটিকে সঠিক সময়ে উত্তর উপনিবেশিক প্রবণতা সমূহ দিয়ে আঘাত করতে না পারা যায়, তবে উত্তর উপনিবেশের ভিতরে ছায়ার মতোন সংহারী উপনিবেশ থেকে যাবে। সাংস্কৃতিক মুক্তি কখনো আসবে না। 

এশিয়ার নগর ও গ্রামগুলির চরিত্র উন্নয়নমুখী। আধিপত্যবাদী বা আগ্রাসীমুখী নয়। এশিয়ার মানুষ ও জনজীবনের রক্তে সরল ও সহজ অভিব্যক্তির ছাপ রয়েছে। কোন কোন দেশে একেবারে রিমোট এলাকায় এখনো যৌথ জীবন ধারণা গঠনপ্রণালী বিদ্যমান। এসব দেশের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনাচরণ শুধুমাত্র এশীয় উপমহাদেশের মধ্যে ক্রম সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে উপনিবেশত্তোর চেতনাকে ধারন ও পালন করা যায়। আমাদের এই অঞ্চলে সার্ক আসিয়ান কিংবা এরকম আরো আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের আছে নিজস্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প। তাদের সম্মিলিত পুঁজি একত্রিত করে জমি ও শিল্পের উন্নয়ন প্রসারণে এগিয়ে এলে উত্তর উপনিবেশ একটি শক্ত কাঠামো পাবে। একটি কথা এখানে লক্ষযোগ্য যে পাশ্চাত্যকে আমরা যত বেশি গ্রাহ্যতার মধ্যে রাখি, তত বেশি প্রাচ্যকে নয়। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির পর্বটাও যদি হিসেবে রাখি তাহলে পাশ্চাত্যের জীবনামুখী আচরণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা অনেকটা অজু করে পালন করতে চাই। পার্শ্ববর্তী দেশ এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো তৈরি হয় না। ফলে আমরা বঞ্চিত হই এশিয়ার উল্লেখযোগ্য কবিতা ও সাহিত্য থেকে। যেমন একজন অমৃতা প্রীতম কি লিখছেন? তার দর্শন কী, আমরা জানি না। যেমন জানি না একনিষ্ঠ পাঠ করে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, নিশিওয়াকি জুন ঝাবুরু, মাহমুদ দারবিশ, অরুন্ধতি রায়, লেন এনগুয়েন, শু চেং অথবা অহিলা সাম্বামূর্তির মতো নবীন কবিরা কবিতায় কী কাজ করছেন? এভাবে আমাদের অগোচরে থেকে গেছে, কবি কমলা দাশ (কেরালা), কেদারনাথ সিং (উত্তর প্রদেশ), অরুণ কোলাৎকার (কোলাহাপুর), আহমদ ফায়াজ (কোহার্ট, পাকিস্তান) ভুপি শেরচান (নেপাল), মাধব ঘিমির (নেপাল), জুইট ও কিতা (জাপান) দু ফু চীনা আমরা ভুলেও বাড়ির পাশের আরশি নগরের দিকে তাকাইনি। তারা আধুনিক, উত্তর আধুনিক অথবা প্রাগৈতিহাসিক, আমাদের নজর কখনো পড়েনি। উল্লেখিত এসব দেশ শুধু শিক্ষা, সাহিত্যে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে কর্মে, অর্থনীতিতে প্রভূত সাফল্য নিয়ে এসেছে। এমনকি একক ও যৌথভাবে প্রভুত্ববাদী অর্থনীতির চালিকাশক্তি হতে পারে তাহলে একটি এশিয়াটিক গ্রাম কমপ্লেকস্ কেন হবে না? এশিয়ার এসব দেশ উত্তর উপনিবেশ একক শক্তি ও প্রতীক। স্বয়ম্ভ ও স্বাধীন। 

এশিয়া কবিতার দেশ। মিশ্র সংস্কৃতির বঙ্গ ভাষা মানুষ ও জনপদের সুখ-দুঃখের অমর গাঁথা নিয়ে দাঁড়িয়েছে এশিয়া মহাদেশ। এখানে কোন কোন দেশের ধর্মের আচরিত জীবন প্রবাহে সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরী হয়েছে। এই জনপদের মানুষের ভাগ্য ও নিয়তি একটি সুতোয় গেঁথে অপার জীবনধারায় সামিল হয়েছে। নদী ভর্তি মানুষ মাঠ, জনপদ, সবুজ পাহাড় এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নির্মল পবিত্র সংস্কৃতি জীবন ও বেদনার কাব্য হয়ে অপার সৌন্দর্য্যরে স্রোতে মিশে গেছে। এশিয়ার একটি জনপদ ভারত। ভারত সহ তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ উপনিবেশের যাঁতাকলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিল। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ উপনিবেশ পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়ার কারণ হলো - তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই কিন্তু সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয় নি। মূল কথা যে জনগণ সম্মতি দেবে, তারা তা দেয়নি, আর জনগণের সম্মতি না থাকলে হেজিমনি কায়েম করা যায় নি। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি, সম্ভবত যে কোন ঔপনিবেশিক শক্তির কিছু কৌশল থাকে,শাসন করার, যেমন একটি হচ্ছে কর্তৃত্ব করার জন্য আইন আদালত, বল প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনী, তাদের সাহায্যে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে জনগণকে চাপের মধ্যে রাখে। দ্বিতীয়টি সম্মতি আদায়। এটিও করা হয়ে থাকে নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের চাপ, সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে চিন্তাধারা পরিবর্তন করে। এসব গবেষণা বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক রণজিৎ গুহের ডমিনেন্স উইদ আউট হেজিমনি : হিস্ট্রি এ্যান্ড পাওয়ার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া ১৯৯৮, তে সরাসরি পাওয়ায় উত্তর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সবচে প্রয়োজনীয় টার্মিনোলজি হচ্ছে সাব অলটার্ন মানুষ। এরা ভারতবর্ষীয় জনপদের সবচে অবহেলিত দলিত দুর্দশাগ্রস্ত সমাজভুক্ত মানুষ। ঔপনিবেশের যাঁতাকলে তদের ইতিহাস সঠিক ভাবে নিরূপিত হয় নি। এটা সর্বত্র ঔপনিবেশের চরিত্র ছিল যে কিভাবে তাদের কে ইতিহাসের বাইরে রাখা যায়। উপনিবেশত্তোর সার্ব অলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা যুৎসই কিছু কাজ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা সমাজকে যতটুকু গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন তা চেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেন সংস্কৃতির বিকাশমান পর্বগুলোকে। সে কারণে সাব অলটার্ন কথাটি তাদের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেছে। আন্তনিয় গ্রামসি মনে করেছেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতরে এটি লক্ষ্য করা গেছে যে, উচ্চবর্গ, সে দেশী হোক কিংবা বিদেশী হোক, নিম্নবর্গের ওপর তারা নানাভাবে কর্তৃত্বারোপ করেছে। কিন্তু মতাদর্শিক সম্মতি না বশ্যতা আদায় করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এই নিম্নবর্গের ইতিহাস তথাকথিত স্থানীয় ইতিহাসও নয়। স্থানীয় ইতিহাসের ভেতরে সকল পেশা শ্রেণীর কাহিনী বর্ণনা করে অথচ বলা হয়ে থাকে যে, নিম্নবর্গ ইতিহাস জনপদের এবং জনমানুষের কথা সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেন এবং সর্বত্র খুঁজে বেড়ায় উচ্চবর্গীয় বিজ্ঞজনদের বিরুদ্ধে জনসমুদ্র বিদ্রোহের ঘটনার। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গকে কখনোই নীচ থেকে কিংবা ওপর থেকে দেখেন নি। ভেতরের জীবন প্রবাহের ধারাপাতিক ব্যঞ্জনা থেকে চেতনার জগতটাকে আবিষ্কার করেছেন। জিজ্ঞাসা ও পাঠের ভেতর দিয়ে তাদের উনুত্তাপিত ইতিহাসের প্রপঞ্চগুলো ওঠে এসেছে। ফলাফল এসেছে সঠিক ও গভীর অনুসন্ধিৎসার মধ্যে থেকে যে নিম্নবর্গের চেতনা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক, সেখানে তাদের স্বর ভিন্ন, সংস্কৃতি, উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতি থেকে দীর্ঘ দূরে। 

বিখ্যাত তাত্ত্বিক খ্যাতনামা নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। 

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের কিছু দিকে এইভাবে উন্মোচন করেছেন : দীর্ঘকাল ধরেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস পাঠ উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। বই উচ্চবর্গীয়রা দুই রকমের পাঁচটি উপনিবেশিক, অপরটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী। উভয়ের উদ্ভব ব্রিটিশ শাসনের আদর্শিক পরিশ্রম থেকে। জাতীয়তাবাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও এই উচ্চবর্গীয়তা বহাল রয়েছে। ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা মূলতঃ ব্রিটিশ কিন্তু ভারতে এবং অন্যত্র যে তাদের অরুকারীরা নেই তা নয়। অপরদিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদেরা প্রায় সবাই ভারতীয়। ইতিহাসের উভয় পাঠই মনে করে যে ভারতীয় জাতির সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ উচ্চবর্গীয়দের দ্বারাই ঘটেছে। 

উচ্চবর্গীয় ইতিহাসপাঠের কোন উপযোগিতা যে নেই তা নয়। আছে। এইটি থাকার পাঠ ,পাঠককে অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে যার মধ্যেরয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গঠন, বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম, ওই রাষ্ট্রের সংরক্ষক বিভিন্ন শ্রেণীর বিন্যাস, উচ্চবর্গীয়দের যে মতাদর্শ কর্তৃত্ব করেছে তার বিভিন্ন দিক, দেশীয় ও বিদেশী উচ্চবর্গের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তাদের পারস্পরিক বিরোধ ও সংযোগের জটিলতা গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ও ভারতীয় ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের ভূমিকা, এবং সর্বোপরি উচ্চবর্গের নিজস্ব মতাদর্শ, কিন্তু এই ইতিহাস পাঠ সেখানে ব্যর্থ সেটা হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্র ব্যাখ্যা। কেননা ইতিহাসের ওইপাঠ নিম্নবর্গের বিপুল সংখ্যক জনগণের স্বকীয় যে অবদান, যা উচ্চবর্গের অবদান থেকে আলাদা, তার খবর রাখে না। যার খবরই রাখেনা তার ব্যাখ্যা সে করবে কি করে? 

নিম্নবর্গের মানুষের অশিক্ষিত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত তারা ইতিহাস কি? তার ধারাবাহিকতা কী এমনকি অধিকারের প্রশ্নে তারা অনেকটা নিস্পৃহ। প্রকৃতপক্ষে নিম্নবর্গের মানুষদের সচেতন করতে হবে একজন উচ্চবর্গীয় বেনিভোলেন্ট ইতিহাসবিদদের মধ্যে থেকে, যে নিম্নবর্গীয়দের সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক কাঠামো, যেমন নিম্নবর্গীয় মানুষের মৌখিক বয়ান, লোক কাহিনী, ছড়া ও গানের যে সরল উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার ভেতর থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ইতিহাসের কাজ শুরু করা। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ মানুষ কোন না কোন সময়ে জয়ী হয়। তারা জয়ী হতে না পারলে, তার উত্তরাধিকার যারা আছে তারা হবে। কারণ ইতিহাসের দলিল মানুষের সংগ্রাম ও অধিকারের দলিল। 

পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত করে সেজন্য নিম্নবর্গের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। যদি ঐক্যবদ্ধ না করা যায় তাহলে শ্রেণী বিভাজনের যাঁতাকলে পূর্বের ন্যায় পিষ্ট হতে হবে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না। উচ্চবর্গের লোকেরা যেভাবে ধর্ম অঞ্চল সামাজিকতা ইতিহাস বিভাজন করে খড়গহস্ত হয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করে অনুরূপ একই কর্তৃত্বে নিম্নবর্গকে শোষিত করে যাবে। 

ইতিহাস সঠিকভাবে বিবৃত না হলে কোন না কোন সময়ে মানুষ শোষিত হয় কারণ ইতিহাসের সঙ্গে শ্রেণীর একটা সম্পর্ক আছে। যে জায়গায় ইতিহাস নিয়ে সে জায়গার মাটির রং ও সংস্কৃতির কি ধরন তা বোঝা অনেক কষ্টসাধ্য। এসব কথা অন্যরকম করে ভাবেন আন্তোলিও গ্রামসি। অন্যভাবে যদি বলি মিশেল ফুকো। তিনি শ্রেণীর কথা তেমন করে ভাবেন না। ব্যক্তি তার কাছে যত বড়, শ্রেণী তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রামসি আর ফুকো এদের কে এত বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার প্রধান কারণ হলো, তারা উভয়ই নিম্নবর্গ ইতিহাস নিয়ে চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। 

উত্তর ঔপনিবেশিক মানস গঠনে নিম্নবর্গীয়দের বেশি দরকার। ইতিহাসের আলোকে তাদের আলোকিত করে সামনের দিকে নিয়ে আসা। এখানে আরো একটি কথা বলা জরুরি যে, নিম্নবর্গীয়দের অধিকারবোধ প্রচার করে আলোড়ন সৃষ্টি করে পরবর্তী পর্যায়ে চুপসে যাওয়া নয়। মৌলিক পরিবর্তন ও অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলে, সেটি কেবল নিস্ক্রিয় বিপ্লব বা প্যাসিভ বেভুলেশন হবে। আন্তোলিও গ্রামসি তার প্রিজন নোটবুকস এ ধরনের বিশাল প্রকৃত বিপ্লব প্রকৃত বিপ্লবকে যথেষ্ট ক্ষতি করে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে নিম্নবর্গীয় মানুষেরা এসব জানে না, তাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বীর্যবান করে তুলে আনবে ঐতিহাসিকেরা। 



সহায়ক গ্রন্থ 

১) উপনিবেশপূর্ব বাংলার সমাজ সংস্কৃতি 
২) রোমিলা থাপার, ভারত ইতিহাস 
৩) ইরফান হাবিব, Colonial Transformation in India 
৪) বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব 
৫) Maurice Goodlier; Notions of Asiatic mode of Production 
After marks & Engels 
৬) ভারতে বৃটিশ শাসন; কার্ল মাকর্স 
৭) ডমিনেন্স উইদ আউট হেজিমনি; হিষ্ট্রি এন্ড পাওয়ার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া ১৯৯৮ 

1 comment:

  1. অত্যন্ত জরুরি তথ্যসমৃদ্ধ। শ্রেণীহীণ সমাজ গঠন কি সোনার পাথরবাটিই থাকবে?

    ReplyDelete