গল্প - রঙ্গন রায়
Posted in গল্পললিতমোহন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটা মারুতি এইট হান্ড্রেড এসে থামলো। একটু পরেই প্রেয়ারের ঘন্টা পড়বে। আমি, অর্ণব আর সৌমেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজ আমাদের ক্লাস নাইনের প্রথম দিন। একটা কথা সিনিয়রদের কাছে এতদিন শুনে এসেছি যে নাইন মানেই লাইন মারা শুরু। ক্লাস এইট অবধিও আমরা যারা হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে এসেছি আজ তারা সবাই ফুলপ্যান্ট।
মারুতি এইট হান্ড্রেডের ভেতর থেকে আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো। জানিনা নাইনে উঠলে আমাদের ছেলেদের চোখে মেয়েরা বেশি সুন্দরী হয়ে যায় কি না, কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে চোখ আটকে যেতে বাধ্য। টুকটুকে ফরসা গায়ের রং। নীল সাদা ইউনিফর্মে তাকে আরোও সুন্দর লাগছে। অর্ণব আর সৌমেন হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
মেয়েটা নামার পর গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক। সম্ভবত মেয়েটির বাবা।
গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় মেয়েটি একবার আমাদের দিকে এক ঝলক তাকালো। তারপর সামনের রাস্তা ধরে অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো লোকটির সঙ্গে।
"উফফফ, ঘ্যামা দেখতে রে মাইরি! আগে কোনোদিন দেখিনি তো! আজ প্রথমদিন বোধহয়। কোন ক্লাসে যে ভর্তি হল! দেখেতো আমাদের বয়সীই মনে হচ্ছে।"
সৌমেনের এই কথায় আমার খুব রাগ হলো। যেই একটা মেয়ে দেখলো অমনি ওটা ওর চাই। এসব একদম ঠিক না।
অর্ণব ওর কথায় হেসে উঠতেই প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ে গেলো। আমরা তাড়াতাড়ি লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
মেয়েটার নাম জানতে পারলাম প্রথম পিরিয়ডে নাম ডাকার সময় ।
তানিয়া। তানিয়া চক্রবর্তী।
কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগলো যেটা জেনে সেটা হলো এত সুন্দর দেখতে মেয়েটা কথা বলতে পারেনা। কেন ভগবান ওকে সব দিলেও আসল জিনিসটাই দেয়নি! আমার ভীষণ কষ্ট হলো মেয়েটার জন্য। একটা দিন আমরা বন্ধুদের সাথে কথা বলতে না পারলেই কেমন ছটফট করতে থাকি, আর ও কোনোদিনই বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারবেনা। কথা বলতে না পারার জন্য হয়তো ওর কোনো বন্ধুই হবেনা সেভাবে।
কিন্তু আমার ভাবনা ভুল ছিল। টিফিনের সময়ই দেখলাম তানিয়া যে বেঞ্চে বসেছিল তার বাকি মেয়ে গুলোর সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কথা বলতে পারেনা বলেই বোধহয় ওকে সাহায্য করবার জন্য, সহানুভূতি থেকে বন্ধু হয়েছে ওর। জয়া আর মোহিনী ওকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে ওদের সেকি খিলখিল হাসি!
টিফিনে বাইরে বেরিয়ে সৌমেন আমাদের বললো, "ধুস! যাওবা ভেবেছিলাম নাইনে উঠে একটা দারুণ মেয়েকে লাইন মারবো, সেটাও গুব্লেট হয়ে গেলো। প্রথম বলেই আউট হয়ে গেলাম।"
"আমি তো মারবো!"
অর্ণব চোখ নাচিয়ে বলে উঠলো।
সৌমেন অবাক হয়ে বলল, "মানে? কাকে মারবি? ওই বোবাটাকে?"
"ধুর, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি! ওর পেছনে লাইন মারলে তো ওদিক থেকে কোনোদিনই সিগনাল আসবেনা। তাহলে আমার টাওয়ার খাড়া হবে কী করে অ্যাঁ!" এই বলে ও বিশ্রী শব্দে হাসতে লাগলো। "আমাদের প্রাইভেটে একটা মেয়ের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে চোখাচোখি হচ্ছে। যদ্দুর জানি ওর এখনো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি নাইনের হাতেখড়িটা এবার সেরে নেবো ভাবছি।"
ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো কষিয়ে দুটোকে যদি চড় মারতে পারতাম তাহলে ভালো লাগতো। একজন বোবা মেয়ের প্রতি কী ভাষা ওদের! কিন্তু সৌমেনের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবোনা বলে চেপে যেতে হলো।
ছুটি হলে আমরা সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্রিজে এসে দাঁড়াই। এখান দিয়ে ছুটির পর সব মেয়েরা যায়। আরেক প্রস্থ আমাদের মেয়ে দেখা শুরু হয়। এই অভ্যাসটা ক্লাস এইট থেকে চালু হয়েছে। ক্লাস নাইনের প্রথম দিনেও তাই নিয়মের ব্যাতিক্রম করা কোনোভাবেই চলেনা। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় তানিয়াদের মারুতিটা নজরে এলো। ভীড়ের জন্য আস্তে আস্তে যাচ্ছে। আমি জানালার দিকে তাকালাম। তাকাতেই তানিয়ার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে গেলো। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাইনা আমার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয়ে যাই। আমি একটু অবাক হলাম। গাড়িটা যখন সামনের দিকে চলে যাচ্ছে তখনও ও মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আশ্চর্য তো! আমাকে নোটিশ করেছে নাকি! একটু ভালোও লাগলো। আমার সত্যিই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার ইচ্ছা। সহানুভূতি থেকে না। এমনি ওর সাথে যদি বন্ধুত্ব হয় তাহলে খুব ভালো হবে। কী ভালো হবে বলতে পারবোনা। হয়তো ওর প্রতি সহানুভূতিই মনে হবে ব্যাপারটা , কিন্তু বন্ধুত্ব কি এমনি এমনি হয়না?
সেদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে বারবার তানিয়ার মুখ মনে পড়ছিলো। ওর মুখে আমি কোনো হাসি দেখিনি। হাসলে ওকে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগবে! নাহ, ওর সাথে বন্ধুত্ব করতেই হবে। কিন্তু কীকরে করবো! কিছুতেই তো মাথায় আসছেনা! ওকে গিয়ে কিছু বললে তো ও তার উত্তরও দিতে পারবেনা। আর এমনি এমনি ওকে গিয়ে বলবো যে আমি তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই! ইশশ! নানা। এটা ভীষণ কেমন কেমন যেন।
সপ্তাহ খানেক পর টিফিনের সময় আমি সৌমেনদের থেকে সুযোগ বুঝে কেটে পড়লাম। অনেক ভেবেছি আমি। তানিয়ার সাথে বন্ধুত্ব করবার এই একটাই রাস্তা আছে বলে আমার মনে হয়েছে। ওর কাছে সরাসরি যাওয়া। কিন্তু সেই সময় অন্য কেউ থাকলে হবেনা। একা একা পেতে হবে ওকে। আমি এতদিন দেখেছি যে ও টিফিনের সময় বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পরই ক্লাসে ফিরে আসে। একাই থাকে এইসময়টায়। ক্লাসের বাকিরা বাইরে ঘুরপাক খায়। ও এক মনে বই পড়ে।
আমি সাহস করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
"হাই , আমি রাহুল।"
তানিয়া বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো।
"তোকে রোজই দেখি বই পড়িস। বাইরে ঘুরতে যাস না কেন?"
প্রশ্নটা করেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। ও উত্তর দেবে কী করে! ছিঃ কি গাধা আমি!
"মানে বাইরে বেরোলেই তো পারিস। সবসময় ঘরে থাকা কি ঠিক!"
তানিয়া আমার দিকে তাকিয়েই আছে। আশ্চর্য! ওর মুখে কোনো এক্সপ্রেশন নেই! আমাকে দেখে অবাকও হয়নি!
"বলতে কেমন যেন লাগছে, আসলে আমি তোর বন্ধু হতে চাই।" বলে আমি একটা কাগজ ওর ডেস্কে রাখলাম। "এটা আমার হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার। নাইনে ওঠার পর বাবা আমাকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। সারাদিনে এক ঘন্টা অন করার নিয়ম। তোর যদি হোয়াটস অ্যাপ থাকে তাহলে আমাকে পিং করিস। কথা হবে।"
এরপর আমি দৌড়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম।
কথা হবে!
কথাটা বলতেই কেমন যেন লাগছিলো। আমার পুরো অ্যাপিয়ারেন্সটাই কি খুব বোকা বোকা ছিল? তানিয়া কি খারাপ পেলো? কিন্তু আমি তো খারাপ কিছু করিনি! বন্ধু হতেই তো চেয়েছি! ওর যদি হোয়াটস অ্যাপ না থাকে! আমি জেদাজেদি করাতে বাবা মোবাইল কিনে দিয়েছে , কিন্তু ওকে তো নাও দিতে পারে!
যা হবার হবে। হাত থেকে এখন তীর বেরিয়ে গেছে। তাছাড়া এই ঘটনা তো ও ওর বান্ধবীদের বলতেও পারবেনা। কাজেই কেউ জানবেনা যখন তখন অস্বস্তির কিছু নেই। কিন্তু তবুও একটা অস্বস্তি থেকেই গেলো।
যখন কথা বলছিলাম তখন মেয়েটির মুখে কোনো এক্সপ্রেশন ছিলনা। যে কথা বলতে পারেনা তার কি এক্সপ্রেশনও থাকেনা?
২
"এভাবে আজ অবধি কেউ আমার বন্ধু হয়নি। তানিয়া।"
প্রথম এই ম্যাসেজটা যখন হোয়াটস অ্যাপে ঝঙ্কার তুলে ঢুকলো তখন সবেমাত্র আমি মোবাইল খুলে অনলাইন হওয়ার অনুমতি পেয়েছি। ঘড়িতে পোনে দশটা বাজে।
ম্যাসেজটা পড়ে খুশিতে আমার মুখ ঝলমল করে উঠলো। এই তো কথা বলেছে! টেকনোলজির কি অসীম ক্ষমতা, বোবাকেও কথা বলাতে পারে। হ্যাঁ এটা কথাই তো। কমিউনিকেশন! ভাবের আদানপ্রদান।
ভাব!
ছোটবেলায় আমরা আড়ি আর ভাব নিয়ে বিভিন্ন ছড়া শুনেছি। আড়ি আড়ি আড়ি, কাল যাবো বাড়ি, পরশু যাবো ঘর, হনুমানের ল্যাজ ধরে টানাটানি কর।
আমার হাসি পেয়ে গেলো। ভাবের ছড়াটা কি যেন ছিল!
লিখলাম, "যাক, তাহলে কোনো না কোনো ভাবে প্রথম হওয়া গেলো!" লেখার সঙ্গে একটা হাসির ইমোজিও জুড়ে দিলাম।
ওধার থেকে এবার ভেসে এলো, এইচ আর দুটো এম, অর্থাৎ হমম।
এরকম কেউ লিখলে কনভার্সেশন চালিয়ে যাওয়াটা ভীষণ চাপের হয়ে যায়। আমি সেই হাসির ইমোজিটাই আরেকবার পাঠিয়ে দিলাম।
প্রোফাইল পিকচারে একটা গোলাপ ফুলের ছবি দেওয়া। আমার ইমোজিটা সীন করে রেখে দিয়েছে তানিয়া। রিপ্লাই নেই দেখে দমে গেলাম। তবে কি আমার দেওয়া রিপ্লাইয়ের প্রগলভতা ওর ভালো লাগেনি?
সেদিনের পর থেকে টুকটাক করে কথাবার্তা শুরু হলো। বেশি এগোয়না কনভার্সেশন। ও কিছুক্ষণ পর hmm লিখে ছেড়ে দেয়। নয়তো এক্সপ্রেশনলেস যে ইমোজিটা আছে সেটা পাঠায়। এই ইমোজিটা দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। এটার আমি কোন মানে ধরবো? এটা পাঠিয়ে ও কী বলতে চাইছে?
ইমোজিগুলো যে বা যারা ডিজাইন করেছে তাদেরকেও প্রশ্নটা করা উচিৎ। তাদের সামনে পেলে আমি নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতাম , এরকম এক্সপ্রেশন লেস ইমোজি বানানোর মানে কী?
একদিন তানিয়া হঠাৎ লিখলো , "অনেক কটা হাসির ইমোজি পাঠা তো!"
আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কীরকম ধরণের কথা! হাসির ইমোজি নিয়ে কী করবে ও?
তবুও কোনো প্রশ্ন না করে যতরকম হাসির ইমোজি আছে সব কটা এক সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। কোনোটা হেসে গড়িয়ে পড়ছে , কোনোটার হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল পড়ছে , কোনোটা দাঁত ক্যালাচ্ছে।
সীন করার পরই হঠাৎ ও অফ হয়ে গেলো। আমারও বরাদ্দ সময় ফুরিয়ে যাওয়ায় মোবাইল বন্ধ করে খেতে যেতে হলো। আবার কাল অবধি অপেক্ষা।
৩
"ভাই , একটা ঘটনা শোন, আমি মামার সঙ্গে মামি দেখতে গেছি -"
অর্ণবের কথা শেষ করতে না দিয়ে সৌমেন বললো, "ক্বী! মামার সঙ্গে গেছিস মামি দেখতে! হ্যা হ্যা হ্যা!" সৌমেন সহকারে আরোও যারা ছিল তারা বিটকেল ভাবে হেসে উঠলো।
অর্ণব বললো, "আরে মামি মানে মামার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেছিলাম।"
"তুই তোর মামার মামি ঠিক করতে গেছিলি! ওরে ঘটক কালী!"
"আহ গল্পটা শেষ করতে দে না।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ বল।" বাবলু হাসতে হাসতে বললো এবার।
"তো মেয়ের বাড়ি থেকে একগাদা মিষ্টি ভর্তি প্লেট দিয়েছে। এদিকে বাবা আমাকে বলে দিয়েছিলো যে ওখানে গিয়ে আদেখলামো না করতে, তো আমিও সেই পুরনো স্টাইলে গুলি চালিয়ে দিলাম।"
"কী করলি?"
"সাপও মারলাম, লাঠিও ভাঙলোনা! মুখে গোবেচারা ধরণের হাসি এনে হাত দুটো লম্বা করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, হেহে আবার এসবের কী দরকার ছিল! বলে হাত থেকে দুটো প্লেট নিয়ে থামাথামি না করেই স্টার্ট করে দিলাম। বলাতো যায়না, এসব বলাতে যদি দু চারটে টপাটপ তুলে রেখে দেয়!"
সবাই প্রথমে হেসে গড়িয়ে পড়ে শেষে অর্ণবের মাথায় গাট্টা দিয়ে বললো, "এটা কমন জোকস্, আমাদের হাসি পায়নি।" এই বলে আবার সবাই হেসে উঠলো।
সৌমেন বললো, "কি রে রাহুল , তুই হাসছিস না কেন? তোর হাসি পায়নি তাইতো? জানি জানি, এসব ঘাটিয়া কমেডিতে কি আর হাসি পায় তোর! দাঁড়া -"
বলে এবার ওরা সবাই আমাকে পাকরাও করে কাতুকুতু দেওয়া শুরু করলো। আমার কাতুকুতু একটু বেশি এটা ওরা জানে। কিন্তু আজ প্রথমবার আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার কোনো কিছুতেই একটুও হাসি পেলোনা!
ওরা কাতুকুতু দিতে দিতে হাঁপিয়ে গিয়েও যখন আমাকে হাসাতে পারলোনা তখন রাগের মাথায় আমাকে গাট্টা মারতে তাড়া করলো। এবার আমি পালালাম। কিন্তু ওদের সবাইকে একসঙ্গে নাস্তানাবুদ করতে পেরেও আমার একটুও হাসি পাচ্ছেনা।
আমি হাসছিনা কেন? না এটা ঠিক হলনা। আমি হাসতে পারছিনা কেন?
"আজ স্কুলে আসিস নি যে?"
ম্যাসেজের পিং শব্দটা মোবাইল ভাইব্রেট করে ঢুকতেই আমি ফেসবুক ছেড়ে হোয়াটস অ্যাপে চলে এলাম। তানিয়া লিখেছে। আমি টাইপ করলাম, "শরীরটা ভালো ছিলনা আজকে।" সাথে একটা মুখ ভারের ইমোজি জুড়ে সেন্ড বটনে চাপ দিলাম। সেকেন্ডের কয়েক ভাগের মধ্যেই নীল দুটো টিক পড়ে গেলো। সীন করেছে। ও কি আমার এই চ্যাট বক্সেই বসে আছে নাকি!
ওধার থেকে 'টাইপিং' দেখাচ্ছে। আমি অন্য কোথাও গেলাম না। অপেক্ষা করে থাকলাম।
"কী হয়েছে?"
"এই কিছুনা। সামান্য সর্দি লেগেছে।"
ওদিক থেকে এবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ভেসে এলো , "ডাক্তার দেখাস নি?"
এই সামান্য ব্যাপারে ডাক্তার দেখাবো! আমার হাসি পেতে গিয়েও পেলোনা। আশ্চর্য তো! হাসি পেলোনা কেন?
আমার দিক থেকে কোনো রিপ্লাই নেই দেখে তানিয়া এবার লিখলো, "সাবধানে থাক আর তোর সব দুঃখগুলো আমায় ইমোজি করে পাঠিয়ে দেতো! হিহি।" ম্যাসেজটার সঙ্গে কতগুলো হাসির ইমোজি পাঠালো মেয়েটা।
আমি এবার দারুণ অবাক হলাম। এর আগে কোনোদিন তানিয়া ওই এক্সপ্রেশনলেস ইমোজি ছাড়া আর কোনো ইমোজি ব্যবহার করেনি। ভেবেছিলাম ও বোধহয় ইমোজির ব্যাপারটা এখনো ভালো করে জানেনা।
আমি তাড়াতাড়ি ইমোজির স্টোরে গিয়ে যতরকম দুঃখের ইমোজি আছে সব কটা পাঠালাম তানিয়াকে। তানিয়া উত্তরে বড় একটা স্মাইলি পাঠিয়ে রেখে দিলো।
স্কুলে তানিয়ার ধারেকাছে যাইনা আমি। অন্যান্য ছেলেরা যেমন ওর সাথে সেভাবে মেশেনা, আমিও তাই। তবে এই রাত দশটার দিকে কিন্তু প্রায় রোজই ওর সাথে দু একটা কথা হয় আমার। আমি অন্য ছেলেদের মত না। আমার ওকে ভালো লাগে। বোবা হলে কি মানুষ কথা বলতে পারেনা? এইতো দিব্যি ওর সাথে কথা বলি আমি!
৪
"রাহুল চৌধুরী ক্লাসে আছে?"
ঘন্টাকাকু আমাদের ক্লাস নাইনের রুমে ঢুকে অংকের কড়া টীচার সত্যব্রত স্যারকে জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি অবাক হলাম। আমাকে কী দরকার? সত্যব্রত স্যার আমার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে বললেন। ক্লাসের সবাই এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
"তোমার বাড়ি থেকে লোক এসেছে। ব্যাগ গুছিয়ে নাও। তোমাকে বাড়ি যেতে হবে।"
ঘন্টাকাকুর এই কথায় আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। বাড়ির লোক কেন এসেছে এখন?
সব বন্ধুদের জিজ্ঞাসু চোখ পেরিয়ে আমি স্যার কে বলে ক্লাস থেকে বের হলাম। ঘন্টা কাকু আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ওঁর সাথে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম অফিসের সামনে আমার কাকা খুবই বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। আমি কাছে যেতেই ঘন্টা কাকুকে বললেন , "তাহলে ওকে নিয়ে গেলাম?"
ঘন্টা কাকু মাথা নাড়াতেই কাকা বললেন ,"চল।"
"কী হয়েছে বলবে তো?"
কাকা কোনো কথা না বলে আমার হাত ধরেই নিয়ে চললো প্রায়।
সেইদিনের ঘটনা আমি সারাজীবনেও ভুলবোনা। কাকা সরাসরি আমাকে সেন্ট টমাস নার্সিং হোমে নিয়ে এলো। দেখি বাইরে আমার বাবা, মা, কাকিমা সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। সবারই চোখে দুঃখের একটা কালো ছায়া। আমি একটু অবাক ছাড়া আর কিছু হলাম না।
বাবা এসে এবার আমার কাঁধ শক্ত করে ধরে বললো, "পিন্টু মনটাকে শক্ত কর। তোর ঠাম্মা ... তোর ঠাম্মা ... আর নেই -" বলে বাবা আমাকে শক্ত থাকতে বলে নিজেই ভেঙে পড়লো কান্নায়। স্বাভাবিক, নিজের মায়ের মৃত্যুতে তার ছেলে তো কাঁদবেই। কিন্তু যে ঠাম্মার বুকে পিঠে আমি বড় হয়েছি, যার নয়নের মণি আমি, সেই আমিই কিন্তু অস্বাভাবিক রয়ে গেলাম। আমার একটুও দুঃখ হচ্ছেনা। একটুও কান্না পাচ্ছেনা। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম নার্সিং হোমের সামনে পাথর বসানো চকচকে রাস্তাটার ওপর। একটু দূরের বড় রাস্তা দিয়ে অজস্র গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। সব কিছু স্বাভাবিক চলছে। আমি তার মাঝখানে অস্বাভাবিক একটা ছেলে হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
"কেমন আছিস?"
আজ অনেকদিন পর আমি অনলাইন হয়েছি। নেট অন করার সাথে সাথে ম্যাসেজটা এসে ঢুকলো ফোনে।
"ভালো।"
"ও।"
এরপরে আর কিছু লেখা যায়না। অন্তত আমি পারিনা। সীন করে রেখে দিলাম। মোটামুটি সবাই জানে আমার ঠাম্মা মারা গেছে। তানিয়ারও জানার কথা। ও কেন একদিনও আমাকে এই নিয়ে কিছু বলেনি? সব বন্ধুরা যেখানে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছে। মন খারাপ না করতে বলেছে! যদিও আমার একটুও মন খারাপ হয়নি। কান্নাও পায়নি। কিন্তু এটুকু তো সবাই করে। হ্যাঁ এই সহানুভূতিটা আমি চাইছি সবার কাছে। তানিয়া কেন দেবেনা। কেন?
আমার মাথা গরম হতে শুরু করলো। খুব রাগ হলো। আমি কতদিন হল হাসতে পারছিনা, কাঁদতে পারছিনা এ আমার কী অসুখ হয়ে গেলো? আমার এখন পৃথিবী ফাঁটানো রাগ উথলে উঠছে। মনে হচ্ছে সব ভেঙে চুরে লণ্ডভণ্ড করে দিই।
"রাগ করিস না। রাগ করতে হয়না। ঠাম্মারা তো একদিন মারা যাবেই। তাইনা? এটা তো স্বাভাবিক।"
ম্যাসেজটা আসতেই আমি চমকে উঠলাম। ও জানলো কী করে যে আমি রেগে আছি? এটা কী করে সম্ভব? এবার একটা মুখ ভার করা ইমোজি ভেসে এলো।
আমার হাত চলছেনা। আমি টাইপ করতে পারছিনা। এবং ঠিক যেটা ভেবেছিলাম সেই ম্যাসেজটাই ভেসে এলো এরপর।
"তোর সব রাগগুলো আমায় দিয়ে দে তো!"
পাগলের মত আমি ইমোজি স্টোর খুল্লাম। তারপর যতরকম রাগের ইমোজি আছে সব ওকে পাঠিয়ে দিয়ে মোবাইল অফ করে দিলাম। আহ! শান্তি লাগছে। ভালো লাগছে ভীষণ। রাগ খুব খারাপ জিনিস। খুব। ঠাম্মা আমাকে বলতো গীতায় নাকি লেখা আছে যে রাগ একদম ভালো জিনিস না। মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
এখন আমার কোনো রাগ নেই।
৫
"ঠাম্মা মারা গেলো আর আমাদের নেমন্তন্নও করলিনা শ্রাদ্ধে! কতদিন কোনো নেমন্তন্ন বাড়ি খাইনি শালা!"
সপ্তর্ষি এ কথাটা বলতেই সৌমেন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাঠের মাঝখানে মারামারি শুরু হয়ে গেলো ধুন্ধুমার। ধূলো উড়ছে ওদের ধস্তাধস্তিতে। সৌমেন আমাকে খুব ভালোবাসে জানি, কিন্তু আজ প্রথম দেখলাম বন্ধুকে বাজে কথা বললে সে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সপ্তর্ষি 'বি' সেকশনের। আমরা 'এ' সেকশন। দুজনেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া হয় প্রায়ই। আর আজ তো সৌমেন ওদেরকে পিটানোর দারুণ সুযোগ পেয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে ব্যক্তিগত মারপিট সেকশন গত হয়ে গেলো। আমাদের দুই সেকশনের সব ছেলেরাই এবার চলে এসেছে। এরা সেই ক্লাস ফোর থেকে মারমিট করে আসছে। এখনো বড় হলনা।
আরে আমাকে ওই কথা বলেছে তো কী হয়েছে! আমার তো একটুও রাগ হয়নি। আমার এখন আর রাগ হয়না। এখন একটুও অবাক লাগেনা এসব বিষয়ে। এই যে হাসি পায়না, কান্না পায়না, রাগ ওঠেনা, কিচ্ছুনা, এসব তো স্বাভাবিক ব্যাপার! এই নিয়ে এত মারামারির কী আছে!
দুই সেকশনের সবাইকে টিফিনের পর মাঠে নীল ডাউন করে রাখা হলো। আমিও দলে আছি। মারামারি না করলেও দোষ পুরো সেকশনের ওপর পড়েছে। সব ছেলেরা শাস্তি পাবে , মেয়েদের ক্লাস নেওয়া হবে খালি। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় এক ঝলক তানিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখি সে হাসছে। আশ্চর্য! এই প্রথম আমি তাকে সামনাসামনি হাসতে দেখলাম! কী সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে! আমি ভীষণ অবাক হলাম। সেইসঙ্গে আনন্দও হলো। কিন্তু মুখে কোনো হাসি ফুটলো না আমার।
"তোদের শাস্তি পেতে দেখে আমার সেকি হাসি পেয়েছিল!" ম্যাসেজটার সঙ্গে একগাদা হাসির ইমোজি পাঠালো তানিয়া।
আমি কিছুই টাইপ করতে পারছিলাম না। কী উত্তর দেব? এই কথায় হাসবো না কাঁদবো? নাকি রাগ করবো? কোনো অনুভূতিই তো হচ্ছে না আমার!
অবশেষে শুধু চোখওয়ালা মুখ হীন যে ইমোজি আছে সেটা পাঠিয়ে দিলাম। অর্থাৎ কিছুই বলার নেই আমার। আমি নিশ্চুপ।
ওদিক থেকে আর কোনো ম্যাসেজ এলোনা। সীন করে রেখে দিয়েছে। আমি মোবাইল বন্ধ করে খেতে গেলাম।
মা আমাকে বললো, "কিরে , এত কম ভাত নিয়েছিস কেন?"
"খেতে ইচ্ছা করছেনা মা।"
অনেক কষ্টে কথাটা বের হল। কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা আমার। আমার যে কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছিনা। এইসব অদ্ভুত কথা কি মা'কে বলা যায়? আমার হাসি পাচ্ছে না, আমার কান্না পাচ্ছেনা, আমার রাগ উঠছেনা - ধুর! যত্তসব!
৬
পরদিন ঘুম থেকে উঠে শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগলো। বাথরুমে গেলাম। আয়নায় দেখলাম নিজেকে। চোখের তলে ডার্ক সার্কেল পড়েছে। মাথার চুলে কদিন শ্যাম্পু দেওয়া হয়নি। আজ দিতে হবে। ছুটির দিন।
এমন সময় মা চিৎকার করে ডাকলো, "পিন্টুউউউ! তোর ফোন এসেছে। একটা মেয়ে কথা বলছে। দেখ কে ফোন করলো!"
আমি ছুটে গেলাম ঘরে। মা ফোনে হাত চাপা দিয়ে চোখ নাচিয়ে বললো,
"কীরে , নতুন বান্ধবী নাকি!"
মায়ের চোখে রহস্যভরা হাসি। কিছুই না বলে আমি মায়ের কাছ থেকে ফোনটা নিলাম। ওধার থেকে একটা অপূর্ব সুন্দর অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
আমি এতটা অবাক জীবনে হইনি। সবাই বড় হলে অনেক কিছু হয়। আমি কি শুধুই অবাক হবো! কিন্তু আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে "হ্যালো" বলতে। এযে মীরাকল হয়েছে! এযে অভাবনীয়! কিন্তু আমি বলতে পারছিনা কেন? আমার জীভ একটুও নড়ছেনা। আমি প্রাণপন চেষ্টা চালালাম। কিন্তু আড়ষ্ঠ জীভ এক চুলও নড়লোনা।
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শিরদাঁড়া দিয়ে এতদিন ভূতের বইয়ে পড়ে আসা সেই বিখ্যাত বরফের হিম স্রোত সত্যি সত্যিই বয়ে নেমে এলো। আতঙ্কে আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। আমি কথা বলতে পারছিনা। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছিনা। কিন্তু এর জন্য আমার রাগ হচ্ছেনা, হাসি পাচ্ছেনা, কান্নাও পাচ্ছেনা। আমি সেই এক্সপ্রেশনলেস ইমোজিটার মত ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছি শুধু।
"হ্যালো রাহুল, চিনতে পারছিস? আমি তানিয়া বলছি , তানিয়া চক্রবর্তী ..."
0 comments: