0

ধারাবাহিক - গার্গী বসু

Posted in


(পর্ব ৬)

ঠিকানা খুঁজে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল তাঁকে। অনাথআশ্রমের সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ফাদার। ভায়োলেট পৌঁছল তাঁর সাথে দেখা করতে। ফাদার একাই থাকেন শহরের প্রান্তে। একটা পুরনো ধাঁচের বাড়ি। দরজার কাছে আগাছার জঙ্গল। ভেতরে মানুষ থাকে কিনা বোঝা যায় না। দিনের আলো ফুরিয়ে আসেনি এখনও, তবুও ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে। চারিদিকে প্রচুর কাগজপত্র ছড়ানো। টেবিলের ওপরটা নানা ধরণের জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে আছে। বই-খাতা খোলা অবস্থায় রাখা, তার সাথে রাখা মোমবাতি, খোপকাটা কাঠের বাক্স, রঙিন কাঁচের শিশি আর লম্বা লম্বা পাখির পালক। জায়গাটা প্রায় জনমানবহীন। একজন বয়স্ক মানুষের এইভাবে একা থাকতে অসুবিধা হয় না? ভায়োলেটের মনের কথা যেন বুঝে ফেললেন ফাদার। দুধসাদা চুল দাড়ির আড়ালে মুচকি হেসে জানালেন বুড়ো বয়সে একটু ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলতেই ভাল লাগে তাঁর। তাছাড়া, তাঁর বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে আসেন তাঁর সাথে দেখা করতে। কি সহজ করে কথা বললেন। যেন আগে থকেই জানতেন ভায়োলেটের আসার কথা। ভায়োলেট আর দ্বিধা করল না। একটা চেয়ারে গুছিয়ে বসে নিজের কথা বলল। বিলিকে জড়িয়ে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, সালেমের ইতিহাসে লেখা উঈচ ট্রায়ালের কথা, তিতুবার কথা এমনকি বিলির চেহারার সাথে তিতুবার চেহারার সাদৃশ্যের কথা কিছুই বাদ দিল না সে। ফাদার একটু সময় নিলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘‘অনাথআশ্রমে আসার আগে বিলি মিসেস নিনিবের বাড়িতে কিছুদিন ছিল। তখন এক রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় বিলিকে দেখে মিসেস নিনিবে ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। এমনকি বিলিকে আর একদিনের জন্যেও কাছে রাখতে চাননি। এই ঘটনার পরে মিসেস নিনিবে পুলিশের কাছে একটি জবানবন্দী দেন এবং চাঞ্চল্যকর রোমহর্ষক মজার বৃত্তান্ত হিসেবে সেই জবানবন্দী খবরের কাগজে বেরোয়। এই সেই খবর। এই বলে ফাদার টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজপত্রের ভেতর থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে ভায়োলেটের হাতে দিলেন। 

ভায়োলেট এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল মিসেস নিনিবের জবানবন্দী। খানিকটা এরকমঃ

বিলিকে মিসেস নিনিবের বাড়িতে নিয়ে আসার পরে এক গভীর রাত্রে মিসেস নিনিবে হঠাত আবিষ্কার করেন ঘরের ভেতরে বিছানার ওপর বিলি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আর ওর মাথার কাছে বসে আছে অতিকায় একটা কাক। ঘরের সব আলো নেভানো। কিন্তু মিসেস নিনিবে কাকটাকে স্পষ্ট দেখতে পান। কি করে? পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে মিসেস নিনিবে এক অদ্ভুত কথা বলেন। উনি যখন ঘরে ঢোকেন তখন উনার মনে হয় একটা হাল্কা নীলচে আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে। অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখেন ঘুমন্ত বিলির দুচোখ বন্ধ কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ওর কপালে আরেকটা চোখ মিসেস নিনিবের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের মণি স্থির নয়, পাহারাদারের মতো সেই চোখটা এদিক ওদিক তাকিয়ে সারা ঘরে নজর রাখছে। সেই চোখ স্নিগ্ধ এক নীল আলোতে জ্যোতির্ময়।মিসেস নিনিবের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। উনি চিৎকার করতেই কাকটা নড়েচড়ে ওঠে। ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেন মিসেস নিনিবে। ওঁর মনে হয় ‘অলৌকিক কিছু’র কবলে পড়েছে বিলি। পুলিশ এসে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পায়নি।

তৃতীয় চোখ! অতিকায় কাক! ঠিক এরকম ভাবেই যে তিতুবাকে দেখেছিল প্যারিস স্যামুয়েলের মেয়ে বেটি আর তার দিদি আবিগেইল! বিলি শুধু অবিকল তিতুবার চেহারাই পায়নি তিতুবার সাথে জড়িয়ে থাকা আরও অন্যান্য অলৌকিক ঘটনাগুলো বিলির সাথেও ঘটছে। ভায়োলেট বুঝল ঠিক যেখানে এই রহস্যের সূচনা হয়েছিল ঘটনাচক্রে সেখানেই আবার পৌঁছে গেছে সে। অর্থাৎ সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আরও কি কি রহস্য জুড়ে আছে ওই এক রত্তি মেয়ের সাথে কে জানে!

ফাদার বললেন, “খবরের কাগজে এই খবর বেরনোর পরে দুজন আমার সাথে যোগাযোগ করেন। একজন মাদাম ভার্জিনিয়া কেন্ট মিলার, যিনি নিজেকে বিলির পিসি হিসেবে পরিচয় দেন এবং আরেকজন স্যার জেরাল্ড বি গার্ডেনার।’’

ভায়োলেট লাফিয়ে উঠে বলল, ‘‘জেরাল্ড গার্ডেনার!!! ‘উইচক্র্যাফট টুডে’, ‘মিনিং অফ উইচক্র্যাফট’ এইসব বই যার লেখা? সেই জেরাল্ড গার্ডেনার? আমি ওর লেখা বই পড়েছি।”

উত্তেজিত ভায়োলেটকে হাত তুলে শান্ত করলেন ফাদার। তারপর বললেন, ‘‘হ্যাঁ তার কথাই বলছি। এই দুজনেই আমার কাছে বিলির খোঁজ করেন। দুজনেই নিজেদের উদ্দেশ্য গোপন করলেও আমি বুঝতে পারি, বিলি যে সাধারণ শিশু নয় এটা ওরা দুজনেই জানেন। অন্য সবাই মিসেস নিনিবের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও ওরা ছুটে এসেছে সেই মেয়ের খোঁজে। জেরাল্ড গার্ডেনারের কট্টর বিশ্বাস, উইচক্র্যাফট বা ডাকিনীবিদ্যায়; যা পৃথিবীতে সেই আদিম যুগ থেকেই বর্তমান কিন্তু এমন সত্যিকারের উঈচ বা ডাইনি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, যাদের মধ্যে কোন অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। যেমন ছিলেন ইয়র্কশায়ারের মাদার শিপটন, কিম্বা রাশিয়ার বাবায়াগা। মিসেস নিনিবের জবানবন্দী পড়ে ওর মনে হয় সালেম উঈচ ট্রায়ালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অভিযুক্ত তিতুবা ফিরে এসেছে বিলিন্ডা গ্রিনের রূপ ধরে। এখন যে কোন মূল্যে বিলিকে তার গবেষণার জন্য চাই। এমনকি অনাথআশ্রম থেকে মোটা টাকার বিনিময়ে বিলিকে কিনে নিতেও চায়। বলাই বাহুল্য আমি রাজি হইনি। ওর কাছেই আমি জানতে পারি থিওডোরার কথা।” 

থিওডোরা নামটা ভীষণ চেনা লাগে ভায়োলেটের। কোথাও যেন পড়েছে সে। চোখের সামনে ছাপার অক্ষরে নামটা ভেসে উঠলেও, কোথায় দেখেছে নামটা, কিছুতেই মনে পড়ল না। “থিওডোরা কে?” ভায়োলেট জিজ্ঞেস করল। 

উত্তরে ফাদার বললেন থিওডোরা নামের এক বিশালদেহি কাক নাকি তিতুবার সঙ্গী ছিল। রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে থিওডোরাকে তিতুবার কাঁধে এসে বসতে দেখা গেছে একাধিকবার। কথিত আছে থিওডোরার মৃত্যু নেই। ভায়োলেট একরকম অবিশ্বাসের গলায় বলল, “আপনার কি মনে হয় একথা সত্যি?” ফাদার বললেন, “মিসেস নিনিবের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ধরে নেওয়া যায় সে রাত্রে উনি থিওডোরাকেই দেখেছিলেন বিলির মাথার কাছে। আর জেরাল্ড মিথ্যা কথা বলার লোক নয়। ওর স্থির বিশ্বাস বিলিকে নজরে রাখলে আশেপাশে থিওডোরাকেও পাওয়া যাবে। হয়তো সত্যি থিওডোরা বিলির কাছাকাছি আছে। আমরাই তাকে দেখতে পাচ্ছি না বা চিনতে পারছি না।”

ভায়োলেট জিজ্ঞেস করল, “আর ভার্জিনিয়া? বিলির পিসি? উনিও তো অনাথআশ্রমে এসেছিলেন বিলির খোঁজে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন আদেও বিলির কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে কিনা। তাই শার্লি মেরিউইক নামে একটি মেয়েকে অনাথ সাজিয়ে উনি পাঠান বিলির উপরে নজর রাখতে। বলাই বাহুল্য শার্লির কাজই ছিল বিলির সমস্ত খবর ভার্জিনিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়া। শার্লি ছায়াসঙ্গী হয়ে বিলির সাথে সবসময় থাকত। আমি জানতে পারি অনেক পরে। প্রথমে আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল। পরে জানতে পারি ভার্জিনিয়া আদালতে প্রমাণ করেছে ওর ভাই এবং তার স্ত্রী দুজনের কেউই বেঁচে নেই। পথ দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই প্রাণ হারান। কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাবার সমস্ত সম্পত্তি বিলি পাবে তার আঠেরো বছর বয়স হলে। ততদিন পর্যন্ত বিলি কোন আত্মীয়ের কাছে থাকতে পারে। আর যদি আঠেরো পূর্ণ হওয়ার আগেই বিলির মৃত্যু হয় তাহলে তার সমস্ত সম্পত্তির একছত্র মালিকানা হবে ভার্জিনিয়ার। মিসেস নিনিবের জবানবন্দী পড়ে ভার্জিনিয়া শার্লিকে পাঠায় অনাথাশ্রমে। কিন্ত কিছু করার আগেই বিলির দিদা-দাদু এসে ওকে নিয়ে যায়।” 

ভায়োলেট মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। এত নীচে নামতে পারে কেউ? ঐ ছোট্ট মেয়েটা হয়তো জানেই না তাকে ঘিরে কত বড় ষড়যন্ত্র চলছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল বিলিকে কিছুতেই নিউইয়র্কে যেতে দেওয়া যাবে না। ওকে আটকাতে হবে।

ফাদার এবারেও ভায়োলেটের মনের কথা কিভাবে যেন বুঝে ফেললেন। 

বললেন, “আপনার ওপর আমাদের অনেক আস্থা মিস ভায়োলেট। আপনি যে বিলির শুভাকাঙ্খী সেটা আমরা জানি।”

আমরা?? ফাদার তো একাই থাকেন। এই আমরা মানে তাহলে কারা? 

সন্ধ্যে ঘন হয়ে আসছে বাইরে। এবার যেতে হবে। ভায়োলেট ফাদারকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় নেমে ধীরে ধীরে হাঁটছিল ভায়োলেট। মাথার মধ্যে হিজিবিজি কাটছে সদ্য পাওয়া তথ্য। হঠাত দূরে একটা তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাক শোনা গেল। কাকের ডাক। ভায়োলেট চমকে তাকাল চারিদিকে। দূরে রাস্তার আলোটা দপদপ করছে। তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। ঠিক তখনই খুব জোরে একটা ডানা ঝাপটানোর মত শব্দ হল। পাখির ডানায় কি এত আওয়াজ হয়? এটা কি কোনও পাখি নাকি অদ্ভুত কোন প্রাণী? শব্দ অনুযায়ী আয়তনে প্রাণীটা সাধারণ পাখির তুলনায় প্রায় দশগুণ বড়। ভায়োলেট সাহস পেল না পেছন ফিরে তাকানোর। দৌড়তে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে কিছু দূরে গিয়ে হঠাৎ পড়ে গেল সে। ঠিক তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা লোক এসে দাঁড়াল তার সামনে।

“মিস ভায়োলেট! আপনি এখানে?” লোকটা বলল।

অল্প আলোয় তার মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। ভায়োলেট শুধু বলতে পারল, “আমাকে বাঁচান।”

বয়স্ক লোকটা হাত ধরে তাকে তুলল। ভায়োলেট এতক্ষণে শ্বাস নিতে পারে। ততক্ষণে ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলিয়ে গেছে দূরে। ভায়োলেট দেখল, পড়ে যাওয়ার ফলে পায়ে চোট লেগেছে তার। বয়স্ক লোকটি বলল তার দোকান কাছেই। এই পথ দিয়ে রোজই সে দোকান থেকে বাড়ি ফেরে। ভায়োলেটকে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলে, উপায় না দেখে রাজি হয়ে গেল ভায়োলেট। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে লোকটির সাথে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল। আলাপচারিতায় জানা গেল বয়স্ক লোকটি বিলিন্ডার দাদু।

ভায়োলেটের মনে হল সে এক বিশাল রহস্য-বৃত্তের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বৃত্তের কেন্দ্রে আছে বিলি স্বয়ং। আর তাকে ঘিরে অনেক লোক। ভার্জিনিয়া কেন্ট মিলার, জেরাল্ড বি গার্ডেনার, অনাথাশ্রমের ফাদার, বিলির দিদা এমনকি সে নিজেও।পাশাপাশি চোখের সামনে ফুটে উঠল আরেকটা বৃত্ত। যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে তিতুবা। তাকে ঘিরে রয়েছে বেটি, আবিগেইল, স্যামুয়েল প্যারিস এবং আরও অনেক নারী-পুরুষ। ইতিহাস বলে সেই মর্মান্তিক ঘটনার শুরু হয় এক শীতের রাত্রে। প্যারিস হাউসের দুটি কিশোরী মেয়ে একই সাথে উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করে। কখনও তারা চিৎকার করে ওঠে, কখনও মৃগী রোগীদের মত তাদের সারা শরীর কাঁপতে থাকে, আবার কখনও হিজিবিজি ভাষায় অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কি সব যেন বলতে থাকে তারা। চিকিৎসক আসেন, কিন্তু রোগ ধরতে পারেন না। চিকিৎসকের সামনেই হাত–পা বেঁকে মুর্ছিত হয়ে পড়ে একটি মেয়ে। সবাই ভয় পেয়ে যায়। ক্রমে ঐ এলাকার এবং আশেপাশের এলাকার বারোজন অল্প বয়সী মেয়ে একইরকম অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কোনও চিকিৎসা, টোটকা, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কোনও কিছুতেই ফল হয়না। বাধ্য হয়ে ভীত–সন্ত্রস্ত মেয়েগুলিকেই জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, এ হল শয়তানের চক্রান্ত। কিছু কিছু এলাকাবাসীর নাম নিয়ে তারা বলে শয়তানের কুমন্ত্রণায় কাজ করছে এরা। সমগ্র সালেম জনপদ ধীরে ধীরে চলে যাবে শয়তানের কবলে। সঙ্গে সঙ্গে বিচারসভা বসে। সালটা ১৬৯২, ফেব্রুয়ারি মাস। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় দেড়শ জন লোককে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। চার বছরের শিশু, সেও বাদ যায়না। বলাই বাহুল্য তারা কেউই নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি। ১৬৯৩ সালের মে মাস পর্যন্ত দফায় দফায় শুনানি চলতে থাকে। কোনরকম প্রমাণের পরোয়া না করেই উনিশজনকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। একটা বেশ বড় গাছের ডালে উনিশটা ফাঁসে উনিশজন অভিযুক্তকে ফাঁসি দেওয়া হয়। একজন বয়স্ক মানুষকে বুকের ওপরে ওজন চাপিয়ে জ্যান্ত মেরে ফেলা হয় শুধুমাত্র ডাইনী সন্দেহে। কিন্তু তারপরেও কোনও সুরাহা মেলে না। তুঘলকি বিচারব্যাবস্থায় আস্থা হারিয়ে, ব্যাখ্যাহীন সন্দেহের বশে স্বজন হা্রিয়ে ক্ষেপে যায় এলাকার মানুষ।রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে এসে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় প্যারিস হাউসে।দ্রুত আগুণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তারা ফিরে যেতে থাকে। কিন্তু কর্কশ একটা ডাক শুনে পেছন ফিরে অনেকে দ্যাখে এক অতিকায় কাক তার বিশাল ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে প্যরিস হাউসের দিকে। ডানার আড়াল করে প্রানপণে কাকে যেন বাঁচাতে চাইছে সে।এই দৃশ্য স্তব্ধ করে দেয় সবাইকে। তারা নিশ্চিত হয়ে যায় শুভ হোক বা অশুভ কোন মায়ার খেলা নিশ্চয়ই জড়িয়ে আছে প্যারিস হাউসের সাথে। অচিরেই রেভারেণ্ড স্যামুয়েল প্যারিসের দিকে আঙ্গুল ওঠে। প্রভুর স্বার্থে এবং ভালবাসার প্যারিস হাউসের সম্মান বাঁচাতে এগিয়ে আসে তিতুবা। স্বীকার করে ঐ বিশাল কাক তার সহচরী, নাম – থিওডোরা। মুহূর্তেই তিতুবাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে আগুণে পুড়িয়ে তাকে মারা হবে এমন ঘোষণা শোনা যায়। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সবাই সেই দৃশ্য দেখতে ভিড় করে আসে। লম্বা কাঠের খুঁটিতে তিতুবাকে বেঁধে তার পায়ের কাছে শুকনো কাঠখড় দিয়ে অগ্নি-সংযোগ করা হয়। সবাই বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকে কাঠখড় সব পুড়ে যায় কিন্তু তিতুবার গায়ে আগুণ লাগেনা। আশ্চর্য! একবার, দুবার, তিনবারের চেষ্টাও বিফল হয়। কি এক অজানা কারণে তিতুবাকে ঘিরে অগ্নিবলয় তৈরি হচ্ছে, কিন্তু আগুণ তাকে ছুঁতে পারছে না। ভিড়ের মধ্যে থেকে চীৎকার ওঠে, “ডাইনী ডাইনী, ওটা একটা ডাইনী’’ পাথর ছুঁড়তে থাকে তারা তিতুবাকে লক্ষ্য করে। অবিচল তিতুবা মাথা তুলে আকাশের দিকে কাকে যেন খুঁজতে থাকে। পাথরের আঘাত লাগতে থাকে তিতুবার গায়ে। অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তিতুবাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। তিতুবা বারবার বলতে থাকে মেয়েদের অসুস্থতার কারণ সে জানেনা, সে জানেনা। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করে না সেই কথায়। থিওডোরা নামের অতিকায় কাকের দেখা মেলে, কারাগারের ছাদের ওপরে চক্কর খেতে খেতে করুণ সুরে ডাকতে থাকে কাকটা। সেই রাত্রে প্যারিস হাউসের আগুণে তার ডান দিকের ডানার পালক পুড়ে গেছে। ডান চোখটা আংশিক নষ্ট হয়ে গেছে। কারাগারের রক্ষীরা বলাবলি করে, তারা তিতুবাকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছে, “তিতুবার মৃত্যু নেই। থিওডোরার মৃত্যু নেই। ফিরে আসবে, তারা ফিরে আসবে।” 

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভায়োলেট একেবারে উদাস হয়ে গেছিল। হঠাত একটা কথা মনে হতে প্রায় লাফিয়ে উঠল সে। আর পরক্ষনেই পায়ের ব্যাথায় আবার বসে পড়ল চেয়ারে। বিলির দাদু জিজ্ঞেস করলেন, “কি হল মিস? কি ব্যাপার?” ভায়োলেট তার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, “বিলির দিদার নাম কি?” 

“থিওডোরা গ্রিন।” উত্তর দিলেন তিনি। 

ঠিক। একেবারে ঠিক। সব ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে এবার। ভায়োলেটের সামনে পরিস্কার হয়ে যায় সব। কেন বিলির দিদার গলার স্বর এত কর্কশ! কেন তার ডান হাত আর ডান চোখ আগুণে পোড়ার চিহ্ন বহন করে! বিলির স্কুলবুকে অভিভাবকের জায়গায় এই নামটাই লেখা ছিল ছাপার অক্ষরে।

এই সময়ে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে এলেন বিলির দিদা। ভায়োলেট তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে থাকল, “তুমি! তুমিই থিওডোরা। তিতুবার সহচরী থিওডোরা। হ্যাঁ! সব মিলে যাচ্ছে। প্যারিস হাউসের আগুণে তোমার ডান দিকের ডানা ঝলসে যায়, ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সেই চিহ্ন তুমি মানুষ রূপেও বহন করে চলেছ।”

একটু চমকে গিয়েও থিওডোরা কোনও কথা বললেন না। কি এক আগুণ যেন তার চোখে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। তাঁর শক্তপোক্ত মধ্যযুগীয় কালো জুতোটা খুলে দাঁড়ালেন সামনে। ভায়োলেট স্পষ্ট দেখল, মানুষরূপী থিওডোরার পায়ের পাতা দুটো অবিকল পাখির পা। আয়তনে বৃহৎ, লম্বা নখরযুক্ত তিনটে আঙ্গুল। দাদুর বানানো জুতোর আড়ালে লুকিয়ে থাকত এই পা দুটো। 

ভায়োলেটের মনে পড়ল শেক্সপীয়রের একটা লাইন – স্বর্গে, মর্তে এমন অনেক ব্যাপার আছে, হোরেশিও, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।

0 comments: