প্রবন্ধ - অবন্তিকা পাল
Posted in প্রবন্ধপ্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই ও তাঁর পুত্র রেবন্ত সারাভাই উত্তর কলকাতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন- “এবার আমরা শিব ও শক্তির আরাধনা করব। শিব আর শক্তি একে অন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৃত্য করেন। কেউ কারও চেয়ে কম কিংবা বেশি নন। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ের লীলায় শক্তি কেবল শিবের অনুগামিনীমাত্র নন, তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক। বাংলার মঞ্চ এই নৃত্য উপস্থাপনের শ্রেষ্ঠ জায়গা, কেননা দেবী কী, তা বাংলার মানুষ জানেন।” একদিকে নটরাজের উদ্দাম নাচ, অন্যদিকে শক্তির সংহারকারী নৃত্যরূপ, প্রায় কুড়ি মিনিটের রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত-শেষে শক্তি আর শিব একে অন্যের মধ্যে বিলীন হন, রূপ নেন অর্ধনারীশ্বরের। রাজ্য জুড়ে অসুরদলনী এবং স্ত্রী ও জননীরূপী দুর্গার আরাধনার পাশাপাশি, ক্ষুদ্র পরিসরে, স্বল্প পুঁজি সম্বল করে এক শ্রেণির প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে সেজে ওঠে আরও এক আরাধ্য, খোদ শহর কলকাতার বুকেই, যার অর্ধেক শরীরে শিব এবং বাকি অর্ধেকটায় শক্তি বা পার্বতী।
একটি অলাভজনক সংস্থার উদ্যোগে গত বছর থেকে শুরু হয় এই উৎসব। দুর্গাপুজোর পাঁচদিনের নিয়ম মেনে অর্ধনারীশ্বরের বোধন হয়, হয় কলাবউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর মতো যাবতীয় রীতিরেওয়াজ। কিন্তু না, পৌরোহিত্যে থাকেন না কোনও ব্রাহ্মণ। মন্ত্রজ্ঞ কোনও রূপান্তরিত-মানুষ এই পুজো সম্পাদন করেন। গত কয়েক বছর ধরেই নানান প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁদের। কেননা, উৎসবের পুরোধায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই ভিন্নলিঙ্গের (প্রচলিত তৃতীয় লিঙ্গের) মানুষ – তাঁরা ট্রান্সজেন্ডার, তাঁরা হিজড়ে। অলাভজনক সংস্থাটির নিত্যদিনের কাজকর্ম তাঁদের ঘিরেই। একদল মানুষ বলে ওঠে, “হতেই পারে তারা তৃতীয় লিঙ্গ, তাই বলে আলাদা করে পুজোর আয়োজন করতে হবে কেন? দুর্গাপুজো তো আপামরের!” অন্যদল রে রে করে ওঠে অব্রাহ্মণকে দিয়ে পুজো করানোর শাস্ত্রবহির্ভূত সিদ্ধান্ত দেখে। কিন্তু দুর্গাপুজো কি আজও সত্যিই আপামরের? ভোগ রান্নায় এখনও অব্রাহ্মণ রমণীর ঠাঁই হয় না। হিন্দু পাড়ায় বেড়ে ওঠা কোনও সংখ্যালঘু কিশোরী অঞ্জলি দিতে গেলে পুজো কমিটির গণ্যমান্যরা তার অভিভাবককে ডেকে বলেন মেয়েকে ঠাকুরদালান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। শহর ছাড়িয়ে জেলার অভ্যন্তরে ঢুকলেই দেখা যাবে, গ্রামের দলিতরা উচ্চবর্ণের পুজোয় অবাধ প্রবেশাধিকার পান না। এমনকি পুষ্পাঞ্জলিতেও তাঁদের পৃথক সারিতে দাঁড়াতে হয়। ভোগ বিতরণের সময় আলাদাভাবে বসানো হয় তাঁদের। আর ভিন্নলিঙ্গ মানুষের দূরবস্থা তো ততোধিক শোচনীয়। ইদানিং শহরের পুজো উদ্বোধনে মাঝে মধ্যে ডাক পান তাঁরা, অথচ ওই পুজো প্যান্ডেলে বসেই কৌতুকেরও শিকার হন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভিন্নলিঙ্গের মানুষ আজ ‘আদার জেন্ডার’ হিসাবে সমস্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধা পেতে সক্ষম। কিন্তু আইনি ছাড়পত্র মানেই তো আর সামাজিক স্বীকৃতি নয়!
অর্ধনারীশ্বরের পুজো এই লিঙ্গকেন্দ্রিক, ধর্মকেন্দ্রিক, বর্ণকেন্দ্রিক সমস্ত অবমাননার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রতীকী প্রয়াস। পুজোর পাঁচদিনের প্রত্যেকটি দিনে তাই আলাদা আলাদা গোষ্ঠির মানুষেরা এসে সামিল হন উৎসবে, যাঁরা সকলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রত্যাখ্যাত। হয়ত তাঁরা যৌনকর্মী, দুর্গাপুজোয় বেশ্যাবাড়ির মাটি নিয়ে আসার পরেও এই বাবুবিবি-অধ্যুষিত দুনিয়া যাদের মূলধারার অঙ্গীভূত করতে অপ্রস্তুত। ওরা কেউ পথশিশু, মাতৃপিতৃহীন, অভুক্ত, উদযাপনের দিনেও ওই ফুটপাথই যাদের বিশ্বসংসার। কেউ বা অ্যাসিড আক্রান্ত নারী, ত্রিনয়নী চিন্ময়ীর সামনে অগণিত আইলাইনার-পরিহিত বঙ্গতনয়াদের ভিড়ে যাদের মুখ দেখে ফেললে ভয়ে দূরে সরে যায় দর্শনার্থীরা।
অর্ধনারীশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পর-বৈপরীত্যের একাত্মকরণের দর্শন। শিব শ্বেতবর্ণ, শক্তি কাঞ্চনবর্ণা। শিব স্থিতি, শক্তি সৃষ্টিশীল ও গতি। শিব অসীম, শক্তি সীমাহীনের পরিমেয় প্রকাশ। এই দুই বিপরীতধর্মী সত্তা একীভূত হলে তবেই সৃষ্টি সম্ভব, গঠন সম্ভব। কেননা পার্বতী বিনা শিব আসলে শব-সদৃশ, আবার শিব-ব্যতীত শক্তির প্রকাশ সম্ভব নয়। প্রাচ্যদর্শনের এই স্বর অনুরণিত হয় জীববিদ্যার ক্ষেত্রেও। একটি ভ্রূণ, সৃষ্টির আরম্ভকালে ‘উভয়লিঙ্গ’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্তর্ভাগের মেডুলা অংশ টেস্টিস অর্থাৎ পুরুষের অণ্ডকোষের উৎস, আর বহির্ভাগের কর্টেক্স ওভারি বা নারীর ডিম্বাশয়ের মূল। যদি একটি ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম প্রাধান্য পায় তাহলে মেডুলা থেকে উৎপন্ন হয় পুংজননতন্ত্র; অন্যদিকে একটি ‘এক্স’ ক্রোমোজোম সক্রিয় হলে কর্টেক্স বৃদ্ধি পেয়ে তৈরি হয় নারীর জননতন্ত্র। এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ পুরুষের অণ্ডকোষ থেকেও শুধুমাত্র যে পুরুষের হরমোন বা টেস্টোস্টেরন ক্ষরিত হয় তা নয়, সামান্য মাত্রায় নারীর হরমোন অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন-এর ক্ষরণও ঘটে থাকে। উল্টোদিকে নারীর ডিম্বাশয় থেকে পর্যাপ্ত মাত্রায় ইস্ট্রোজেন নির্গমনের পাশাপাশি ন্যূনতম টেস্টোস্টেরন-এর অস্তিত্বও দেখা যায়। অধুনা মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এ কথা স্বীকার করে যে যৌন-অবস্থানের নিরিখে কোনও মানুষ কেবলমাত্র বিপরীতকামী বা সমকামী হয় না, একজন বিপরীতকামী মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্ন সমকামিতা, অথবা সমকামী মানুষের মধ্যে প্রছন্ন বিপরীতকামিতা বিদ্যমান। অর্ধনারীশ্বর এই লিঙ্গ ও যৌনতার পরিসরেও পরস্পর বিপরীতধর্মী চেতনার সহাবস্থান।
অথচ যাবতীয় অসহিষ্ণুতার মূলে থাকে বিপরীতকে অস্বীকারের প্রবণতা। সাদা চামড়ার কালোকে অস্বীকার, বিপরীতকামীর সমকামীকে অস্বীকার, পুরুষের নারীকে অস্বীকার, নারীপুরুষের ভিন্নলিঙ্গকে অস্বীকার। পৃথিবীর নিজ-অক্ষের প্রতি আবর্তনে যেমন একটি দিন থাকে, তেমনই তার বিপরীতে থাকে একটি রাতও। ভিন্নলিঙ্গের অর্ধনারীশ্বর সাধনা যাবতীয় বৈপরীত্যের প্রতি অসহিষ্ণুতার উৎসমূলে কুঠারাঘাত করুক – দেবীপক্ষে এটুকুই প্রার্থনা।
এই সহিষ্ণুতার শিক্ষা আমাদের নিজস্ব যাপনঅভ্যাসে সমৃদ্ধ হোক।
ReplyDeleteখুব জরুরি বিষয়ে আলোকপাত।
ধন্যবাদ।