2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন মিত্র

Posted in


তখন রাত একটা বাজে। সকাল থেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে ছিলাম। একটিবারের জন্য উঠতে পারিনি। সারাদিন শুধু অঝোরে কান্না। এ কান্না স্মৃতি হয়তো আমার জীবনের শেষ সজ্ঞান মুহূর্ত পর্যন্ত থেকে যাবে। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক, কম দিন নয়- আজ যেন একটা সমাপ্তির সামনে এসে দাঁড়াল। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক কথাটা যেমন সত্য, আবার এটাও ঠিক যে সম্পর্ক সবসময় সমান ঘনিষ্ঠতার চেহারায় ছিল না। নানান উত্থান-পতন, ওঠা নামা গেছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে আমার কোনও সাময়িক বিচ্ছেদও কখনও ঘটেনি। একটি বারের জন্য তাঁর কাজের প্রতি আমার কোনও অনাগ্রহ তৈরি হয়নি। আজ একরাশ শূন্যতার সামনে আমি বসে আছি। ব্যথায় বুকটা টানটান করছে, পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে- প্রথম ছবি ওঁর সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার; আপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুর পরে প্রায় বৈরাগী, জীবনবিমুখ অপু তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির পাতা এক এক করে উড়িয়ে দিচ্ছে বনজঙ্গল, পাহাড় ঘেরা নিসর্গে। সময় যেন স্তব্ধ দুঃখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে অপুর সামনে, চারিদিকে শুধু অসীম শূন্যতা। এইক্ষণে আমার মনের অবস্থাও যেন কতকটা অপুর-ই মতন।

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর - সত্যজিৎ রায়ের করা হয়ে গেছে তখন। এই চারটি ছবির কোনটাতেই প্রচলিত কোনও নায়কের প্রয়োজন পড়েনি; যেমন দরকার হল অপুর সংসারের বেলায়। সেই সময়ে বাংলায় সিনেমার কোনও নায়ক/অভিনেতা-কে সত্যজিৎ রায় নিজের ছবির নায়ক করে তুলতে রাজি ছিলেন না। তাঁর প্রয়োজন হল নিজস্ব এক নায়ক নির্মাণের। নিজের মনের মতো গড়ে নিলেন সৌমিত্র-কে। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পরে, তাঁকে নিয়ে লেখা অসামান্য গ্রন্থ- ‘মানিকদার সঙ্গে’, সৌমিত্র লিখেছিলেন- ‘উনি অসাধারণ যত্ন ও ভালোবাসায় শেখাতে চেয়েছিলেন আর আমি শিখতে চেয়েছিলাম। উনি যা চেয়েছিলেন, তা ওঁকে অনুসরণ করেই করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়। উনিও তখন যথেষ্ট পরিণত বয়সের মানুষ নন, সেই প্রথম অ্যাডাল্ট অপুকে নিয়ে কাজ করবেন। সে জন্য যথেষ্ট সতর্ক হয়ে কাজ করছিলেন এবং আমাকেও তৈরি করে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, উনি কিন্তু অন্য কোনও অভিনেতার জন্য এতটা সময় দেননি, এতটা উদ্যোগ নেননি।’ প্রথম ছবিতে সৌমিত্র সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনাকে আত্মস্থ করে অভিনয়ে এমন উৎকর্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন- যা শুধু বিশ্বমানেরই নয়, সিনেমার আন্তর্জাতিক মানের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের অভিনয়ের সমতুল্য। প্রথম ছবিতেই সৌমিত্র দেশে-বিদেশে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এদেশের সিনেমার অভিনয়ে এক নতুন অভিনয় ধারার সূচনা হয় তাঁরই হাত ধরে। অপর্ণা সেন, সৌমিত্র বিষয়ক এক নিবন্ধে, সঠিকভাবেই লিখেছিলেন- 'পুলুদা(সৌমিত্র ডাকনাম) বাংলা ছবির অভিনয় ধারায় এক নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। খুব স্বাভাবিক, বাস্তব আর জীবন্ত অভিনয়ের এক নতুন ধারা এনেছেন তিনি৷' অপুর সংসার ছবিতে অভিনয়ের পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সিনেমায় তাঁর যে যুগ্ম পরিক্রমণ শুরু হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণেরর পূর্ব মুহূর্ত অবধি তা নিরবচ্ছিন্ন থেকেছে। ১৯৯০ সালে কলকাতার সিনে সেন্ট্রালের আয়োজনে সৌমিত্র রেট্রোস্পেকটিভ 'তিন দশকের সৌমিত্র' অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন- 'সৌমিত্রর ওপর আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে, এটা আমি জানি।'

অপুর সংসারের পরের বছরের সৌমিত্রর দুটি ছবি ক্ষুধিত পাষাণ ও দেবী। ক্ষুধিত পাষাণ বাংলা সিনেমার সর্বকালের অন্যতম বড় হিট ছবি। খুব দ্রুত পাকাপোক্ত হয় বাংলা সিনেমায় সৌমিত্রর স্থান। এই পর্যায় ক্রমে ক্রমে মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অসিত সেন, অজয় কর প্রমুখ বড়ো পরিচালকদের ছবিতে নানান ধরনের ভূমিকায় বিবর্তিত হতে থাকেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সমসময়ে নির্মিত তিনটি সিনেমায়, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রে অসামান্য অভিনয়ের সূত্রে- [ঝিন্দের বন্দী(১৯৬১), অভিযান(১৯৬২) এবং সাত পাকে বাঁধা(১৯৬৩)] জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় স্টার ও তুমুল শক্তিমান অভিনেতা উত্তম কুমারের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার দিনে একজন সমান্তরাল নায়ক রূপে খুব দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন সৌমিত্র। এই সময়কালেই বাঙালীর চিরসুন্দর বিবাদ, উত্তম বনাম সৌমিত্র- আরম্ভ হয়ে যায়- যা অদ্যবধি অব্যাহত থেকেছে। জানি না, সৌমিত্রর প্রয়াণের পরে সেই ঝগড়া বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে পরিণত হবে কিনা! তবে এই পরিণত মধ্য পঞ্চাশের উপান্তে পৌঁছে এখন মনে হয় - সেই ঝগড়ার মধ্যে আর যাই থাকুক যুক্তি বা বুদ্ধিজনিত বিশ্লেষণের কোনও স্থান ছিল না। আমরা তর্কের উত্তেজনায় উপলব্ধি করতে ভুলে গেছি যে - আমরা কত বিরল সৌভাগ্যবান যে, প্রায় দুই দশক এই স্তরের দুজন নায়ক/অভিনেতা-কে আমরা পাশাপাশি অভিনয় করতে দেখেছি। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিনয় ধারা, অথচ কি অতুল ঐশ্বর্য, দুটি ধারা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়- একে অপরের পরিপূরক। সারা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এঁদের সহবস্থানের জন্য আমরা তো গর্ব করতে পারি।

প্রথম থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্য ছিল নায়ক চরিত্রের চরিত্র-অভিনেতা হওয়ার। শুধুমাত্র রোমান্টিক নায়কের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করতে চাননি। নানান ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অদম্য বাসনা ছিল তাঁর। নানাবিধ অনুশীলনী, নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের অভিনয় শৈলী, অভিনয়ের ক্রাফটকে এমন উচ্চপর্যায়ে সম্প্রসারিত করেন যে, যখন-ই অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ এসেছে - কোথাও কখনও এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ বোধ করেননি। চারুলতা(১৯৬৪) সিনেমায় ধ্রুপদী নায়কের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয় তো আজ বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে রয়ে গেছে। এরই পাশাপাশি অনায়কোচিত চরিত্র - অয়নান্ত(১৯৬৪), আকাশকুসুম(১৯৬৫), বাঘিনী(১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে(১৯৬৯)- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিনয় সার্থকভাবে করতে পেরেছিলেন। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের অমন রূপবান চেহারাকে ডিগ্লামারাইজ করতে কখনও আপত্তি করেননি, সাহসের অভাব মনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজের নায়ক জীবনের প্রভূত পরিমাণ জনপ্রিয়তার দিনেও সৌমিত্রর অশনি সংকেত(১৯৭১), সংসার সীমান্ত(১৯৭৫), গণদেবতা(১৯৭৯), অগ্রদানী(১৯৮৩), কোনী(১৯৮৬) ছবিগুলোতে তাঁর অসামান্য চরিত্রাভিনয়ের সার্থক রূপদান ইতিহাস হয়ে আছে। সারাজীবন অসংখ্য বড় পরিচালকের অসামান্য সব সিনেমায় অভিনয়ের দুর্লভ সুযোগ সৌমিত্র পেয়েছেন (ভারতবর্ষের অন্য কোনও অভিনেতা ভাল পরিচালকের উল্লেখযোগ্য ছবিতে এমন সুযোগ পাননি)- সেই সব সিনেমায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করে নিজেকে একজন উচ্চস্তরের ভার্সেটাইল অভিনেতা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মধ্য পঞ্চাশে উপনীত হয়ে যখন সৌমিত্র পুরোপুরি একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন, তাঁর উল্লেখযোগ্য পূর্বপ্রস্তুতি-দরুণ সেই সব ভূমিকায় অনায়াসে স্বাচ্ছন্দে মানিয়ে যান। 

নিজের নায়কজীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের দিনে তাঁর তিনটি ছবিতে তিন ধরনের অসামান্য চরিত্রচিত্রন তাঁকে ভার্সেটাইল অভিনেতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। অশনিসংকেত, সোনার কেল্লা এবং সংসার সীমান্তে কিন্তু প্রায় সম সময়ে নির্মিত। অথচ কি বৈচিত্রে ভিন্নধর্মী তিনটি চরিত্র নির্মাণে সৌমিত্র তাঁর চূড়ান্ত অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একজন অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা হিসেবে কমেডি চরিত্রেও খুব ভালো অভিনয় করতে পারতেন সৌমিত্র। অভিনয় জীবনের প্রায় প্রথম পর্বেই বাক্সবদল(১৯৬৫), একটুকু বাসা(১৯৬৫), হঠাৎ দেখা(১৯৬৭) এবং সত্তর দশকে নির্মিত সিনেমা বসন্ত বিলাপ(১৯৭৩), ছুটির ফাঁদে(১৯৭৫) এবং মন্ত্রমুগ্ধ(১৯৭৭)- ছবিগুলিতে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন কমেডিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়ে কি তুমুল হাসির অভিনয় সার্থকভাবে করেছিলেন সৌমিত্র। পুরোপুরি চরিত্রাভিনয়ে সরে আসার সময়ে তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতা, নিবিড়চর্চা ইত্যাদিকে মূলধন করে আতঙ্ক(১৯৮৬), একটি জীবন(১৯৯০), গণশত্রু(১৯৯০), শাখা-প্রশাখা(১৯৯১), মহাপৃথিবী(১৯৯১), অন্তর্ধান(১৯৯২) বা হুইলচেয়ার(১৯৯৪)- সিনেমায় অমন উচ্চস্তরের সার্থক অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। নিজের অভিনয়কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিশ্লেষণ করবার এক দুলর্ভ ক্ষমতা ছিল তাঁর। মু্ক্তচিন্তা, যুক্তিবাদী মনের অধিকারী এবং অতৃপ্ত ও অসন্তুষ্ট স্বভাবের মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের কাজের দিকে তাকাতে জানতেন। এ ক্ষমতা সকলের থাকে না। সমস্ত পৃথিবীর সিনেমার অভিনয়ের বদলও তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে ধরা পড়তো। দীর্ঘদিন অভিনয় কর্মে রত থাকলে অভিনয়ে একটা একঘেয়েমি আসতে পারে। সচেতন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের মৌলিক অভিনয় শৈলী, নাটক বর্জিত সংলাপ উচ্চারণ, শান্ত, নিরুচ্চার অনুচ্চ অভিনয়ের ধারা অক্ষুন্ন রেখেও নানা পরিবর্তন এনেছেন। পারমিতার একদিন বা অসুখ নয় দশকের শেষভাগে নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রে সৌমিত্র সম্পূর্ণ অন্য এক অভিনয় করেছিলেন। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গৌতম ঘোষের দেখা সিনেমায় সৌমিত্রর অভিনয় তো তাঁর সারা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য। এই সময়কালে তৈরি ছবি সাঁঝবাতির রূপকথা বা আবার অরণ্যে, কালবেলা বা আরও কিছুকাল পরের ছবি পদক্ষেপ, অংশুমানের ছবি, রূপকথা নয় প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয় আজকের দিনের বিচারেও চূড়ান্ত আধুনিক। ছ’টি দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে অভিনয়ের পর তিনি একজন আধুনিক সিনেমার অভিনেতা রয়ে গেছেন- কখনও পুরনো হননি। অভিনয় জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এসে মঞ্চে রাজা লিয়ার(নভেম্বর,২০১০; নির্দেশনা- সুমন মুখোপাধ্যায়) এবং সিনেমা ময়ূরাক্ষী(ডিসেম্বর,২০১৭; পরিচালনা- অতনু ঘোষ) অভিনয়ে সৌমিত্র তাঁর আধুনিক মনন ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রায় সব ধরনের সিনেমার সঙ্গে নিজের অভিনয়-কে মানিয়ে নেওয়ার কারণে হাল আমলের মূলধারা ছবি বেলাশেষে বা পোস্ত- তেও তিনি আশ্চর্য ভালো অভিনয় করেছেন এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতে পেরেছেন। ভারতীয় সিনেমায় মূল ধারার ছবি ও অন্য ধারার শিল্প সম্মত সিরিয়াস সিনেমা- দুটি ক্ষেত্রেই এমন অনায়াস বিচরণ, অভিনয় ক্ষমতার সহজাত প্রকাশ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতীত আর কাউকে স্মরণকালে ঘটাতে দেখা যায়নি। সেই দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে সৌমিত্র এক বিরল প্রতিভা সম্পন্ন অভিনয় শিল্পী। মানুষের জীবনের সঙ্গে নিরন্তর যোগ বিপুল পঠন-পাঠনের নিয়মিত অভ্যাস, মনন ক্ষমতা, তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তি, এক অদ্ভুত দার্শনিক মন, শিল্পীর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যোগ- এসবের সংমিশ্রণেও প্রায়োগিক ক্ষমতায় ভারতীয় সিনেমার একজন বিশিষ্টতম অভিনেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন সৌমিত্র, জীবিতকালেই হয়ে উঠেছেন এক প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব অভিনেতা রূপে সৌমিত্র আন্তর্জাতিক সিনেমার অঙ্গনে ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান, মান্যতা পেয়েছেন বহুদিন আগেই, সেই বিচারে তিনি আন্তর্জাতিক সিনেমার চৌহদ্দিতে সবচেয়ে মান্যতা প্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা।

বাংলা ভাষার উপর তাঁর অসামান্য দখল, উচ্চারণ, ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষমতা- যে নিবিষ্ট চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি আয়ত্ত করেছেন- তাঁর সংলাপ উচ্চারণে, কথা বলার যে সহজ প্রকাশ দেখা যায় অভিনয় কালে- তেমন বৈচিত্র্যময় উচ্চস্তরের প্রকাশ স্মরণকালে কোনও বাঙালি অভিনেতার মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। আসলে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ থেকে বাংলা সিনেমায় আসেন সৌমিত্র। তার মানে এই নয় যে, তাঁর আগে বা পরে আর কোনও শিক্ষিত সুদর্শন বাঙালী অভিনেতা আসেননি। অনেকেই এসেছেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে যে বিপুল সংযোগ, চর্চা সৌমিত্রর ছিল তেমন আর কারোর ছিল না। আদতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্মাণ করেছে এক বিশেষ সময়। অন্য এক শিক্ষায়, রাজনৈতিক বিশ্বাসে, ভিন্নতর পঠন পাঠনে, অন্যতর সংস্কৃতির উজ্জীবনে তাঁর মন ও মনন ঋদ্ধ হয়েছিল। যৌবনের শুরুর দিনগুলোয় পেয়েছিলেন দুজন অসামান্য প্রতিভা সম্পন্ন মানুষের শিক্ষা, দিকনির্দেশ- শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং সত্যজিৎ রায়-কে। সিনেমায় যোগদান এবং প্রথম ছবিতেই তুঙ্গজয়ী সাফল্য, তাঁর মনকে নষ্ট করতে পারেনি। এক অতি উচ্চমানের পত্রিকা এক্ষণ সম্পাদনা যুগ্মভাবে করেছেন বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে। সিনেমার অভিনয়ের প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘ আঠারো বছর অক্ষুন্ন থাকে তাঁর এই পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশের সঙ্গে সংযোগ। গদ্য রচনায় প্রথম থেকেই সৌমিত্র তাঁর মৌলিক চিন্তা-ভাবনা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার আকৈশর কবিতা লেখা অনেক সুসংহত হয়েছে তাঁর কলেজ জীবনে কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কৃত্তিবাসী কবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার পঠন-পাঠনের ফলে এবং প্রায় সমসাময়িক কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, এঁদের প্রভাব আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন প্রকাশরীতি বা বাচনভঙ্গি খুব দ্রুত অনুধাবন করে, নিবিড় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ক্রমে ক্রমে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে ওঠেন। কবিতার প্রতি এই আজন্ম ভালোবাসা আবৃত্তিকার হিসেবে সৌমিত্রকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায়াণের পরে একটি লেখায় কবি জয় গোস্বামী একদম সঠিক কথা লিখেছেন - কোনও ভারতীয় অভিনেতার একইসঙ্গে কবিতা সমগ্র, নাটকসমগ্র এবং গদ্য সমগ্র নেই- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া। তাঁর বিপুল কবিতা লেখা, গদ্য রচনা, নাটক রচনা, রূপান্তর, আবৃত্তিকার, পত্রিকাসম্পাদনা, নাটকে অভিনয়, নাটক নির্দেশনা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ- এ সব নিয়ে পৃথক বই লেখা যেতে পারে। বাংলা থিয়েটারে তাঁর অসামান্য অবদান, পেশাদার থিয়েটারে তার একক লড়াই- অবশ্যই আলাদা বই লিখে আলোচনা করার যোগ্য। চিত্রকর রূপেও তাঁর কাজ ইতিমধ্যে শিল্পক্ষেত্রে তাঁর সম্পর্কে অন্য এক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়ের সর্বোচ্চ উত্তরাধিকার এসে পৌঁছেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুবিধ শিল্পচর্চার মধ্যে। তাঁর নানাবিধ কাজ, তাঁর মৌলিকচিন্তা, গভীর জীবনবোধ তাঁকে এক অনন্য সাধারণ শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। শোক সন্তপ্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এত সব কাজের দিকে তাকাই, তখন মনের মধ্যে এক সান্ত্বনা পাই, মৃত্যুতে সৌমিত্রকাকু ফুরিয়ে যাবেন না। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়'- এই অমোঘ উচ্চারণ আমরা ক’জনের ক্ষেত্রে করতে পারি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া।

2 comments:

  1. আস্ত সৌমিত্রকে পেলাম পরম মুগ্ধতায়।
    বুক ভারি পাহাড় হয়ে গেল।

    ReplyDelete
  2. Akrash mugdhota.Resh ta roye galo tai aar kichhu likhchhi na

    ReplyDelete