0

গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in





কিছুদিন হল সোমনাথের বুকের বাম দিকে চিন চিন করে একটা ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা যদিও খুবই মৃদু তবুও বিষয়টা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। মাঝে মধ্যে একটু যেন শ্বাসকষ্টের ভাবও আছে। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ শ্বাস নেওয়াই হয়নি। হাপরের মতো ইচ্ছে করছে শ্বাস টেনে নিতে। বিশুদ্ধ বাতাসের এখন দারুণ অভাব। পূর্ব দিকের জানলাটা অনেক দিন খোলা হয় না। ঐ দিকের একটা বাড়িতে করোনা হয়েছিল। তুলনায় পশ্চিমের বারান্দাটাকে একটু নিরাপদ মনে হয়। এদিকে আর বাড়ি নেই। পাশেই বড় রাস্তা। রাস্তার ওপারে একটা নির্মীয়মাণ শপিং মল। যার নির্মাণ কাজ অনেকদিন বন্ধ হয়ে আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দিকে হতাশ নয়নে তাকিয়ে ছিল সোমনাথ। হঠাৎ একটা গাড়ি দারুণ শব্দ করে চলে যেতেই বুকের ভিতরটা ধড়পড় করে উঠলো! এটা একটা নতুন উপসর্গ। কিছুদিন হল চালু হয়েছে। বেশি শব্দ শুনলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। এই জন্যে সে ভয়ে ভয়ে থাকে। আজকাল বড় একটা বাড়ি থেকে বেরোয় না। কাজের লোকের সঙ্গে স্ত্রী মিলির বাদানুবাদ কিংবা টিভি চ্যানেলের চিৎকারও এখন তার অসহ্য মনে হয়। শুধু কি তাই! অসময়ে ফোন বেজে উঠলেও বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে যেন কারেন্ট মারে। সারাদিন মাথার ভিতরে কেমন যেন একটা চাপ চাপ ভাব। হঠাৎ হঠাৎ গলা শুকিয়ে যায়। মাঝে মাঝেই মনে নয় কপালের ভিতরে একটা শিরা ঘড়ির মতো টিক টিক করে নাচছে। সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে জীবনটা স্বস্তি হীন হয়ে পড়েছে।

এই কথা গুলো চট করে কাউকে বলা যায় না। এমন কি নিজের স্ত্রী কন্যাকেও নয়। অফিসের মাইনে যাচ্ছে কমে আর জিনিসপত্রের দর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তার উপর রোজ রোজ এমন সব খবর আসছে! সেজো পিসির শাশুড়ি আর বাবুদার বাবার না নয় বয়েস হয়েছিল। কিন্তু ওপাড়ার বরুণ বাবু! তিনি তো সোমনাথের বয়েসি ছিলেন। তিন দিন আগেই ডাক্তার ফুল বডি চেকআপ করে ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তারপরেও হার্টফেল করে গেল গাড়ি চালাতে চালাতে। বাড়ির লোকজন কোন ক্রমে বেঁচে গেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছিল সোমনাথ। সঙ্গে বসেছিল স্ত্রী মিলি আর তাদের সতেরো বছরের মেয়ে, মিঠু। মিঠু এখনো জীবনের সাত-সতেরো বোঝেনি। ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাই ভুতের গল্প পড়ে। কারণ রাতে এসব পড়লে তার ঘুম হয় না। আজ মিঠু পড়ছিল রবিন সাহেবের স্পুকি হ্যামলেট বইটা। এমন সময় মিলি ভুত দেখার মত চিৎকার করে উঠতেই মিঠু ও সোমনাথ সম্বিৎ ফিরে পেল। অবাক হয়ে সোমনাথ দেখল সে দুধে পাউরুটির বদলে অমলেটের টুকরো ডোবাচ্ছে! ভ্যবাচাকা খেয়ে সে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। মিঠু গল্পের বই বন্ধ করে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, “তোমার কি হয়েছে বাবা?” মিলি মেয়ের প্রশ্নের সুর টেনে বলল, “বেশ কিছুদিন ধরেই তোমাকে অন্য মনস্ক লাগছে। আগে রান্না একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই তুমি বলতে। কই এখন তো কিছুই বলো না”। সোমনাথ বুঝল বিষয়টা বেশিদিন আর লুকিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই একে একে বলে ফেলল সব কথা।

বাবার কথা শেষ হতেই মিঠু ফোন নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। সোমনাথের বয়েস এখন ছেচল্লিশ। সে একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করে। মিলি অবাক হয়ে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে আছে। ইন্টারনেটের দৌলতে আজ সে কত মানুষের কত কিছু জানে; অথচ এক ছাদের তলায় থেকেও এই মানুষটার মনের খবর সে পাইনি! স্বামীকে এখন তার ঠিক কি বলা উচিৎ; এটা ভাবতে ভাতেই মিঠু পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বলল, “পরীর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তুমি ব্রেকফাস্ট শেষ করে এখুনি ফিফটিজ হাসপাতালে চলে যাও”। সোমনাথ অবাক হয়ে বলল, “হাসপাতালে গিয়ে কি করবো?” মিঠু কাগজে কি যেন লিখতে লিখতে বলল, “পরীর বাবা ডাঃ এ.কে.তলোয়ার নামকরা কার্ডিয়াক সার্জেন্ট। পরী ওর বাবাকে বলে দিয়েছে, তুমি যাবে!” সোমনাথ একটু ভেবে বলল, “প্রথমেই একজন কার্ডিয়াক সার্জেন্টের কাছে যাওয়া কি ঠিক হবে! তার চেয়ে বরং মেডিসিনের কাউকে…”। এখন সোমনাথের কোন কথাই গ্রাহ্য হবে না; সে জানে। মিঠুই এখন তার অভিভাবক। সমস্যার কথা সে অনেকদিন গোপন করে রেখেছে অভিভাবকের কাছে এটাই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ।

মানা করে কোন লাভ নেই। আজ ছুটির দিন তাই অফিসের দোহাই দেওয়ারও উপায় নেই। সোমনাথ গাড়িতে স্টার্ট দিল। পাশের সিটে মিঠু বসেছে। তাকে একটু চিন্তিত লাগছে। তবে তার বিশ্বাস বাবাকে তলোয়ার আঙ্কেল একদম ঠিক করে দেবেন। গাড়ি কিছুটা চলতেই সোমনাথের মনে হল তার কানের ভেতরে ভোঁভোঁ করছে। একটা বড় ঢোক গিলে সে ভাবল, এই সময় হাসপাতাল খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়। তার উপর ফিফটিজের মতো বড় হাসপাতালের তো কথাই নেই। মিঠুকে সঙ্গে নিয়ে আসা কি ঠিক হচ্ছে। সোমনাথ একটু আমতা আমতা করে বলল, “আমি বলি কি, আমি একাই যাই। তোকে বরং বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসি”। কিন্তু মিঠু কিছুতেই রাজি হল না। পাড়া ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই পরের চিন্তাটা মাথায় এলো। যদিও সে ইংরেজিতে খুবই ভালো তবু, বুকের বাম দিকে মিষ্টি মিষ্টি ব্যথা বা কানের ভিতরে ভোঁভোঁ, শোঁশোঁ শব্দ সহ পুরো বিষয়টা সে কি গুছিয়ে বলতে পারবে ডাক্তারকে! তলোয়ার আর যাই হোক বাঙালি নয়। নিজের হিন্দি ভাষার দক্ষতা সম্পর্কে সোমনাথ পুরোপুরি নিশ্চিত। কাজেই নিতান্ত বিপদে না পড়লে সে হিন্দি বলে না।

রিসেপ্সহনের মেয়েটি দেড় হাজার টাকা জমা নিয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। সেটা পরের কাউন্টারে দেখাতেই একজন নার্স বলল, “আসুন জামা কাপড় বদলে নিন”। মনে মনে হাসল সোমনাথ। জামা কাপড় বদলে, তিন ঘর ঘুরে ডাক্তারের কাছে না গেলে দেড় হাজার উশুল হবে কিভাবে! ছোটবেলায় তার মাষ্টার মশাই বলতেন, “বড় বড় বাঁদরের বড় বড় লেজ”। এটাও তেমন বিষয়। পোশাক বদল করার পর, নার্স উচ্চতা, ওজন, রক্তচাপ ইত্যাদি মাপজোপ নিয়ে তাকে ডাক্তারের ঘরে পাঠিয়ে দিল। মিঠু বসে আছে রিসেপ্সহনে। ডাঃ তলোয়ার অবশ্য পরিচয়ের ধার কাছ দিয়ে গেলেন না। প্রশ্ন করে করে সোমনাথের বিষয়টা জেনে নিয়ে কাগজে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন, “টেস্ট করকে আইয়ে। উসকে বাদ দাওয়াই দেঙ্গে!” সোমনাথ বেরিয়ে এসে টেস্টের স্লিপটা এগিয়ে দিল কাউন্টারে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটার দিকে। অনেক দূরের একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে মিঠু। সে এখন বাবার দিকে তাকাচ্ছে। সে দিক থেকে চোখ ফেরাতেই কাউন্টারের মেয়েটা বলল, “নাইন থউসেন্ট ট্রি হান্ডেড ফিফটি, স্যার”। সোমনাথ আকাশ থেকে পড়লো। ইসিজি, ইকো, টিএমটি আর কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে এত টাকা কেন লাগবে? প্রশ্ন করতেই মেয়েটি বলল, “ডাক্তার যা লিখেছেন আমি তো তাই যোগ করছি স্যার। আপনি চাইলে তলোয়ার স্যারের সঙ্গে…”। সোমনাথ দূরে বসে থাকা মিঠুর দিকে তাকাল। আচ্ছা, যদি সে এখন টেস্ট না করিয়ে চলে যেতে চায় তাহলে কি হাসপাতাল তার জামা কাপড় গুলো ফেরত দেবে না! এ বিষয়ে মিঠুরই বা কি প্রতিক্রিয়া হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোমনাথ ক্রেডিট কার্ডটা এগিয়ে দিল।

প্যাথলজির ছেলেটা রক্ত নিতে নিতে বলল, “আপনার কি অ্যাটাক হয়েছিল?” সোমনাথ অবাক হয়ে বলল, “কই না তো!” ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, “তাহলে এই টেস্ট টা…” এরপর রক্ত নিয়ে বলল, “হয়ে গেছে। রিপোর্ট এক ঘণ্টার মধ্যেই স্যারের কাছে চলে যাবে”। সোমনাথ বুঝল হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা, সেটা বোঝার জন্যে এই রক্তের টেস্ট! মনটা কেমন যেন হয়ে গেল তার। ডাক্তারদের কি মন থাকতে নেই! জোর করে নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে সে একে একে ইসিজি, ইকো, টিএমটি সহ বাকি সব কটা টেস্ট শেষ করলো। সব রিপোর্টই ডাক্তারের কাছে চলে যাবে অনলাইনে। জুনিয়ার ডাক্তার ইকো করতে করতে প্রশ্ন করেছিল, “আপনার হার্টের অবস্থা বেশ ভালো দেখছি। এটা কি আপনার রুটিন চেকআপ?” সোমনাথ জানে রুটিন বললে কেউ ভালো ভাবে দেখে না। তাই সে বুকে ব্যথার বিষয়টা বলেছিল। সেসব শুনে জুনিয়ার ডাক্তার অনেকক্ষণ প্রব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “আমি কিছুই দেখছি না। দেখুন তলোয়ার স্যার কি বলেন”। ডাঃ তলোয়ারের ঘরে সোমনাথ যখন গেল তখন প্রায় লাঞ্চ টাইম হয়ে এসেছে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, “অল আর নর্মাল! আপনি কিছু চেপে যাচ্ছেন না তো?” কথাটা শুনে হঠাৎ মনে পড়লো, নাকের ভিতর যে মাঝে মাঝে ফড়ফড় করে সেটা তো বলা হয়নি। শ্বাসকষ্টের ভাব যে হয় সেটাও বলতে ভুলে গেছে সে। বিষয়টা শুনে ডাক্তার বাবু বললেন, “শ্বাসকষ্টের ব্যাপারটা আপনি আগে তো বলেন নি! যান তাড়াতাড়ি এল.এফ.টি করে আসুন। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। লাঞ্চ টাইম প্রায় হয়ে গেছে”। নাকের ভিতরে ফড়ফড় আর শ্বাসকষ্টের ভাব দুটো কি এক বিষয়? প্রশ্নটা করবে করবে করেও করতে পারলো না সোমনাথ। বাইরে এসে সে দেখল মিঠু এখনো দূরে বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে। আর কথা না বাড়িয়ে সোমনাথ আরও তিন হাজার দুশোর বিল মিটিয়ে এল.এফ.টির ঘরে ঢুকে গেল। না, এখানেও কিছুই পাওয়া গেল না। তবুও ডাঃ তলোয়ার বেশ কিছু ওষুধ আর নির্দেশনামা লিখে দিয়ে বললেন, “দিন পনেরোর ওষুধ দিলাম। তারপর কেমন থাকেন না থাকেন দেখে পরের ব্যবস্থা হবে; কেমন!” হাসপাতাল থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এলো সোমনাথ। মিঠু প্রশ্ন করলো, “তলোয়ার আঙ্কেল কি বলল বাবা?” সোমনাথ কোন উত্তর দিল না। একবার ইচ্ছা করছিল বলে, কি আর বলবে, পকেটটা কেটে ছেড়ে দিন। এখন বেশ খিদে পাচ্ছে তার। বড় রাস্তার পাশে একজন আখ মাড়াই করে রস বিক্রি করছে। এই করোনার বাজারে খোলা রস খাওয়ার সাহস সোমনাথের হল না। সে শুধু পাশে পড়ে থাকা ছিবড়ে গুলোর দিকে ঝুল ঝুল চোখে তাকিয়ে রইলেন। নিজেকেও এখন তার ঐ রকম মনে হচ্ছে।


প্রায় দুই বছর হতে চলল; অফিস চলছে বাড়ি থেকেই। জীবন যে এমন অনলাইন হয়ে যাবে কে জানত! বাজার দোকান থেকে শুরু করে মিঠুর নাচের ক্লাস; সব কিছুই এখন ফোনের মধ্যে। মনটা বড়ই খুঁতখুঁত করছে। কোন কিছুতেই মন দিতে পারছে না সোমনাথ। অসুখ না জানা এক বিষয়। আর গাদা গাদা টাকা খরচ করে এতো এতো টেস্টের পরেও সেটা জানতে না পারাটা অন্য বিষয়। বিকেলের পর থেকে তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। অনেকদিন থেকেই পায়খানাটা যেন ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে ডাক্তারকে এসব কথা বলার দরকার ছিল। আরও কয়েকটা দিন এই ভাবেই গেল। ডাঃ তলোয়ার যে ওষুধ গুলো দিয়েছিলেন সে গুলো শেষ হওয়ার পরেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই দেখে সোমনাথ ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লো। এখন সে দীর্ঘ সময় একা একা অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তা দিয়ে শব্দ করে গাড়ি গেলে কানে আঙুল চাপা দেয়। রাতে ঠিক ঠাক ঘুম আসে না। শুধু এপাশ ওপাশ করে। একদিন অনেক রাতে মিলি দেখল সোমনাথ পাশে নেই। খাট থেকে নেমে বারান্দার দরজাটা খোলা দেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। দেখল, সোমনাথ রাস্তার উল্টোদিকের নির্মীয়মাণ শপিং মলের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলি তার হাতে হাত রেখে বলল, “ঘুম আসছে না?” সোমনাথ মুখে কোন উত্তর দিলো না। শুধু মিলির পাশে সরে এসে দাঁড়ালো। মিলি নিচু স্বরে বলল, “আমি বলি কি, তুমি একবার ভোলানাথ ডাক্তারের কাছে যাও না!” ভোলানাথ আগে এই পাড়াতেই বসতেন। বয়স্ক মানুষ। অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুগীর কথা শোনেন। রুগীরা তার নির্দেশ না মানলে বকাবকি করতেও ছাড়েন না। এই জন্য অনেকে তাকে অপছন্দ করেন। তবে অনেক সময় বড় ডাক্তার’রা জটিল রোগ ধরতে পারে না। ছোট ডাক্তার পারে। বছর দশেক আগে একবার মিঠুর নাক নিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। হঠাৎ হঠাৎ, কোন কারণ ছাড়াই। সেবার বহু ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। শেষে এই ভোলানাথ ডাক্তারই তাকে ভালো করেছিল। মিলির প্রস্তাবটা তাই মনে ধরল সোমনাথের।

ভোলানাথ ডাক্তারের পুরনো চেম্বারে গিয়ে জানা গেল তিনি এখন নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও বসেন না। বিকেলে খুঁজতে খুঁজতে তার বাড়ি এসে সোমনাথ দেখল রোগীদের লাইন বিরাট। গত দশ বছরে ডাক্তারের ফিস বাড়েনি তবে রুগী বেড়েছে বিস্তর। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর ডাক্তারের চেম্বারে তার ডাক পড়ল। সব ঘটনা একে একে বলে সোমনাথ এগিয়ে দিল, ডাঃ তলোয়ারের সব কাগজপত্র। ভোলানাথ ডাক্তার তাতে খানিক চোখ বুলিয়ে বলল, “হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে?”

-“আগে পার্কে যেতাম, এখন বারান্দাতে…”

-“নেশা করেন?”

-“সিগারেট খাই না তবে…”

ভোলানাথ পেশার দেখলেন। তারপর বুকে পিঠে টেথো রেখে লম্বা শ্বাস নিতে বললেন। এরপর বললেন, “ডাক্তারদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে। যদি কোন রোগী ডাক্তারকে বিশ্বাস করে ওষুধ খায় তাহলে অনেক রোগ এমনিতেই সেরে যায়। এই কথাটা কি আপনি মানেন?”

এই প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া উচিৎ সোমনাথ বুঝতে পারলো না। সে মাথা চুলকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

-“কুকুরকে লাই দিলে মাথায় ওঠে, এটা নিশ্চয়ই জানেন?”

সোমনাথ ভুরু কুঁচকে বলল, “এসব কথার সঙ্গে আমার রোগের কি সম্পর্ক?”

ভোলানাথ ডাক্তার হেসে বললেন, “রোগ ভোগকে কুকুর বেড়াল ছাড়া আর কি বলি বলুন। রোগের কথা বেশি ভাবলেই রোগ বাড়ে। তাই বেশি চিন্তা করবেন না। পুরনো জীবনে ফিরে যান। দিনে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটুন। প্রচুর জল খান। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে”।

সোমনাথ চিন্তিত ভাবে বলল, “আসলে চারিদিকে ভাইরাসের আক্রমণ যে রকম চলছে তাতে…”

-“ভ্যাকসিন নিয়েছেন?”

-“হ্যাঁ”।

-“তবে আর চিন্তা কি। নিয়ম মেনে চলুন। ভয় পাবেন না। ভয় পেলেই রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। একটু আগে একজন এসেছিলেন; হাত ধুতে ধুতে হাজা বাঁধিয়েছে”।

ভোলানাথ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো সোমনাথ। সবটাই তাহলে মনের ব্যাপার! তাও কি সম্ভব। পকেট থেকে প্রেসক্রিপশনটা বার করে ওষুধের দোকানে এগিয়ে দিল সে। ছেলেটা কাগজটা হাতে নিয়ে হেসে ফেলল, “দেখুন পাগল ডাক্তার কি লিখেছে”। কাগজটা এবার দেখল সোমনাথ। তাতে ওষুধের বদলে বড় বড় করে লেখা ‘হাঁটুন খাটুন আনন্দে থাকুন’। সোমনাথ বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। বাইরে চমৎকার হাওয়া ছেড়েছে। এতদিন পর ভেতরটা তার বেশ হালকা লাগছে।

0 comments: