1

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in





বেরোনোর সময় ই সন্দেহ হয়েছিল যে সময়টা ভালো নয়। ট্রেন থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার পর পরই একটা কান্ড। একটা কালো বেড়াল পথ কেটে গেল। আর তারপর কিছুটা আসার পরেই গাড়িটা গেলো বিগড়ে। কেন রে বাপু আগে থেকেই গাড়ি টাড়ি সারিয়ে টিপটপ করে রাখ্। তা না। তাদের একটা ছোট চায়ের দোকানে বসিয়ে রেখে, সে ড্রাইভার গেল মেকানিক ডাকতে। গেলো তো গেলোই। আর আসেইনা। তাদের দুকাপ চা, বিস্কুট সব শেষ হয়ে যাবার পর, তিনি এসে জানালেন যে মেকানিক গেছে শ্বশুর বাড়ি। তবে ফোন করে দেওয়া হয়েছে। এই এলো বলে।

আধ ঘন্টা পার। মেকানিকের চিহ্ন মাত্র নেই। চোখের সামনে দিয়ে কতো গাড়ি হুস হুস করে সিমলার দিকে চলে যাচ্ছে আর তারা পথের ধারে বসে ধুলো খাচ্ছে।

তিতিবিরক্ত হয়ে পরমা একবার বলেছিল রীতেশকে অন্য গাড়ি দেখতে। কিন্তু রীতেশ বিয়িং রীতেশ, অপদার্থ টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি, মিনমিন করে উত্তর দিয়েছিল, “ না, এখন তো অনেকটা উঠে এসেছিইই। এখন কোথায় গাড়ি পাবো বলো? কালকা হলে না হয়…তাছাড়া বলছে তো মেকানিক আসবে এখুনি”

রীতেশের সঙ্গে আর কথা বলা বৃথা। অভিজ্ঞতা থেকে পরমা জানে। তাই রাস্তা আর গাড়ির দিকে যুগপৎ চোখ চালাতে থাকলো। ওই যে, ড্রাইভারটা নিজেই বনেট খুলে কী যেন ঠুকঠাক করছে। আরও একবার ঘড়ির দিকে তাকালো পরমা। প্রায় একঘন্টা হতে চললো। অবশ্য প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ই সে ঘড়ি দেখছে।দুরাত্তিরের ট্রেন জার্নি করে এসেছে, টয়লেটে যাওয়া নেই, স্নান নেই এভাবে আর কতক্ষন! প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে, শ্বশুর বাড়ির আদর খাওয়া মেকানিকের আগমন হলো। তবে এতো ' আগমন নয়, যেন আবির্ভাব’!

কী সব ঠুকঠাক করে কড়কড়ে হাজারটি টাকা নিয়ে চলে যাবার পর তাদের গাড়ি ছাড়লো। আর সিমলা পৌঁছতে না পৌঁছতেই নামলো বৃষ্টি ।

তাদের হোটেলটা আবার ম্যাল ক্রস করে ওদিকে। ফলে ম্যালের ওপর দিয়ে একরকম প্রায় দৌড়তে দৌড়তে যেতে হচ্ছিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আরকি। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

সবার প্রথমে দৌড়ে যাচ্ছে রূপু, তাদের কিশোরী কন্যা, হাতে জলের দুটো বোতল। তার পেছনে পরমা, সোয়েটার , চাদর, মাফলার জড়ানো এক মূর্তি,এক হাতে একটা লাল ট্রলি সুটকেস- যেটা যতো জোরে চলছে, শব্দ করছে তার থেকে অনেক বেশি। আর অন্যহাতে একটা ব্যাগ ও তার উপরে চাদরের আড়াল থেকে খসে পড়া আধখানা আঁচল। তার অনেকটা পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে রীতেশ। দুহাতে দুটো সুটকেস, গলায় মাফলার জড়ানো। আর সুটকেস দুটো ছাড়াও একটা খাবারের ব্যাগ বিস্কুট, ট্রেনের আধখাওয়া কেক জলের বোতল ইত্যাদিতে শোভিত শরীর।

পরমা গাড়ি থেকে নেমেই বলেছিল, ‘শোনো, গাড়ি তো আর যাবেনা। তুমি একটা কুলি টুলি পাও কিনা দ্যাখো।‘ কিন্ত রীতেশ সে কথা কানেও নেয়নি। উল্টে বলেছে, ' এই তো এরা বলছে ম্যালটা পেরোলেই হোটেল। এর জন্য আবার কুলি কীসের?’..’এখন বোঝো কিপ্টেমির ফল’। নিঃশব্দে গজগজ করতে করতে , বৃষ্টির মধ্যে চলতে থাকে পরমা।

আধভেজা জামাকাপড়ে তারা যখন হোটেলে পৌঁছল তখন আর তাদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।

চেক ইন করে সবে ঘরে ঢুকেছে, বাথরুম থেকে রূপুর আর্ত চিৎকার। “ মা, শিগগির এসো। দেখে যাও” ‘কী রে বাবা, পাহাড়ি জায়গা। সাপখোপ নাকি?’- এসব ভাবতে ভাবতে পড়ি কী মরি করে বাথরুমে ঢুকে পরমা শুধু বলেছে,’কী?কী?” আর রূপুর উৎকট হাসি শুরু হয়ে গেল। “ দেখো, দেখো মা” । চমকে স্কাইলাইটের দিকে তাকিয়ে দেখে সারেস্সার বাঁদর পা ঝুলিয়ে বসে আছে।“ এর জন্য এমন চিৎকার! আমার হার্ট ফেল হয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই ঝামেলার শেষ নেই। তুইও তো ওরকম একটা বাঁদর”, বলে মেয়ের মাথায় একটা স্নেহের চড় মেরে নিজেও হেসে ফেলে পরমা।

বাকি দিনটা আর হোটেল থেকে বেড়োনো গেলনা। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই নেই।

হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করায় জানা গেলো “ পরশো তক্ রূক্ যায়েগি”।

কিন্তু “পরশো তক্ হলে তো চলবেনা। তাদের তো কাল সকালেই কিন্নরের দিকে রওনা দিতে হবে। সেরকমই প্ল্যান। বুকিং ফুকিং সব করা। বৃষ্টির জন্যে তো আর ওতোগুলো টাকা জলে দেওয়া যায়না।দেখা যাক কাল কী অবস্থা থাকে!হোটেল ম্যানেজারের কথা তো আর বেদবাক্য নয়।

কিন্তু নাঃ,পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেও সেই একই দৃশ্য। আকাশ ভাঙা মেঘ আর ঝ্যাপঝ্যাপে বৃষ্টি।বোধহয় বার সাতেক ফোন করার পরে প্রায় বারোটা নাগাদ গদাইলস্করি চালে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। আর এসেই বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে, দর বাড়াবার জন্যেই বোধহয় ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করলো, “ মৌসম ঠিক নেহি হ্যায়”, “বারিশ থোড়া রুকনে দিজিয়ে। ফির আরামসে চলেঙ্গে”..ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকম ধানাই পানাই।

কিন্তু তার আপত্তিতে এক্কেবারে পাত্তা না দিয়ে পরমা, রীতেশ আর রূপুকে তাড়া মেরে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পরলো।

কিন্তু খানিকটা যেতেই আর এক বিপত্তি। রীতেশ একেবারে হৈ হৈ করে উঠলো। সে তার নতুন কেনা রীবক জুতো জোড়া হোটেলের ঘরেই ফেলে এসেছে। আসলে পরমাই তাকে বলেছিল, “ এই বৃষ্টি বাদলে নতুন জুতোজোড়া পরে আর কাজ নেই। গাড়িতেই তো বসে থাকবে। হোটেলে পড়ার স্যান্ডাকটাই পায়ে গলিয়ে নাও।“ আর তার ই ফলে ওয়ার্ডরোবের নীচের তাকেই রয়ে গেছে সে জুতো।

ব্যাস, আবার গাড়ি ঘোরাও। আর পাহাড়ে তো আর যেখান সেখান দিয়ে ইউটার্ন নেওয়া যায়না। সুতরাং অনেকটাই ঘুরতে হল। তার সঙ্গে উৎকন্ঠা। জুতোটা পাবে নাকি বেয়ারারা মেরে দিল! অমন নতুন জুতো, আর কী ফেরৎ দেবে!

“এবার বেড়োনোটাই খারাপ হয়েছে। পইপই করে বলেছিলাম, পাঁজি টা একটু দেখে নাও। কী জানি,যোগিনী রাইজিং ছিল কিনা! ”-একনাগাড়ে ভয় ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে পরমা।

“ কিচ্ছু রাইজিং হয়নি মা। ওই দেখো, বাবা জুতো নিয়ে ফিরে আসছে।“

“ পেলে জুতো! দিলো?”

সংক্ষেপে ‘হ্যাঁ ' বলে রীতেশ গাড়িতে এসে বসলো।

গাড়ি চলছে , বৃষ্টি পেছল রাস্তায় খুবই আস্তে আস্তে চলেছে গাড়ি। রীতেশের প্ল্যান অনুযায়ী তাদের নারকান্ডায় লাঞ্চ করার কথা। তা সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রায় বিকেল চারটে বেজে গেল। যা হোক্ তাড়াতাড়ি করে খেয়ে গাড়িতে এসে বসে যেই ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলা হয়েছে, তখনই সে বলে উঠলো, ' এবার আমি খেয়ে আসি'?

মানে? যখন আমরা খেতে গেছিলাম তখন তুমিও খেয়ে নাওনি কেনো?মনে মনে বলে পরমা। কিন্তু এখন আর সেকথা বলে কী লাভ! যাও, বলে তারা গাড়ির মধ্যে বসে কাঁপতে লাগলো। বাপরে বাপ! কী শীত! একে শীতের জায়গা, তার মধ্যে এই তুমুল বৃষ্টি! হাড় অবধি যেন কালিয়ে যাচ্ছে।

যা হোক, আধঘন্টা খানেক বাদে ড্রাইভারের ও খাওয়া হলো, গাড়িও ছাড়লো। রাস্তা বেশ ফাঁকা। মাঝে মধ্যে এক আধটা গাড়ি উল্টোদিক থেকে আসছে। একটা সময় ড্রাইভার হিন্দিতে বলে উঠলো যে রামনগর প্রায় এসে গেছে। আর ঠিক তার পরেই জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থেমে গেল। সামনে গাড়ির মস্ত লাইন। আর সব যাকে বলে একেবারে, স্ট্যান্ডস্টিল।

“কী ব্যাপার? এতো জ্যাম কেনো? এখানে এরকম হয় নাকি? কী জ্বালা বলো দেখি…প্রথম থেকেই জানতাম। তুমি যদি একবার পাঁজি টা…”

“আঃ, একটু চুপ করো তো। দেখতে দাও কী হয়েছে”- রীতেশের কথায় পরমার কথাটা অর্ধপথেই বন্ধ হয়ে যায়…

রীতেশ গাড়ি থেকে নীচে নেমে এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে একটা জম্পেশ করে সিগারেট ধরায়।

কিছুক্ষণ পরে ড্রাইভার এসে জানালো, সামনে প্রচন্ড ধ্বস নেমেছে। পথের দুটো ধার একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অফিসাররা এসেছে, কিন্ত কখন রাস্তা খুলবে কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না।একটু অপেক্ষা করি, “ বাদ মে আরামসে চলেঙ্গে”,ড্রাইভার সুভাষের সুচিন্তিত মত।

গাড়িতে বসে বসে অশেষ বোরড হচ্ছে আর এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছে পরমা। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে, গাড়ির ভিড়ের মাঝে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে।সবে সবে ড্রাইভিং শিখেছে পরমা। রীতেশের সাহায্যে কলকাতার পথে একটু একটু বেড়োচ্ছেও। তা ওতোটা ফাঁকা জায়গা থাকতে এগিয়ে না গিয়ে ড্রাইভারটা এখানেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন কে জানে!অদ্ভুত! আনাড়ি নাকি? একটু সামনে এগিয়ে থাকলে জ্যামটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হুশ করে বেড়িয়ে পড়া যাবে। হুঁ হুঁ বাবা, জ্যাম কাটানোর এই সব কায়দা সে ভালোই শিখে গেছে।

“এইযে ড্রাইভারজী, ওই তো জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে। ওখানে গাড়িটা এগিয়ে নিন।“ ড্রাইভার, যার নাম সুভাষ, কী যেন অস্পষ্ট ভাবে বলতে চেষ্টা করছিল কিন্তু সেসব একেবারে পাত্তা না দিয়ে, তাড়া মেরে সে ড্রাইভারকে প্রায় বাধ্য করলো গাড়িটা এগিয়ে ওই ফাঁকা জায়গাটায় নিয়ে যেতে।

আরও কিছুক্ষণ কেটে গেলো। গাড়ির লম্বালাইন, কোথায় যে তার শুরু খোদায় মালুম, নড়েওনা, চড়েওনা। হঠাৎ প্রচন্ড আওয়াজ আর সমবেত ভয়ার্ত চিৎকার, “ পাহাড় গির রহা হ্যায়, পাহাড় গির রহা হ্যায়”। চমকে তাকিয়ে পরমা যা দেখলো তাতে তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার যোগাড়। দেখে যে সে ড্রাইভারটাকে প্রায় বাধ্য করে, গাড়িটা এগিয়ে এনে যেখানে দাঁড় করিয়েছে, ঠিক তার ওপর থেকে মাঝারি সাইজের পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের আশেপাশে পড়ছে থেকে থেকে।

গাড়ির বাঁদিকে অথৈ খাদ, আরও নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঘোলাটে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। আর ডানদিক দিয়ে পাহাড় থেকে লুজ পাথর নেমে এসে তাদের গাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা যদি সেরকম বোল্ডার গড়ায়, ব্যস্ আর দেখতে হবেনা। ভবলীলা সাঙ্গ একেবারে।

ও, আচ্ছা, এইজন‌্যেই তাহলে জায়গা থাকা সত্ত্বেও কোনো গাড়ি এখানে এসে দাঁড়ায়নি। নাঃ, কলকাতার ড্রাইভিং এর জ্ঞান পাহাড়ে চলবেনা।

“ পাহাড় থেকে ধ্বস নামছে; এ্যক্টিভ ধ্বস..আর তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি এখানে ঢোকাতে বললে! এখন তো আর ব্যাক করাও যাবেনা। কলের ইঁদূরের মতো মরতে হবে” এই পর্যন্ত জোরে বলে রীতেশ বিড়বিড় করে দাঁত চেপে বলে, “ স্টুপিড কোথাকার”। বিড়বিড় করে বললেও কথাটা ঠিকই কানে গেছে পরমার। কিন্তু এখন প্রাণ বাঁচানোর সময়। ঝগড়া করার নয়। তাই ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্যে কথাটা মাথার খোপে জমিয়ে রেখে চুপ করে বসে থাকে পরমা। যেন কিছুই শুনতে পায়নি।

বসে বসে তারা অপেক্ষা করছে তো করছেই। সন্ধ্যে হয় হয়। এবার পরমার ভয় ভয় করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে রীতেশ এসে জানালো, আজ আর ধ্বস সরানোর কোনো আশা নেই। ধ্বস পরিষ্কারের কাজ এখন বন্ধ। আবার কাল চেষ্টা হবে।ব্যাক করে পেছন থেকে গাড়িগুলো আসতে আস্তে মুভ করতে শুরু করেছে। ‘ সময়টাই খারাপ ছিল বেড়োনোর। পাঁজি দেখা নেই, কিছু নেই। আরো কী কী কপালে আছে কে জানে!” পরমার সআক্রোশ দোষারোপ চলতেই থাকে। বাকি দুজন চুপ। রীতেশ সিগারেটের আশ্রয় নিয়েছে আর রূপু একমনে মোবাইলে গেম খেলে চলেছে।ছেলেমানুষ আর কিবা করবে! আর সুভাষ ড্রাইভার উদাস দৃষ্টি তে নদীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে, একসময়ে গাড়িতে উঠে বসে আস্তে আস্তে গাড়িটাকে ব্যাক করে নিতে থাকে। কিছুক্ষণ ব্যাকে আসার পরে জায়গা পেয়ে ইউটার্ন নিয়ে গাড়ি আবার যে পথে এসেছিল সেই পথ ধরে চলতে শুরু করল।

ফিরতি পথে একটু আসতে না আসতেই সন্ধ্যে কাটিয়ে রাত্তির নেমে এলো। আর ব্যাস্, চারদিক একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় যেটুকু যা দেখা যাচ্ছে, ব্যাস আর কিছু না। এদিকে সুভাষ ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে দেখো! কোথায় তাড়াতাড়ি তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে, তা না , টিকটিক টিকটিক করে চালাচ্ছে ঘন্টায় কুড়ি মাইল স্পিডে। আর, একটু স্পিড বাড়াতে বললেই প্রশান্ত সুরে বলছে, “ আরাম সে চলিয়ে…আরামসে'।আরে বাবা, আর কতো আরাম করবো? এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারদিক ছেয়ে গেছে। কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না। আর তার মধ্যে, ‘আরামসে’!

হঠাৎ দূরে খানিকটা উঁচুতে আলো দেখা গেল। নিশ্চয়ই কোনো হোটেল টোটেল হবে। ওই আলোটুকুকেই শেষ আশ্রয় মনে হচ্ছে পরমার। যতোটা আকুলতা ঢালা সম্ভব গলায় ততোটা আকুলতা ঢেলে সে তার নিজস্ব হিন্দিতে বলে ওঠে, ' উহ রহা এক হোটেল। চলিয়ে উস জায়গা ড্রাইভারজী”!

তারপর রীতেশকে উদ্দেশ্য করে “ আরে, কী বসে বসে ঢুলছো? ড্রাইভারটাকে বলোনা ওখানটায় নিয়ে যেতে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রাত কাটাবো নাকি? কিছু একটা করো”

রীতেশ মুখ খোলার আগেই ড্রাইভার যা বললো তার মর্মার্থ এই যে, ওটা ভালো জায়গা নয়। ওখানে বিটিয়াকে নিয়ে থাকা নিরাপদ নয়, সে ঠিক জায়গায়,গরমেন্টের বাড়ি, যেখানে ফিমিলি থাকে, ফিমেলরাও সেফ- সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।

এটা শুনেই পরমার বুকের ভেতরটা একেবারে হিম হয়ে গেল। সঙ্গে যে উঠতি বয়সের মেয়ে রয়েছে এতো তার মাথাতেই আসেনি। হে ভগবান! রীতেশের পাঁজি না দেখার জন্যে ই এইসব হচ্ছে। রক্ষা কর ঠাকুর! চট্ করে একবার হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে, রীতেশের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললো, “ সঙ্গে মেয়ে রয়েছে। এতো অন্ধকার! ডাকাত গুন্ডা যদি…একটু তাড়াতাড়ি চালাতে বলোনা” পরমার কাঁদো কাঁদো অবস্থা দেখে রীতেশ মাথাটা নেড়ে ড্রাইভারকে একটু জলদি চালাতে বলতেই তার উত্তর শুনে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ। তার গাড়ির চাকার অ্যলাইনমেন্টই নাকি ঠিক নেই। একটা একটু বেঁকে আছে। এরথেকে স্পিড বাড়ালে, চাকা খুলে যেতে পারে।

“মানে?! তুমি বেরোবার আগে গাড়ির কনডিশন্ ভালো ভাবে চেক করে নাওনি?!”-এবার আর্তনাদ করে ওঠে রীতেশ।

“ না, মানে…আজ সকালে ই তো পাঁচ দিনের একটা ট্রিপ করে ফিরলাম..এসেই বেড়িয়ে পড়তে হল…তাই আর কী..সময় পাইনি”

কী যে বলবে রীতেশ যেন ভেবেই পায়না। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থেকে শেষ আশা আঁকড়ে ধরার মতো করে জিগ্যেস করে, “ ডিকিতে স্টেপনি আছে তো?”

হ্যাঁ, তা আছে বটে , কিন্ত স্টেপনিতে হাওয়া কম আছে, সেটাই যা অসুবিধা আরকী! ড্রাইভার সুভাষের এই অপূর্ব উত্তরে রীতেশের একেবারে বাক্যি হরে যায়। স্তব্ধ পাষাণ শিলার মতো গ্রাউন্ডেড হয়ে পড়ে সে। আর এইসব কথাবার্তা শুনে ভয়ে ভাবনায় এই শীতেও আতঙ্কে কুলকুল করে ঘামতে থাকে পরমা।

উঃ, কোথায় নিয়ে চললো কে জানে! পাঁজি না দেখে বেড়িয়ে এবার প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে কিনা কে জানে!

এইসব সাতপাঁচ ভাবছে তখনই একটা খোলা মাঠের ছোট বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল ড্রাইভার। আর পরমার বুকের ভেতরটা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। এইসব লোকেদের কোনো বিশ্বাস আছে? এবার প্রাণটাই না যায়! একটু পরে কোথা থেকে যেন ঘুরে এসে ড্রাইভার সুভাষ জানালো , গরমেন্ট লজ, অর্থাৎ কিনা ঐ ছোট বাড়িটা একদম তালা বন্ধ। কেয়ারটেকার ও নেই। কিন্তু কোই চিন্তা নেই পরমারা গাড়ি থেকে নেমে আসুক। মাল গাড়িতেই থাকুক।সে তাদের থাকার চমৎকার ব্যবস্থা করে দেবে। আর রীতেশ ও ওমনি গাড়িতে মাল রেখে রওয়ানা দিতে শুরু করলো!

‘এই কোথায় যাচ্ছো? মাল নাও” “ মাল কেন? সুভাষ তো বললো মাল থাক। ও গাড়িতেই থাকবে।“

“আর তুমি ওমনি বিশ্বাস করলে! এই সব অচেনা অজানা লোকেদের কোনো বিশ্বাস নেই। এরা সব সাংঘাতিক! চোর ডাকাত কিছু হওয়াই আশ্চর্য নয়”,চাপা গলায় ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে রীতেশকে সাবধান করতে চায় পরমা।

“ কী যে বলো তুমি! না মাল নিতে হবেনা”, বলে রীতেশ হনহন করে ড্রাইভারের সঙ্গে রওনা দেয়। তার পেছন পেছন রূপু। অগত্যা পরমাকেও নিঃশব্দে গজগজ করতে করতে রওনা দিতে হয়।

মিনিট চার পাঁচ নিকষ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে মোবাইলের মিটমিটে আলোয় হাতড়াতে হাতড়াতে, ড্রাইভারের পেছন পেছন এসে তারা যেখানে উপস্থিত হল, সেটা একটা পাহাড়ী গ্রাম্য রেস্টুরেন্ট। ধাবা আর রেস্টুরেন্টের মাঝামাঝি কিছু একটা।

ড্রাইভার কথা বলতে ভেতরে চলে গেল। ফিরলো সঙ্গে একজন বছর কুড়ি বাইশের ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটি জানালো, হ্যাঁ, তারা রাতের মতো একটা ঘর দিতে পারবে বটে, কিন্ত ছোট ঘর। ছেলেটির কথাবার্তা ও ব্যবহার অতি মধুর।ছেলেটির ব্যবহারে পরমার মনের ভয় অনেকটাই কেটে গেল।

তাদের, ওই ধাবার পাশের একটা ছোট মাটি টাইপের কিসের যেন একটা ঘর দেওয়া সম্ভব হলো, যেখানে একটা মাঝারি তক্তাপোষ থাকলেও দরজাটা টিনের এবং কোনো ছিটকিনির বালাই নেই। একটি লোহার অত্যন্ত সরু হুড়কো দিয়ে আধা বন্ধ মতন হয়।

খানিক পরে সেই ছেলেটি, যার নাম জানা গেল ‘সোনু’, সে গোটাকতক রুটি আর এক বড় বাটি রাজমা এনে দিয়ে খুবই বিনীত ভাবে বললো, এতো রাতে আর কিছু নেই।‘ ইসিসে কাম চলা লিজিয়ে’।আর থালাবাটি ঘরের বাইরে রেখে দিলেই হবে।

সে সকালে নিয়ে যাবে।

আজ তেমন খাতিরদারী করা গেলোনা বটে , তবে কাল সকালে উমদা নাস্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে চলে গেল।

যাবার আগে পরমার টয়লেটে সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে জানিয়ে গেলো যে রাতে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গেলে উল্টো দিকের দরজা খুলে বাইরে যেতে হবে, যার নীচে অন্ধকারে জঙ্গলের আভাস পরমা পেয়েছে।

সেখান থেকে বাঘ না হোক্ , নেকড়ে টেকড়ে আসার সম্ভাবনা কী উড়িয়ে দেওয়া যায়? অতএব আবার, সোনুকে নেকড়ে আসতে পারে কিনা, না জিজ্ঞেস করে পারেনা পরমা।আর নেকড়ে বিষয়ক পরমার ভয়ার্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে সোনুর উদাস উত্তর, ' আ সাকতা হ্যায়। লেকিন আভি তক কভি আয়া নেহী’

‘আয়া নেহী... হুঁঃ... এতোদিন আসেনি তো কী? আসতে কতক্ষন?’ নিজের মনে নিজেকেই বলতে থাকে পরমা; ‘নাঃ, শুকনো রুটি গুলোই গিলতে হবে। জল একদম কম ‘ভেবে ফেলে পরমা।

যাইহোক, খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ছোট তক্তাপোষে চাপাচাপি করে শোওয়াও গেলো। সারাদিনের টেনশনের পর কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছিল, হঠাৎ পরমার ঘুম ভেঙে গেল পাশের ঘর থেকে আসা একাধিক লোকের চাপা গলার আওয়াজ আর মেটাল ঘসার ঘসঘস খসখস শব্দে। এ কিসের শব্দ ? কেউ যেন তরোয়ালে শান দিচ্ছে মনে হচ্ছে। হুবহু সেরকম আওয়াজ। বটি, ছুরি ধার দেবার সময় তো এরকম ই আওয়াজ হয়।ভয়ে বুক একবারে হিম হয়ে গেল পরমার।

এটা নির্ঘাত ডাকাতদের বাড়ি। প্রথমে ভালো মানুষ সেজে তাদের অতিথি করে থাকতে দিয়েছে আর এখন সঙ্গী সাথীদের ডেকে এনেছে। ড্রাইভারটাও ডাকাতদলের ই মনেহয়। লোক ধরে আনে। এখন অস্ত্র শস্ত্রে শান দিচ্ছে। ভেবেছে অতিথিরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু জানতে পারবেনা।আর জানলেই বা কি? পালাবে কোথায় ? ঘরের একদিকে খাদ আর জঙ্গল, আর অন্য দিকে তরোয়াল ছোরা কাটারি হাতে ডাকাত!

হে ভগবান! ওই কালো বিড়াল টাই সব সর্বনাশের মূল। এবার থেকে পাঁজি না দেখে সে কোথাও যাবেনা।…দূর, কী ভাবছে সে; প্রাণে বাঁচবে তবে না পাঁজি দেখা! শেষ সময় বোধহয় এসেই গেল।আর বাপ মেয়েকে দ্যাখো! ঘোড়া বেচে ঘুমিয়ে আছে।ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে অথচ ঘুমের শেষ নেই।

খুব সাবধানে, ডাকাতরা যেন টের না পায় এমন ভাবে রীতেশকে ধাক্কা দিতে থাকে পরমা।

“আরে এই, শোনোনা, ওঠোনা, পাশের ঘরে ডাকাত। ওয়েপেন ঘষছে” ফিসফিস করে বলতে বলতে ভয়ে, আতঙ্কে প্রায় কেঁদেই ফেলে পরমা।

ঘুম জড়ানো গলায় “ঘুমুতে দাও তো। পাগলামি বন্ধ করো” ছাড়া আর কোনো রকম রিয়্যাকশন ই আসেনা রীতেশের দিক থেকে।

‘সঙ্গে বয়সের মেয়ে, কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে?’ এই বিপদে সব শিক্ষা নস্যাৎ করে ঠাকুমার মুখের ভাষা টাই মনে আসে।

কী আর করা!কালো বিড়াল…সব ওই কালো বিড়ালের জন্যে। আর কোনো উপায় না পেয়ে একমনে ঠাকুরকে ডাকতে থাকে পরমা। চোখ বুজে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ' এ যাত্রা রক্ষা করো, রক্ষা করো ভগবান!’

বিড়বিড় করতে করতে ক্লান্তিতে, আতঙ্কে সেও যে কখন

ঘুমিয়ে পড়েছে, পরমা টেরও পায়নি।

ঘুম ভাঙলো যখন বৃষ্টি ফৃষ্টি থেমে চারদিক একেবারে রোদে ভেসে যাচ্ছে।

মেয়ে আর তার বাবা মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বললো,

“কী? ঘুম ভাঙলো ? দরজা দিয়ে সোজা বেরিয়ে বাঁ দিকে বাথরুম।যাও ফ্রেস হয়ে এসো। আমাদের হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট সেরে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে”

খানিকটা হতভম্বের মতোই তাদের ঘরের পরের টানা লম্বা ঘরটা পেরিয়ে ধাবার বাঁ দিকে সে এগিয়ে গেল। এটা ধাবার মালিকের দোতলা বাড়ির একতলা। এখানেই বাথরুম এবং টয়লেট।

বাথরুমের সামনে বাড়ির জনা তিনেক মহিলা কাজকর্ম করছিল। আইয়ে, আইয়ে বলে অতি সমাদরে তাকে বাথরুম দেখিয়ে দিল।

ফ্রেস হয়ে নিয়ে, ধাবার বেঞ্চে বসে চমৎকার পুরী সবজি খেতে খেতে পরমা ভাবতে থাকে, এদের তো সব ঠিকঠাক ই লাগছে। তাহলে কাল রাতের ব্যাপারটা কি? তাছাড়া তাদের ঘরের টিনের হুড়কো খুলে সামনের বড় ঘরে সকালে যখন সে বেরোলো, সে তো একটা লোককে ও দেখতে পায়নি। ঘর পুরো ফাঁকা।সব গায়েব। অথচ ফিসফিস কথা, ধাতব আওয়াজ সে তো নিজের কানে শুনেছে।

কৌতুহল আর চাপতে না পেরে সোনুকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো পরমা। তারপরে কালকের লোকগুলো ই বা কে আর ওই ধাতব আওয়াজ ই বা কিসের, তা সোনুর কাছে জানতে না চেয়ে আর পারা গেলনা; “সোনু ভাইয়া, রাত মে দুসরা ঘরমে কৌন থা? আউর মেটালকা উতনা আওয়াজ!!ব্যাপার ক্যা থা?”-নিজের অপরূপ হিন্দিতে জানতে চায় পরমা।

উত্তরে সোনু যা বলে তার মর্মার্থ এই যে আগের রাতে অনেক লোক অবশ্যই ছিল। যে সব ট্রাক ড্রাইভার ধ্বসে ফেঁসে গিয়েছিল তারাই ওই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। সকালে উঠে চলে গেছে। আর পাশের ঘরে এক মাতাজী ফ্যামিলি নিয়ে আছে জানতে পেরে, তাদের যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না হয়, তাই গলা নামিয়ে কথা বলছিল।

“আর ওই মেটাল ঘষনেকা আওয়াজ?”

“উও তো বর্তন সাফা করনেকা, ধোনেকা আওয়াজ থি ম্যাডাম।“

আসলে এতো লোকের খাবার ব্যবস্থা করতে অনেক রাত হয়ে গেছিল তাই বাসন কোসন মাজতেও অনেক দেরি হয়ে গেছিল।

সোনুর কথা শুনে রীতেশ আর রূপু তো পরমার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসেই অস্থির। পাঁজরে একটা খোঁচা মেরে হাসি আর হাসতে হাসতে কাশির একটা মাঝামাঝি অবস্থায় পরমার দিকে তাকিয়ে রীতেশ বলে, “ওই যে তোমার ডাকাত আর তাদের বাসনাস্ত্র”

“চুপ করো তো” -মুখে বললেও লজ্জায় পরমার মুখটা একেবারে লাল হয়ে যায়।

আর তখনই ওই ধাবার মালিক, সোনুর বড়েপাপা অর্থাৎ জ্যেঠা সত্যপাল সিং জী তাদের সামনে এসে দুহাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকলেন। তিনি বারবার বলতে থাকলেন যে, মেহমানদের যথেষ্ট খাতিরদারি না করতে পারায় তিনি খুব ই দুঃখিত। আসলে তার মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে। কালই দিল্লি থেকে মেয়ে জামাই এসেছে। তাই নিজেদের পাকা বাড়ির ভালো গেস্ট রুমটা তাদেরই দিতে হয়েছে। অগত্যা সাধারণের থাকার জায়গায় মেহমানদের শুতে দিতে হয়েছে। সেজন্য তিনি খুবই লজ্জিত। রীতেশ তো রীতিমত অপ্রস্তুত। এই অনভ্যস্ত আন্তরিক কথার উত্তরে কী যে বলতে হয় সে বুঝতেই পারেনা যেন। কয়েকবার অসহায় ভাবে, “ওকে..ওকে..সব ঠিক থা…আপকি বহোত মেহেরবানি…বহোত শুক্রিয়া” বলে বারবার ধন্যবাদ দেবার অতিরিক্ত কী যে করবে সে ভেবেই পায়না। এমন সৎ, হেলপিং মানুষ সে তার জীবনে দেখেনি।

ইতিমধ্যে তাদের ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট। রীতেশ ধাবা মালিককে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, খাওয়া থাকা বাবদ কতো দিতে হবে জিজ্ঞেস করলে, অত্যন্ত সংকুচিত ভাবে হিন্দি আর হিমাচলী মিশিয়ে তিনি বারবার বলতে লাগলেন,” কী যে বলেন সাব! ব্যবসা করছি যখন খাবারের দামটাতো নেবো। কিন্তু ঘরের ভাড়ার কথা বলবেন না। বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। মানুষ তো মানুষের জন্য এটুকু করবেই। তাও তো দুঃখ রয়ে গেল ভালো ঘরটা আপনাদের দিতে পারলাম না। আবার একবার আসুন ।মেহমানকে ভালো ভাবে খাতিরদারি করার সুযোগ দিন “

ধাবার মালিকের কথায় পরমার বিস্ময় যেন বাঁধ মানেনা। এমন মানুষ ও হয়! কাল তাদের যা অবস্থা ছিল ওই মাটির ঘরটুকুর জন্যে হাজার দেড়হাজার টাকা চাইলেও নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনে তারা তাও দিয়ে দিতো।

পরমার মনটা সবে কৃতজ্ঞতায়, বিস্ময়ে বিগলিত হবো হবো করছে, তখনই পায়ের কাছে একটা শব্দ হলো, “ম্যাও”!

প্রায় লাফিয়ে উঠে পরমা দেখে পায়ের কাছে একটা ছোট্ট কালো বিড়াল ছানা জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।

রীতেশ আর রূপু একসঙ্গে বলে উঠলো, “সেরেছে রে”

কিন্তু কী ভেবে পরমা একটু ইতস্তত করেও, বিড়াল টাকে কোলে তুলে নিল। আর বিড়ালটাও একেবারে গুটিশুটি মেরে পরমার বুকের ভেতর আহ্লাদে মাথা রেখে আবার ডাকল, “ম্যাও” ।

“গাড়ি একদম রেডি। বেরোবেন তো?

সুভাষ ড্রাইভার একেবারে ফিটফাট হয়ে গাড়ি নিয়ে হাজির।

“সামনের পথ খুলতে ক’দিন সময় লাগবে। তাহলে সিমলাতেই ফিরবেন কী ? অবশ্য সকালেই মেকানিক ডেকে গাড়ি একেবারে টপ কনডিশনে করে নিয়েছি। সিমলা থেকে আপনারা চাইলে মানালিও ঘুরিয়ে আনতে পারি”

“আচ্ছা, সে ভেবে দেখছি”, সুভাষ ড্রাইভারের জলস্রোতের মতো অজস্র কথায় বাঁধ দিয়ে, আরও একবার ধন্যবাদ দিতে আর বিদায় নিতে রীতেশ সত্যপালজীর দিকে এগিয়ে যায়।

এদিকে গাড়ির দিকে যেতে যেতে পরমা ভাবতে থাকে, আচ্ছা?.. কালো বিড়াল বিপদ যদি আনে তাহলে নতুন কিছু, ভালো কিছু ও বোধহয় নিয়ে আসে।

দূর, প্রাণী তো প্রাণীই হয়, কী যে তার বোকা বোকা চিন্তা আর ভয়! নিজের মনেই হেসে ফ্যালে পরমা।

গাড়িতে ওঠার আগে আর একবার চারপাশটা ভালো ভাবে , শেষবারের মতো দেখে নেয় সকলে।

রীতেশের মতো কেজো লোক ও পরমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ দেখছো তো পরমা , দেবতাত্মা হিমালয়। আর সত্যপালজীর মতন এখানকার এইসব মানুষেরাই হিমালয়ের আত্মা। দেশের আত্মাও বলা যায়। আর দেশকে, আর তার এইসব লোককে জানতেই বারবার হিমালয়ে আসতে হবে।“

গাড়িতে বসে আরো একবার পিছন দিকে তাকায় পরমা। গতকাল ভয়ে, চিন্তায়, অন্ধকারে তার চোখে পড়েনি। এখন দেখতে পেল, ধাবার দরজায় সোনালী কাগজ কেটে লেখা রয়েছে,”অতিথি দেব ভব”

রীতেশ সুভাষকে বলে ওঠে, “বস্, চলিয়ে সুভাষজী”

রীতেশ আর সুভাষের মুখ থেকে একসঙ্গে বেড়োয়, “ আরাম সে”

আর মা,বাবা, মেয়ের, এমনকি ড্রাইভার সুভাষেরও উচ্ছ্বল অনাবিল হাসিতে যেন আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দেবতাত্মা হিমালয়।

গাড়ি সিমলা যাবার রাস্তা ধরে।।

1 comment:

  1. গল্প টি পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। গল্প টি পড়তে পড়তে কোথায় যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ছিলাম জানি না।

    ReplyDelete