0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















নতুন নিয়ম হয়েছে। আমাদের হেডমাস্টার মশায় নিজের ছোটছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোতলার দুটো ঘরে থাকবেন। ইউ -শেপের দোতলায় প্রায় পনেরটা ঘর। ওনার জন্যে ঘর ছেড়ে দেওয়া হল প্রথম সমকোণের ওপর ঘরটায়।
আরে, ওর পাশ দিয়েই তো আমাদের ছোট ছাদে যাওয়ার জায়গা। তারমানে?
--মানে খুব স্পষ্ট ; কোন শালা নতুন মহারাজদের কাছে গিয়ে দালালি করেছে যে ক্লাস টেনের ছেলেগুলো ওই ছোটছাদটিতে সিগ্রেট খাওয়া আর আড্ডা মারার ঠেক বানিয়েছে। আর গরমের দিনে ওরা খোলা ছাদে বিছানা করে ঘুমোয়!
-- বেশ করি ঘুমোই, কার বাবার কি! একটা ঘরেও পাখার বন্দোবস্ত নেই, তো? গরমে সেদ্ধ হব? তারচেয়ে খোলা হাওয়ায় ছাদে শুলে কার কি ক্ষেতি? বরং ভোরের দিকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে।
--- বুঝলি না! এসব ওই ক্লাস এইটের বাঁদরগুলোর কাজ। ওরা সেবারের ঘটনার জন্যে আমাদের উপর খার পুষে রেখেছে।
গুরু মুখ খোলে।
-- ওদের পরে দেখে নেব। কিন্তু সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন? খালি চুগলি আর ষড়যন্ত্রের ভূত! কারও আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আসলে হেডস্যারের অসুখ সেরে গেছে, তাই।
বিপ্লব আমাদের মত লোয়ার ক্লাসে হোস্টেলে আসেনি। ও জানে না। তাই বলে দিই।
-- স্যারের হয়েছিল হাইড্রোসিল। অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ লোক। শুধু ছাত্ররা নয়, কিছু স্যারও ভয় পেতেন। উনি কখনও হাসতেন না। 'বেরিয়ে যা শুয়ার'--ছিল ওনার বাঁধা বুলি। একবার ভুল করে একজন নতুন স্যারকে বলে ফেলেছিলেন, তিনি পরের দিন রিজাইন করেন।
--উঃ প্রেসি কর। উনি দোতলায় কেন?
-- আরে বলতে তো দে! তা অমন রাগী লোক হাইড্রোসিলে কাবু হলেন। সেইজন্যে ওঁকে একতলায় বাথরুমের পাশে একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়খানায় জলের কল ছিল না। বাইরের চৌবাচ্চার থেকে ছোট একটা বালতি করে জল নিয়ে ঢুকতে হত।
কিন্তু ওই ফোলা ধুতি নিয়ে পা ফাঁক করে হাঁটতে গিয়ে জল তোলা আর হয়ে উঠত না। তখন যে কোন বাচ্চাকে দেখলেই বলতেন --বৎস, আমায় এক বালতি জল এনে দাও তো!
--- তোরা দিয়েছিস?
'--সবাই । যে যখন সামনে পড়েছে আর কি।
--তুই?
-- একবার। ওই সামনে পড়ে গেছ্লাম। কিন্তু সেদিন ওই রাগী ভদ্রলোক অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন--বাবা, একটু জল দিয়ে যাবে বাবা? বড় কষ্ট পাচ্ছি গো!
সেই হেডস্যার এখন দোতলায় মানে উনি সেরে গেছেন। আর কাউকে জল টেনে দিতে হবে না।
হঠাৎ গুরু চমকে ওঠে। --অ্যাই পোদো! শীগগির যা! নীচের বারান্দায় দেয়ালের গায়ে যে ম্যাগাজিনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে নিয়ে আয়।
--কেন গুরু?
--কেন কী রে ভোঁদাই? ওতে হেডস্যার নাম দিয়ে একটা কবিতা আছে না? স্যার দেখলে--!
-- আরে গুরু! ভাল মনে করিয়েছ, ওটা পোদোর জিদেই ছাপা হয়েছিল। ওই খুলে আনুক।
ছাপার কথাটা বাড়াবাড়ি।
আসলে গত কয়েকমাস ধরে আমরা একটা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করেছি--- নবীনসাথী। আমি সম্পাদক, কিন্তু তিনজনের কমিটি আছে। একেকবার একেক রঙের আর্ট পেপারে ক্লাস নাইনের সুব্রত’র সুন্দর হাতের লেখায় ভরে দেওয়া হয়।
এবারে ক্লাস ফোরে একটি বাচ্ছা ফ্রি-তে ভর্তি হয়েছে। ওর মা এই পাড়ায় কাজের মাসি। বাবা নেই। চকচকে চোখের বাচ্চাটা এবার ম্যাগাজিনের জন্যে একটি কবিতা বা ছড়া লিখে আনল ।
কবিতাটি পড়ে কমিটি খুব হাসল, কিন্তু ছাপতে চাইল না। আমি তখন সম্পাদকের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে ছাপালাম। তর্ক দিয়েছিলাম-- ছন্দ ও অন্ত্যমিল নিখুঁত, সেন্স অফ হিউমার আর ছোট্ট বাচ্চাকে উৎসাহ দেওয়া।
তাই বড় বড় অক্ষরে বেরোল এবং ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলঃ

হেডশ্বর
=========
আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা,
টিফিনেতে খেতে দেয় পাউঁরুটি কলা।
আমাদের হেডশ্বর এমে বিয়ে পাস,
পড়া না পারলে মারে ঠাস ঠাস।।

না, ওই দেয়ালপত্রিকা ঠিক সময়েই নামিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর এক জরুরী মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে নামিয়ে শুধু কমিটি মেম্বার করে দেওয়া হল। নতুন সম্পাদক হবে প্রশান্ত।
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা গেল। রাত্তিরে ওঁর ঘর ডিঙিয়ে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। সিগ্রেট খাওয়া তো দূর অস্ত্‌।

উনি বর্ধমানের লোক। প্রতি শনিবার বা অন্ততঃ একবার বাদ দিয়ে পরের বার ট্রেন ধরে বাড়ি যান। সোমবারে দুপুরে ফিরে আসেন। ফলে আমাদের সেই দুদিন ১৫ ই আগস্ট আর ২৬ শে জানুয়ারী। ঘটা করেই পালন করা হয়।
কিন্তু একদিন খবর ভুল ছিল। শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় উনি ঘরে শুয়ে ছিলেন। শুধু ওঁর ছেলে গেছল।
সন্ধ্যের মুখে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার জুড়লেন।
-- ও মহারাজ ! মহারাজ! ও সুনীল মহারাজ, এদিকে আসুন।
সুনীলদা অবাক। ব্যস্তসমস্ত হয়ে একতলার থেকে দোতলায় এলেন।
--কী হয়েছে মাস্টারমশাই?
--আর বলবেন না। ক্লাস টেনের রমেনকে দেখি এমনি এমনি করে টেবিল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছে-- আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে, আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে!
এই বয়সেই যদি ওদের যৌবনজ্বালা জুড়িয়ে থাকে তা'লে পরে কী হবে গো!

সেদিন আমরা ১৫ই আগস্টের বদলে ১৪ই আগস্ট দেখলাম।

কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে!
কোথায়? আমার স্মৃতিতে।
আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হই নি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত- পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায় নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব।
১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা , দুদিনের মত জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরনো জীবনে ফিরে আসবে।
প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দুঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন।
গেটপাস দেখাতে না পারলে সুনীল মহারাজ , হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, সুনীল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে কানাইদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমত করেছে।আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল।
নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া , ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি(কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই।
আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট্স।
সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি! তারপরে ক্যাম্প ফায়ার, সব গ্রুপ থেকে কালচারাল প্রেজেন্টেশন, শেষে প্রাইজ ঘোষণা । সমস্ত পয়েন্ট জুড়ে যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে তার ক্যাপ্টেনকে দেয়া হবে মিশনের এম্বলেম আঁকা বড়সড় এক ফ্ল্যাগ। সেই ফ্ল্যাগ হাতে নিয়ে ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন গ্রুপটির অন্য সদস্যরা মার্চ করে ক্যাম্প ছেড়ে হোস্টেলে নিজের নিজের রুমে ফিরে যাবে। ক্ল্যাপ! ক্ল্যাপ! ক্ল্যাপ!

এভাবেই যাবে একের পর এক অন্য গ্রুপের ছেলেরা।

তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি।

এগার বছরের প্রদ্যুম্ন্ব ভাবল -- ইস্‌, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে বৃটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায় ! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি!
ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্ততঃ ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না?
পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না।


সম্পাদক পদ হইতে শ্রীমান প্রদ্যুম্নের অপসারণের পিছনে একটি গল্প আছে। এই গল্পের উৎস ওই শিশুসুলভ কবিতাটি, পোদোর সম্পাদকসুলভ আভিজাত্যবোধ ও ক্ষমতার অহংকার ।
এটাই কমিটির মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। না, একটু ভুল হল। এব্যাপারে কমিটির সমর্থন ও সহানুভূতি আমার সঙ্গেই ছিল। আসল অভিযোগ হল আমি উপরোক্ত কারণের বশে , বিশেষতঃ ক্রোধ ও মাৎসর্য্য রিপুর দাস হইয়া ক্লাস এইটের বর্বর গুন্ডাপ্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে ,মারপিটে জড়াইয়া পড়িয়া উত্তমমধ্যম প্রাপ্ত হইয়া ক্লাস টেনের প্যাট্রিশিয়ানদের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ঢালিয়া দিয়াছিলাম।
ফলে ক্লাস টেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনিয়র ক্লাসের সমান রক্ষার্থে হা-রে -রে রবে ক্লাস এইটের সঙ্গে ক্লাস-ওয়ারে জড়াইয়া পড়ে।
অগত্যা ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সিজ-ফায়ার ঘোষণা হয়, কিন্তু ক্লাস এইট ও সেভেন আমাদের দেওয়াল পত্রিকায় কোন লেখা দিবে না ঘোষণা করায় সিনিয়রদের কূটনৈতিক ও রণনীতিগত লোকসান হয়।
শেষে আমাকে না জানাইয়া গুরু ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ক্লাস এইটের নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালায়। উহারা সমস্ত ঘটনা ভুলিয়া শেক হ্যান্ড করিতে রাজি হয় ও ম্যাগাজিন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিল করে-- কিন্তু শর্ত রাখে যে নষ্টের গোড়া শ্রীমান পোদোকে পত্রপাঠ সম্পাদকের পদ হইতে নামাইতে হইবে।
ব্যাপারটা এই রকম। ক্লাস এইটের কতগুলো বখা ছেলের গ্রুপ ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিল। নাইনের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু হল। পড়াশুনো, লাইব্রেরির বই পড়া , নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। ওরাও আমাদের মতই প্রথম ও ফিফথ পিরিয়ডে ব্যাক বেঞ্চে বসে ঘুমোত। স্যারেদের ও ডে-স্কলার ছেলেদের হাসির ও বিদ্রূপের খোরাক হত । আবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে উপরের দিকে থাকত।
কিন্তু ক্লাস এইটের ব্যাচটা একটা ব্যাচ বটে! এদের মধ্যে বেশ কজন আমাদের ও নাইনের ব্যাচের থেকে ফেল করে ভিড় জমিয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, য্খন তখন কড়কড়ে নোট বের করে। এও সহ্য হচ্ছিল। জানা গেল এদের পালের গোদা দুজনের হরমোন অত্যধিক ক্ষরণের কারণে প্রায়ই বেশ কিছু বাচ্চা এদের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে এরা বেশ গর্বিত। এমনকি লুকোনোর চেষ্টাও করে না।
আমদের পাঁচজনের টিম এদের ব্যুহ ভেদ করতে ব্যর্থ হল। যে তিনজন মুখ খুলতে রাজি হল তারা স্বামীজির সামনে গিয়ে বেঁকে বসল। মারের ভয়!
পরে সেই মাফিয়ারাই ওই বাচ্চাদের নিয়ে মেজমহারাজের কাছে (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ) নালিশ করাল যে ক্লাস টেনের আমরা ক'জন নাকি ওদের ভয় দেখিয়ে মিথ্যে অভিযোগ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বোধহয় আমাদের অন্য কোন ব্যক্তিগত ইস্যু আছে।
মেজ মহারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে আমাদের যা বললেন তা দুটো লাইনে বলা যায়ঃ
ডক্টর, কিওর দাইসেল্প্ফ!
অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন!
ওই ঘটনার পর থেকে ওরা -আমরা হল; আমরা একে অপরের ক্লাস-এনিমি হয়ে গেলাম।

এই অবস্থায় একদিন ওদের ক্লাসের দুজন বাচ্চামত ছেলে হাতে করে দুটো কবিতা নিয়ে আমাদের ঘরে এল। দেয়াল পত্রিকায় ছাপতে হবে। ওদের দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
সেই দুটো বাচ্চা! যারা বয়ান বদলে আমাদের মুর্গী করেছিল!
তবু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসলে জাজমেন্ট দেওয়ার আগে পূর্বাগ্রহ মুক্ত থাকাই আদর্শ আচরণ বিধি।
আমি ও বিপ্লব লেখাগুলো পড়তে লাগলাম।
তারপর গম্ভীর মুখে বললাম-- এটা কী লিখেছ?
--কবিতা।
--কোথায় কবিতা?
ও অবাক হয়ে মিনমিন করে বলল--কেন, পোদোদা? আপনার হাতেই তো ধরা রয়েছে। দেখুন না--বর্ষাকাল।
পোদোদা! হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
গম্ভীর মুখে বললাম, - হুঁ, বর্ষাকালই বটে!
বর্ষা আসিল, ডাকিয়া উঠিল আকাশের যত মেঘ?
এটা কবিতা হয় নি, শুধু অন্ত্যমিল মিলিয়ে একটা গোদা বাহ্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা ছাপা যাবে না। পরেরবার চেষ্টা কর।
অন্য বাচ্চাটা করুণ মুখে বিপ্লবকে বলল --আমারটা তো ঠিক আছে?
বিপ্লব খেঁকিয়ে উঠল।


-- এটা? এটা তো ডাহা চুরি! গতবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন থেকে টুকলি!
বাচ্চাটার চোখে হতাশা ও আতংক।
--না, টুকলি নয়।
বিপ্লব উঠে গিয়ে ওর তাক হাতড়ে একটা বিস্কিট রঙের ম্যাগাজিন বের করে এনে দ্রুত হাতে পাতা ওল্টাতে লাগল।
--পেয়েছি; এই যে! শোন্‌।
" ৩ নম্বর বাসের তলায় ব্যাঙ রাজার মৃত্যু"
----------------------------------------------
হৈ চৈ পড়ে গেছে সারা বাঁকুড়া নগরে,
ব্যাঙেদের মহারাজা মারা গেছে আহা রে!
------ ।
একেবারে কমা-সেমিকোলন পর্য্যন্ত টোকা। না, না; এসব চালাকি চলবে না।
-- বিপ্লবদা , একটু দেখুন। দুটো এক নয়। ওটা হল ৩ নম্বর বাসের তলায়, আর আমি লিখেচি--৪ নম্বর বাসের তলায়।
বিপ্লব খ্যা -খ্যা করে হাসতে লাগল।
-- ওরে একটু চুপ কর। ৩ নম্বরকে ৪ নম্বর করে দিলেই কবিতা আলাদা হয়ে গেল?
-- দেখুন, দুটো বাসই তো রেলস্টেশন থেকে জেলা কোর্ট যায়, তবে?
আমার আর সহ্য হল না। উঠে ঠেলতে ঠেলতে বাচ্চাদুটোকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। বললাম--কবিতা লেখা? কবি? খালি ৩ কে ৪ করে লিখলি তো হয়ে গেল? ইয়ার্কিরও একটা সীমা আছে। তোদের গোটা ক্লাসটাই এইরকম গবেট নাকি?

দুটো দিন কেটে গেল।
বিকেলে ফুটবল পেটাতে না গিয়ে ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর ফাইল খুলে বসেছিলাম, আমি আর বিপ্লব।
নরেশ আর সুদীপ এল। ক্লাস এইটের সেই মাফিয়া টাইপের ছেলে গুলো। সুদীপের একটু রোমশ চেহারা। এই বয়সেই গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে।
ওকে দেখা মাত্র আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। শুনেছিলাম নতুন ছেলেদের পেছনে লাগার সময় ওর দুটো চ্যালা অনিচ্ছুক বাচ্চাটার হাত ধরে রাখে। আর গত পুজোর সময় ওর বাড়ির লোক নিয়ে যেতে এসেছিল। ও নাকি তখন ঘরের মধ্যে একটি ছেলের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত ছিল। বন্ধ ঘরের মধ্য থেকে বাড়ির লোককে বলে -- একটু অপেক্ষা কর। প্যাকিং করছি, জামাকাপড় বদলাচ্ছি--সময় লাগবে।
ওরা ঢুকল, একটু পেছনে আগের সেই বাচ্চা দুটো।
-- এই যে, এডিটর! এদের কবিতাগুলো রিজেক্ট করলে কেন?
-- একটা কবিতা হয় নি, অন্যটা টুকে লেখা--তাই।
--কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, কে ঠিক করবে? তুমি?
--আলবাৎ; এটাই আমার কাজ। আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে।
---- বেশ, কোনটা তোমার কাছে কবিতা? ওই ফালতু " টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি-কলা"?
নরেশ দোহার দেয়,-- ওই কবিতাটার টাইটেল আবার "হেডশ্বর"! গুরুজনদের স্যারেদের নিয়ে ইয়ার্কি করলেও ম্যাগাজিনের স্ট্যান্ডার্ড থাকে, তাই না পোদো?
বিপ্লব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে-- অ্যাই, নরেশ! মুখ সামলে। তোর দু'বছরের সিনিয়র, প্রদ্যুম্নদা বলবি।

ওরা হেসে উঠল।
তারপর বলল,-- দু'বছর আগে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, তখন থেকেই ও আমাদের পোদো। কী রে , ঠিক বলেছি না?
আমি কোন কথা বলি না।
সুদীপ আবার বলে-- তাহলে আমাদের ক্লাসের দুটো কবিতা রিজেক্ট করছ?
আমি ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখি--উকিল ধরে এনেছিস? লাভ হবে না। ঘরে ফিরে যা।
ওরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
সুদীপদের বলি--শোন, ক্লাস -টাস নয়। একটু ভাল কবিতা নিয়ে এস, নিয়ে নেব।
ওরা চোখে চোখে কথা বলে।
তারপর সুদীপ বলে-- আধুনিক কবিতা চলবে? গদ্য কবিতা?
--হ্যাঁ হ্যাঁ। নিয়ে এস।
--অ্যাই নরেশ, তোর সেই আধুনিক কবিতাটা দেখা তো আমাদের সম্পাদককে, স্ট্যান্ডার্ডটা দেখে নিক।
নরেশ ভালমানুষের মত মুখ করে একটা চোথা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।
আমি ভাঁজ খুলে হতভম্ব , এটা কী?
--কেন , আধুনিক কবিতা।
আমার মুখের ভাব দেখে বিপ্লব কাগজটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে চোখ বোলায়, তারপর হা-হা করে হেসে ওঠে আমাকে ফেরৎ দেয়।
কাগজটায় কয়েকটি রেলস্টেশনের নাম একটি বিশেষ অর্ডারে লেখা রয়েছে।




" টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,
টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,

টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,
ঢাকুরিয়া--যাদবপুর।
গড়িয়া-সোনারপুর,
বজবজ-বজবজ।"
আমি কিছু বলার আগে বিপ্লব হাসতে হাসতেই বলে-- সরি ! এইসব অশ্লীল লেখা ছাপতে পারব না।
অশ্লীল লেখা! ওরা আকাশ থেকে পড়ে।
-- ওতে কোন শব্দটা অশ্লীল? নাকি দু'ক্লাস উঁচুতে পড়েন বলে যা খুশি কমেন্ট করবেন?
আমি রাগের চোটে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়তে থাকি।
ওরা হাঁ-হাঁ করে ওঠে।
--এটা কী হল সম্পাদক মশাই? আপনার লেখা রিজেক্ট করার রাইট আছে; কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা?
--- পছন্দ না হয় ফেরৎ দিয়ে দে। ছিঁড়লি কী করে?
--বেশ করব, এই সব অশ্লীল ইয়ার্কি আমার সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও মারাবি!
ওরা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টায় আমার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম চড় বোধহয় আমিই মেরেছিলাম। কিন্তু ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। আমি বা বিপ্লব কেউই মারামারিতে অভ্যস্ত নই, একটু লালুটাইপ। ফলে দুজনেই বেশ মার খেলাম। আমার বরাদ্দে একটু বেশি জুটল।
তারপর ক্লাস-স্ট্রাগল, সিজফায়ার ইত্যাদি। ওরা চ্যালেঞ্জ করে মহারাজকে বলল-- আমি ব্যক্তিগত কারণে ওদের গ্রুপের কারও কবিতা ছাপতে চাই না। তাই ওদের একটি ভাল আধুনিক কবিতাও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
আমরা বললাল--যা তা অশ্লীল লেখা!
--ওরা বলল বাজে কথা, পোদো কাগজটা দেখাক।
কী করে দেখাব, ছিঁড়ে ফেলেছি যে!
হেডস্যারকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। উনি বললেন--প্রদ্যুম্ন, কাগজ নেই তো কি হয়েছে, তুমি মুখে বল বা লিখে দাও যে ওরা কী অশ্লীল শব্দ লিখেছে--মেনে নেব।
ওরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
আমার কাছ থেকে শুনে হেডস্যার সন্দিগ্ধ মুখে মাথা নাড়তে লাগলেন।
এ তো ক'টা রেলস্টেশনের নাম-- অশ্লীল কোথায়?
আমার মুখে বাক্যি নেই।
আমার অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল, বন্ধুরা বলল আমার বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি আমাদের গোটা ব্যাচের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল।

সেই থেকে আমরা ও ক্লাস এইটের ব্যাচ আশ্রমের বাকি জীবনে তীব্র জীবনমরণের শ্রেণীসংগ্রামে বৃত হইলাম।

0 comments: