0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক 





ছুটি কথা ১২ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



‘না, আজ থেকেই অভ্যাস কর, নতুন কাকিমা এসে কি ভাববে? ছিঃ’ মা অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বুঝিয়েছিল, এটা মনে আছে আমার এখনও। কাকাকে আমি ‘তাতু’ বলে ডাকি, এটা চলতে পারে। কিন্তু তুইতোকারি! একদম নয়। অতএব, মা বোঝানোর পরে আমি তাতুকে ঘুম থেকে তুলতে গেলাম। অন্যদিন এক ঠ্যালা মেরে বলি, ‘কি হল, ওঠ, এখনও উঠলি না!’ তাতু চোখ খুলে একটা আঙুল বাড়িয়ে বলে, ‘ধর’। আমি ধরি, তারপর তাতু আস্তে আস্তে ওঠে। সেদিন ডাকতে গিয়ে আর কোনও কথাই বলতে পারি না। ওই যে, তুইয়ের বদলে ‘তুমি’ বলতে হবে তাতুকে। কি বিপদ! আমি জ্ঞান হয়ে ইস্তক ‘তুই’ বলেছি। কেউ কিচ্ছুটি আপত্তি করেনি। এখন নতুন কাকিমা আসবে বলে বদলাতে হবে। এত সোজা নাকি! আমি খুব তোতলাতে থাকি। তারপর খুব চেষ্টা করে বলি,... ‘তাতু, এবার ওঠো, আর ঘুমিও না’। এমনকি রোজ যে জোরসে ঠ্যালা মারি, সেদিন সেটাও আস্তে হয়ে যায়। অতএব, বেশ কয়েকবার বলবার পরে তাতু চোখ খোলে এবং আঙুল না বাড়িয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়, বলে ...‘এমুন কইরা কস ক্যান?ঠিক কইরা কথা কইতে পারস না?’ তাতু ক্ষেপে গেছে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু আমাকে তো কারণটা বলতে হবে কেন এভাবে ডেকেছি। বললাম। তাতু বলে, ‘ধুররর, তুই এই লেইগ্যা ডাকখোঁজ বদলাইবি! হ, তর মায়ের যেমন বুদ্ধি! না, ওই যেমন ডাকতিস, তুই, তুই-ই থাকবো। ব্যস। বদলাইবি না’। বাব্বা, আমার ধরে প্রাণ আসে। 

সামনেই তাতুর বিয়ে। নতুন কাপড় কেনা হচ্ছে, বাড়ি- ঘরদোর সাজানো হচ্ছে, বিয়ের কার্ড নিয়ে বাবা-মা বা ঠাকুরদা রোজ কোন না কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছে নেমন্তন্ন করতে, কোথাও কোথাও আমিও যাচ্ছি। সে এক হুলস্থুল কাণ্ড! বিয়ের দুদিন আগেই মাসিঠাম্মা আর আমার পিসি চলে এলো। পিসি আসা মানেই আমাকে চেপে ধরে ডলে ডলে স্নান করাবে। বলবে... ‘ইসস, হাতে, পায়ে, হাঁটুতে কি মাটি দেখো... কি করিস তুই?’ এবারো তাই। বলে, ‘চল, মাথায় শ্যাম্পু করে দিই’। এই খেয়েছে!শ্যাম্পু? সেটা আবার কি জিনিস? আমি হাঁদার মত তাকিয়ে আছি দেখে পিসি বলে, ‘আরে বুদ্ধু, মাথা ঘষে দেবো চল’। ও, মাথা ঘষা! সে তো ঠাম্মা মাঝে মাঝে ঘষে দেয় আমাকে, রিঠা, শিকাকাই আর নানা রকম মশলা দিয়ে। চুল একদম সিল্কের মত হয়ে যায়। পিসি আমাকে দেখায় একটা শিশি, তার মধ্যে কিরকম হলুদ হলুদ ডিমের কুসুমের মত দেখতে একটা থকথকে কি যেন! পিসি বলে, ‘এটা এগ শ্যাম্পু! চল চল, মাথা ঘষে দিই, দেখবি কি ফুরফুরে চুল হয়ে যাবে। তারপরে আমরা বরযাত্রী যাবো, আর তুই এই আকাশী রঙের নেটের জামাটা পরবি। দেখবি তোকে একদম পরীর মত দেখাবে’। এবার আমি ভাবতে থাকি, এগ মানে ডিম। ও, ওইজন্যই ওই শ্যাম্পুটা ডিমের কুসুমের মত দেখতে। কিন্তু মাথায় যদি ডিমের গন্ধ হয়! এত কিছু ভাবলেও পিসিকে বলবার সাহস হবার আগেই আমার মাথা ঘষা হয়ে গেল। না, কোনও ডিমের গন্ধ নেই, উল্টে একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ! পিসি খালি বলছে, ‘চোখ বোজ, নইলে জ্বালা করবে’। উফফ, বেশ কিছুক্ষণ পরে ছাড়া পেলাম চানের ঘর থেকে। সেদিন কতকিছু যে হচ্ছে সকাল থেকে বাড়িতে। তিনতলার বড় হলঘরে কত পূজা, যজ্ঞ এসব হচ্ছে আর এটা, ওটা ... সলতে, শঙ্খ, ঘটি, বাটি- ছোটখাট জিনিস দোতলায় ঠাম্মার ঘর থেকে আনতে হলে খালি আমার ডাক পড়ছে। এদিকে আমার যে পা ব্যথা হয়ে গেল। তুলতুল, মানে আমার পিসির মেয়ে আমার থেকে একটু বড় সে। খালি বলছে, ‘এত দৌড়াস কেন? এক জায়গায় বসতে পারিস না তুই?’ ইসসস, আমার কি বসার জো আছে। দেখতে হবে না কোথায় কি হচ্ছে। তাতুর বিয়ে বলে কথা। তাও তো ভোরবেলায় দধিমঙ্গলে কি যে হল, আমি কিছু দেখতে পেলামনা, খুব ঘুম পাচ্ছিল। শুধু দেখলাম দোতলায় রান্নাঘরের সামনে তাতুকে একটা আসনে বসিয়ে কপালে কিসব ফোঁটা দিয়ে দই-খই এসব খাওয়াচ্ছে আর বাড়িশুদ্ধ লোক হাহাহিহি করছে। বাবি আবার একটা ধুতি পড়েছে মালকোঁচা মেরে আর মাথায় একটা খালি পেতলের কলসি নিয়ে নেচে নেচে কি একটা গান করছে, অদ্ভুত কথা সেই গানের। সেটা নাকি ‘বিয়ার গান’। অল্প অল্প দু এক লাইন মনে আছে সেই গানের কথা..

“(ত্বরা)আয় লো সকলে, 

রাম-সীতার বিয়ে হবে- 

ভরিব কলসখানি, সুশীতল জলে”... 

তারপরেই মাসিঠাম্মা ‘আর জাইগো না, ঘুমাইয়া পড়, ক্লান্ত হইয়া পড়বা, হ্যাষে দিনের বেলা আনন্দ করতে পারবা না’ এইসব বলে আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে আলো নিভিয়ে আর থাবড়ে-থুবড়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিলো।

তারপর বিকেল হতেই আমরা সব্বাই সেজেগুজে নিলাম। সব্বাই সাজছে। আমার মাকে এত সুন্দর লাগছে যে কি বলব। মা একদম সাজে না। সেদিন মা একটা হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে, একটা বড় টিপ আর কানে, গলায়, হাতে কি সুন্দর গয়না। মাকে একদম সরস্বতী ঠাকুরের মত দেখাচ্ছে। পিসি সবসময় সুন্দর, ফিটফাট সেজে গুজে থাকে। সেদিন পিসিকেও দারুণ দেখাচ্ছে। পিসি আবার একটা কি শিশি নিয়ে বাড়িময় ঘুরছে আর সবার জামায় ফ্যাচফ্যাচ করে কি একটা দিচ্ছে। এই যে আবার, নিচু হয়ে আমার জামায় লাগিয়ে দিলো, ওমা কি মিষ্টি গন্ধ! কিন্তু জামাটা একটু ভিজে গেল যে ওই জায়গাটা- কি হবে? তুলতুলকে বললাম সে কথা, তুলতুল তো হেসেই খুন। বলে, -‘সত্যিই, তুই শহরে থেকেও এত বাঙাল কেন রে? জানিস না, ওটা পারফিউম। এই দ্যাখ, এক্ষুনি উবে আর শুকিয়ে যাবে’।... ওমা, তাইই তো, মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে গেল, আর চিহ্ন নেই! কিন্তু সুগন্ধ আছে ভরপুর। তারপর হুলুধ্বনি, হট্টগোল, বাসে করে বরযাত্রী, গান-বাজনা, দই, পাঁঠার মাংস, রসগোল্লা, নতুন বৌ দেখা এসবের মধ্যে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর কিচ্ছুটি মনে নেই। পরদিন সন্ধেবেলা নতুন কাকিমা আসবার আগে ‘বলো’ (বড়মাসি) এসে আমাদের দরজার সামনে বিরাট বড় একটা আলপনা দিলো। তারপর একটা বড় পিতলের গামলায় দুধ আর আলতা গুলে রেখে দেওয়া হল, তাতে নাকি নতুন বউ পা দেবে। তারপর নতুন কাকিমা এলো, বড়দের মাঝে আমি ভাল করে মুখটাই দেখতে পাচ্ছিনা, কাছে যাওয়া তো দূরস্থান! তারপরে গান-বাজনা হল, আমি তাও ধারে কাছে ঘেঁষতে পারছি না। সব্বাই খালি বলে, ‘না, এখন বিরক্ত করো না কাকিমাকে’। আমি এক ফাঁকে গিয়ে ঠিক নতুন কাকিমার মাথার ওড়না ধরে টেনে এলাম। তুলতুল বলল, ‘ছিঃ, এরকম করতে নেই। কি মনে করবে নতুন মাইমা?’ কিন্তু নতুন কাকিমা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলো। হাসলো, মানে কিচ্ছু মনে করে নি। আমি গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তারপর ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি তোমাকে কি বলে ডাকব?’ মিষ্টি হেসে নতুন কাকিমা বলল, ‘তোমার যা খুশি!’ আমি বললাম, ‘ছোটমা। তোমাকে বেশ ছোটমা বলে ডাকবো। কেমন?’ ছোটমাও মাথা নেড়ে সায় দিলো। 

ব্যস, ওই দিন থেকে শুরু হল, ছোটমা, ছোটমা আর ছোটমা। এমন এক বন্ধন যা আজও রয়েছে। পরদিন বউভাতে যা মজা হয়েছিল সে আর কি বলব! তখনকার দিনে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কোথাও কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে ‘কেটারার’ বলে কিছু থাকত না। কিন্তু তাতুর বউভাতে ছিল; বিজলী গ্রিল কেটারার। দেখে লোকজনের চক্ষু চড়কগাছ। কন্টিনেন্টাল আর মোগলাই মিলিয়ে এত রকমের মেনু ছিল যে কেউ ভেবে ঠিক করতে পারছিল না কি খাবে; সুপ খাবে না মাটন রেজালা। তাতু আমাকে চুপি চুপি বলে গেল, ‘তোর দ্বারা বেশী কিছু হবে না, তুই ফিস-রোল আর আইসক্রিম খা আপাতত!’ উরেব্বাস, সে কি ফিস-রোল। খেয়ে যাচ্ছি, খেয়েই যাচ্ছি, শেষ আর হয় না। তার পর অনেক দৌড়েছিলাম গোটা বাড়ি ময়, সব্বার সাজগোজ দেখছিলাম, মানে বেশ বড়সড় একটা ব্রেক নিয়ে- আইসক্রিম নিয়ে বসে বসে হাঁ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছোটমার ফুলের গয়না, সাজগোজ সব দেখে মুখস্ত করে পরদিন সকালে ছোটমার সেই বউ-সাজা চেহারা এঁকে ফেলেছিলাম আমার ড্রয়িং খাতার পাতায়। 

ও হ্যাঁ, ওই তাতুকে ‘তুই’ বলা নিয়ে যে চিন্তা ছিল সেটা মিটতেও সময় লাগলো না। ছোটমার দিদির শ্বশুরবাড়িতে নাকি গুষ্টিশুদ্ধ মানুষ বয়স নির্বিশেষে এ ওকে ‘তুই’ বলে ডাকে, কাজেই ছোটমা একটুও অবাক হয়নি। 



0 comments: