প্রবন্ধঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ এবং আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
নারী না পুরুষ? এই প্রশ্নবৃত্তের বাইরে আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার কোন চেনা গল্প নেই। যদিও বা থাকে তা কেন্দ্রচ্যূত, বিধ্বস্ত এবং ধ্বংসচিত্রের মত ম্লান এবং খণ্ডিত। ক্রমশ দলদাসের মত হয়ে যাচ্ছে মানুষের সামাজিক পরিসর। হয়ে যাচ্ছে শব্দটাও বোধ হয় ঠিক নয়। ছিলই। ইতিহাস পুরাণ তার সাক্ষ্য বহন করে। চেতনা বাড়ছে। জ্ঞানতাত্বিক পক্রিয়ার প্রতিদিন নবায়মান হচ্ছে আমাদের চেতনা। কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে উঠছি কতদূর? শোচনীয় কালের দুর্বিপাক বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ছি আবার। চিন্তা বিশ্বাসের জায়গা থেকে ক্রিয়াকলাপের দুনিয়া – ব্যবধান দুস্তর। অন্তর্ঘাত দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তিবাদের সম্ভাবনা ঋদ্ধ পরিমণ্ডল।
বৃহন্নলা – কীভাবে দেখছি এদের? একজন মানুষ হিসেবে? সমাজের অধিবাসী হিসেবে? না কি প্রান্তবাসী বা নিছকই দ্রষ্টব্য কিছু? আসলে যৌন পরিচয়ের বাইরে আমাদের কোন পরিচয় নেই – এই চর্চার মধ্যেই আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের সামাজিক চোখের প্রসারণশীলতা। এখন প্রশ্ন হল কাদের আমরা বৃহন্নলা বলব? ক্রোমোজোম বা হরমোনে ত্রুটি বা মানসিক কারণে লিঙ্গ পরিচয় নির্ণয়ে জটিলতা দেখা দিলে বা দৈহিক পরিচয়ের সাথে আচরণগত বৈসাদৃশ্য দেখা গেলে তাদের আমরা বৃহন্নলা হিসেবে চিহ্নিত করি। সচরাচর আমরা যাদের কিন্নর গোষ্ঠীভুক্ত মনে করি,তাদের মূলত হার্মফ্রোডাইট বা উভলিঙ্গ হিসেবে সূচিত করাই সমীচিন। এরা প্রধানত দুধরনেরঃ-
১) প্রকৃত উভলিঙ্গ ২) অপ্রকৃত উভলিঙ্গ। অপ্রকৃত উভলিঙ্গ আবার ছ'ভাগে বিভক্ত ১) কনজেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া ২) এন্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম ৩) গোনাডাল ডিসজেনেসিস ৪) হাইপোস্পাডিয়াস ৫) টার্নার সিনড্রোম(XO) ৬) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (XXX)।আপাতদৃষ্টিতে উভলিঙ্গত্বকে অপ্রাকৃত এবং অস্বাভাবিক মনে হলেও আমরা যদি ফিরে দেখি প্রাণীজগতের আদিপর্বের দিকে, তাহলে দেখতে পাব যে প্রোটোজোয়া, পরিফেরা, প্ল্যাটিহেলমিন্থিস,অ্যানালিডা, মোলাস্কা, কর্ডাটা পর্বের প্রাণীদের মধ্যে উভলিংগত্বের সহাবস্থান বিদ্যমান। সুতরাং বিষয়টি কোন অপ্রাকৃত ব্যাপার নয় বা নেচার একে সাপোর্ট করেনা এরকম ভেবে নেওয়ার সঙ্গত কোন কারণ নেই। তাই বৃহন্নলাদের ভিনগ্রহেরদ্রষ্টব্য কোন জীব বা সাধারণের চেয়ে অন্যকিছু ভেবে নেওয়ার মধ্যে বিকৃতিই আছে, যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
আমাদের দেশে জেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা খুব অস্পষ্ট। প্রখ্যাত রূপান্তরকামী বিশেষজ্ঞ হেনরি বেঞ্জামিন কী বলেছিলেন দেখা যাক – Every Adam contains the element of Eve and Every Eve harbors traces of Adam physiologically as well as psychologically. এই পরিপ্রেক্ষিতে সেক্স এবং জেন্ডার শব্দদুটির মর্মার্থ অনুধাবন জরুরি। বাংলা ভাষায় লিঙ্গ শব্দটিই পরিপূরক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেক্স শব্দের বাংলা তর্জমা লিঙ্গ হলেও জেন্ডার শব্দটির গ্রহণযোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ সেভাবে পরিস্ফুটিত হয়নি। সেক্স একটি শারীরবৃত্তীয় ধারণা হলেও জেন্ডার হচ্ছে নারী ও পুরুষের সমাজ মনোবৃত্তিয় অবস্থান। ডঃ অভিজিৎ রায় যথার্থই বলেছেন – সেক্স দেহজ পরিকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জেন্ডার আমাদের নিয়ে যায় এক সাংস্কৃতিক নীলিমায়।
এটা বুঝতে হবে যে লিঙ্গ কোনোভাবেই একজন মানুষের মূল পরিচয় নয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা আসলে জন্মগতভাবে যৌন প্রতিবন্ধী। সেক্স ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে একটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে কিছু জটিলতা তৈরি হয়। যেভাবে অনেক শিশুর হাত পা গঠিত হয়না।শারীরিক বিকাশ সম্ভব হয় না। না পুরুষ না নারী - তৃতীয় লিঙ্গ। একটি শিশু যখন ছেলে হয়ে জন্মাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তার সেক্স ক্রোমোজোম – XY এবং যখন মেয়ে হয়ে জন্মাচ্ছে তখন তার সেক্স ক্রোমোজোম XX। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ নিষিক্তিকরনের সময় বা বিভাজনকালে জেনেটিক্স এর কারনে সেক্স ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে বা অন্যান্য কোন অজ্ঞাত কারণে কিছু অস্বাভাবিক সেক্স ক্রোমোজোম তৈরি হয়ে যায় অনেকানেক সময়, যেমন - XYY বা XXY। এই শিশুরা লিঙ্গের অসম্পূর্নতা ব্যতীত আর অন্যকোন ভাবেই অসম্পূর্ণ নয় মানুষ হিসেবে। প্রকৃতির খেয়ালিপনার জন্য তাদের এই অন্যভাবে গড়ে ওঠা।
এ তো গেল বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে? কেমন হবে ব্যক্তিগত আচরণের জায়গা বা অবস্থান? লিঙ্গগত পরিচয়ের উপরে উঠে আদৌ কি সামাজিক হতে পারছি আমরা? অন্তত আমাদের এই উপমহাদেশের কাঠামোর মধ্যে? দ্বিধাহীন উত্তর নেতিবাচক। পশ্চিমেও যে অবস্থা খুব মানবিক তাও কিন্তু নয়। তবু সেখানে অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা সামাজিক ভাবে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি, আইন, ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষাজগতে তাঁরা সম্ভ্রমের জায়গা আদায় করে নিতে পেরেছেন। এই জয় কে হয়তো সার্বিক বলা যাবে না।আংশিক হলেও তা অর্জন। ডোনাল্ড ম্যাকক্লসকি (Donald MCloskey) একজন ট্রান্সজেন্ডারযিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরস্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক। শিকাগোর পোলিশ ভাইয়েরা Wachowski Brothers,যাঁদের নাম সারা দুনিয়া জানে Matrix Trilogy-র জন্য,তাঁরাও ট্রান্সজেন্ডার। এরকম উদাহরন আরও অনেক দেওয়া যেতে পারে। এতে কিন্তু এটা প্রমান করা যাবে না যে তাঁরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না বা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন না। হতেই পারে তাঁরা সামাজিক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে উঠে আসতে পেরেছেন। ভারতেও কম বেশি এ উদাহরণ আছে। কিন্তু আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে এই দৃষ্টান্ত অপ্রতুল।
আমরা যে দুনিয়াটাকে প্রতিদিন দেখি, আমাদের নজরসীমার মধ্যে যে ভূমণ্ডল, সেখানে হিজড়া কালচার অত্যন্ত অমানবিক এবং বর্বর। বাবা মাও এক্ষেত্রে সমাজের ভয়ে যৌন বিকলাঙ্গ সন্তানকে গ্রহন করতে পারেন না। সমাজ ঘৃণা, করুণা আর অবজ্ঞার চোখে তাকাবে, এই আতঙ্কে। কোথাও বৃহন্নলার জন্ম হলে অন্তেবাসী হিজড়ারা এসে শিশুটিকে নিয়ে যায়।আবার কখনও কখনও পরিবারের মধ্যে বড় হতে হতেও পারিবারিক বা সামাজিক নিগ্রহের চাপে তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলি খুঁজে নেয় ভালোবাসার উষ্ণ আশ্রয়। নিরুপায় এই মানুষজনের সামনে এছাড়া আর কোন সোনালি আলোকরেখা নেই। বিয়েবাড়ি, বাসাবাড়ি থেকে চাঁদা তুলে, সন্তান জন্মালে সেই পরিবার থেকে গৃহীত চাঁদা এবং ট্রেনে বাসে ভিক্ষার মাধ্যমে এদের দিনাতিপাত। দৈনিক আয় এরা তুলে দেয় গুরুমার হাতে। লৈঙ্গিক বৈষম্যের এই ঘৃণার দীনতা আমরা কবে কাটিয়ে উঠতে পারব?
কী করবে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী? দীর্ঘ লড়াই এবং সংগ্রামী পথ চলার মধ্য দিয়ে তাদের যৌন পরিচয়ের আইনি স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ১৫ই এপ্রিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণাণ এবং এ কে সিক্রি’র ডিভিশন বেঞ্চ এই মর্মে রায় এবং নির্দেশ দেন যে –
১) হিজড়া বা কিন্নরদের যৌনপরিচয় আজ থেকে আইনস্বীকৃত হল, অর্থাৎ যেকোন আবেদন পত্রে নারী পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচিতিও বৈধ রূপ পেল।
২) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি চাকুরিতে তাদের জন্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকবে।
৩) এই সংরক্ষণ ওবিসি দের সমান্তরাল হবে।
৪) এদের জন্য অফিসে, রেল স্টেশনে আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) সরকার জনসচেতনতা অভিযান প্রকল্পের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্বসহ প্রচার করবে যাতে সমাজ তাদের নিচু চোখে না দেখে।
৬) ভোটার কার্ড এবং পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
ট্রান্সজেন্ডার দের তরফে আইনজীবী সঞ্জীব ভাটনগর সেদিন এই রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন- এর ফলে ১৫ লক্ষ মানুষের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এশিয়া প্যসিফিক ট্রান্সজেন্ডার নেটওয়ার্ক এর লক্ষী নারায়ন ত্রিপাঠীর বক্তব্য ছিল- অবশেষে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মানবাধিকার অর্জন করল। আর যিনি দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক ও আইনি অধিকার নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই শ্রদ্ধেয় ডঃ স্মরজিত জানাও খুশি হয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছিলেন, যে এই অধিকারের প্রশ্নে তামিলনাড়ু অনেক এগিয়ে আছে। এখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলি নিজেদের জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করতে পেরেছে।
এখানেই কি দুর্গ জয় শেষ হয়ে গেল? যতদিন না অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকার কায়েম করা যাচ্ছে ততদিন যে তিমিরে তারা ছিল সেই তিমিরেই থাকবে তাদের অবস্থান। মূলস্রোতে ফেরা তো দূরের কথা, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না এই প্রান্তিক মানুষগুলি। কলোনিজীবন চলতেই থাকবে।
বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির পর্যালোচনা করলেই তো হবেনা। দেখতে হবে সামাজিক এবং মানবিক চিন্তন সহকারে। শুরু করেছিলাম যে কথাগুলো দিয়ে আবার সেখানেই ফিরে আসছি। নারী না পুরুষ, এর বাইরে আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার কোন সচেতন প্রয়াস নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও কি প্রকারান্তরে এই ধারনাকেই লালন পালন করেনা? বিচ্ছিন্নকরণের অচলায়তন কখনোই রসে ভরা ফল বাসে ভরা ফুল সুস্নিগ্ধ মাটি সুধাসম জলে সকলের সম অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দেয়নি। আইনি স্বীকৃতি অবশ্যই একটি দৃঢ় অর্জন। কিন্তু পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিদুনিয়ার প্রসার না ঘটলে আমাদের অগ্রসারণ কতদূর?তাই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে এক সুন্দর বৈষম্যহীন ভাবনার আলোকে প্রাণের চর্চার মাধ্যমে বিশুদ্ধ করতে হবে আমাদের বিবেক।
সমকালীন বিষয়ের ওপর প্রয়োজনীয় ও সঠিক আলোকপাত করেছেন বিপ্লব । এবং একটা সারসত্যেরও উচ্চারণ করেছেন যে 'যতদিন না অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকার কায়েম করা যাচ্ছে ততদিন যে তিমিরে তারা ছিল সেই তিমিরেই থাকবে তাদের অবস্থান। মূলস্রোতে ফেরা তো দূরের কথা, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না এই প্রান্তিক মানুষগুলি। কলোনিজীবন চলতেই থাকবে।'
ReplyDelete