3

প্রচ্ছদ কাহিনীঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রচ্ছদ কাহিনী




স্বাধীনতা 69
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



‘ফর্সা, সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, শিক্ষিতা, ব্রাহ্মণ পাত্রী চাই’

খবরের কাগজটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে সেটা টেবিলের উপর রেখে দিলেন সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর টেবিল থেকে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিলেন হাতে। হুঁ। ঠিকঠাকই ছেপেছে। একটু চিন্তায় ছিলেন সুহৃদবাবু। আগের বার ব্রাহ্মণটা বাদ দিয়ে দিয়েছিলো ব্যাটারা।

একটু আগে সুহৃদবাবু ফিরেছেন প্রগতি সংঘের স্বাধীনতা দিবস পালনোৎসবে বক্তৃতা দিয়ে। পৌরপিতা হওয়ার সুবাদে তিনিই ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। বেশ জম্পেশ একখানা স্পীচ দেওয়া গেছে। স্বাধীনতা মানে শুধু বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তি নয়। স্বাধীনতা মানে দৃষ্টির প্রসার, চিন্তার মুক্তি, নাগরিক দায়িত্ববোধের দৃঢ়তা, ইত্যাদি, ইত্যাদি... প্রচুর হাততালি পড়েছে সভায়।

পড়বেই, সুহৃদবাবু জানতেন। তিনি সুবক্তা। এলাকায় জনপ্রিয়। আগামী পৌরসভা নির্বাচনেও তিনিই শাসকদলের প্রার্থী। তাঁর সম্ভাব্য জয় নিয়ে শাসক বা বিরোধী, কোনও দলেরই বিশেষ সন্দেহ নেই। আজকের সভায়ও তার স্পষ্ট আভাস মিলেছে। তাই সুহৃদবাবু আজ খুশি।

পাত্রপাত্রী কলামে বিজ্ঞাপনটা দেখেও তিনি সন্তুষ্ট। ছেলে সুজয় গত এপ্রিলে ছাব্বিশে পড়লো। দু’বারের চেষ্টায় জয়েন্ট এন্ট্রান্স ক্লিয়ার করতে না পারার পর প্রচুর টাকা ডোনেশন দিয়ে তাকে দক্ষিণ ভারতের নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়িয়েছেন সুহৃদবাবু। এখন একটি সফ্টওয়্যার সংস্থায় কর্মরত সুজয়। মাইনে মন্দ নয়। তবু তার শিক্ষার পিছনে যা খরচ হয়েছে, তার তুলনায় কিছুই নয়। তাই তাকে আর বিব্রত করেননা সুহৃদবাবু। ওই বিয়ের পণ থেকেই টাকাটা উঠিয়ে নেবেন তিনি।

ওই ক’লাখ টাকা সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের ময়লা হলেও তিনি বিলক্ষণ হিসেবী লোক। সেই কোন কাল থেকে ব্যবসা করছেন, আজ অবধি এক পয়সাও লোকসান দেননি। শুরু করেছিলেন সামান্য রিয়েল এস্টেট এজেন্সি দিয়ে। মূলধন জুগিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। বিয়ের প্রধান শর্তই ছিলো সেটা। সেই রিয়েল এস্টেট এজেন্সি আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কন্স্ট্রাকশন কম্পানি। সেই সঙ্গে আছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কেবল টিভির ব্যবসা এবং একটি বিরাট মোটর গ্যারাজ। এই মধ্যপঞ্চাশে দাঁড়িয়ে সুহৃদবাবু আজ একজন সফল এবং প্রতিপত্তিশালী মানুষ। তাঁর দাপটে এলাকার পুলিশ-সমাজবিরোধীরা এক ঠেকে মদ খায়।

আজ তাঁর কন্স্ট্রাকশন কম্পানির অফিস ছুটি। কিন্তু তবু সুহৃদবাবু একবার সেখানে যাবেন। তাড়া নেই। স্বপ্না বসে থাকবে এসে। থাকুক। সেক্রেটারির চাকরি করা অত সোজা নয়! এখন সবে এগারোটা বাজে। ধীরে সুস্থে খেয়েদেয়ে গেলেই চলবে।

দুপুরবেলা খেতে বসে সুহৃদবাবুর মনটা টইটম্বুর হয়ে গেলো। নীলিমা আজ নিজের হাতে লাউচিংড়ি ও কচি পাঁঠার ঝোল রেঁধেছেন। দু’টোই সুহৃদবাবুর অতি প্রিয়। অফিসে যাওয়ার ঝামেলাটা না থাকলে আজ জমিয়ে খাওয়া যেত। আসলে, ব্যাপারটাকে ঝামেলা বলেই ভাবতে পারছেন না সুহৃদবাবু। তাই নীলিমার অনুযোগ সত্ত্বেও খুব বেশি ভাত খেলেন না তিনি। নীলিমা নিজে কোনওদিনই খুব বেশি খাননা। বিশেষ করে এই পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এখন তিনি অত্যন্ত ফিগার সচেতন। তাই স্বামীকে খাইয়েই যতটুকু আনন্দ পান। সুহৃদবাবু নিজেও যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। তবু তিনি এককালে খাইয়ে লোক ছিলেন, এবং এখনও প্রিয় খাদ্য পেলে মাঝেমধ্যে একটু অতিভোজন করে ফেলেন।

আজ তিনি সেটা করলেন না। আজকের দুপুরটা কোনওমতেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বাড়িতে আজ দুপুর থেকে নীলিমার এন.জি.ও’র মীটিং আছে। নারীকল্যানব্রতী সংস্থাটি নীলিমা অতি দক্ষভাবে পরিচালনা করেন। সেই মীটিং-এর জমায়েত শুরু হওয়ার আগেই সুহৃদবাবু বেরিয়ে পড়লেন, এবং ঝকঝকে নতুন সেডানটি চেপে সোজা অফিসে এসে উপস্থিত হলেন। গেটে সিকিউরিটির থেকে খবর নিলেন, স্বপ্না সেই দশটা থেকে এসে বসে আছে। সিকিউরিটিকে বলে দিলেন, কাউকে যেন এখন অফিসে ঢুকতে দেওয়া না হয়।

স্বপ্না মাস দুয়েক হলো চাকরিটা জয়েন করেছে। বছর পঁচিশেক বয়স। খুব যে সুশ্রী, তা নয়। কিন্তু একটা চটক আছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী, ভারভার্তিক চেহারা। ঠিক যেমনটা সুহৃদবাবুর পছন্দ। আর মেয়েটাও মনে হয় বেশ সাহসী। চোখে বেশ বিদ্যুৎ খেলে। আগের মেয়েটার মতন ম্যাড়ম্যাড়ে, ঘ্যানঘ্যানে নয়। ওরকম মেয়ে সুহৃদবাবুর একদম পছন্দ নয়। সুন্দরী দেখে নিয়ে ফেলে ভুল করেছিলেন। আজকালকার মেয়ে হবে আউটগোয়িং, সেক্সি। কেরিয়রে উন্নতি করার জন্য কোনও কিছুতেই পিছ্পা হবেনা। তবে না নতুন যুগের স্বাধীনচেতা নারী!

সন্ধ্যের মুখে যখন সুহৃদবাবু অফিস থেকে বেরোলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত। মুখে একটি স্বর্গীয় হাসি লেগে আছে। অনেকদিন পর আজ নিজের সমগ্র শরীরটাকে, তার সজীবতাকে অনুভব করেছেন। স্বপ্না তুলনাহীনা! কালিদাস, বা নিদেনপক্ষে জয়দেব গোস্বামী পড়া থাকলে সুহৃদবাবু হয়তো রতিচতুরা বা রমণকুশলিনী গোছের বিশেষণ ব্যবহার করে ফেলতেন মেয়েটার জন্য। মোটের উপর, সুহৃদবাবু তাঁর নতুন সেক্রেটারি নিয়োগের সার্থকতায় মহা খুশি!

অফিস থেকে বেরিয়ে সুহৃদবাবু চলে এলেন পার্টি অফিসে। সেখানে আজ আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে জরুরি মীটিং। যদিও সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায় যে জিতবেন তাই নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই কারও, তবু বিরোধী দলকে হাল্কাভাবে নিলে চলবে না। দেশের অন্যান্য রাজ্যে ওরা বেশ জাঁকিয়ে বসছে। এখানে সেটা মোটেই হতে দেওয়া যাবে না। এ রাজ্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ। এখানকার প্রশাসন শুধুমাত্র মানবকল্যানে বিশ্বাসী। কোনওরকম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এরাজ্যে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হবে না। তাই ইলেকশন ক্যাম্পেনের পরিকল্পনাটা ভালো করে করতে হবে।

সে সব করে পার্টি অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় ন’টা বাজলো সুহৃদবাবুর। বাড়ির পথে যেতে যেতে তেমাথার মোড়ে ড্রাইভারকে বললেন গাড়িটা দাঁড় করাতে। গাড়ি থেকে নেমে কালী মন্দিরের দিকে এগোলেন। বড় জাগ্রত দেবী! আজকের এমন সফল, সুন্দর দিনটায় কি তাঁকে প্রণাম না করে যাওয়া যায়? ভক্তিভরে নিকষকৃষ্ণ দেবীমূর্তিকে প্রণাম করলেন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিনিধি পৌরপিতা সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং একটি কড়কড়ে পাঁচশো’ টাকার নোট প্রণামীর থালায় রেখে দিলেন গাড়িতে ফিরে আসার আগে।

3 comments: